জ্বলদর্চি

সুজিত ভৌমিক (সাংবাদিক, কবি, সংগঠক, মহিষাদল) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯৯
সুজিত ভৌমিক (সাংবাদিক, কবি, সংগঠক, মহিষাদল) 

ভাস্করব্রত পতি

চোখে ক্যামেরার লেন্সের ফোকাস। সেই লেন্সে ধরা পড়ে সমাজ জীবনের জলছবি। যা ইথার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে তরঙ্গায়িত হয় উন্মুখ দর্শকের চোখে। আর হাতে ধরা বুম। জিহ্বার ওলটপালট চলাচলে 'আঁখো দেখা হাল' মুহূর্তের মধ্যে কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয় ছবি ও ভাষ্য সহযোগে। আর ক্যামেরা, ফোকাস, ফিড, ব্রেকিং নিউজ, লাইভ রিপোর্টিং, অ্যাম্বুশ ইন্টারভিউ, অ্যাঙ্কর, ফুটেজ, স্ক্রিপ্ট, এডিটিং, জুম ইন, টিল্ট আউট, নিউজ কভারিংয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে একান্ত নির্জনে হাতে তুলে নেন কলম। তখন সাদা খাতায় উচ্চারিত হয় ---
'ফিকে হয় 
কালো সাদা মেঘ 
ফিকে হয় আবছা আকাশ 
তবু সত্য সন্ধানে মিলে যায় আকাশ বাতাস 
সন্ধানী মন খুঁজে বেড়ায় 
অন্য এক পৃথিবীর অন্য এক রহস্য দেশ 
ভিন জগৎ আর অজানা এই 
সে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে 
সত্যের খোঁজে আজও মুখোমুখি হয়'। (মেঘ) 

সুজিত ভৌমিক। অবিভক্ত মেদিনীপুরের সাংবাদিকতার সিলেবাসের অন্যতম পাঠক্রম। দীর্ঘ তিন দশক ধরে একই ছন্দে একই গন্ধে এই 'নোবেল প্রফেশন'টি চালিয়ে এবং চাগিয়ে নিয়ে চলেছেন। বিরল দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন মেদিনীপুরের বুকে। এখানকার মানুষের কথা, ইতিহাসের কথা, সংস্কৃতির কথা, রাজনীতির কথা, জীবন যন্ত্রনার কথা, শিক্ষা স্বাস্থ্য উন্নয়ন থেকে শুরু করে উত্থান পতন -- সর্বোপরি জেলায় ঘটমান জাগতিক কাহিনীর সুচারু ধারাবিবরণী তুলে ধরে একটা 'ডকুমেন্টারি হিস্ট্রি' তৈরি করেছেন মেদিনীপুরের বুকে। যা গোটা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে ভারত এবং ভারতের বাইরের বিভিন্ন প্রান্তের বাংলাভাষী মানুষজনকে সমৃদ্ধ করেছে, ঋদ্ধ করেছে, সম্পৃক্ত করেছে। 

অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের বাসুলিয়ায় ১৯৬৯ এর ৩ রা ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন সাংবাদিক এবং কবি সুজিত ভৌমিক। বয়স তখন দশ বা এগারো মাস। মাথায় ভেঙে পড়ল বাজ। চিরতরে বিদায় নিলেন বাবা লক্ষ্মীকান্ত ভৌমিক। ফের বিপদ ঘনিয়ে এলো জীবনে। গাড়ি দুর্ঘটনায় মা রেনুকা বালা ভৌমিক মৃত্যু অমানিশা নিয়ে এলো জীবনের চাঁদোয়ায়। তখন ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে ওঠা কিশোর একজন। বখে যাওয়ার আদর্শ সময়। কিন্তু এখানেই টুইষ্ট। মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেন বয়ে যাওয়া যাবেনা। বখে যাওয়া চলবে না। নষ্ট হওয়া যাবেনা। এইসব মাথায় রেখেছিলেন সব সময়। এরপর জ্বরের কারনে একটা বছর পড়াশোনায় নষ্ট হয়ে যায়। এক বছর পিছিয়েও 'পিছিয়ে পড়া যাবেনা' --- এই মন্ত্র নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন দাঁতে দাঁত চেপে। 

শুরুর পড়াশোনা মহিষাদল রাজ হাইস্কুলে। এখানে কমার্স বিভাগে এক নম্বর স্থান দখল করে সরাসরি কলকাতায় পাড়ি। এরপর কলকাতার সিটি কলেজে কমার্স নিয়ে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। যদিও তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল বাংলা। তাই পরে বাংলা নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। নেতাজী ওপেন ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলা অনার্সও কমপ্লিট করেছেন। কিন্তু মনে বাসনা, সাংবাদিক হওয়া। এই মহান পেশায় কাজের জন্য ছটপট করতেন। সেইমতো সাংবাদিকতার লক্ষ্য, বাসনা এবং শিক্ষা নিয়ে ঢাকুরিয়াতে থাকাকালীন কলকাতার একাধিক প্রথম শ্রেণীর সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, দৈনিক এবং মেদিনীপুরের সংবাদপত্র 'দৈনিক সব্যসাচী'তে শুরু সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আগ্রহ বরাবর। সেসময় আনন্দবাজার পত্রিকা, আজকাল, বর্তমান, সাতসকাল, এ টি এন বাংলাতে সাংবাদিকতা করেছেন দিনের পর দিন। অবশেষে প্রিন্ট মিডিয়া থেকে লাফ দিলেন ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে। সেসময় ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদ চ্যানেল ছিল ই টিভি বাংলা। এখানে ২০০০ সালে যোগ দিলেন সাংবাদিক হিসেবে। দীর্ঘদিন ধরে এই চ্যানেলে এই জেলার অন্যতম সাংবাদিক হন। আমার বাংলা, অন্নদাতা সহ এই চ্যানেলের জনপ্রিয় নানা অনুষ্ঠানে দর্শক আটকে রাখতেন নিজের ক্যারিশ্মায়। 

তখনও বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ আসেনি। বাসের ড্রাইভারের হাতে ভিডিও ক্যাসেট পাঠাতেন কলকাতার নিউজ হাউসে। এভাবেই লড়াই করতে হয়েছে সাংবাদিকতার জন্য। তাঁর কাজে অনুরক্ত হয়ে বহু ছেলেমেয়ে অনুপ্রাণিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বাজারেও এসে যায় বহু সংবাদমাধ্যম। ইউ টিউব, ব্লগ, ফেসবুক নির্ভর সাংবাদিকতা বাড়তে থাকে। নিজের কাজ বজায় রেখেই পাশে দাঁড়ান সবার। তাঁর হাত ধরেই অনেকেই আজ নাম করেছেন সাংবাদিকতার জগতে। 
তাই জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্লাব, সংগঠন, সাহিত্য প্লাটফর্ম গড়া চালিয়ে গেলেন নিজের বুভুক্ষু মনের রসনা তৃপ্ত করতে। ইটিভি বাংলা, ইটিভি নিউজ বাংলা ছেড়ে এখন নিউজ এইট্টিন বাংলায় একটানা কাজ করে চলেছেন তিনি। নিউজ চ্যানেলের মালিকানা বদল হয়েছে। । কিন্তু চ্যানেল হাউস বদল করেননি। আপাতত হাতে ৪ রকম বুম নিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। যদিও দক্ষতার গুণে অন্যান্য সব মিডিয়া হাউস থেকে অফার ছিল। কিন্তু রামোজি রাওয়ের প্রতি দুর্বলতা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা থেকে অন্য কোনও দিকে মন ছোটাতে পারেননি। রামোজি ফিল্ম সিটির মিটিং হলে স্বয়ং রামোজি রাও তাঁর প্রশংসা করেছিলেন নন্দীগ্রাম কভারেজ নিয়ে। 

অসাধারণ কর্মদক্ষতা এবং কাজের প্রতি অনুরক্ত মানসিকতা দেখিয়ে তাঁর এই পথচলা সুমুখপানে। এখনও জারি রেখেছেন নিজের যাবতীয় ভাবনা চিন্তা এবং সখ আহ্লাদগুলো পূরণ করার লক্ষ্যে। ফলে তাঁর গড়ে তোলা সেই সাংস্কৃতিক সুর আজ অনুরণিত হচ্ছে মেদিনীপুরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। গড়ে তুলেছেন 'সকলের কথা' পরিবার। যে পরিবারে আজ সামিল কবি থেকে সাধারণ মানুষ, সাহিত্যিক থেকে খেলোয়াড়, চিকিৎসক থেকে সমাজের গন্যমান্য লোকজন। প্রতি মাসের সেই সাহিত্য আড্ডা হয়ে উঠেছে মিলনক্ষেত্র। 

তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন নিরন্তর এবং নিরবচ্ছিন্ন কাজের মাধ্যমে। সাংবাদিকতার মাধ্যমেই জেলা এবং রাজ্যের নেতাদের কাছাকাছি এসেছেন। গড়ে তুলেছেন সখ্যতা। রচনা করেছেন সম্পর্ক। মেলে ধরেছেন নিজের দক্ষতা। আর অভিযোজিত করেছেন বিচিত্র পেশার, বিচিত্র নেশার লোকজনের সঙ্গে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই পেশায় ব্যাপৃত রেখেছেন নিজেকে। নিজের অতুলনীয় বাচনভঙ্গি, কর্মদক্ষতা, সংবাদ সংগ্রহের প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা, পেশাগত জহুরির চোখ আর অভাবনীয় Public Relation ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে। 

আজ তাঁর নামের পাশে জুটেছে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, স্পেশাল করপন্ডেন্ট ইত্যাদি বাঘা বাঘা পদগুলি। না, কলকাতা নির্ভর সাংবাদিকতা করেননি তিনি। মেদিনীপুরের মেঠো পথে প্রান্তরে থেকেই জেলার সাংবাদিক হয়েও নামের পাশে এই সবকিছু জুটেছে। পেশাদার সাংবাদিক হতে চেয়ে হলদিয়ার এক বেসরকারি হাইস্কুলের কয়েক বছরের শিক্ষকতার চাকরিও ছেড়ে দিয়েছেন অবলীলায়। সাংবাদিকতার প্রতি ডেডিকেশন, শ্রদ্ধা, সততা এবং ভালোবাসা না থাকলে তিন দশক ধরে এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারা যায়না। কিন্তু তিনি পেরেছেন। অন্যদের পথ দেখিয়েছেন। কলকাতার যাবতীয় আগ্রাসন এড়িয়ে এবং হঠিয়ে মেদিনীপুরের বুকে দাঁড়িয়েও লড়াইয়ে টিকে থাকার কলিজা তৈরি করা, অবশ্যই তারিফযোগ্য। 
গৌতম ভট্টাচার্য-র সঙ্গে

তাঁর সাংবাদিকতার ঝুলি ঘাঁটলে বেরিয়ে আসবে নয়ের দশকের কেশপুর পর্বের বোম মাস্কেট গুমখুন সমৃদ্ধ রাজনৈতিক লড়াইয়ে সামনে থেকে অর্জন করা অভিজ্ঞতা। ২০০৭ এ শুরু হওয়া জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের নন্দীগ্রাম ট্রিলজি। শাসক বনাম বিরোধী দলের চাপানউতোর এবং সর্বশেষে রক্তক্ষয়ী উত্তর তিনি লিখেছেন সাংবাদিকতার খেরো খাতায়। কাটাছেঁড়া করেছেন রাজনৈতিক অ্যানাটমিতে। দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক, নন্দীগ্রামের ঘটনার সাক্ষী থেকে ইতিহাসকেই জারিত করেছেন সাংবাদিক হিসেবে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনা লকডাউনের সময়কালে সবাই যখন ঘরবন্দী, তখন নিরলসভাবে এবং ভয়ডরহীনভাবে বেরিয়েছেন রাস্তায়। বাড়ির চার দেওয়ালে বসে থাকেননি। বরং রাস্তায় নেমে অনেক বেশি বেশি করে খবর করেছেন সাংবাদিকতার ব্রত নিয়ে। এই টেনাসিটি এবং খবর খোঁজার আগ্রহ তাঁকে অন্যদের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে দিয়েছে। 

তাঁর সাংবাদিকতার পাতায় পাতায় বহু ভোট কভারেজ,  এক্সক্লুসিভ ব্রেকিং স্টোরি গিজগিজ করছে। গত ২০২৩ এ ছিল গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চায়েত ভোট। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলায় নন্দীগ্রাম, খেজুরি, কাঁথি, হলদিয়া, তমলুক সহ বিভিন্ন এলাকা ভোটকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়েছিল বারবার। সেইসব স্পটে দাঁড়িয়ে কভারেজ দিয়েছেন দিনের পর দিন। নন্দীগ্রামে ভোট, ভোট গননা ঘিরে বোমাবাজি সংঘর্ষের খবর, খেজুরির বোমাবাজি, গুলি চালানো, মারামারি সহ অনেক বড় বড় খবর রিস্ক নিয়ে কভার করেছেন প্রতিনিয়ত। তেমনি ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের দামামা বাজতে না বাজতেই নিউজ এইট্টিন চ্যানেলে ভোটের এক্সক্লুসিভ স্টোরিতে অন্যদের বিট করেছেন নিজের স্বভাব দক্ষতায়। তিনিই প্রথম এক্সক্লুসিভ নিউজ করেছেন যে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেবেন এবং তমলুক কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রার্থী হবেন। একইভাবে ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিং আবার দলবদল করবেন এবং নিজের কেন্দ্র থেকেই তিনি বিজেপির টিকিটে প্রার্থী হবেন কিংবা ঘাটালে দেবের বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী হবেন হিরন এবং কাঁথিতে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় সৌমেন্দু অধিকারীর নাম চমক হিসেবে থাকতে পারে বলে বহু আগে তিনিই ব্রেকিং স্টোরি করেছেন। 

পেশায় এবং নেশায় সাংবাদিক সুজিত ভৌমিক পুর্ব মেদিনীপুর জেলার সাংবাদিকদের নিয়ে গড়া বেশ কয়েকটি সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকেই সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করেছেন। দক্ষতার গুণগত মান বিচার করেই তাঁর এই পদপ্রাপ্তি। আপাতত পুর্ব মেদিনীপুর প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন। তাঁর সাংবাদিকতার আপোষহীন লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়েছে ইটিভি বাংলা। সুন্দর সুন্দর অফবিট নিউজ ফিচার পরিবেশন করার জন্য এক সময় ইটিভি বাংলা তাঁকে পুরষ্কৃত করেছে। করোনা চলাকালীন লকডাউন অধ্যায়ে নিউজ এইট্টিন চ্যানেল থেকে পেয়েছেন পুরস্কার। হলদিয়া পৌরসভার চেয়ারপার্সন থাকাকালীন কবি তমালিকা পন্ডা শেঠ দুবার জেলার সেরা সাংবাদিক হিসেবে পুরস্কৃত করেন সুজিত ভৌমিককে। সেসময় আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, আই এস মদনলাল মীনাদের উপস্থিতিতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। যা তাঁর একনিষ্ঠ কাজের অন্যতম স্বীকৃতি। 
বিমান বসুর সঙ্গে

সুজিত ভৌমিকের আত্মকথনে, "একটাই মাত্র জীবন। সেই এক জীবনেই যা কিছু করার ইচ্ছে তা পূরণ করা উচিত। পুরোদমে সবকিছু করে যাওয়াই আসল লক্ষ্য। হরিদা, সত্যেনদা, অনিমাদি, চিত্তরঞ্জন কুন্ডু, নরেশদা, মনিকাদি, বীরেনদাদের শুভেচ্ছা স্নেহ প্রশংসা পাওয়া ছেলে আমি। সুমন চট্টোপাধ্যায়, রূপক সাহা সহ নামী ও গুণীদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়া জেলা সাংবাদিকতার একজন আমি। এঁদের আশীর্বাদ শুভেচ্ছা ভালোবাসা পেয়ে পেয়েই নিজের কাজের উন্নতি করতে চাই"। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাধারণ মানুষ, ক্রীড়াবিদ, রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের থেকেও অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছেন জীবনভর। ঝুলিভরা অভিজ্ঞতা আর দুচোখে পৃথিবীকে দেখতে চাওয়ার মনোবাসনা -- তাঁকে করে তুলেছে 'খোলা মনের মানুষ'। এ প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান সাংবাদিক হরিপদ সিনহার একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি (১৭/০৯/১৯৯৮) লিখেছেন, "তোমাদের মতো ছেলেরা আজকের উচ্ছৃঙ্খল যুবসমাজের মধ্যে ভিন্ন চিন্তার জগতে উজ্জ্বল সম্পদ। আমি আশাবাদী, অসত্যকথন ও অমানবিক আচরণের জন্য ব্যাথা পাই। তবু যাঁদের সঙ্গ পেলে মনে জোর পাই, প্রেরণা পাই, তাঁদের মধ্যে (যদিও সীমিতসংখ্যক) তুমি অন্যতম। সংস্কৃতির মনটা তৈরি না হলে সংস্কৃতির কর্মী হওয়া যায়না; অধিকার জন্মায়না। সহানুভূতিশীলতা সংস্কৃতির একটা দিক"। 

সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন অসংখ্য ব্যস্ততার মাঝেও। করোনা লকডাউনের সময় বড়সড় টিমকে সঙ্গে নিয়ে দিনের পর দিন হাজার হাজার মানুষের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার কাজে যুক্ত থেকেছেন। যা এক মানবিক গুণের সাথে পরিচিত হয়েছি আমরা। আর এজন্য হলদিয়ার সুতাহাটার 'প্রয়াস' স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে সুজিত ভৌমিকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে 'করোনা যোদ্ধা' সম্মান। আর ক্ষনিক অবসরে আত্মার আত্মস্থল ভেদ করে উঠে আসা সাহিত্যচর্চা তাঁকে চিত্রিত করেছে প্রেমিক কবি হিসেবে --
'সবুজ জঙ্গলে পা রেখে 
মন ভালো করি। মন ভালো হয়, অনেকটা ভালো 
মন ভালো করা জঙ্গল, সবুজ জঙ্গলে 
পা রেখে এগিয়ে চলা আর সামনে চোখ রেখে 
অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া। 
জঙ্গলে পা রেখে অনুসন্ধান করি 
ভালো আর ভালো মানুষের খোঁজও করি। 
তারপর, মন ভালো হয় যে সবুজ, 
ঘন সবুজে তারই সন্ধানে সামনে হেঁটে চলা 
অনেক ভাল আর অনেক আনন্দ বুকে নিয়ে 
ধেয়ে আসে ঘন যে সবুজ বন। সেই 
মন টানা ঘন সবুজ আর ঘন বনরাশি 
মিলেমিশে স্বপ্ন দেখায়। মনও ভালো করে 
আসলে ঘন কালো সবুজ বনের সৌন্দর্য্য 
না পেছন ফিরে ঘাড় ঘুরিয়েই অনায়াসে দেখে ফেলি 
দেখি সবুজের সমাহার। দেখি মানুষের আনন্দ আয়োজন দেখি নিজেদের হারিয়েই একদল ভালো মানুষের দল 
জয়ী করে বন্য প্রাণীদের'। (মাটির কাছে) 

তিনি কবিতা লেখেন রসনাসিক্ত হৃদয়ে কিঞ্চিৎ বাষ্পচাপের উপলব্ধি ঘটাতে। মনপবনের ঢেউ তুলে প্রতিটি শব্দক্ষেপনে শিশির মাখা ঘাসের অনুভূতি জন্মায়। জীবনবোধের চিরন্তন মাত্রাটিকে ছোঁওয়ার লক্ষ্যে তাঁর কলম চলে এভাবে --
'ফিরছি
তবু ফেরা হয়না।
ফিরে আসা মায়ের কোলে মাথা রাখা 
মায়ের সঙ্গে কথা বলা হয়না, 
হয়না আর আগের মতো।
সেজে ওঠা বাগান জুড়ে ফুল অনেক ফুল 
লাল সাদা হলুদ বেগুনি নীল ফুলে ঘেরা বাগানে আজকাল সময় দেওয়া হয়না। 
ব্যস্ততার অজুহাতে নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার মতো ফুলেদেরও ফাঁকি দিই। 
মা চান বাগানে নিয়মিত পা রাখি 
মা চান বাগানের লাল নীল হলুদ রঙে রঙিন 
ফুলেদের থেকে ভালোবাসা শিখি
কিন্তু ভালোবাসা শেখা আর হয়না'। (চরিত্র) 

সুজিত ভৌমিকের কাব্যগ্রন্থ 'এতদিন বলিনি যে কথা' (২০১৭), 'ফাঁকা ফুটপাতে চোখে ঘুম আসে' (২০১৮) পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছে। করোনা অধ্যায়ে প্রকাশিত হয়েছে 'পৃথিবীরও মন খারাপ' (২০২১)। গত বছর কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'এক সমুদ্র বালি' (২০২৩)। আসলে সাংবাদিক সত্ত্বাকে অতিক্রম করে কবিসত্ত্বা যখন প্রাণবন্ত হয়, তখন জীবনের রূপ রস গন্ধ প্রতিভাত হয় কবিতার ককটেলে। যার নির্যাসে মায়াময় হয় কবিতার বাক্যবন্ধ এবং বাক্যবুনন। 

এই সাংবাদিক কবি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় মানুষ ও সমাজজীবনকে দেখেছেন প্রত্যক্ষভাবে। এবং তা দেখেছেন সরাসরি মাটির ওপর দাঁড়িয়েই। মানুষ ও বাস্তব সমাজজীবনের প্রতিফলনকে সযত্নে লালন করে সাংবাদিকের কবিসত্তা কলম। তাঁর কবিতার খাত ধরে বয়ে চলে মানবহৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা, সংস্কার, অন্তর্দাহ, হতাশা ও ভালোবাসা আহত দিনলিপির চলন। সাংবাদিকের কাব্য ভাবনা বলেই তাঁর কবিতা শুধুই জীবন বা আবেগের সুচারু প্রকাশ মাত্র নয়, কবি সুজিত ভৌমিকের কাব্য ভাবনায় রয়েছে তত্ত্বের উপস্থিতি, প্রকরণের ব্যাঞ্জনা এবং সময়ের প্রেক্ষিতে এই সাম্প্রতিক পৃথিবী। জীবনের দীর্ণতা, শূন্যতা এবং মহত্বের সমগ্র প্রকাশ নিয়েই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে বাঙময়। বক্তব্যের অধিক, শিল্পসম্মত হয়ে ওঠার দায়বদ্ধতায় উত্তীর্ণ কবিতা। মেদিনীপুরের মাটির নির্যাস চুঁইয়ে পড়েছে কবিতার পরতে পরতে। সব মিলিয়ে রূপনারায়ণের কোলঘেঁষা এক জনপদের মাটি থেকে শুনতে পাওয়া যায় অস্ফুট সুর ও স্বরের সম্মিলিত উচ্চারণ --
'গোলাকার পৃথিবীর 
প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে 
সরলরেখা খুঁজি 
সরলের একমুখী সন্ধ্যা আকাশে 
যেখানে উজ্জ্বল তারাদের বসবাস 
সেখানেই সাদা আয়নার সামনে 
মুখ রাখা আর মুখ দেখে নেওয়া চলে 
গোলাকার পৃথিবীর মাটি পথ জুড়ে 
রক্ত মুখের হলুদ অবয়বেরও 
খোঁজ চলে অবিরাম'। (আবছা)

🍂


Post a Comment

0 Comments