নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক,প্রখ্যাত রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ, কবি, কথাসাহিত্যিক অমিয়রতন মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হলেও কালের কঠিন রহস্যময় ভাবনায় আজ বিস্মৃতপ্রায়। বিশেষ করে সমালোচনামূলক প্রবন্ধের আলোকে তাঁর সর্বাধিক ও সর্বাধুনিক কৃতিত্ব। অমিয়রতনের প্রবন্ধের বিষয়বস্তুও গঠন শৈলী বিচিত্র। দৃষ্টান্ত:-
"ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি" ইত্যাদি।
প্রাবন্ধিক অমিয়রতন মুখোপাধ্যায় বিরোচিত প্রবন্ধ গ্ৰন্থাবলী:-
''রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী'' (১৯৫৫), ''রবীন্দ্রনাথের পূরবী'' (১৯৫৬), ''জীবনশিল্পী শরৎচন্দ্র'' (১৯৫৭), "'রবীন্দ্রনাথের মহুয়া'' (১৯৫৮), ''রবীন্দ্রনাথের বলাকা'' (১৯৬০), ''সাহিত্যচিন্তা'' (১৯৬১), ''বাঙালীর সাহিত্য'' (১৯৬২), ''স্বদেশচিন্তা'' (১৯৬৪), ''গান্ধীজি: কী পেয়েছি তাঁর কাছে'' (১৯৭০), ''রবীন্দ্রনাথের মনোদর্শন'' (১৯৭৩)।
প্রাবন্ধিকের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দার্শনিক হৃদয় ও মননের পরিচয়বাহী পুস্তক ''রবীন্দ্রনাথের মনোদর্শন'' । সাহিত্যিক অমিয়রতন রবীন্দ্রনাথের দর্শনের সঙ্গে রবীন্দ্র সাহিত্যের সুসংযোগ যে গভীর ও আন্তরিক-এই বিষয়ে গ্রন্থটি একক পূর্ণাঙ্গ বলেই গ্ৰহনযোগ্য। বইটির দুটি খণ্ড মনোনয়ন- ''মনোদর্শন'' ও ''কাব্যমানস''। ''মনোদর্শন'' বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাবনার দর্শন ও মানসিকতার সঙ্গে রবীন্দ্র সাহিত্যের মেলবন্ধন প্রতিষ্টিত।
🍂
প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের 'কাব্যমানস' বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নানাবিধ গল্প, কাব্যের বিস্তার ,উপন্যাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে রবি কবির মনন মানসিকতা ও দর্শনের ক্রমবিকাশের সাধনতথ্য প্রতিফলিত।বিশ্ববন্দিত কবি রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন, তিনি একাধারে দার্শনিক, ঋষি এবং মানুষ । তাঁর আধ্যাত্মিক স্বভাব ও মানবতাবাদী রূপটি যৌক্তিক পারম্পর্যে বিশ্লেষিত ও ব্যাখ্যাত ।
বস্তুতঃ রবীন্দ্র প্রতিভা যে বিস্ময়কর বিচিত্র হয়েও একক উদ্দেশে যাত্রা ,সে ভাবনাটি অপূর্ব দক্ষতায় সুনিপুণ বিশ্লেষিত । দৃষ্টান্ত পুস্তকাদির উপসংহারে প্রাবন্ধিক অমিয়রতন সাহেবের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
"কাব্যে তিনি বহুবিধ বিশেষের মধ্য দিয়া অশেষের পথে ছুটিয়াছেন, দর্শনে তিনি নির্বিশেষ অশেষ হইতে বিশেষে অবতরণ করিয়া বিশেষকেই অশেষকল্প করিতে চাহিয়াছেন। বলাবাহুল্য, এই বিশেষটি হইতেছে 'মন'। এই মন ছোটে, ছোটে, কেবলি ছোটে, কিন্তু নিজের সীমা পার হইয়া মুহূর্তকাল থামিতে চাহে না। পারে যেন প্রহরীর মত দাঁড়াইয়া আছেন দার্শনিক, চঞ্চল মনকে তিনি ছুটিতে দেন আপনার সীমার মধ্যেই, পারে দাঁড়াইয়া বিচিত্র মনের সমগ্রতার রূপৈশ্বর্য দর্শন করেন স্তব্ধ আনন্দে, কিন্তু পারটিকে ভাঙিয়া ফেলার অর্থাৎ সীমাকে নিশ্চিহ্ন করার কথায় সায় দেয় না মন। এইজন্য মন তাঁহার বিচিত্রের রূপমোহে একদিকে যেমন কাব্য করিতে পায়, অপরদিকে তেমনি সর্ববিধ গতি ও চাঞ্চল্যের অখণ্ড রূপটি দৃষ্টিগোচর হওয়ায় একের ইঙ্গিত ও দর্শন করিতে থাকে"।
প্রাবন্ধিক অমিয়রতন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের"সোনার তরী'', ''পূরবী'', ''মহুয়া'', ''বলাকা'' কবিতা গ্ৰন্থ বিচার বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্র কাব্যের ভাববিষয় ও ভাব প্রকরণের যে নবনির্বাচিত মূল্যায়ন করেছেন, তা সত্যি পাঠকের কাছে আস্বাদনীয় ও মনোরঞ্জক।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক মুখোপাধ্যায় সাহেব কথাশিল্পী শরৎ সাহিত্যেরও নবমূল্যায়ন সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ''জীবনশিল্পী শরৎচন্দ্র'' গ্রন্থই বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও কল্যাণ পাঠক দরবারে হাজির করেছেন।
সাহিত্যিকের ''স্বদেশ চিন্তা'' পুস্তকাদি সমকালীন ''স্বদেশ, সমাজ'' সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রবন্ধের সমাহার ও সমাবেশ।
প্রাবন্ধিক অমিয়রতন মুখোপাধ্যায় এই গ্ৰন্থে ইতিহাস সচেতনতা, যুক্তিবাদী আধুনিক সংস্কৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ধ্যানধারণা, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বাসন্তিক ভাবনা সমগ্ৰ প্রবন্ধে ফুটেছে। সাহিত্যিকের বিষয়ভাবনায় মার্জিত রুচিশীল বৈচিত্র্যে, তত্ত্ব ও তথ্যের তালাশে , কঠিন বিষয়কে আন্তরিক অন্তরঙ্গ ও ঘরোয়া রূপ ভাবনায় পরিবেশন, শিল্পজনোচিত রসাবেদন ও গদ্যশৈলী'র স্বচ্ছতায় অমিয়রতন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধগুলি স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত ও কালজয়ী উপস্থাপন।
সাহিত্যিক অমিয়রতন মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের ভাষারীতি ও গঠনকৌশলে কাব্যময়তার ছাপ ও ভাবুকতা, আবেগে আপ্লুত চেতনা প্রকাশেও যুক্তিনিষ্ঠতা ও আত্মনিষ্ঠ প্রকাশশৈলীর জন্য প্রাবন্ধিক মনন সর্বাঙ্গসুন্দর হওয়া সত্ত্বেও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments