জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৬/ বিজন সাহা

বিদায়, সূর্য বিদায়!

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৬ 

বিজন সাহা 

সামারা 

তলিয়াত্তি থেকে আমরা পথ ধরলাম সামারার দিকে। এটা আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। সামারা - সোভিয়েত আমলের কুইবিশেভ। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে এক সময় বর্তমান বুলগার শহরের নামও ছিল কুইবিশেভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো থেকে এখানে স্থানান্তরিত করা হয়। স্তালিন নিজে মস্কো ত্যাগ না করলেও অনেক মন্ত্রণালয় এখানে সরিয়ে আনা হয়। এই শহরের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মে। সেবার সবে মাত্র ভাষা কোর্স শেষ করে ছাত্র নির্মাণ দলে কাজ করতে আমরা যাচ্ছিলাম  কাজাখস্তানের এক গ্রামে। এখানে দিনের বেলায় বেশ কিছুক্ষণ আমাদের ট্রেণ থেমেছিল।

এখানেও ফুটেছিল ফুল

মস্কো থেকে ট্রেণে ওঠার পর এখানেই প্রথমে প্ল্যাটফর্মে নামার সুযোগ হয়। এখানেই প্রথম দেখেছিলাম বাবুশকা মানে বয়স্ক মহিলাদের আপেল, ঘরে তৈরি বিভিন্ন খাবার বিক্রি করতে। এরপর এখানে আসি ১৯৮৭ সালে দেশ থেকে ফেরার পথে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে আমাদের প্লেন কুইবিশেভ পাঠানো হয়। আমাদের ছোট বেলায় দেশে বিমান এত ঘনঘন উড়ত না। দুপুরে ঢাকা থেকে যে বিমান যেত কোলকাতার দিকে তার ছায়া পড়ত আমাদের উঠানে। আমরা বাচ্চারা হৈচৈ করে ছুটতাম ছায়ার পেছনে। কুইবিশেভ ল্যান্ড করার আগে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছায়া ছুটে চলছে আমাদের সাথে সাথে ঠিক যেমন পূর্ণিমার চাঁদ হাঁটে পাশে পাশে। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম এটা আসলে আমাদের বিমানের ছায়া। খুব মজা লাগছিল সেটা দেখে। বলতে গেলে মস্কোর বদলে এখানে নামার কষ্টের কথা ভুলেই গেছিলাম। পাশে লন্ডনগামী ভদ্রলোককে দেখালে তিনিও অবাক হলেন। এখন ঠিক মনে নেই সেদিন আমরা বিমান থেকে বেরিয়েছিলাম কিনা, নাকি বিমানে বসেই গ্রীন সিগন্যালের অপেক্ষা করছিলাম। পরে ছাত্রজীবনের শেষের দিকে এই শহরের এক মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। মস্কোয় বেড়াতেও এসেছিল। পরে আর যোগাযোগ হয়নি। তবে সামারায় যখন এলাম ওর চেহারা আবার নতুন করে মনে পড়ল। সামারা থেকে ফেসবুকে ছবি ও ভিডিও আপলোড করে শুনেছি আমার এক বন্ধু ইভান এই শহরে বেশ কিছুদিন ছিল ব্যবসায়িক কাজে। আরও একটা কারণে সামারা আমার কাছে বেশ পরিচিত ছিল – সেটা হল সেখানকার গভর্নর কনস্তান্তিন তিতভ। যদিও সোভিয়েত আমলেই তিনি কমসোমল ও পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন, তবে ১৯৯১ পরবর্তী রাশিয়ার জনপ্রিয়  রাজনীতিবিদদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, বিশেষ করে ১৯৯০ এর দশকে। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সামার গভর্নর আর ২০০৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত সামারা অঞ্চলের সিনেটর। 

🍂

সামারা শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন ভার্সন আছে। প্রথম ভার্সন অনুযায়ী এ শব্দটি এসেছে তুর্ক ভাষা থেকে যা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ভাষার আদিভাষা, ঠিক যেমনটা সংস্কৃত বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার। এই ভাষায় আর বা এর অর্থ নদী,  সাম – স্তেপ। সেক্ষেত্রে সামারা মানে স্তেপের নদী বা স্তেপের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী। দ্বিতীয় ভার্সন অনুযায়ী সামারা শব্দটি এসেছে তাতার ও চুভাস ভাষার সামার, কালমিকি ভাষার সামর, কিরঘিজ ভাষার সারদার থেকে যার অর্থ বস্তা, গামলা, কলসি ইত্যাদি। মাক্স ফাসমেরের মতে সামার বা অনুরূপ শব্দ নদীর বাঁক বোঝাতে ব্যবহার করা হতে পারে যা দেখতে বস্তা বা কলসির মত মনে হয়।  তৃতীয় ভার্সন অনুযায়ী এটা এরজিয়ান শব্দ। বরিস সেরেব্রেন্নিকভের মতে এরজিয়ান ভাষায় মার মানে পাহাড় বা টিলা। আর সামারার সা আসলে সেইয়ার অপভ্রংশু যার অর্থ ছাগল। পুরানো মানচিত্রে বলা আছে যে সামারা জনপদ সাদা ছাগল নামে নদীর তীরে অবস্থিত। তাই সামারা হল ছাগলের টিলায় অবস্থিত শহর। আরবের নথিপত্রে সামারা নদীর উল্লেখ পাওয়া যায় ৯২২ সালে। সেই সময় বুলগারের আশেপাশে সামারা নদী দিয়ে বড় বড় কাফেলা যেত। আরবের পরিব্রাজক ইবন ফাদলান সেই ভ্রমণের দিনলিপিতে কাফেলার সামার নদী অতিক্রম করার কথা উল্লেখ করেন। সেই অর্থে এখানে অনেক আগে থেকেই জনপদ ছিল। তবে আধুনিক সামারার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫৮৬ সালে। জার ফিওদর ইয়ানোভিচের নির্দেশে যেখানে সামারা নদী ভোলগায় পড়ছে সেখানে যুবরাজ জাসেকিন ও সেনাপতিদ্বয় এলচানিনভ ও স্ত্রেশ্নেভের নেতৃত্বে দুর্গ নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ভোলগার নৌ চলাচল নিরাপদ করা আর যাযাবরদের আক্রমণ থেকে রুশ সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষা করা। সামারায় দুর্গ স্থাপনের আগে মস্কোর জার নোগাইয়ের মুরজার সাথে আলোচনা করেন। শান্তিপূর্ণ ভাবে দুর্গ তৈরি করার জন্য বলা হয় এর উদ্দেশ্য দস্যুদের হাত থেকে নোগাইদের রক্ষা করা। তবে এই দুর্গের মূল কাজ ছিল ভোলগা ও সামারা নদীর বিশাল এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, পরিকল্পনা মাফিক নতুন নতুন ভূমি দখল করা, যাযাবরদের আক্রমণ থেকে রুশ ভূমি রক্ষা করা এবং কাজান থেকে আস্ত্রাখান পর্যন্ত নৌপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। বর্তমানে যেখানে ভাল্ভ তৈরি কারখানা তার পাশে এই দুর্গ নির্মিত হয়েছিল। দুর্গের প্রথম অধিবাসীরা ছিল সরকারি কর্মচারী – বয়ারদের সন্তানেরা, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ যারা নগাইদের আক্রমণ থেকে নতুন দুর্গ রক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। ১৬৯০ ও ১৭০৩ সালের অগ্নিকাণ্ডে দুর্গ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে ১৯৮৬ সালে শহরের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ভদনিকভ ও কুতিয়াকভ রাস্তার মিলন কেন্দ্রে একটি লগ হাউজ নির্মাণ করা হয় যা আমাদের সামারার দুর্গের একটি টাওয়ার ও দেয়ালের কথা মনে করিয়ে দেয়।  

১৫৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সামারা শহরের মর্যাদা লাভ করে। ১৬৪৬ সালে সামারায় প্রথম পারিবারিক আদমশুমারি পরিচালিত হয়। প্রথম পিওতরের রাজত্বকালে সামারা কাজান প্রদেশের নবম শহর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৭১৯ সালে সামারা আস্ত্রাখান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময় এখানে ২১০ টি পরিবার বসবাস করত। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকে সামারা দুটি কৃষক বিদ্রোহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৬৭০ সালে স্তেপান রাজিনের সেনাবাহিনী সামারা দখল করে। ১৭৭৩ সালে সামারা ছিল প্রথম শহর যা এমিলিয়ান পুগাচেভের পক্ষে যোগদান করে। ১৭৪০ এর দশকে সামারা অরেনবুরগ অভিযানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই অভিযানের ফল অরেনবুরগ ও স্তাভ্রপোল শহর দুটির পত্তন। স্তাভ্রপোল সম্পর্কে আমরা আগেই বলেছি, যা বর্তমানে তলিয়াত্তি নামে পরিচিত। এই অভিযানের চার নেতার একজন ছিলেন তাতিশেভ। ১৭৭৩ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত স্তাভ্রপোল এই এলাকার প্রধান শহরে পরিণত হয়। ১৭৮০ সালে সামারা কাউন্টি শহরের মর্যাদা পেয়ে সিমবিরস্ক প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

শেষ বিকেলের রোদ

আমরা যখন তালিয়াত্তি থেকে সামারা এসে পৌঁছুই তখন বিকেল হয়ে গেছে। বেশ খানিকটা  অপেক্ষা করার পর  ফ্ল্যাটের মালিক এসে পৌঁছুলেন। যে ফ্ল্যাটটা আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম সেটা ছিল ভোলগার তীরে। একটা নতুন বাড়ি। দেখে মনে হয় বেশ দামী। এখনও সমস্ত কাজকর্ম শেষ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে অনেকেই থাকতে শুরু করেছে বা বাসা ভাড়া দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে কয়েকটা শহরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি আজকাল অনেকেই স্থাবর সম্পত্তিতে টাকা ইনভেস্ট করে। এটা মনে হয় মার্ক টোয়েনের উপদেশ শুনে। জমি কেন, কারণ নতুন জমি আর তৈরি হবে না। অন্তত রাশিয়ায় বাড়ির দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। তাই অনেকেই এখানে ইনভেস্ট করে ইনফ্ল্যাশনের হাত থেকে ক্যাপিটাল রক্ষা করে। আগে এরা মার্ক্সের ক্যাপিটাল রক্ষা করত, এখন ভিন্ন ক্যাপিটাল। অনেকেই এসব বাসা ভাড়া দিয়ে ইনকামের পথ বের করে। কেউ কেউ ভাড়া দেয় দীর্ঘমেয়াদী, কেউ এরকম অল্প দিনের জন্য, অনেকটা হোটেল টাইপে। বেশ বড় বাসা, অনেকটা হোটেলের মত। ভদ্রলোক আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমরা আপাতত এক রাতের জন্য ভাড়া নিলাম। তখনও ঠিক হয়নি আমরা কয়দিন এখানে অবস্থান করব। পরের দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস তেমন সুবিধাজনক নয়। তাই ঠিক হল সকালে পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেব। শেষ বিকেলের সূর্য ভোলগার বুকে লুটিপুটি খাচ্ছে। যদিও নদীর তীর এখন জনশূন্য, সার ধরে ফোটা রং বেরঙের গোলাপ এখনও সবে মাত্র বিদায় নেয়া গ্রীষ্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। আমরা সেদিকেই পথ ধরলাম। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখার পাশাপাশি খাবার ব্যবস্থাও করতে হবে।     

ছবিতে সামারা 

http://bijansaha.ru/album.php?tag=257

সামারা ভিডিওতে
https://www.youtube.com/watch?v=TDb5DWGHVRo&t=27s

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments