জ্বলদর্চি

ঋণ / মিলি ঘোষ

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ

গল্প  : ঋণ 

মিলি ঘোষ

অতীত ঘাঁটে না বৈশালী। তবে, বৈশালী বাদে বৈশালীর কথা অন্য লোকে ভাবে বেশি। ওই অতীতটাই। বৈশালী বরাবরই পড়াশুনায় মনোযোগী এবং সুশীলা। ওর মতো মেয়ে বাবাকে কার্যত একা ফেলে রেখে দুম করে আঠেরো বছর বয়সে বিয়ে করে বসবে, এখানেই সবার মাথাব্যথা। এরপর যখন শোনা গেল বাবার প্রচ্ছন্ন মদতেই নাকি বৈশালীর এই কাজ, তখন পরিচিতদের মাথায় একটা চুলও আর কালো থাকল না।

বৈশালী অবশ্য পড়াশুনা চালিয়ে গেছে এবং যথাসময়ে একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষিকার পদও গ্রহণ করেছে। সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার পেছনে কারণ ছিল। 
এক পশলা বৃষ্টির পরে আকাশ ধোয়া রোদ উঠেছিল সেদিন। পাখিও ডেকেছিল। সুনন্দও পাশে ছিল। কোচিং ক্লাস থেকে ফিরছিল ওরা। জেঠু কোনোদিনই ওই রাস্তায় যান না। সেদিন গেছিলেন। যেতেই পারেন। বৈশালী যখন খেয়াল করেছে, জেঠু তখন অন্য দিকে তাকিয়ে। যেন কিছুই দেখেননি। কত জনের কত জেঠুই তো কত কিছু দেখেন। তাতে কী এসে যায়। বৈশালীরও তেমন হতে পারত। কিন্তু হয়নি। বিনা নোটিশে একদম পরদিন থেকেই বৈশালীর কোচিং যাওয়া বন্ধ করেছিলেন জেঠু। 
   ভাই সমরেশকে ডেকে বলেছিলেন পরমেশ দত্ত, "কাল থেকে আর মেয়েকে পড়তে পাঠিও না।"
দত্ত বাড়িতে দাদার চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে কথা বলার চল ছিল একসময়। তবে সে'দিন গেছে। যেদিন নিজের অসাবধানতায় কারখানার মেশিনে দুটো হাতই খোয়াতে হয়েছিল সেদিন থেকে সমরেশের চোখ নিচের দিকেই। মালিক এককালীন কিছু টাকা দিয়েছিলেন হাত দুটোর বদলে। সে'সব পুরোনো কথা। দাদার অমোঘ বাণী শুনে একবার তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করলেন সমরেশ। কিছুই জানতে চাইলেন না। জানানোর হলে বৈশালী নিজেই জানাবে বাবাকে। 
মোবাইল কেড়ে নেওয়া, দরজায় তালা দিয়ে আটকে রাখার মতো নিচ কাজ পরমেশ করবেন না। তাঁর রুচিতে বাধে। উচ্চ মাধ্যমিকের আগেই ভাইঝির পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ের ব্যবস্থা করার মতো মূর্খও তিনি নন। পড়াশুনা বাড়িতে বসেই করুক। পরীক্ষা তো এসেই গেল। তারপর দেখেশুনে একটা বিয়ে দেওয়া যাবে। ভেবেও রেখেছেন এক সুপাত্রের কথা।

🍂

পরমেশ সংসারের ত্রাস আবার পরমেশ সংসারের ত্রাতা। এ বাড়ি পরমেশ নিজে বানাননি। পৈতৃক সম্পত্তি। বাবা তো আর উইল করে যাননি, কোন তলা কার। ক'টা ঘর কোন ছেলের। তাই সিদ্ধান্ত পরমেশের। ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনবোধ করেননি। দরকারই বা কী। আট বছরের ছোট ভাই। ছোট থালায় খেয়ে অভ্যেস। তাই বাবা মারা যাবার পর দাদা ওপরতলায়। ভাই নিচতলায়। তখন সমরেশের দুটো হাত ছিল। মুখে বোলও ছিল। বৈশালীই চুপ করতে বলেছিল বাবাকে। তাই আর কথা এগোয়নি। তারপর যেদিন হাত দুটো গেল, সেদিন থেকে খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া ঠোঁটদুটো আর খোলেন না সমরেশ।

মা'কে বৈশালীর সেভাবে মনে পড়ে না। একটা ধূপছায়া রঙের স্মৃতি। বাবার কাছে শুনেছে, রান্না ঘরেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলেন। আর ওঠেননি। চোখে ক্লান্তি ছিল কিনা, কপালটা ফেটেছিল কিনা তা অবশ্য বৈশালী শোনেনি। ছোট্ট মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে সমরেশ যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে দিগন্ত রেখার ওপারে চোখ রাখার চেষ্টা করতেন, তখন নিঃশব্দে পরমেশ এসে ভাইয়ের পিঠে হাত রাখতেন। সমরেশের মতো পাষান হৃদয়ও কান্নায় ভিজে যেত। সে'ও অনেক আগের কথা।

হাসপাতাল থেকে দুটো হাত ছাড়া যেদিন সমরেশ বাড়ি ফিরলেন, আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চোখের জল মোছার জন্য নিজের হাতটাই খুঁজেছিলেন। সেই থেকে বৈশালীর হাতই সমরেশের হাত। তবু বৈশালী যখন থাকে না, একটা লোক তো লাগেই। লোক রেখেছেন পরমেশ। কার্পণ্য করেননি।
পরমেশ ওপর তলায় একাই থাকেন। মাঝেমাঝে নিচ থেকে তাঁর পায়ের শব্দ শোনা যায়। একতলাতে তিনজন। সমরেশ, বৈশালী আর কাজের লোক লতা।  সমরেশের ঘরটা কোনার দিকে। আলো বাতাস কম। বাড়িতে কেউ এলে চট করে যাতে চোখে না পড়ে। ঢুকেই একজন হাতহীন পুরুষের মুখোমুখি হতে কার ভালো লাগে। পরমেশের তেমনই মনে হয়েছে। তাই আর কী। তবে, সমরেশের ঘরে মশার উপদ্রব একটু বেশি। তা হোক, মশা তাড়াতে সমরেশের পা দুটো তো আছে। 

পরমেশ রেলে উচ্চ পদে কর্মরত। অর্থের অভাব নেই। কিন্তু বিবাহিত জীবনে তাঁর আস্থা নেই। বউ থাকবে বউয়ের মতো। সংসারের কাজ করতে না চাইলে লোক রেখে দেবেন পরমেশ। শাড়ি গয়না দেবেন। কিন্তু মুখ ঝামটা যেন না দেয়। বিয়ে করবে ব'লে দু'তিন জায়গায় গিয়ে মেয়ে দেখেও এসেছিলেন। মুখে বড্ড খৈ ফোটে এদের। তবু একজনকে পছন্দ করে ফেলেছিলেন প্রায়। সেবারে পরমেশের মা গেছিলেন সঙ্গে। যা কিছু জিজ্ঞাসা তিনিই করেছেন। মেয়েটি যতটা পেরেছে ঘাড় নেড়ে উত্তর দিয়েছে। নয়তো ওর বাবা মা'ই যা বলার বলেছেন। পরমেশ দেখলেন এই মেয়েই সব দিক দিয়ে ঠিকঠাক। কী মনে করে বেরোনোর সময় পরমেশ একবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "আপনি কথা বলতে পারেন না?"
   তৎক্ষণাৎ উত্তর এলো, "আপনিও তো তাই।"
পিলে চমকে গেছিল পরমেশের। আর মেয়ে দেখতে যাননি। কেউ কোনও মেয়ের খোঁজ দিলে এটা ওটা ব'লে কাটিয়ে দিয়েছেন। 

পরমেশের এই এক রোগ। কারোর চোখ রাঙানি সহ্য হয় না। বাড়িতে তাঁর সমস্যা নেই। এখানে সবার উপরে তিনি সত্য। তবু, যত ভয় তাঁর বৈশালীকে নিয়ে। বৈশালীর পরীক্ষার রেজাল্ট বলে দেয় সে লম্বা রেসের ঘোড়া। তাই অফিসে নিজের অধীনস্ত দেবাঞ্জনকে তিনি পছন্দ করে রেখেছেন বৈশালীর জন্য। দেবাঞ্জনের গ্রামের বাড়িতে মা বাবা আছেন। কলকাতা শহরে সে একাই। নম্র, বিনয়ী। পরমেশের কথায় ওঠে বসে। তবে টোপটা এখনও ফেলেননি পরমেশ।

বৈশালীর উচ্চ মাধ্যমিক হয়ে গেছে প্রায় এক মাস। গাছের আড়াল থেকে কোকিলের কুহুতান মনে করিয়ে দিচ্ছে এমাসে ওর আঠেরো পূর্ণ হবে। পরমেশ আর বৈশালী, দু'জনেই তাকিয়ে ওই তারিখটার দিকে। ইতমধ্যে অফিস থেকে ফেরার পথে দেবাঞ্জনকে নিয়ে পরমেশ এসেছেন একদিন। সোজা ওপরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসতে দেন ছেলেটিকে। বৈশালীকে ডেকে পাঠান চা মিষ্টি দেবার জন্য। শুধু সমরেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি। প্রয়োজনও ছিল না। তা ছাড়া হাতকাটা সমরেশকে দেখে যদি দেবাঞ্জন চমকে যায়! নেতিবাচক বিষয় শুরুতে না আনাই ভালো। জল গড়ালে আস্তে আস্তে বলা যাবে। অধস্তনের জন্য কতটা সুতো ছাড়বেন আর কখন গুটিয়ে নেবেন তা পরমেশ ভালোই জানেন। তাই এ বছর বৈশালীর জন্মদিন একটু ঘটা করেই হলো এবং নিমন্ত্রিত হিসেবে দেবাঞ্জনও এলো। 
ঠিক এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল বৈশালী। অনুষ্ঠানের পালা মিটলে পরমেশ রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ার পর বৈশালী এসে দাঁড়ায় বাবার কাছে। সমরেশের নিস্প্রান ঘরে জানলা দিয়ে কীভাবে যেন জ্যোৎস্না ঢুকে পড়েছে।
   মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন সমরেশ, "এটা চোখের জল ফেলার সময় নয়। দেরি করিস না, মা। সুনন্দ বাইরে ওয়েট করছে।"

সমরেশ জানেন, এ বাড়িতে থাকলে বৈশালীর পড়াশুনা আর এগোবে না। তাই মাত্র আঠেরো বছর বয়সে মেয়েকে এক অনিশ্চয়তার পথে চলে যেতে দিলেন। দাদার দূরদৃষ্টির পরিচয় সমরেশ আগেও পেয়েছেন। দেবাঞ্জনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে ঘরজামাই করে রাখার চেষ্টা পরমেশ করবেনই। কারণ হিসেবে সমরেশের হাতের কথাই আসবে। বৃদ্ধ বয়সে নিজের প্রয়োজনের কথা সযত্নে এড়িয়ে যাবেন। পয়সার অসুবিধা হবে না। দেবাঞ্জন নিজেও ভালো চাকরি করে। 

সুনন্দর বাবা গ্রামে চাষ আবাদ করেন। সে খবর পরমেশ আগেই জোগাড় করেছেন। ভাইঝি চলে গেছে বুঝে যাবতীয় রোষ উগরে দিয়েছেন সমরেশের ওপর। সমরেশ একটাও উত্তর দেননি। মেয়ের পড়তে যাওয়া বন্ধ করতে হবে শুনে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, আজও তেমনই নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তবে, লতাকে বেশি ঘাঁটাতে চাননি পরমেশ। একটু আধটু ধমক দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, লতা হাতছাড়া হলে সমরেশের যতটা বিপদ, পরেমেশের তার চেয়ে কিছু কম নয়। 

একটা পুরোনো বাড়ি। তার সিঁড়ির পাশে সূর্য উঁকি দিতে লজ্জা পায়, এমন একটা ঘুপচি ঘরে মাদুর পেতে জীবন সংগ্রাম শুরু করল বৈশালী আর সুনন্দ। আরও দু'ঘর ভাড়াটে আছে। বাথরুম একটাই। পাশে একটা পাতকুয়ো। ওদের সম্বল বলতে বৈশালীর মায়ের রেখে যাওয়া গয়না। আর বন্ধুদের সহায়তায় দুজনেরই কিছু টিউশন। 

বাড়িটা লতাই খুঁজে দিয়েছে। বৈশালীদের বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে। সমরেশের অ্যাক্সিডেন্টের সময় থেকে রয়ে গেছে লতা। সুযোগ পেলেই বৈশালীর কাছে নিজের যন্ত্রণা উগরে দিয়ে হালকা হতে চায় সে। কোন্ কালে বিয়ে হয়েছিল লতার। স্বামী মারা যেতেই লতার মায়ের দেওয়া লাল বেনারসীটা বাক্স খুলে নিয়ে গেছিল ননদ। যদিও ওটা বেনারসী না। ওরকম দেখতে ঝলমলে কোনও সস্তার শাড়ি। লতা ওটাকেই বেনারসী ভেবে তৃপ্ত ছিল।
পরমেশ বেরিয়ে গেলে লতা প্রায় দিনই আসে। টিফিনবক্সে ভরে কোনওদিন তরকারি কোনওদিন দু'টুকরো মাছ রান্না করে দিয়ে যায়। বৈশালী জানে, সমরেশ আর লতা নিজেদের ভাগের মাছ না খেয়ে দিয়ে দিলো। কারণ, পরমেশ বাজার থেকে মাছ কাটিয়ে আনেন।  মাছের পিস কোনদিন ক'টা আসে, তাঁর হিসেব আছে। বৈশালী আর সুনন্দ বারণ করেছে অনেকবার। লতা শোনে না। 

সমরেশের কোনও ফোন নেই। হাতই নেই, তার আবার ফোন! লতার অবশ্য আছে একটা। ওতেই বাবার সঙ্গে কথা বলে বৈশালী। লতা মাইক অন করে টেবিলে বা সমরেশের বিছানার পাশে দেয়। 
উচ্চ মাধ্যমিকে বৈশালী আর সুনন্দ দু'জনেই পঁচাশি শতাংশের ওপর নম্বর পেয়েছে। মেয়ে বলেছে বাবাকে, হয়তো দু'জনেই স্কলারশীপ পেয়ে যাবে। খুশি হওয়া ছাড়া আর কোনওভাবেই মেয়ের পাশে দাঁড়াতে পারেননি সমরেশ। কিন্তু পরমেশ সারাদিন উশখুশ করেছেন। কৌতূহল ছিলই। দু'একবার নিচ থেকে ঘুরেও গেছেন। তবু, ভাইকে জিজ্ঞাসা করতে পারেননি বৈশালীর রেজাল্টের কথা। ভাইঝির স্কুলে গেলেই জানতে পারতেন। তবে,সে ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্ন দেখা দিত। তিনি সে'সবের মুখোমুখি হতে চাননি। কিন্তু একটা প্রশ্ন পরমেশকে ভাবায়। টাকা কে জোগাচ্ছে? খাচ্ছে কী? সঙ্গীটি তো চাষার ছেলে। তাহলে? 

একদিন শেষ দুপুরের দিকে লতা এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। রোদে ঝলসে লতার কষ্টিপাথরের মুখ চকচক করছিল।
   পাঁচ হাজার টাকা বৈশালীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, "এটা রাকো দিকি। বই কিনতে লাগবে।"
   "কে দিলো টাকা তোমায়?"
    "কে আবার দেবে? মাস গেলে বড়দা যে টাকা দেয়, সব জমিয়ে রেকেচি গো।"
   "সে টাকা আমাকে দিচ্ছ কেন? আশ্চর্য তো!"
   "আচ্চজ্যির কী আচে। তোমরা ছাড়া তিন কূলে আমার আর কেউ আচে, বলো দিকি?"
   "একে জেঠুর কাছে আমার গলা পর্যন্ত ঋণ। আবার তুমিও ......  তোমার এ ঋণ আমি কী করে শোধ করব পিসি? টাকা দিয়ে যে এর পরিমাপ হয় না।"
লতা আর দাঁড়ায়নি। 
   জোর করে টাকাটা বৈশালীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, "আচ্চা, আচ্চা। চাগরি পেয়ে একখান বেনারসি দিও তো। অনেক দিনকার শক।"
তারপরেই "বড়দা এসে পড়বে" ব'লে প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল লতা। 

দুপুরের শেষে সদ্যজাত বিকেল তখন চোখ মেলার চেষ্টায়। বৈশালী দরজায় দাঁড়িয়ে স্থানুর মতো চেয়ে রইল। লতা চলে যাচ্ছে। হরিণীর মতো। কখনও ছুটে, কখনও লাফিয়ে। গন্তব্যে ওকে পৌঁছতে হবেই, বাঘের মুখে পড়ার আগে।

Post a Comment

0 Comments