উলিয়ানভস্কের গির্জা
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪২
বিজন সাহা
উলিয়ানভস্ক
যারা গোর্কি বা রুশ সাহিত্যের সাথে পরিচিত তারা সিমবিরস্কের নাম শুনে থাকবেন। এমনকি লেনিন সম্পর্কেও লেখা যে তিনি ১৮৭০ সাথে সিমবিরস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে যখন বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তখন এটা ছিল তীর্থ ক্ষেত্রের মত। কিন্তু পরে দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলে সেই আবেগে ভাটা পড়ে। বেশ কয়েকবছর আগে এখানে রাশিয়ান গ্র্যাভিটৈশনাল সোসাইটির কনফারেন্স আয়োজিত হলে উলিয়ানভস্ক আসার সুযোগ আসে, তবে বিভিন্ন কারণে সেখানে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলতে কি এজন্য নিজের প্রতি একটু ক্ষোভও আছে আমার।
উলিয়ানভস্ক ভোলগা ও সভিয়াগি নদীর তীরে ভোলগাতীরের মালভূমি অঞ্চলে অবস্থিত। মস্কো থেকে ৭১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই শহর উলিয়ানভস্ক অঞ্চলের রাজধানী। ২০১৫ সাল থেকে উলিয়ানভস্ক ইউনেস্কো স্বীকৃত রাশিয়ার একমাত্র সাহিত্য শহর।
লেনিনের বাড়ির বেঞ্চ যেখানে অতিথিদের নিয়ে বসে গল্প করতেন তাঁর বাবা ইলিয়া উলিয়ানভ
১৬৪৮ সালে জার আলেক্সেই মিখাইলোভিচের নির্দেশে বগদান খিত্রোভ নোমাড বা যাযাবর জাতির আক্রমণ থেকে রুশ সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত রক্ষার জন্য এখানে দুর্গ নির্মাণ করেন। সে সময় এই শহর সিনবিরস্ক নামে পরিচিত ছিল। এই নামের পেছনে বিভিন্ন যুক্তি ঐতিহাসিকগন খোঁজার চেষ্টা করেন। কারো কারো মতে চুভাশ শব্দ “সিন বিরেন” বা “সাদা পাহাড়” থেকে শহরের নাম হয় সিনবিরস্ক, কারো মতে মারদোভিয়ার “সিউইউন বির” বা “সবুজ পাহাড়” থেকে শহর এই নাম পায়। আবার অনেকে ভাবেন এই নামের উৎপত্তি তিউরক বা তুর্ক শব্দ “সীন বের” থেকে যার অর্থ “একাকী সমাধি”। কাঠের এই দুর্গ গড়া হয় ১৬৪৮ সালে সিনবির পাহাড়ের চূড়ায়। আয়তকার এই দুর্গের চার কোণ ও বাহুতে ছিল মোট আটটি টাওয়ার আর তিনটি বিশাল দরোজা। দুর্গের চারিদিকে ছিল গভীর খাদ। দুর্গের মধ্য ভাগে ছিল ত্রইৎস্কি সাবর, পশ্চিম দিকে স্পাসস্কি মহিলা মনাস্তির। দুর্গের ভেতরে বাস করত সেনাবাহিনী, এলিট শ্রেণী, আমলাদের সন্তান ও রাজকর্মচারীরা। ১৬৫২ সালে দুর্গ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। ১৬৭০ সালের হেমন্তে দনস্কই কসাক প্রধান স্তেপান রাজিন সিনবিরস্ক অবরোধ করে, কিন্তু দুর্গে অবস্থানকারী সেনা বাহিনী তাদের চার চারটি আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। স্তেপান রাজিন নিজে আহত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। ১৬৭২ সালে প্রথম পিওতরের নির্দেশে সিনবিরস্ক কাজান প্রদেশের অংশ হয়। পরবর্তীতে আস্ত্রাখান প্রদেশ গঠিত হলে ১৭১৭ সালে সিনবিরস্ক তার অন্তর্ভুক্ত হয় আর ১৭১৯ সালে সিনবিরস্ক প্রদেশ গঠন করা হয়। ১৭২২ সালে আস্ত্রাখান ভ্রমণের পথে প্রথম পিওতর সিনবিরস্ক অবতরণ করেন এবং শহরকে কঠিন হৃদয় নমনীয় করার ঈশ্বরমাতা নামক আইকন উপহার দেন যা পরবর্তীতে ত্রইৎস্কি সাবরে সংরক্ষিত ছিল। ১৭২৮ সালে সিনবিরস্ক আবার কাজানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেহেতু সিনবিরস্ক ছিল কাঠের তৈরি তাই বেশ কয়েকবার অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬৭১ সালে শহর অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হলে তাকে নতুন নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৬৮৭, ১৬৯৪, ১৬৯৬, ১৭৩০ ও ১৭৪০ সালে শহর সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। ১৭৬৩ সালে সেন্ট আন্দ্রেই সিমবিরস্কি জন্মগ্রহণ করেন যিনি পরবর্তীতে শহরের রক্ষাকর্তা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৭৬৬ সালে সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনার নির্দেশ অনুযায়ী নগর প্রধান বা মেয়র পদ তৈরি হয়। ১৭৬৭ সালে সম্রাজ্ঞী নিজে সিনবিরস্ক পরিদর্শন করেন। ১৭৭৪ সালে আলেক্সান্দর সুভোরভ বিদ্রোহী এমেলিয়ান পুগাচগকে বন্দী করে সিমবিরস্ক হাজির করেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সে সময় পানিন ও পাতমকিন মস্কো থেকে সিনবিরস্ক আসেন। সেখান থেকে পুগাচগকে মস্কো চালান করা হয়। ১৭৭৫ সালে আবার সিনবিরস্ক প্রদেশ গঠিত হয়। ১৭৮০ সালে সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার প্রাশাসনিক সংস্কারের পরে সিমবিরস্ক এই এলাকার প্রধান শহরের মর্যাদা পায় আর ১৭৮০ সাল থেকে শহরের নাম হয় সিমবিরস্ক।
১৮১২ সালের মহান পিতৃভূমির যুদ্ধের সময় এখানে চারটি পদাতিক ও একটি অশ্বারোহী বাহিনীর সমন্বয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হয়। ১৮২৪ সালে সম্রাট প্রথম আলেক্সান্দারের উপস্থিতিতে ১৮১২ সালের যুদ্ধের স্মৃতিতে ত্রইৎস্কি সাবরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্তালিনের শাসনামলে ১৯৩৭ সালে এই সাবর ধ্বংস করা হয়। ১৮২৯ সালে জর্জিয়া থেকে নির্বাসিত হলে রাজকুমারী তামারা প্রায় দশ বছর এখানে বসবাস করেন। ১৮৩৬ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাই সিমবিরস্ক আসেন ও শহরের কেন্দ্রে বিভিন্ন নতুন স্থাপনা তৈরির নির্দেশ দেন। ১৮৪৮ সালে এখানে কারামজিন ও ১৮৯৩ সালে গনচারেভ পাবলিক লাইব্রেরি উদ্বোধন করা হয়। সে সময় শহরবাসীর মূল জীবিকা ছিল বিভিন্ন রকমের কুটির শিল্প, কৃষিকাজ ও মাছধরা। পুরো উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে এবং ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত এখানে বার্ষিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা হত যেখানে ১০ মিলিয়ন রুবলের পণ্য কেনাবেচা হত। এই মেলায় তন্তুজাত পণ্য, চামড়া, উল, ঘোড়া এসব বিক্রি করতে আসত বিভিন্ন এলাকার বনিকেরা আর কিনে নিয়ে যেত রুটি আর ফলমূল। ১৮৬৪ সালে ৯ দিন ব্যাপী অগ্নিকান্ডে শহরের প্রায় তিন চতুর্থাংশ পুড়ে যায়। সে সময় প্রাশাসনিক ভবন, কারামজিন লাইব্রেরি, স্পাসস্কি মনাস্তির, ১২ তি গির্জা, পোস্ট অফিস ও সবচেয়ে সুন্দর প্রাইভেট স্থাপনা ধংস হয়ে যায়। ১৮৯১ – ১৮৯২ সালে রুশ সাম্রাজ্যের অনেক প্রদেশের মত সিমবিরস্কেও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৮৯৮ সালে এখানে প্রথম রেল লাইন চালু হয়। সেদিক থেকে আমরা দেখি এই শহর ১৬৪৮ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত সিনবিরস্ক নামে পরিচিত ছিল, ১৭৮০ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এর নাম ছিল সিমবিরস্ক।
১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সিমবিরস্কে সোভিয়েত শাসন কায়েম হয়। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পরে শহরের নামকরণ করা হয় উলিয়ানভস্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখান থেকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ যুদ্ধে যায়। এসময় জার্মান অধিকৃত এলাকা থেকে বিভিন্ন শিল্প কারখানা উলিয়ানভে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চের মূল কেন্দ্র এখানে সরিয়ে আনা হয় আর ১৯৪২ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ভোলগা নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হয় উলিয়ানভস্ক। পরবর্তী কালে লেনিন স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি করা হলে মস্কো ও লেনিনগ্রাদের পরেই উলিয়ানভস্ক সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়। তারচেয়েও বড় কথা উলিয়ানভস্ক বিদেশীদের জন্যও খোলা রাখা হয়। ১৯৭৬ সালে ভোলগার বাম তীরে তৈরি হয় বিমান নির্মাণ কারখানা, গড়ে ওঠে নতুন আবাসিক এলাকা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উলিয়ানভস্কের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ২০০৯ সালে এখানে তৈরি করা হয় বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা। তৈরি হয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ভোলগার উপর তৈরি হয় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সড়ক সেতু। শহরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানি কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালে নতুন ইনডোর স্টেডিয়াম উদ্বোধন করা হয় যেখানে ২০১৬ সালে বিশ্বকাপ হকি অনুষ্ঠিত হয়। এক কথায় রাশিয়ার অন্যান্য অনেক শহরের মতই উলিয়ানভস্ক ধীরে ধীরে নতুন করে সেজে ওঠে।
এই বাড়িতেই ১৮৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন লেনিন। এখন লেনিন মিউজিয়াম
আমরা যখন উলিয়ানভস্ক এসে পৌঁছুই তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। বাসায় জিনিসপত্র রেখে গেলাম লেনিনের হোম মিউজিয়াম দেখতে। তখন পাঁচটা পেরিয়ে গেছে। ওরা বলল কিছুক্ষণ পরেই মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে, তাই আমরা যেন পরের দিন ভোরে আসি। আমরা তখন যে ব্রীজ দিয়ে এপার এসেছিলাম সেই পথেই অন্য পাড়ে চলে গেলাম। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এক ক্যাফেতে খেয়ে নতুন ব্রীজ দিয়ে ফিরে এলাম নিজেদের ডেরায়। ঘরে ফেরার আগে চেষ্টা করলাম ভোলগার তীরে সূর্যাস্ত দেখতে। তবে শুধুমাত্র জিপিএসের উপর নির্ভর করে সব সময় সব কিছু হয় না। এই শহরেও আমার পরিচিত কলিগ আছে। তবে প্রফেসর সেরগেই চেরভন তখন ছিলেন ব্রাজিলে। আমি ফোন করলাম ইগর ফোমিনকে। ও এখান থেকে পড়াশুনা শেষ করে এখন মস্কো বাউমান ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করে। ও অনেক দিন মস্কোয়, তাই কিছু আইডিয়া দিলেও কোন লোকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারল না। তাছাড়া আমাদের সব পরিচিতই শিক্ষকতার সাথে জড়িত, সবাই সবে শুরু হওয়া ক্লাস নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক হল পরের দিন সকালে লেনিনের বাড়ি দেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা সামারার পথে পা বাড়াব।
ভিডিওতে উলিয়ানভস্ক
https://www.youtube.com/watch?v=QvxgKjox-j8&t=62s
উলিয়ানভস্কের ছবি
http://bijansaha.ru/album.php?tag=254
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments