জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( ষটপঞ্চাশত্তম পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( ষটপঞ্চাশত্তম পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

বিড়িতে একটা জোর টান দেয়। অনভ্যস্ত টান। সামলাতে পারে না। দমকা কাশির তোড় চোখে নাক দিয়ে জল বের হয়। বিড়িটা তখনও দু' আঙুলের খাঁজে আটকে থাকে। লোখা বকুনি দেয়,
– কেনে অত জোরে টানঠ? নাকে মুখে ধুমা আটকি গেলে অ্যাকে অ্যাক্কার হই যাবে। তুমি কি মোদের মত বিড়িখোর? ফেলি দাও, আর খেতে হবে নি।
– দাঁড়া ত তুই। কিছু হবেনি। বেতালে জোর টান দিয়া হয়ে গেছে। এবার বল কি বোলছিলি?
– কি আর– অই গেরামে যেদি মাধুকে আনা লিয়ে হুজ্জুতি হয়, তখন?
–সেটা গেরাম বুজবে। মোর কি যায এসে! অকে লিয়ে যাবে কি যাবেনি সেটাও বুজবে গ্রাম। আমি অ্যাসার মালিক এসচি। দেখব, শুনব, বলার মত হলে বোলব, নাইলে মুুখে রা'টি কাড়ব নি।
–মোর কাছে বেশি নাটক কোরোনি,বুইলে। মুখেই বলঠ কিন্তু অন্তর তমার হাউহাউ করেঠে। উসব মোর জানতে বাকি নাই। লোখা বাগদিকে অতটাও হাঁদাকাড়া পেয়ে যাওনি।
–থাইলে তোর কি মত আগে বল দিখি?
– আমি অত মারপ্যাঁচ বুজিনি। মোর রাফসাফ কথা। যেখিনের বউড়ি সে যেদি চায় সেখিনেই থাকবে। বাপের ঘরকে সে যখন খুশি যাবে। তার স্বামীর ভিটা ছেড়ে যাবে কেনে? আর যেদি যেতেই হয় ত রোগের কারণে তাড়ি দিবে উটি চোলবেনি। তার ছেনাটা আছে কি জন্নে?
– অই ত, মিটিং থাইলে ত তুই এগিই রেখেচু। চ তবে। আসনে বসে তুই অই মতটাই দিবি।
– তুমি পার মাইরি! মোকে দিয়ে বলাচ্চ! আমি কি জানিনি বুজেচ! তমার সব প্যাঁচ ভাঁজা আছে। কেনে তুমি ঝন্টাকে পশাসনের লোককে জানাতে বোল্লে, তা কি আমি বুজতে পারিনি ভেবেচ! 
– এত সব বুজে গেছু যখন তখন মোর আর কিছু চিন্তা নাই।
– তা মোর উবরে তমার এত ভরসা জেনে ভালই লাগেঠে। কুন্তু তমার মন যে এখন ভাল নাই সেটা বুজি, মেস্টার।
🍂

সত্যিই মন ভাল নাই খগেন মাস্টারের। কিন্তু সেকথা কাউকে বলা যাবে না সহজে। এখন তো সে ঢোলের বাগদি পাড়ার অবুঝ কিশোরটি নেই। বাগদিরা একগুঁয়া। বাগদিরা আনাড়ি। সবেতেই হুড়দাঙ্গা করা তাদের স্বভাব। এরকম কত বদনাম তার কানে আসে। তার এই জাতিগত বদনামের জালে সে কখনো নিজেকে জড়াতে দেয়নি।যেদিন থেকে বুঝেছে আসলে খিদের লড়াইয়ের পাশাপাশি আরো একটা লড়াই তদের লড়তে হবে। লড়তে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই লড়াই জাতের আত্মসম্মানের লড়াই। খগেন মাস্টার অনেক সংগ্রাম করে নিজের একটা জায়গা তৈরি করেছে। আর পাঁচটা বাগদির সঙ্গে তাকে ফেলে হেয় করার আগে সাতবার ভাবে অন্যেরা। বিশেষ করে নিজেদের জাহির করা উচ্চবর্ণের লোকজন। আজকে যদি আবেগে বেশি উত্তিজিত হয়! যদি সবার বাধা সত্ত্বেও মাধুকে গ্রামে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে জোর সওয়াল জবাব করে!  তবে ঢোলের মনে চাপা পড়ে যাওয়া তাদের কথা নতুন করে বেঁচে উঠবে। তাদের জাতের মানুষজনকে সে চেনে ভাল করে। নিজেরাই বাতাসের আগে খবর পৌঁছে দেবে চারদিকে। এমনটা সে হতে দিতে চায় না আর। কিন্তু সেও ত মানুষ। তার মনেও ত ভালবাসার একটা প্রদীপ নিভু নিভু করে এখনো জ্বলছে। কিশোরবেলার সেই প্রেমকে আজও ভুলতে পারেনি সে কিছুতেই। ভুলতে তো চায়নি সে কখনো। বরং সার জল দিয়ে আদর যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে তার কিশোরবেলার প্রেমের চারাগাছটি।  সেই প্রেমতরুর শাখায় ফুল ফোটেনি কোনদিন। পর্ণমোচি গাছের মতো মনের এক খন্ড জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। দিনান্তে সেই ছায়াহীণ গাছতলায় দুদন্ড সে বসে। তাতেই তার সুখ।
          মাধুর শ্বশুর ঘরে পৌঁছাতে দেরি হয় তাদের। ততক্ষণে সবাই আলোচনায় বসে পড়েছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পাড়া গ্রামের অনেক গণ্যমান্য হাজির সেখানে। লোখা আসনে বসে না। পিছনে দাঁড়ায়। খগেন মাস্টার নমস্কার করে বসে পড়ে। এরই মাঝে দু'একবার তার চোখ চরদিকে কাউকে যেন খোঁজ করছিল। লোখা বুঝতে পারে। তার না বসার পিছনে কারণ অনেক। মাস্টারের আবভাব বুঝাও ছিল একটা কারণ। আলোচনায় আগে শ্রাদ্ধশান্তি নিয়ে একপ্রস্ত আলোচনা হয়। তারপরেই মাধুর থাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। তাদের গ্রামের এক দুজন মাধুর স্বামীর ভিটায় থাকার পক্ষে কথা বলে,
– তমরা পাড়া লোক ঠিক কথা বোলচ নি। মানলম সে লোকটা মোরেচে এটস রোগে। তার বউ ছেনার রক্ত রিপোটে ত সেই রোগ ধরা পড়েনি। থাইলে কেনে তাকে ইখিনে থাকতে দিবেনি?
কিন্তু কে বোঝায় তাদের একথা। পাড়া বাখুলের সবাই যেন একজোট বেঁধেছে। পুরুষেরা যতনা বাধা দেয়,তারচে বেশি কাউঝাউ শুরু করে মেইয়া বউড়িরা। সেটাই তো চিরকালের নিয়ম। সেই অতীতকাল থেকে নারীর হাতেই নারী সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়েছে। আর দোষ পেয়েছে পুরুষেরা। নারী ধরেছে অত্যাচারের লাঠি কিন্তু আড়াল থেকে চালনা করেছে পুরুষ। এইরকম বলে অতিসরল করে দিয়েছে সমাজ। 
ভবতারণ পাড়ার লোকেদের উদ্দেশ্যে বলে,
– মোদের ঝিউড়ি হাজার হতে পারে। এখন কুন্তু তমাদের দেশের বল,পাড়ার বল বউড়ি। তমরা যেদি অবুজের মত কাজ কর থাইলে মেইছেনাটা ত পথে বসবে এগবারে। তার উবরে দুদের বালক একটা আছে তার।
– হাজার মোদের বউড়ি হতে পারে। কুন্তু ওই রোগ লিয়ে মোদের পাড়ায় থাকতে দুব নি। 
— একদম ঠিক বলেচু। যাদের বউড়ি তাদের! মোদের কি? সব জেনেশুনে উসব রুগীকে লিয়ে এক পাড়ায় থাকা যায় কুনু দিন!
সুবল পিয়ন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে। ভীড় দেখে ঝোন্টা কিছুটা ভড়কে যায়। বুঝতে পারে,তার দলের পঞ্চায়েতের কথা এখানে চলছে না। সেক্ষেত্রে তার বেশি হম্বিতম্বি খাটবে না। ঘন ঘন সে খগেন মাস্টারের দিকে তাকায়। তবে অজা দোলই মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। গলা ঝাঁঝিয়ে বলে উঠে,
– ই কি মেকানের কথা হয়ঠে। একটা অবলা বউড়িকে ইভাবে গেরাম ছাড়া কদ্দিবে। তমাদের গেরামে কি বিচার সালিশ বলে কিছু নাই। আর তুমি মুখে চাবি এঁটে বসে আছো কেনে বিয়াই? তমার ত বউম্? তমার কুনু কথা নাই? নাকি সম্পত্তি বাঁচানার তালে চুপ মেরে আছ। সে কটা কুটতে হবে নি। যেদি লিয়ে যেতে হয়, তবে পাওনা কড়ি বেঁদেই লিয়ে যাব।
অজা দোলইয়ের কথায় যেন দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। পাড়ার ছেনা বউড়ি ঝিউড়িরা কাউচান ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি চলে।আসনে বসে থাকা লোকজন অসহায়ের মতো বসে থাকে। এদিকে লোখাকে খুঁজতে এদিক ওদিক তাকায় খগেন মাস্টার। কিন্তু তাকে নজর করতে পারে না। অনেক কষ্টে গ্রামের পঞ্চায়েতের ধমক ধামকে চিৎকার কিছুটা থাকে। পঞ্চাযেত ঝোন্টার দিকে তাকিয়ে বলেন,
– বুজতেই তো পাচ্ছেন পরিস্থিতি।  এই অবস্থায় বোলুন আপনারাই।
ঝোন্টা চুপ থেকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু এই মুহুর্তে তাকে তো কিছু বলতেই হবে। যদিও তার মাথায় কাজ করছিল অন্য ভাবনা। এখানে আসার আগে সে ঢোলের অনেকের সাথে কথা বলেছে। সুবল পিয়নের পাড়ার লোকের সাথেও বলেছে। তারা মাধুকে না আনার কথাই পইপই করে বলে দিয়েছে। এমন কি পিয়নের বউয়েরও একই মত। ঝোন্টা জীবনে একটা কথাই বুঝে,পার্টি আগে। পার্টি থাকলে তার পেটে টান পড়বেনা। যখন যেই পার্টি আসবে সেই দিকেই ডিগবাজি দিলেই হল। বাগদির লাঠি ছাড়া কোন পার্টি রাজনগরে দাঁড়াতে পারবে না। আর লেঠাল তার হাতে থাকবে সবদিন। যতদিন মদ মাংস আর টাকা থাকবে। দিগার পাড়ায় তার অনেক ভোটার। তাদের চটালে হবে না। পিয়নের বউকেও হাতে রাখতে হবে। পার্টি চালাতে টাকা তো লাগে। অতএব সাবধানে তাকে চলতে হবে। তাল বুঝে খগেন মাস্টারের গায়ে কথা ফেলে দেয়। 
— একটা মেইয়া মানুষের কথা যেদি কেউ না ভাবে থাইলে বেচারি কি কোরবে। বাধ্য হয়ে থািলে থানা পুলিশ কত্তে হবে। না তুমি কি বোলচ মেস্টার?
অনেক আগে থেকেই অস্থির হয়ে উঠছিল খগেন মাস্টার। অবাকও হচ্ছিল সে। পাড়ার একটা বউ,এত অল্প বয়স, যার জীবনে এত বড় একটা বিপর্যয় নেমে এসেছে,তার প্রতি এতটুকু মায়া হচ্ছে না কারও! রোগের দোহাই দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে! যার কোন ভিত্তি নেই। এখনই হয়তো স্বাস্থ্য দপ্তরে জানানো যায়। থানায় জানানো যায়। হয়তো আরও বড় কোন প্রদক্ষেপ করতে পারা যায। তাতে হয়তো কাজও হবে। কিন্তু শেষ অব্দি মেয়েটাকে থাকতে হবে এদের সঙ্গে। প্রতি মুহুর্তে এদের ঘৃণার বিরুদ্ধে, অবহেলার বিরুদ্ধে, টিটিকারির বিরুদ্ধে যুঝতে হবে তাকে। তা যেন আজকের এই নিদারুণ আঘাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর। তারচেয়ে ভাল হয় বাপের ভিটেতে থাকা। একই সঙ্গে এখানের অধিকার থেকে মা ছেলে যেন বঞ্চিত না হয়, সেটাও নিশ্চিত করা। মাস্টার স্থির করে এই পথে আলোচনাকে নিয়ে যেতে হবে। কৌশল করে এগোতে হবে তাকে। ঝোন্টার মনোভাব সে জানে। গ্রামে হয়তো বাধা আসবে। কিন্তু সেই বাধাকে সে রুখে দিতে পারবে। কিন্তু কিছু বলার আগে লোখাকে তার প্রয়োজন। রাগ হয় লোখার উপর। এই মুহুর্তে কোথায় যে গেল সে ভেবে পায় না। হঠাৎ পাড়ার ভিতর থেকে চিৎকার করে কান্নার স্বর ভেসে আসে। সভাস্থল থেকে ভিড় প্রায় খালি হয়ে যায়। খগেন মাস্টার লোখার খোঁজ করে। ঠিক সেই মুহুর্তে তার সামনে হাজির হয লোখা। তাকে দেখা মাত্রই ঝাঁঝিয় ওঠে মাস্টার,
– তুই সব দিন লটম্বোরা রয়ে গেলি। কাজের সময তুই ঠিক কেটে পড়বি।
– সে তুই যা বলো মোকে। তমার সুবিদার জন্নেই আমি সটকে গেইলম। উ দিকে কে কাঁদেঠে বল দিখি?
– কে কাঁদেঠে?
— মাধু। আমি ত জানি তমরা হলে মেদ্দা লোক। আইন কাননের কথা বোলবে। কুন্তু আমার মত লটম্বোরার কাছে নিয়ম আলাদা। কথা বলতে গেইলম মাধুর কাছকে। বোল্লম,মাধু! তোর যা হবার ত হইচে। এখন ছেনাটার মুখের দিকে চেয়ে তোকে শক্ত থাকতে হবে।  সব ত শুনুঠু। তোর শ্বশুর ঘরের লোকেরা তোকে রাকতে চাইনি। তোর কি মত? কথায় থাকবি?
— কি বোল্লে উ?
–হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকল পথমে। পরে মোকে জিগ্যাস কল্লে,মোর বাম মার মত কিরে?
— যা সত্যি তা বোল্লম। বাপের মত থাকলেও তোর মাকে ত জানু। আর গেরামের লোকেরাও এট্টু গঁ ধোরেচে। কুন্তু মেস্টার কারো কথা শুনবেনি। সে সবকে বুজিয়ে ঠিক করে লিবে। তুই চিন্তা কোরিসিনি। বোলতেই অমন চিৎকার করে কাঁদতে লেগে গেল। অর কাঁদা দেখে আমি পালি এসচি।
– তুই কেন এত বাড়াবিস্তর করে বলতে গেলি। তোকে দিয়ে কিছু হবে নি। 
লোখা রাগত মুখে তাকায় মাস্টার দিকে। সেই তাকানো না দেখার ভান করেই মাস্টার মিটিং স্থলের দিকে যায়। যেতে যেতে লোখার কথা ভাবে। সে তো এটাই জানতে চাইছিল। এবার তার কাজ আরও সহজ হয়ে গেল। আলোচনা আবার শুরু হয়। ঝোন্টা আবার খগেন মাস্টারকে বলে,
– মেস্টার! তুমি কিছু বল এবার।
মাস্টার কিছু বলার আগে উপস্থিত সকলকে নমস্কার জানায়। তারপর বলে,
– দেখুন, যে ঘটনাটা ঘটেছে, তা মর্মান্তিক! যে মানুষটা চিরতরে চলে গেছে তার আত্মার শান্তিতে আগে ক্রিয়াকর্ম হোক। তারপর সবাই বসে ঠিক করা যাবে। একটা মেয়ের স্বামী মারা গেছে, শোকে সে পাগলের মতো! সেই অবস্থায় আপনারা যদি তাকে এভাবে তাড়িয়ে দেন তাতে গ্রামের অপমান। দেখুন প্রশাসনের কাছে গেলে, সুবিচার মেয়ের তরফেই যাবে। কিন্তু শেষ অব্দি আপনাদের নিয়েই তো থাকতে হবে। তাই এখনি কোন হটকারি সিদ্ধান্ত নেবেন না। এটা অনুরোধ। আর রইল রোগের কথা। সেটা আবার পরীক্ষা হোক। ততদিন এখানেই থাকবে। শ্রাদ্ধ শান্তির পর সবাই বসে ভাবা হবে। আমার এটাই মত। এবার আপনাদের গ্রামের বিবেচনা।
গ্রামের যারা এসেছিলেন তারা মাস্টারের কথা এক বাক্যে মেনে নেন। মাস্টারের কথা মত সিদ্ধান্ত হয়। মাধুর কাছে দিগারপাড়া থেকে যাওয়া দু'একজন মেয়ে রয়ে যায়। পিয়ন সহ বাকিরা ফিরে আসে।

Post a Comment

0 Comments