জ্বলদর্চি

পলাশ /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯
পলাশ

ভাস্করব্রত পতি

'পলাশ ফুলের মউ পিয়ে, ওই বউ কথা কও উঠল ডেকে।
শিস দিয়ে যায় উদাস হাওয়া, নেবুফুলের আতর মেখে॥
এমন পূর্ণ চাঁদের রাতি নেই গো সাথে জাগার সাথি, 
ফুলহারা মোর কুঞ্জবীথি কাঁটার স্মৃতি গেছে রেখে॥ 
শূন্য মনে একলা গুনি কান্নাহাসির পান্না চুনি, 
বিদায়বেলার বাঁশি শুনি আসছে ভেসে ওপার থেকে'॥
-- কাজী নজরুল ইসলাম

আমীর খসরু পলাশের ফুলকে সিংহের রক্তে মাখা নখের সাথে তুলনা করেছেন। ভারতের কবিরাও তাঁদের কবিতায় পলাশ ফুলকে প্রেয়সীর শরীরে নতুন নোখের চিহ্নের সাথে তুলনা করেছেন। মহাকবি কালিদাস তাঁর 'ঋতুসংহার' কাব্যে পলাশ তথা ধাক গাছের জঙ্গলগুলিকে একটি জ্বলন্ত আগুনের মতো বলে বর্ণনা করেছেন, যা কিনা পৃথিবীকে লাল পোশাকে নববধূর মতো দেখায়। কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' কাব্যে, পলাশ হল ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত গাছগুলির মধ্যে একটি। প্রকৃতপক্ষে, যে অনুষ্ঠানগুলিতে অন্যান্য গাছকে সম্মান করা হয় বা যা গাছ লাগানোর উদ্বোধন করে, সেখানে একটি পবিত্র শিখা জ্বালানোর জন্য পলাশ বা বনের শিখার ডালপালা একসাথে ঘষে দেওয়া হয়।

মানুষের মধ্যে প্রবল বিশ্বাস যে, যখন অশ্বিনী নক্ষত্র শারদ ঋতু (শরৎ ঋতু তথা মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি) চলে, তখন যদি একটি পলাশ গাছের শিকড় সংগ্রহ করে নিয়ম মেনে একজন পুরুষের বাহুতে বেঁধে দেওয়া হয়, তবে ঐ পুরুষ যে নারীকে স্পর্শ করবে, সেই প্রেমে পড়ে যাবে। 

'পলাশ' কবিতায় শ্রীজাত লিখেছেন, "শুধু বিচ্ছেদের দাগ আজও লেগে আছে তার ঠোঁটে... / এরকম হোলি খেলা কখনও দ্যাখেনি লোকে আর / তোমার হাসির রঙে সমস্ত পলাশ ফুটে ওঠে"! বসন্তের ফুল এই পলাশ। টকটকে লাল ছাড়াও হলুদ, লালচে কমলা, সাদা রঙের পলাশ ফুলও দেখা যায়। কাজী নজরুল ইসলামের গানে পাই -- 'হলুদ গাঁদার ফুল, রাঙা পলাশ ফুল, এনে দে এনে দে নইলে বাঁধব না, বাঁধব না চুল...'! খুব ছোট আকারের হয় পলাশ ফুল। ২ থেকে ৪ সে.মি. লম্বা। টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো। আর পলাশের ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো। 

সংস্কৃতে পলাশ হল কিংশুক। হিন্দিতে টেসু, ধাক, সাঁওতালীতে মুরুপ, তামিলে পুরাসু, মনিপুরীতে পাঙ গোঙ, কোল ভাষায় সুরুৎ, নেপালীতে পলাশী বলে। এছাড়াও পলাশ পরিচিত পূতদ্রু, যাজ্ঞিক, বাতপোথ, পর্ণ ইত্যাদি নামেও। ইংরেজিতে বলে Bastard Teak, Flame of the Forest,   Parrot Tree ইত্যাদি। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসতে এদের দেখা মেলে। বর্তমানে পলাশ হলো ঝাড়খন্ডের রাজ্য ফুলের তকমা পাওয়া ঐতিহ্যবাহী একটি ফুল। পলাশের বৈজ্ঞানিক নাম Butea monosperma (Lam) Taub। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও এটির অন্যান্য বৈজ্ঞানিক নামগুলি হল --
Butea frondosa Roxb. ex Willd.
Erythrina monosperma Lam.
Plaso monosperma

এই পলাশ গাছ কিভাবে সৃষ্টি হল? এই নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান মেলে। একসময় দেবরাজ ইন্দ্র খুব তৃষ্ণার্ত ছিলেন। দেবতারা দেবী গায়ত্রীকে স্বর্গীয় পর্বত থেকে সোমলতা আনতে নির্দেশ দেয়। এটি আনলে ইন্দ্র তখন সোমরস পান করতে পারবে। গায়ত্রী ঈগলের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন। তিনি পাহাড়ে উড়ে গেলেন এবং দেখতে পেলেন যে, এটি চাঁদের প্রহরীদের দ্বারা সুরক্ষিত। সে ঝাঁপিয়ে পড়ল, লতাটিকে তাঁর ঠোঁটে চেপে ধরল এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রহরীরা কিছু করার আগেই সে উড়ে গেল। এঁদের মধ্যে একজন কৃশানু, পাখির দিকে তাক করে তীর ছুঁড়তে লাগলো। সেই তীর গায়ত্রীর গায়ে না লাগলেও লতাতে লাগলো। তখন তা থেকে একটি পাতা খসে পড়ল এবং তা মাটিতে পড়েই পলাশ গাছে পরিণত হল। এভাবেই ভূপৃষ্ঠে জন্ম নিল পলাশ গাছ। 

ঋগ্বেদে বিবাহের স্তোত্রে এই গাছের কথা বলা হয়েছে। রামায়ণ অনুসারে এটি পঞ্চবটী বনের একটি মনোমুগ্ধকর গাছ। মহাভারতে, ঋষি জমদগ্নি পলাশ বনে দেবতাদের একটি আচার অনুষ্ঠান করেন এবং সেই অনুষ্ঠানে সমস্ত নদী অংশ নেয়। পূর্ণ প্রস্ফুটিত গাছটি দিগন্তে আগুনের মতো দেখায়। বৌদ্ধদের কাছে পলাশ হল অত্যন্ত পবিত্র উদ্ভিদ। খুব শ্রদ্ধা করে তাঁরা। রাণী মহামায়া তাঁর পুত্র গৌতম বুদ্ধের জন্মের পরমুহূর্তে পলাশ গাছের একটি ডাল ধরেছিলেন। ফুলটিতে কমলা লাল রঙ রয়েছে যা পোশাক রাঙানোর জন্য ব্যবহৃত হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের। এই রং পরার মানে হল যে তাঁরা তাঁদের সমস্ত বাসনা পুড়িয়ে ফেলেছে। এটি প্রায়শই বৌদ্ধ জাতক গল্পে চিত্রিত হয়।

'মনুসংহিতা' অনুসারে ব্রাম্ভণের উপনয়নের সময় পলাশ দণ্ডের প্রয়োজন পড়ে। উপনয়নের পবিত্র বাসনপত্রও এই কাঠ দিয়ে তৈরি করতে হয়। পলাশ ডাল দিয়ে যজ্ঞকার্য করার বিধিও রয়েছে এই অনুষ্ঠানে। অথর্ববেদ অনুসারে স্বস্ত্যয়ন কার্যে পলাশের সমিধের প্রয়োজন। আঁতুড়ঘরের ষষ্ঠী পূজার দিনে ভূতাপসারনে পলাশ পাতার প্রয়োজন হয়। 

"পলাশং উপ সংগম্য পার্থয়তে -- সমিধৌ পলাশং, পল গত, চলনং অশতে যৎ পত্রং অশ্নাতি বা ক্রিয়ামত্বাৎ রক্ষতি তৎ, অগ্নিং সমিধৌ, ঘৃতৈঃ চ যজমানঃ দ্যুবস্যতঃ পরিচরতঃ অতিথিং বোধয়ত, হুবেম -- আহুয়ামঃ অস্মে অস্মাসু সুবীরং পুত্রযুতং রয়িং ধনং সুবিরম শোভনং ধত্ত স্থাপয়ত"।  অর্থাৎ পলাশ বৃক্ষের নিকট উপস্থিত হয়ে যজমান প্রার্থনা করবেন -- ওহে পলাশ, পল অর্থাৎ চলমানতার সঙ্গে গমনকারী পত্র অথবা চলমানতাকে যে ভক্ষন করে অর্থাৎ স্থিতিশালী করে, যজমান তোমার পরিচর্যা করেন অতিথি অগ্নি ও সমিধের জন্য ঘৃতের দ্বারা অতিথিকে জাগরিত করে বলেন, তোমার কাছে অতিথি বীরপুত্র এবং সেই পুত্ররূপী শোভন ধন তুমি স্থাপন কর। 

পলাশের পাতার তিনটি ফলা থাকায় তা ব্রম্ভা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর জ্ঞানে ভাবা হয়। এই ত্রিফলীয় পাতাগুলি হিন্দু ত্রয়ী দেবতাদের প্রতিনিধিত্ব করে। বাম দিকে ব্রহ্মা, মাঝখানে বিষ্ণু এবং ডানদিকে শিব থাকে বলে কল্পনা করা হয়। আসলে এটি স্রষ্টা, সংরক্ষণকারী এবং ধ্বংসকারীর রূপ। লাল পলাশ ফুল দেবতাদের নিবেদন করা হয়। এই গাছের কমলা লাল ফুল দেবী কালীকে নিবেদন করা হয়। Richard Pearson (১৯৮৮) এর মতে পলাশ হল গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের আবাসস্থল। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও পাই পলাশের উপস্থিতি --- 
"ওরে গৃহবাসী খোল্‌, দ্বার খোল্‌,   
লাগল যে দোল। 
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।                   
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্‌॥          
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,          
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত আকাশে,                   নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।                        
দ্বার খোল্‌, দ্বার খোল্"!! 

হিন্দুদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয় পলাশের ডাল। স্কটল্যান্ডের গোয়ালারা গোয়ালঘরে ক্ষতিকর আত্মাদের তাড়াতে ব্যবহার করত রোয়ান গাছ। অনেকটা ঠিক এরকমই প্রাচীন ভারতে গরুকে তাদের বাছুর থেকে আলাদা করার জন্য পলাশ ডাল ব্যবহার করা হত। আবার জার্মানির মানুষ বিশ্বাস করে যে, পলাশের লাঠি দিয়ে গরুকে পেটালে সেই গরু নাকি বেশি দুধ দেয়। হিন্দুদের বিশ্বাস, বাছুরকে এই কাঠ দিয়ে আশীর্বাদ করলে তারা ভাল দুধ উৎপাদন করতে পারবে। ড. সমরেন্দ্রনাথ খাঁড়া (জেলা উপ উদ্যান পালন আধিকারিক, পুরুলিয়া) উল্লেখ করেছেন, "তুলসী গাছ যেমন ঘরের সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে, পলাশ গাছ বা এই গাছের ফুল বাড়িতে আর্থিক সমস্যার প্রতিকার করে। পলাশ গাছকে ধন সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। অর্থ সংক্রান্ত যে কোনও ধরনের সমস্যা থাকলে তা দূর করতে একটি পলাশ ফুল ও একটি নারকেল খুবই উল্লেখযোগ্য। পলাশের তাজা ফুল না পাওয়া গেলে শুকনো ফুলও ব্যবহার করা যেতে পারে। সাদা কাপড়ে পলাশ ফুল ও একক্ষী (একটা চোখ বিশিষ্ট) নারকেল বেঁধে আলমারি বা টাকা রাখার জায়গায় রাখলে জীবনে কখনও ধন সম্পদের কমতি হবে না। জীবনের সকল প্রকার আর্থিক কষ্ট মিটে যাবে"। লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠেও উঠে আসে পলাশ নিয়ে ভালোবাসার সুর -- "ও পলাশ...ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে / জানি না জানি না আমার এ ঘুম কেন ভাঙালে.."! 

পলাশের কাঠ বাত চিকিৎসায় ভালো কাজ করে। গাছের আঠা ডায়রিয়া ও আমাশয়ের চিকিৎসায় উপকারী। ব্রণ, টিউমারস পাইলস, আলসার এবং ফোলা নিরাময়ের জন্য পাতার একটি গরম সেঁক প্রয়োগ করা হয়। সর্দি ও কাশি নিরাময়ের জন্য পলাশ ছালের ক্বাথ দেওয়া হয়। অন্ত্রের কৃমি নিরাময়ের জন্য মধুর সাথে মিশ্রিত পলাশ বীজ বেটে খাওয়া হয়। পলাশের বীজে থাকে প্রোটিওলাইটিক এবং লাইপোলিটিক এনজাইম। ত্বকের চুলকানির চিকিৎসাতেও ব্যবহৃত হয়। বীরভূম বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় মানুষজন পুত্র লাভের আশায় পলাশ পাতা বেটে খেয়ে থাকেন। বারবার প্রস্রাব নিয়ন্ত্রণে পলাশ পাতার রস খুব উপকারী। গুজরাটের আহমেদাবাদে পলাশ পাতার থালা ও বাটিতে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। এর চওড়া পাতাগুলো সেলাই করে কোনও কোনও গ্রামাঞ্চলে ছাতা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১ ঘনলিটার বাতাস থেকে ৭৫ শতাংশ ধূলিকণা কমানোর পাশাপাশি এয়ার কন্ডিশনার হিসাবেও কাজ করেকরে পলাশ গাছ। নায়ার, রামামূর্তি এবং আগরওয়াল (১৯৮৯) এর গবেষণায় এটি প্রতিদিন গড় উচ্চতার গাছে প্রায় ১০-২০ লিটার জল শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে মুক্ত করে। বায়ুমণ্ডলে সালফার ডাই অক্সাইডের একটি সূচক হিসেবে পরিগণিত এটি। 

ফাগুন এলেই সঙ্গে নিয়ে আসে পলাশকে। পলাশের রঙের মোহে বনাঞ্চল সেজে ওঠে অগ্নিশিখায়। খোঁপায় পলাশ গুঁজে চারিদিকে যুবতীর দল নিজেদের রাঙিয়ে তোলে দোলের আবহে। কবিগুরুর গানেও সেই ফাগুনের ডাক পলাশের আবেশে --- 
"তোমার অশোকে কিংশুকে 
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে।
তোমার ঝাউয়ের দোলে..
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান"।

🍂

Post a Comment

0 Comments