জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ /পর্ব- ৬/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ৬

স্বপন কুমার দে

টিউশন দুটো সেরে সাইকেল নিয়ে মল্লিকা প্রথমে বাসস্ট্যান্ড ও পরে স্টেশন গেল। সেদিনের সেই রিকশ কাকুকে খুঁজে পেতে হবে। বাকি দশ টাকা দিতে না পারলে তার মনে শান্তি নেই। কোথাও তার দেখা পাওয়া গেল না। একে ওকে জিজ্ঞেস করেও সন্ধান মিলল না। প্যাসেঞ্জার নিয়ে আনাগোনা করাই রিকশওয়ালাদের কাজ, কোনো একটা জায়গায় তাদের দেখা পাওয়াই মুশকিল। তাই বাড়ি ফিরতেই হচ্ছে। পরে একদিন চেষ্টা করতে হবে।

বাড়ি পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। আজ কলেজ বন্ধ, তাই রক্ষে। রান্না বান্না করা, বাবাকে খেতে দেওয়া, নিজে খাওয়া, বাসন ধোয়া --কত কাজ। কাজ শেষ হতে হতে প্রায় তিনটে বেজে যাবে।
" বাবা, তোমার ওষুধগুলো ঠিক ঠাক খাচ্ছো তো?" হাতের কাজ করতে করতেই জিজ্ঞেস করলো মল্লিকা। বাবার কাছ থেকে উত্তর আস্তে দেরি হওয়ায়  মল্লিকা বাবার দিকে চাইল।
" হ্যাঁ, তা খাচ্ছি, তবে--"
" তবে?"
" এই ওষুধগুলো তো মাত্র দশদিন চলবে। তারপর বাকি কুড়ি দিন।" বাবার কথায় হতাশা ফুটে উঠে।
" আজ টিউশন থেকে চার হাজার টাকা পেয়েছি। আরও একটা বাড়ি থেকে দেড় হাজার টাকা পাবো।তা দিয়েই বাকি ওষুধ কিনে নেবো।"
" আর তোর পড়ার খরচ? তার কী হবে?"
" এই মাস থেকে আরও একটা টিউশন ধরেছি বাবা। তারাও আড়াই হাজার টাকা দেবে বলেছে।"
" সারাক্ষণ টিউশন পড়ালে তোর নিজের পড়ার কী হবে? আগের পরীক্ষায় কিছুটা কম নম্বর পেয়েছিস বলে এবার তুই বললি, আরও বেশি বেশি পড়তে হবে।এখন দেখছি,....." হঠাৎ কান্না চলে আসে।গলাটা ঝেড়ে পরিষ্কার করে বলে, " এমন বাবা যেন কারও ভাগ্যে না জোটে। আমার জন্যই আজ তোর এই অবস্থা।" একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে কুরে কুরে খায়।
মেয়ে এবার শাসন করার ভঙ্গিতে বাবাকে বকে দেয়।তারপর মায়ের মতো স্নেহে অবাধ্য ছেলেকে বোঝায়," তুমি এমন কেন করো বাবা? তোমার চোখের জল আমি সহ্য করতে পারি না। নিয়তির ওপর দখলদারি চলে না। তুমি, আমি, আমরা সবাই এক জায়গায় আটকে যাই। তবুও হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এরকম করে নিজেকে দোষারোপ করে ভেঙে পড়ো না বাবা।" এরপর বাবার গলা জড়িয়ে বলতে থাকে," আমি জানি,আমার বাবা, পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো বাবা। সেই বাবাকে আমি কখনোই ছোট হতে দেবো না।"
" ঠিক আছে, ঠিক আছে। বুড়ো বাবাকে আর আদর করতে হবে না। রান্না হয়েছে তো স্নান করে আয় দেখি। বাপ বেটিতে একসঙ্গে খেতে বসি।"
" হ্যাঁ,তুমি একটু বোসো, আমি আসছি।"

🍂

খাওয়ার পর বাসন ধোয়াধুয়ির কাজ সেরে মল্লিকা বই নিয়ে বসল। লাইব্রেরি থেকে তিনটে বই তুলে নিয়ে এসেছে। সেগুলো পড়ে নোটস তৈরি করতে হবে।এবার পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। সন্ধ্যাবেলায় একটা টিউশন থাকে। সেটা সেরে আবার রান্না, খাওয়া এবং ন'টা থেকে বারোটা পর্যন্ত সেলফ স্টাডি।

বিকেল চারটের দিকে পাড়াতে বিষম চিৎকার শোনা গেল। অটোবালা শিবু মদ খেয়ে বউকে পেটাচ্ছে। কান পাততেই শোনা গেল শিবুর অশ্রাব্য গালিগালাজ। সেগুলোর কিছু কিছু অংশ বাদ দিয়েও যেগুলো লেখা যায় তা এইরকম, " ফের যদি ঐ চ্যাংড়া ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে দেখি তোকে খুন করে ফেলবো। তোকে খুন করে আমি জেলে যাবো।নষ্টা মেয়েমানুষ কোথাকার। লজ্জা করে না তোর? ঘরে স্বামী রয়েছে, বাচ্চা আছে। এবার যদি দেখেছি,তোকে মেরেই ফেলবো।" বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এই ধরনের ঘটনার ব্যাপারে পাড়া প্রতিবেশীদের অবদান খুব কম থাকে না। তারা কানে ফুসমন্তর দেয়, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে না। রেগে তেতে উঠে শিবু। শ্যামল বলে একটি ছেলের সাথে শিবুর বউয়ের কিছুদিন আগে আলাপ হয় । তারপর তাদের দু'একবার একসঙ্গে গল্প করতে দেখা গেছে। আর তাতেই শিবু আগুন হয়ে যায়, যদিও শিবুর বউ স্বীকার করে না, তাদের দুজনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে। এই নিয়ে নিত্য অশান্তি পাড়ায়।

আবার এই জোড়াদিঘি বস্তিতে জীবনের অন্য ছবিও দেখেছে মল্লিকা। বস্তির মানুষগুলো খুব সহজ সরল।কুটিল সমাজের প্যাঁচ পয়জার এরা বোঝে না। কেউ একটু ভালো কথা বললে বা ভালো ব্যবহার করলে তারা গলে যায়, আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। তখন তার জন্য এরা জান লড়িয়ে দেয়। তখন তাদের সহজেই ঠকানো যায়, বিপথে চালনা করা যায়। কত সামান্য সাহায্যের দ্বারা এদের বশীভূত করা যায়। অন্যেরা এদের ব্যবহার করে। শোষণের জাল বিস্তার করে এদের মহাজন ঠকায়, দালাল ঠকায়, জ্যোতিষ ঠকায়, নেতা ঠকায়। মিছিলে অথবা লড়াইয়ের ময়দানে এদেরই এগিয়ে দেওয়া হয়।

এই মানুষগুলোই আবার কত সামান্য খুশিতেই উদ্বেল হয়ে ওঠে। আয়োজন সাধারণ কিন্তু আনন্দ ফূর্তির কমতি থাকে না। পাড়ার অনুষ্ঠানে পাড়ার ছেলেমেয়ে বুড়ো বুড়ি সবাই সামিল হয়।একের প্রয়োজনে অন্যেরা সাহায্য করে। মেয়ের বিয়ে বা অন্য প্রয়োজনে এরা যতটা সম্ভব সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। আবার অন্যের উস্কানিতে বা সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতে এরা রক্তারক্তি কান্ড বাঁধিয়ে দেয়।এভাবেই জীবন কেটে যায়।

এমন সব উৎপাত সুস্থ পরিবেশের পক্ষে বিরাট বাধা।কখনও কখনও আবার ছোটোখাটো ঝামেলাগুলো বিরাট আকার ধারণ করে। এসবের মাঝখানে পড়াশোনা চালিয়ে যায় মল্লিকা। সামনের বছর ফাইনাল ইয়ার, ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে এম,এস,সি পড়তে চান্স পাবে না। শতকষ্টের মাঝেও মল্লিকা তার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে। সে চায় ভবিষ্যতে শিক্ষিকা হতে। আর্থিক সংস্থানটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। কর্তব্যের উপরেও যে নীতি বা আদর্শবোধ থাকে তারজন্য সে বাড়তি কিছু করতে চায়। কত দুস্থ মেধাবী ছাত্রছাত্রী অর্থের অভাবে পড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। তাদের জন্য কিছু করতে চায় সে- এজন্য চ্যারিটেবল্ সংস্থা  বা এই ধরনের কিছুর সঙ্গে যুক্ত হতে চায়।কত শত ম্লান মুখে ভাষা জোগাতে চায়। এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে।

মল্লিকার ভালো লাগে এই সহজ সরল মানুষগুলোকে। এখান থেকে আকাশ দেখা যায়, দেখতে পায় মানুষের সহজ সম্পর্ককে। অনুভব করে জীবনকে, জীবনের আন্তরিকতাকে। খারাপ লাগে এখানকার ঘিঞ্জি পরিবেশটাকে। দুঃখ লাগে এই মানুষগুলোর অশিক্ষা আর কুসংস্কার দেখে। ওপাড়ার বাপন ঘোষের মেয়েটার বয়স পনের হতে না হতেই বাপে মায়ে বিয়ে দিয়ে দিল। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। আর কতদিন এমন চলবে। মল্লিকার ইচ্ছা হয় এদের বোঝাতে কিন্তু এটাও মনে হয় তার কথা কেউ শুনবে না। তবুও তো চেষ্টা করতে হয়। এটাও তাকে ভাবায়।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে দেখেছে এমন অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে যারা পড়াশোনার ধারে কাছেও যায় না।বাসস্ট্যান্ডে, স্টেশনে চোখে পড়েছে এইসব ছোট ছোট বাচ্চারা হাত পেতে ভিক্ষা চাইছে।অপুষ্টিতে ভোগা এই নাবালক, নাবালিকারা মারাত্মক নেশার কবলে নেশাগ্রস্ত। এরকম চললে এরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।অকালেই শেষ হয়ে যাবে শৈশব। মল্লিকা ভাবে এদের পড়াতে হবে, শেখাতে হবে। এজন্য সে তার নিজের পাড়ায় সময় করে সেই সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে পড়তে বসায় যেসব ঘরে দেখাবার কেউ নেই। কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই সে এ কাজ করে।

মল্লিকা পরিবর্তন চায় এই সমাজের। যারা সমাজের বাতিস্তম্ভের মতো সমাজে আলো দেয় অথচ নিজেরাই পড়ে থাকে অন্ধকারে তাদের জন্য আলো আনতে চায়। জ্ঞানের আলো, শিক্ষার আলো, সুস্থতার আলো। কবে আসবে সেই সকাল? সে যে সেই সকালের প্রত্যাশী। ভোর হবে, আলো ফুটবে, জীবনের কলরবে ভরে উঠে সূর্য উঁকি দেবে পুব আকাশে। মল্লিকা জানে তার একার দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। আরও অনেককে এগিয়ে আসতে হবে। ভালোবাসার হাতটা বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই রোদ আসবে আঁধার শেষে।

Post a Comment

0 Comments