জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক অরুণ মিত্র/নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক অরুণ মিত্র 
                  
নির্মল বর্মন 

প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্র কবি হিসেবে বিরাট জনপ্রিয়তা অটুট থাকলেও প্রাবন্ধিক হিসেবে বিস্মৃতপ্রায়। ১৯০৯ সালে অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্র মহোদয় প্রগতিশীল লেখক আন্দোলন, ফ্যাসিস্টবাদ  বিরোধী আন্দোলন, গণনাট্য সংঘের আন্দোলন, ,'ভারত সোভিয়েত মৈত্রী' আন্দোলনে ওতোপ্রোতভাবে বিজড়িত ছিলেন। বস্তুতঃ অরুণ মিত্রের প্রবন্ধ নিবন্ধে সাম্যবাদী ভাবনা,চিন্তা ও চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। ফরাসি সরকারের আহ্বানে সরকারি বৃত্তি গ্ৰহন করে প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট লাভ করেন। কয়েক বছর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক ছিলেন।১৯৯০সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডি.লিট ডিগ্ৰী প্রদান করেন।২০০০সালের‌২২শে আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্র মহোদয়ের প্রবন্ধ গ্রন্থ:-
      ''ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে'', ''সৃজন সাহিত্য ও অন্যান্য ভাবনা'' ইত্যাদি। অনুবাদ গ্ৰন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য " ভারত: আজ ও আগামীকাল","কাঁদিদ বা আশাবাদ", "সে এক ঝোড়ো বছর","ভারতীয় থিয়েটার ",গাছের কথা","অন্যস্বর"ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক ফরাসি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে প্রথমসারির প্রতিষ্ঠান স্বরূপ ছিলেন ও বিশ্বস্ত ছিলেন। ভাদিস বা কাঁদিদ'র অতুলনীয় অনুবাদ করেছিলেন , পাশাপাশি বহু ফরাসি কবি সাহিত্যিক কে বাংলা কাব্য , প্রবন্ধ ও সাহিত্য জগতে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। মাধ্যম ছিল-  বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদ। 'প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্রের "ফরাসি সাহিত্য প্রসঙ্গে"প্রবন্ধ গ্রন্থে মূলত 'ফরাসি সাহিত্য অধ্যয়ন' ও 'উক্ত সাহিত্যের প্রতি প্রাবন্ধিকের গভীর নৈকট্যের সুনিবিড় পরিচয় যত্নসহকারে প্রস্ফুটিত।
১৯৯০ সালে শারদীয়া অনুষ্টুপ পত্রিকায় প্রকাশিত অরুণ মিত্রের ''কবিতার পৃথিবী''  প্রবন্ধটি উল্লেখযোগ্য মর্যাদার দাবি রাখে। অরুণ মিত্রের ''কবিতার পৃথিবীর মূল্য চিরন্তন"-এই মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বিশ্ববন্দিত প্রবন্ধটির বক্তব্য কাব্যগুণ সত্যি অতুলনীয়:-
      ‌   ১.হৃদয়ে ভাবের বিহ্বলতা যখন গদ্যের ত্রিসীমানা পার হয়ে যেতে চায়, তখনই প্রয়োজন মাধ্যম হিসেবে কবিতা। প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্র বিষয়টিকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করেছেন এভাবে--                                            ‌                  "প্রেমের উচ্ছ্বাস যদি কাউকে আপ্লুত করে তাহলে তার মনের মধ্যে কবিতা জাগে এবং প্রায়ই মুখে তা আবৃত্তিও করে সে। ...আবার মানুষের কোনো সুখের ছবি বা দুঃখের দশা কাউকে যদি গভীরভাবে নাড়ায়, তাহলে তার সেই মানসিক অবস্থার প্রকাশ সাধারণ পদ্যের অন্বয় ছেড়ে ভর দেয়া হয় ভাঙা ভাঙা শব্দে, যা কবিতারই এক অঙ্গ-লক্ষণ নয় কবিতার নির্মিত ছত্রে।”
    ২.প্রাবন্ধিক কবিতায়  পৃথিবীর স্থান নির্দেশ করে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন যে:-
 "আমাদের এই মাটির পৃথিবীই কবিতার পৃথিবী। এই পৃথিবী, যেখানে আমরা বাঁচি সব মানুষের মধ্যে চরাচরের পরিমণ্ডলে।"
৩.প্রাবন্ধিক কবিতার উন্মেষ কীভাবে সম্ভব ? তা বিচার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে  লিখেছেন:- 
"যা কিছু সে দেখে, শোনে, অনুভব করে, যা কিছু তাকে সরাসরি ধাক্কা দেয় বা তার ইন্দ্রিয়ের পথে অনুভূতিতে সঞ্চারিত হয় সে সমস্তের ফসল তার অভিজ্ঞতা। এই অন্তর্গত কেন্দ্র থেকেই কবিতা উৎসারিত হয়। আগে থেকে ভেবেচিন্তে ঠিক করে নেওয়ার এখানে কোনো প্রশ্ন নেই।"
🍂

 ৪.প্রাবন্ধিক অরুণ মিত্র মহোদয় কবিতা  নির্মাণ  সম্পর্কের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-   
           "বক্তব্যকে আরও অমোঘ করার জন্যে শব্দবদলের কিংবা ধ্বনিতরঙ্গ বাহক দ্বন্দ্বকে আরও ইন্দ্রিয়সঞ্চারী করার জন্যে মাজা ঘষার একটা পর্ব আসতে পারে। তবে তা সবক্ষেত্রে যে অপরিহার্যতা নয়, প্রথম রচনাই চূড়ান্ত রচনা হয়ে থেকে যায় অনেক সময়।” 
 ৫.অরুণ মিত্র কবিদের হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির কথা উপলব্ধি করেছেন বলেই তো বলতে পেরেছেন --যে মানুষ কবিতা লেখে তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সে সম্পর্কে বক্তব্য:- 
     “যে আমি কবিতা লেখে, সে পৃথিবীর অধিবাসী একক মানুষ নয়। সে মানব সমাজের অন্তর্ভুক্ত একজন, এই তার অস্তিত্বের বাস্তব পরিচয়। মানুষ হিসেবে তার অভিজ্ঞতা, যা সমষ্টির সঙ্গে জড়িত, তার চেতনা ও চিন্তাকে গড়ে তোলে। কবি হৃদয়ের ক্রিয়াশীলতা এই মানবিক অবস্থান থেকেই।"
 ‌          ৬.'শিল্পের জন্যে শিল্প'-এই প্রবাদ বাক্য প্রাবন্ধিক মেনে না নিয়ে মন্তব্য করেছেন:-
             "আমি মনে করি, আনন্দ বিষাদ, বিক্ষোভ উল্লাস, প্রশান্তি যন্ত্রণা, অবসাদ উচ্ছলতা, মনের এত রঙে কবিতা যে ফোটে, তা এই পরিস্থিতিরই গূঢ় প্রতিক্রিয়ায়। সুতরাং 'শিল্পের জন্যে শিল্প' তত্ত্ব আমার শূন্যগর্ভ মনে হয়।"
  ৭. প্রাবন্ধিক ও কবি অরুণ মিত্র কবিতার পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রহস্যময় উক্তি:-
 "কবিতার পৃথিবী কোনো কারণেই লোপ পাবে না যতদিন মাটির পৃথিবীতে মানুষ আছে। এবং তাকে নিয়ে বলারও শেষ নেই।"
প্রাবন্ধিক ও কবি অরুণ মিত্র মহোদয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সঙ্গী ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের উপর মূল্যবান অবদানের জন্য ১৯৮৭তে 'সাহিত্য আকাদেমি' পুরস্কার,১৯৭৯ তে 'রবীন্দ্র পুরস্কার'  ও ফরাসি থেকে 'লিজিয়ন অফ অনার' পেয়েছিলেন।
বস্তুতঃ কবির কবিতা বলিষ্ঠ হলেও তাঁর প্রাবন্ধও কালজয়ী । প্রাবন্ধিকের আবেগ ও কাব্যময় ভাষায় প্রবন্ধ সম্পদশালী হলেও কালের অমোঘ নিয়মে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হয়ে ওঠেন-অরুণ মিত্রও তার ব্যতিক্রম কখনোই নয়।

Post a Comment

0 Comments