জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমাপর্ব- ৩৬গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩৬
গৌতম বাড়ই

সোনাঝুরির প্রথমদিনের বনরাত


অনেক রাতেই তো, হ্যাঁ তা প্রায় মধ্যরাতে সবাই ঘুমোতে গিয়েছিল। বসন্তসেনা হঠাৎ ঘুম ভেঙে নিজেকে একা বিছানায় দেখে , নিজের মনেই প্রশ্ন করে। বাইরে কাচের জানালাতে দেখে মনে হচ্ছে এখনও অন্ধকার রয়েছে বাইরে। ঘরে নাইট ল্যাম্পের হালকা আলোয় তার মনে হল আলোমাসি হয়ত রিফ্রেশরুমে গিয়েছেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বিছানা থেকে উঠে রিফ্রেশরুমের কাছে গিয়ে দেখলেন , না রিফ্রেশরুমে আলোমাসি নেই। এবারে রুমের দরজার কাছে দেখলেন দরজা ভেজানো, দরজা খুলে আলোমাসি বাইরে গিয়েছেন। এটুকু বুঝতে পেরে বসন্তসেনা কী করবে এই ভেবে খুব সন্তর্পনে দরজা খুলে বাইরের খোলাবারান্দায় উঁকি মারলেন, এবং দেখলেন যেটা আশাই করেছিল, বাবা আর আলোমাসি ঐ রাতে আলোআঁধারি পরিবেশে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দুজনেই নিচুস্বরে কথা বলছেন। এতে বসন্তসেনা একদমই আশ্চর্য হলেন না। বরং সুশোভন , অর্থাৎ তার বাবার জন্য অনেক দুশ্চিন্তার অবসান হল। বসন্তসেনা আবার রুমে প্রবেশ করতে যাবে, এমন সময় আলোমাসির গলা ভেসে এলো-" হাসনু-মা তুমিও আমাদের কাছে এখানে এসে দাঁড়াতেই পারো। দেখো এই রিসোর্টের বারান্দা থেকে সোনাঝুরির এই বনরাত কত সুন্দর! জঙ্গলকে চুপিসারে অনুভব করতে হয়, গভীর রাতে। শুধু জঙ্গল কেন? সমস্ত প্রকৃতিকে। রাতের অন্ধকারে তারা যেন নতুন করে প্রাণ পায়। সেই প্রাণের স্পন্দন কান পেতে শুনতে হয়। এসো তুমিও। "

--- " না মাসি তুমি আর বাবা দুজনে মিলে এই অন্ধকার রাতটুকুকে, এই নির্জনতাকে উপভোগ করো। আমার ঘুম কাটেনি এখনও, অনেক ঘুমে আমার দুচোখ জুড়িয়ে আসছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে তোমায় বিছানায় না দেখতে পেয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে ঘরের বাইরে এলাম,  সব অনুমান করেও উঁকি মেরেছিলাম। তোমরা দুজনে এখন একান্তে এই নিবিড় বনরাত চাক্ষুষ করো। আমি ঘরে চললাম। " এই বলে নিজের বিছানায় চলে এলো বসন্তসেনা। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো বাবা আর আলোমাসির এই নতুন সম্পর্কের কথা। হয়ত সম্পর্কটা নতুন নয়। সম্পর্কের আগে এবং বহু আগে থেকে এর একটা গড়ন চলে মানুষের মনের মধ্যে। চোখ বুজে বসন্তসেনা মনে করতে থাকে তার মা দীপশিখার কথা। তার বাবা কোনোদিন দ্বিতীয় কোনও নারীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন বলে মায়ের কাছেও শোনেননি। আলোমাসি তো নয়ই। আলোমাসি আর মা তো দুই বোনই নয় শুধু, এর বাইরে ভীষণ রকমের বন্ধু ছিল দুজনে। কী আশ্চর্য!  এই যে দুচোখ জুড়ে এতটা ঘুম ছিল তার এখন বিছানায় এসে সে সব যেন উবে গিয়েছে। 

ভাবতে থাকে বসন্তসেনা, মানুষ সবসময় একটি আশ্রয় খোঁজে। বিশেষত পুরুষ নারীর আশ্রয় ছাড়া এ পৃথিবীতে এক মুহূর্তের জন্য বেঁচে থাকতে পারে না । তবে বাবার কাছে যেটি আশ্রয়, আলোমাসির কাছে তা তো পরকীয়া! এই সম্পর্কের মিষ্টি রসায়নে , অন্য একটি সংসারে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে না তো? মেশো আর ভাই মাসির এই বিবাহ বহির্ভূত প্রেম মেনে নেবে? না কি একটা এমব্যালেন্স করে চলাই জীবনের গহীনে সন্ধিপথ? এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় বসন্তসেনা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভেঙে টের পায় আলোমাসি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাসি আধশোয়া, একহাতে ভর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বসন্তসেনা আলোমাসির গায়ের কাছে আরও নিবিড় হয়ে আসে। মাসি বলে-" এখন কটা বাজে বলতো হাসনু-মা? দশটা বেজে গিয়েছে। শুধু তুই না , বাদবাকি সবাই এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। অবশ্য তারা সকালে একপ্রস্থ চা খেয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আর তোর বাবা প্রায় ভোররাত পর্যন্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করেছি, তারপর এসে সামান্য ঘুমিয়ে নিয়েছি। আমার আবার সকাল আটটার পর বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম আসেনা। এটাও দীর্ঘদিনের অভ্যেস। " 

বসন্তসেনা বলে -" প্লিজ মাসি তুমি এমনটি করেই মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমি আরও মিনিট পনের পর উঠবো। জানতো মাসি, মা তোমার মতন ওইভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, মা যখন প্রচণ্ড অসুস্থ, মায়ের শীর্ণ হাত আমার মাথার দিকে এগিয়ে আসতো ঠিকই কিন্তু মা তারপর আর পারত না। মায়ের দুচোখ জলে ভিজে উঠত। আমি মায়ের এইসব খেয়াল করে বলেছিলাম, এবার আমি বড় হয়ে গিয়েছি মা , আমি এখন তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেব ।"

আলোমাসি কোনো কথা না বলে বসন্তসেনার মাথায় অমনি করে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। হাসনুমা তার চোখ বন্ধ করে থাকে। এমন সময় অভিকাকু আর বাবা এসে তাদের ঘরে ঢোকে। অভিকাকু বলে - " আলোদি খেয়াল আছে আজ এগারোটার সময় গাড়ি করে আমরা মাসানজোরের  দিকে বেড়াতে যাব? তুমি আর শোভন মিলে তো সারারাত রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিলে। 

🍂

----" অভিজিৎ দা, আমি কিন্তু প্রস্তুত। এই মুহূর্তে যেতে বললে আমি -ই সম্ভবত একমাত্র রেডি। চলো-- "এই বলে আলোলিকা অভিজিতের দিকে তাকিয়ে হাসল। 

--- " ওরে বাবা আলোদি তো সব্বাইকে টেক্কা মেরে দিয়েছে। নে নে হাসনু ওঠ--ঠ। দেখি পাশের ঘরে তোর ভালোমামা আর মামি কী তাদের হানিমুন বেড ছেড়ে উঠতে পেরেছেন কিনা! " এই বলে অভিজিৎ আবার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। 

বসন্তসেনা দেখেছে অভিকাকু সঙ্গে থাকলে যে কোনও জায়গা মুহূর্তে সরগরম হয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি রিফ্রেশরুমে ঢুকে পড়ল।  বাইরে থেকে ভালোমামা আর মামির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আজ যে দুবরাজপুর, সিউড়ি হয়ে ঝাড়খণ্ডের মাসানজোরে তাদের বেড়াতে যাওয়ার কথা, এ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল তারা। এবার বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতিতে হুলুস্থুল পড়ে গেল সবার মধ্যে। 

গাড়ির মধ্যে সবাই প্রথমটায় মৌন থাকে, তারপর ধীরে ধীরে যখন টের পায় সবাই তো নিশ্চুপ, ফের একে একে কথা বলতে শুরু করে সবাই। বসন্তসেনা ভাবছে, বাবা আর আলোমাসিকে নিয়ে অহেতুক ভেবেছে তারা। বড়রা নিজেদের ব্যাপারে একদম স্বাভাবিক হয়ে থাকে, অভিজিৎ কাকু বা ভালোমামি সবাই তো জানে আলোমাসি ও তার বাবা সুশোভন প্রায় ভোররাত পর্যন্ত বারান্দার করিডোরে গল্প করেছে। তা এমন কী! দীপশিখা , তার মা চলে যাবার পর সুশোভনবাবুর আলোমাসির সাথে সারারাত গল্প করাটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। যদি সুশোভনের বয়স পঞ্চাশের নিচে আর মাসিরও তাই হত, আর তার মা বেঁচে থাকতেন, তাহলে দেখার চোখও পাল্টে যেত সবার। বসন্তসেনার কাছে কিন্তু পাল্টাত না, একজন পুরুষ বা নারী, অন্য পুরুষ বা নারীর সাথে গল্প করতে ভালোই লাগতে পারে, সে যে সবসময় ধর্মপত্নী হতেই হবে, তার কী মানে আছে? সিউড়ির তিলপাড়া ড্যাম বা- হাতে রেখে গাড়ি ছুটে চলেছে মাসানজোরের দিকে। তার আলোমাসি গান ধরেছে, তবে তা রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, এই গাড়ির গতির সঙ্গে মানানসই জয়জয়ন্তী চলচ্চিত্রের --' আমাদের ছুটি ছুটি ----এই আনন্দ ধরে না--'

সবাই হাততালি দিয়ে গলা মিলিয়ে গাইছে আলোলিকার সঙ্গে। সিউড়ির পর থেকেই দ্রুত ভূ- ভাগ বদলে যেতে লাগল। উঁচু নিঁচু টিলা আর পাথুরে জমি। ধীরে ধীরে দূরে পাহাড় নজরে এলো। সুশোভনের নামে জয়ধ্বনি হল, অল্পসময়ের এরকম বেড়ানোর আয়োজনের। কিন্তু বেড়ানোর সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসে, কথায় বলে না , ঐ ঘেরা চারদেয়াল তোমায় আবার বন্দী করে ফেলবে। আসলে আমাদের গড়পড়তা সবারই তো এই নশ্বর জীবন মানে এক দীর্ঘমেয়াদি বন্দীজীবন। 

একদিকে সুবিশাল জলরাশি আর একদিকে অনেক নিচে সরুসুতোর মতন জলরেখা চলে গিয়েছে। ময়ূরাক্ষী নদীর ওপর এই বাঁধ। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে কানাডা সরকারের সহযোগিতায় এই বাঁধ নির্মিত হয়েছিল। এখান থেকে টারবাইন ঘুরিয়ে জলবিদ্যুৎ ও  উৎপন্ন হয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে এইসব বাঁধগুলো ছিল স্বপ্ন, সমস্ত ভারতবাসীর কাছে। পাঞ্জাব রাজ্য তো সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছিল এই বাঁধ আর সেচের জলে। মাসানজোরের বাঁধের কাছে  যেখানটায় তারা সবাই নামলো , তার বাঁ  হাতের দিকে ড্যাম আর সোজা কালো পিচের‌ রাস্তাটি পাহাড়ের বাঁক নিয়ে নিয়ে দুমকা চলে গিয়েছে। সবাই নেমে প্রথমে রাস্তার পাশে চা দোকান থেকে চা খেল, সঙ্গে চানাচুর - বিস্কুট। ভালোমামির ঝোলা থেকে বেরুলো পটাটো চিপসের প্যাকেট, আলোমাসির ঝোলা থেকে ভুজিয়া। বেশ জমে গেল শুরুতেই নেমে। 

সবাই ড্যামের ওপরের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে । এখন বা হাতে চলেছে তারা তবে কখনও দিক পাল্টে এদিক ওদিক করছে। তাদের আকর্ষণ ড্যামের ওপারের সবুজ পাহাড়। ওপারে সবাই হেঁটেই যাবে। 

বসন্তসেনা প্রথমে ভাবলো ভুল দেখছে। তারপরে দেখলো না, এ তো সত্যি! সুশোভনবাবু যে মহিলার সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে, সে তো দীপশিখা, তার মা! বসন্তসেনা আর থাকতে না পেরে জোরে জোরে ডেকে উঠলো আ-লো-মা-সি! 

আলোলিকা সেই ডাকে ছুটে এসে, বুকে জড়িয়ে ধরেছে তার হাসনুমাকে। " বল বল কী হয়েছে হাসনু- মা! এই তো আমি! "

আলোমাসির বুকের মাঝে দৃঢ় আলিঙ্গনে আটকে রয়েছে সে। তাদের দলের সবাই বসন্তসেনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বসন্তসেনা চোখ মেলে সবাইকে দেখছে। মনে হচ্ছে একটু মৃদু হাসছে সে। সুশোভনের দিকে চোখ পড়তেই তার মৃদু হাসি কেমন ম্লান হয়ে এলো। সবাই চুপ করে নিঃশব্দ এক মুহূর্ত কাটাচ্ছে যেন! 

ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর লেখা

    ReplyDelete