জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি -৪২/সুমিত্রা ঘোষ


লোকমাতা রানি রাসমণি -৪২
সুমিত্রা ঘোষ 

পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, রানি যেন একটি রজতগিরি তুলে এনে গঙ্গার তীরে বসিয়ে দিলেন। সেই রাতে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আলোকমালা দক্ষিণেশ্বর থেকে বরাহনগর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। বেশ কয়েকজন পুরোহিত সেদিন পুজোকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন, এক একজন এক একটি পুজোয় রত। অপরদিকে শাস্ত্রপাঠ, ভক্তিগীতি, সানাই ইতাদির সুরে মন্দির চত্বর  গমগম করছিল। মা ভবতারিণীর ভোগ চূড়ার আকারে সাজানো হয়েছিল। কত রকমের মিষ্টির আয়োজন যে করা হয়েছিল তার ঠিক ঠিকানা নেই।শ্রীরামকৃষ্ণদেব অত এলাহি খাবার-দাবারগ্রহণ করেননি। তাঁর  মনে  হয়েছিল ব্রাহ্মণের সংস্কার ক্ষুণ্ণ করা উচিত হবে না। তাঁর পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় একজন আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন, শূদ্রের দান পর্যন্ত গ্রহণ করতেন না, কোথাও অন্নজল গ্রহণ করতেন না, আচার নিষ্ঠ পিতার কথা মনে করে শ্রীগদাধর ঠাকুর মন্দিরের ভোগ গ্রহণ করেননি। পরে অবশ্য গদাধর ঠাকুর জাতপাতের বেড়াজাল ছিন্ন করেন মা ভবতারিণীর কথা ভেবে কারণ তিনি ভেবেছিলেন মা ভবতারিণী সকলের মা। তিনি জাতপাত মানেন না  সকলের মঙ্গলের জন্য তিনি মন্দিরে জাগ্রত মাতৃরূপে বিরাজ করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। গদাধর ঠাকুর মায়ের দর্শন পেয়ে এই মহান সত্য উপলব্ধি করে ধন্য হয়েছিলেন।

রানি রাসমণির মন্দির প্রতিষ্ঠিত হল ১৮৫৫ সালে আর রানি ধরাধাম ছেড়ে চলে গেলেন১৮৬১ সালে।

কিছুদন ধরে রানি শরীর ভাল যাছিল না। ১৮৬১ সালের শুরুতেই রানি অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অনুমান করা যায় রানি পেটের রোগে আক্রান্ত হয়ে খুবই দুর্বল হয়ে পড়লেন। তখন রানির একটা বিশেষ কাজ বাকী ছিল। মন্দির প্রতিষ্ঠা তো হল, কিন্তু সেবাকাজের জন্য সম্পত্তি দেবোত্তর করার দরকার, নইলে মন্দিরের ব্যয় নির্বাহ হবে কিভাবে? রানি চিন্তান্বিত হলেন।
🍂

উল্লেখ করা প্রয়োজন, দক্ষিণেশ্বরের যে উইল তিনি করে গিয়েছিলেন তাতে প্রথমেই লিখেছিলেন, 'আমি একটি দ্বাদশ শিবমন্দির, জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরানির মন্দির, রাধা কৃষ্ণের মন্দিরসহ একটি দেবালয় বাটী তৈরি করব'। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে রানি দলিলটি বাংলায় যাকে বলে, অর্পণ-নামা তাতে সুস্পষ্টভাবে সব লিখে গিয়েছিলেন। অনুমান করা যায় মন্দির প্রতিষ্ঠার আগেই তিনি দলিল লিখন সম্পন্ন করেন। এবার ফিরে আসা যাক দিনাজপুরের  জমিদারি প্রসঙ্গে। রানির শরীর খুবই খারাপ যাচ্ছে অথচ মা ভবতারিণীর সেবার ব্যবস্থা করা হয়নি অকস্মাৎ রানির দেহবসান হলে কি হবে? রানি এমন চিন্তা করছেন। জীবিত কালে রানি বেশ কয়েকটি শোক পেয়েছেন। যেমন পুত্র সন্তান পেয়েও তাকে নিয়তি বিধানে হারাতে হয়েছে, সেজ মেয়ে করুণাকে হারাতে হয়েছে। জানা যায় কনিষ্ঠ কন্যা জগদম্বার জন্মের চার বছর পূর্বে রানি মৃত পুত্র প্রসব করেন। বড় মেয়ের পুত্র মহিম মারা যায় রানির জীবদ্দশায়। বড় নাতবৌকে( কমলা) বিধবার বেশে দেখে রানি  শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়া কন্যা কুমারীও রানির জীবিতকালে ইহলোক ত্যাগ করে। তাঁর জীবিতকালে বড়মেয়ে পদ্মমণি  ও কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বা বেঁচে ছিলেন।
জমিদারি দেবোত্তর করতে গেলে দু কন্যার সই দরকার হবে। রানির বড় মেয়ে পদ্মমণি সম্বন্ধে জানা যায় এই মেয়ের সঙ্গে মায়ের (রানির) জমিজমা টাকা পয়সা নিয়ে মতান্তর লেগেই থাকত। পদ্মমণি  মনে করতেন মা তাঁর ইচ্ছেমত টাকা-পয়সা খরচ  করেন। বড় মেয়ে অন্য বোনদের তুলনায় বিষয়  প্রতি বেশি লোভাতুর ছিলেন।  

Post a Comment

0 Comments