জ্বলদর্চি

গল্প।। ঘাড় নাড়বার পর।। সন্দীপ দত্ত

গল্প।। ঘাড় নাড়বার পর।। সন্দীপ দত্ত


রুল দেখিয়ে ভূতনাথকে রোল খেতে বলে বৃহস্পতিবাবু শনিঠাকুরের প্রসাদ জিভে নিয়ে টকাস্ করে একটা শব্দ করে চোখ বুজে বললেন,"রোলটা কেমন লাগল খেতে আমায় বল্। আমার আবার ধৈযটা বড় কম। তাড়াতাড়ি শেষ কর্। তোর রোল শেষ হলে আমার কিছু কথা আছে।"
      কাঁচুমাচু হয়ে বৃহস্পতিবাবুর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় ভূতনাথ। "বড়বাবু,আপনি কি থানায় আমায় রোল খেতে ডাকলেন? আমার যেন কেমন ধন্দ লাগছে।"
"কী লাগছে?"
"আজ্ঞে ধন্দ বড়বাবু। কখনও এমন শুনিনি তো!!"
"কী শুনিসনি?"
"না মানে,বাপের জন্মে কখনও শুনিনি চোরকে থানায় ধরে নিয়ে এসে পুলিশ তাকে লকআপে না ঢুকিয়ে সামনে বসিয়ে জামাইআদর করে রোল খাওয়ায়।"
"কলিযুগের নাম শুনেছিস?"
"হ‍্যাঁ,তা শুনেছি বড়বাবু। এটাই তো কলিযুগ।"
"তাহলে? কলিযুগে কী হয়না বল তো? এটা অবশ‍্য ফুলযুগ। কলি পাপড়ি মেলে ফুল হয়েছে এখন।"
"তাই বুঝি আমায় ঘুষ খাওয়াচ্ছেন?"
বৃহস্পতি গম্ভীর গলায় বললেন,"ওটা ঘুষ নয়। রোল। হাবুলের দোকানের। গরম গরম তোর জন‍্য আনালাম। হাবুলটা আর যা-ই করুক,রোল খুব ভাল বানায়। তোর বউদি তো হাবুলের দোকানের রোল ছাড়া অন‍্য কারও দোকানের রোল পছন্দ করে না। খেয়ে দেখ্,মাটন দেওয়া আছে।" বলে টেবিলের ওপর পাজোড়া তুললেন বৃহস্পতি। তারপর ব‍্যান্ড বাজানোর মতো একটা সুমধুর ছন্দে বুটদুটো নাড়িয়ে শব্দ শুরু করলেন।
"ওখানেই তো ধন্দ লাগছে বড়বাবু। হঠাৎ করে আপনার বউ আমার বউদি হয়ে গেল,আপনি আমার দাদা হয়ে গেলেন,আপনার প্রিয় দোকানের মাটন রোল আনা হল আমার জন‍্য.......সব কেমন যেন গোলমেলে লাগছে। ভরসন্ধেতে চোলাইয়ের বোতল নিয়ে বসেছিলাম খেমটির একটু ধিতাং ধিতাং নাচ দেখব বলে,হুট করে আপনি গিয়ে আমার কলার ধরে জিপে তুললেন। ভাবলাম পিঠে তো আমার অসংখ‍্য কেসের দাগ,তাই হয়তো থানায় নিয়ে গিয়ে বেদম ঘাকতক দিয়ে হাজতে পুরবেন। তা না করে হাতে দিলেন রোল। রোলের মধ‍্যে বিষ নেই তো বড়বাবু? বউটা আমার পাঁচমাসের পোয়াতি। দু'দুটো ছেলের পর ও মেয়ে খুঁজছে। ওর মেয়ের বড় শখ। ছেলে মানেই তো বাপের মতো চোর হবে। একটা মেয়ে হলে সে ভয়টা অনেক কম। বউ বলেছে,মেয়েটাকে ও ওসব হতে দেবে না।"
"কী যে বলিস ভূতনাথ! তোকে বিষ খাইয়ে আমি নিজে মরি আর কি! কোথায় আমি যাতে বাঁচতে পারি,তার চিন্তা করছি!"
🍂

"কেন বড়বাবু,কী হয়েছে আপনার?"
"আগে খা। বলছি।" বৃহস্পতি সিগারেট ধরালেন।
          ভয়ে আর তাড়াহুড়ো করে মাটন রোলটা কোনওরকমে শেষ করে জম্পেশ একখান ঢেঁকুর তুলে ভাল করে নড়েচড়ে বসল ভূতনাথ। বসে হাঁ করে তাকাল বড়বাবুর রাঙাআলুর মতোন মুখটার দিকে।
         বৃহস্পতি বললেন,"কেমন ছিল?"
"দারুণ!" আবার একটা ঢেঁকুর তোলে ভূতনাথ।
"এবার শোন্। আগামী শুক্রবার ব্রিগেডে দুপুর বারোটায় সিএমের একটা সভা রয়েছে। তোকে হাজারখানেক লোক ঢোকাতে হবে। মাঠ না ভরাতে পারলে আমার চাকরি থাকবে না।"
          বড়বাবুর কথা শুনে ভূতনাথ থ। "কী বলছেন বড়বাবু! আমি লোক ঢোকাব? আমার যারা চেনাশোনা রয়েছে,তারা তো সব দাগি!"
"ও কিছু হবে না। মাঠ ভরলেই হল। আর আজকাল কে পুলিশ,কে চোর,চেনা যাচ্ছে নাকি? যে নেতা,সে-ই ডাকাত। সব মিশে গেছে।"
"তবু ভয় করছে বড়বাবু। সে আমার হাতে কিছু লোক আছে ঠিকই,কিন্তু তারা তো কেউ ঘটিচোর,কেউ জুতোচোর,কেউ লাউচোর,কেউ বা ফাউচোর। ওরা যদি ওখানে যেতে ভয় পায়? চারদিকে ওখানে পুলিশ থাকবে তো!"
"ছাড় তো পুলিশ! আমিও তো পুলিশ। আমি তোর সাথে দিব‍্যি কথা বলছি কী করে? আসলে কী জানিস ভূতনাথ, এই মুহূর্তে আমরা সকলেই ভীতু। সিএমের নির্দেশে পুলিশের ওপরমহল তটস্থ। পুলিশের ওপরমহল,নেতামন্ত্রী সবাই আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। মাঠে লোক জড়ো করতে না পারলে আমাদের চাকরিতে টান পড়বে। অনেকদূরে বদলি করে দেবে। ওদের হাতেই তো সব। তাই ওদের কথায় ঘাড় নাড়াতেই হয়। সোনা ভূতনাথ আমার,তাই তোকে বলছি যেভাবে পারিস,ওইদিন মাঠ ভরিয়ে দে বাবা। তোকে আমি অনেক টাকা দেব।"
"আমাকে আপনি টাকা দেবেন? আমি কি ঠিক শুনছি?"
"হ‍্যাঁ,ঠিকই শুনেছিস ভূতনাথ। তোর মতো আরও অনেককেই বলেছি,যেখান থেকে পারিস,যেভাবে পারিস,ওইদিন ব্রিগেডে লোক ঢোকা। যত পারিস লোক ঢোকা। বাচ্চা হোক,বুড়ো হোক,নুলো হোক,খোঁড়া হোক,ওখানে বসে বসে ওরা শুধু ঘাড় নাড়াক একটু। নিউজ চ‍্যানেলগুলো দেখুক। তাহলেই হবে। এটা আমার কথা নয় ভূতনাথ। সিএম বলেছেন। সিএমের কথা কি অমান‍্য করা যায়,বল্? মঞ্চে উনি অনেকগুলো প্রকল্পের শিলান‍্যাস যে ইতিমধ‍্যে করে ফেলেছেন,সে কথা বলবেন। সেইসঙ্গে বলবেন,কী দ্রুতহারে উন্নতির বন‍্যা বয়ে গিয়েছে এ রাজ‍্যে। সব মিথ‍্যে। সব ভাঁওতা। আমরাও জানি। তবু আমরা যেভাবে ঘাড় নাড়ি ওনার কাছে,লেজ নাড়ি পোষ‍্য হয়ে,মঞ্চে উপস্থিত মন্ত্রীসভার লোকগুলো যেমন ঘাড় নাড়ে আর হাতে তালি দেয়,ওখানে দর্শক আর শ্রোতার আসনে বসে থাকা লোকগুলো যেন ওরকমই ঘাড় নাড়ে ভূতনাথ।"
"ঘাড় নাড়বার পর?" ভূতনাথ জিজ্ঞেস করে।
"ঘাড় নাড়লেই আমরা সবাই ভাল থাকব। মিথ‍্যে হোক,অভিনয় হোক,প্রবঞ্চনা হোক,ঘাড় নাড়লেই সবকিছু ঠিক থাকে। কে অত ঝুঁকি নিতে চায় বল্ তো? ঝুঁকি নেওয়া মানেই তো চোখ রাঙানি আর প্রাণনাশের হুমকি। তার চাইতে ঢের ভাল ভেড়া হয়ে থাকা। আজকাল তুই যত ভেড়া হয়ে থাকবি,ততই তোর পয়সা। মানুষ হলে ভিক্ষে করতে হবে। মানুষের চেয়ে ভেড়াদেরই প্রভাব বেশি। অনেক বেশি সম্মান। ফুলযুগ ছাড়িয়ে বলতে পারিস,আমরা এখন ভেড়াযুগে।"
          থানার বড়বাবু বৃহস্পতি কোলের কথা শুনে আবার একটা ঢেঁকুর তুলল ভূতনাথ। তারপর বিবর্ণ,ছেঁড়া ফাটা জামার অক্ষত পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরাতে গেলে রে রে করে উঠলেন বৃহস্পতি। "বিড়ি খাচ্ছিস কেন?ফেল ওসব! এই নে,এই সিগারেটটা নে। এটা খা।"
বড়বাবুর বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেটটার দিকে ভয়ে ভয়ে হাত বাড়ায় ভূতনাথ।
"মাঠে লোক ঢোকাতে পারবি তো?" বৃহস্পতি আবার জিজ্ঞেস করলেন।
ভূতনাথ ঘাড় নাড়ে। নাড়তেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বড়বাবু। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন আলমারির দিকে। তারপর কেসফাইলের পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হুইস্কির বোতলটা নিয়ে এসে রাখলেন টেবিলে। রাখতে রাখতে বললেন,"হুইস্কি খাবি এক পেগ? দিচ্ছি দাঁড়া।"
         ভূতনাথের চোখদুটো চকচক করে ওঠে। লোভে ভিজে যায় জিভ।
            বৃহস্পতি কাচের গেলাসে হুইস্কি ঢালেন। গেলাসটা এগিয়ে দেন ভূতনাথের দিকে। দিতে দিতে বলেন,"কীরে,দিনটা মনে থাকবে তো? সামনের শুক্রবার। সকাল দশটার মধ‍্যেই পৌঁছে যেতে হবে তোদের। রিপোর্টাররা যেন বুঝতে পারে,মাঠ ভরছে।"
ঘাড় নাড়ে ভূতনাথ।
হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিয়ে বড়বাবু বললেন,"তোকে একদিন আমি বুলবুলির শরীরের গন্ধ নিতে দেব। তোর খেমটির থেকে ও অনেক শাঁসালো। ছুঁলেই বুঝতে পারবি। শুক্রবারটা আগে পেরিয়ে যাক।"
           বড়বাবুর কথায় গদগদ হয়ে নেশার ঘোরে ভূতনাথ বৃহস্পতিকে অচেনা বুলবুলি দেখে। ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দেয় সে।#

Post a Comment

0 Comments