জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /ত্রিংশতি পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
ত্রিংশতি পর্ব

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী   

দ্বিতীয় ভাগ  -  মথুরা পর্ব
কংস বধ 
দণ্ডহাতে দণ্ডধারী 

পুনরায় জরাসন্ধের কথায় ফিরে আসি। দুই কন্যার দুঃখের কাহিনী শুনে শোকসন্তপ্ত সম্রাট ক্রোধে জ্বলে উঠলেন। শ্রীকৃষ্ণকে বধ করার জন্য বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মথুরা অবরোধ করলেন। জরাসন্ধের অসংখ্য সৈন্যের তুলনায় যাদবদের সৈন্যসংখ্যা নগন্য। তবুও শ্রীকৃষ্ণের সেনাপতিত্ব গুনে যাদবেরা জরাসন্ধকে প্রতিহত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু জরাসন্ধ অদম্য, অকল্পনীয় তার সৈন্যবল। জরাসন্ধ বারংবার এসে মথুরা অবরোধ করতে লাগলেন। এই আক্রমণের ফলে যাদবদের ক্ষুদ্র সৈন্যসংখ্যা যুদ্ধে ক্ষয় হতে থাকলে তাদের সৈন্যসংখ্যা শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এইরূপে সপ্তদশ বার আক্রান্ত হওয়ার পরে যাদবেরা শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শ অনুসারে মথুরা ত্যাগ করে দ্বারকা অভিমুখে যাত্রা করে দুরতিক্রম সমুদ্রের মাঝে দুরারোহ রৈবতক পর্বতে যেয়ে দুর্গ তৈরি করে সেখানে তাঁরা তাঁদের বাসভূমি গড়ে তুললেন। কিন্তু দ্বারকা যাওয়ার পূর্বেই অষ্টাদশ বার মথুরা আক্রমণ করতে এলেন জরাসন্ধ। এই সময়ে জরাসন্ধের সাথে কালযবণ নামে একজন যবন রাজা মথুরা অবরোধ করতে এলেন। পরম সমরকুশলী শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করে তার সাথে সন্মুখসমরে যুদ্ধ করার ইচ্ছা ত্যাগ করলেন, কেননা অতি নগণ্য যাদবসেনা নিয়ে তার সাথে যুদ্ধ করে তাকে বিমুখ করতে পারলেও সৈন্য সংখ্যার ক্ষয় হবে এবং জরাসন্ধকে সেই ক্ষয়িষ্ণু সৈন্য সংখ্যা নিয়ে প্রতিহত করা যাবে না। মহাভারতের সভাপর্বে আমরা জরাসন্ধ বধ অধ্যায়ে দেখতে পাই যে অন্য কোন মানুষের জীবনহানি না করে জরাসন্ধ বধ কিভাবে সম্পন্ন হয় কৃষ্ণ তার সদুপায় চিন্তা করেছিলেন। কালযবনের সম্মুখীন না হয়ে তিনি কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি একাকী কালযবনের শিবিরে যেয়ে উপস্থিত হলে কালযবন তাকে সশরীরে ধরতে উদ্যত হল। ধরা না দিয়ে চতুর শ্রীকৃষ্ণ পালিয়ে গেলেন। কালযবন তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে এক গিরিগুহার মধ্যে প্রবেশ করল। সেখানে মুচুকুন্দ নামে এক ঋষি নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন। কালযবন গুহার অন্ধকারের মধ্যে সেই ঋষিকে শ্রীকৃষ্ণ ভ্রমে পদাঘাত করল। পদাঘাতে নিদ্রা থেকে উত্থিত হয়ে ঋষি কালযবনের প্রতি দৃষ্টিপাত করা মাত্র কালযবন ভস্মীভূত হয়ে গেল।      
🍂

সাহিত্য সম্রাট শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'কৃষ্ণ চরিত্র' গ্রন্থের তৃতীয় পরিচ্ছেদে জরাসন্ধের এই আক্রমণের সম্পর্কে শ্রী কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে যে ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন সেকথা নীচে উদ্ধৃত করছি। " কংসবধের পরে জরাসন্ধ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিল। তখন আমরা জ্ঞাতি বন্ধুগণের সহিত একত্র হইয়া পরামর্শ করিলাম যদি আমরা শত্রুনাশক মহাস্ত্র দ্বারা তিনশত বৎসর অবিশ্রাম জরাসন্ধের সৈন্যবধ করি তথাপি তার সৈন্যদল নিঃশেষিত করিতে পারিব না। আমরা আমাদের বিপুল ধনসম্পত্তি বিভাগ করতঃ সকলে কিছু কিছু লইয়া প্রস্থান করিব, এই স্থির করিয়া স্বস্থান পরিত্যাগপূর্বক পশ্চিম দিকে পলায়ন করিলাম। ঐ পশ্চিম দেশে রৈবতোপশোভিত পরম রমণীয় কুশস্থলীনাম্নী পুরীতে বাস করিতেছি - তথায় এরূপ দুর্গ সংস্কার করিয়াছি যে, সেখানে থাকিয়া বৃষ্ণিবংশীয় মহারথীদিগের কথা দূরে থাকুক, স্ত্রীলোকেরাও অনায়াসে যুদ্ধ করিতে পারে। হে রাজন! এক্ষণে আমরা অকুতোভয়ে ঐ নগরীমধ্যে বাস করিতেছি। যাদবগন সমস্ত পশ্চিম দেশব্যাপী সেই সর্বশ্রেষ্ঠ রৈবতক পর্বত দেখিয়া পরম আহ্লাদিত হইলেন। হে কুরুকুলপ্রদীপ! আমরা সামর্থ্য যুক্ত হইয়াও জরাসন্ধের উপদ্রবভয়ে পর্বত আশ্রয় করিয়াছি। ঐ পর্বত দৈর্ঘ্যে তিন যোজন, প্রস্থে এক যোজনের অধিক এবং একবিংশতি শৃঙ্গযুক্ত। উহাতে এক এক যোজনের পর শত শত দ্বার এবং অত্যুৎকৃষ্ট উন্নত তোরণ সকল আছে। যুদ্ধদুর্মদ মহাবলপরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণ উহাতে সর্বদা বাস করিতেছেন। হে রাজন! আমাদের কুলে অষ্টাদশ সহস্র ভ্রাতা আছে। আহুকের একশত পুত্র, তাহারা সকলেই অমরতুল্য। চারুদেষ্ণ ও তাঁহার ভ্রাতা চক্রদেব, সাত্যকি, আমি, বলভদ্র, যুদ্ধবিশারদ শাম্ব - আমরা এই সাত জন রথী, কৃতকর্মা, অনাবৃষ্টি, সমীক, সমিতিঞ্জয়, কক্ষ, শঙ্কু ও কুন্তি, এই সাতজন মহারথ এবং অন্ধকভোজের দুই বৃদ্ধ পুত্র ও রাজা এই মহাবলপরাক্রান্ত দৃঢ়কলেবর দশজন মহাবীর, -  ইঁহারা সকলেই জরাসন্ধাধিকৃত মধ্যম দেশ স্মরণ করিয়া যদুবংশীয়দিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন"। যাদবগন মথুরা ত্যাগ করে পশ্চিম দেশে চলে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে যুদ্ধ কৌশলে শ্রীকৃষ্ণ যথেষ্ট পারদর্শী হলেও তিনি পরম রাজনীতিজ্ঞ এবং অনর্থক মনুষ্য হত্যার নিতান্ত বিরোধী। আদর্শ মানুষের সমস্ত গুন তাঁহার মধ্যে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হইতেছে। নিজের গুরুত্ব হ্রাস পেতে পারে জেনেও শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু সর্বদা সত্য কথা বলেছেন। উপরের অংশে 'পলায়ন' কথাটি লক্ষণীয়। শ্রীকৃষ্ণ শব্দটি ব্যবহার না করলেও পারতেন, কিন্তু যা সত্য তা অকপটে সর্বসমক্ষে স্বীকার করাই কৃষ্ণ চরিত্রের একটি মহৎ গুন। জরাসন্ধের সৈন্যবলের ভয়েই তো শ্রীকৃষ্ণ স্থান পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সত্য কথনে মানুষের চারিত্রিক স্বচ্ছতা প্রকাশ পায় - একথা কৃষ্ণ চরিত্র আমাদের শিখিয়েছেন। পাশাপাশি একথাও অস্বীকার করা যায় না যে অত্যাচারী জরাসন্ধ অনেক রাজা ও নিরপরাধ মানুষকে বন্দী করে রেখেছিলেন কোন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে - এই কথা জেনে শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেননি, কারণ তাতে প্রতিহিংসাপরায়ণ জরাসন্ধের হাতে বন্দী বহু মানুষের অযথা মৃত্যু হত। কৃষ্ণ অনর্থক মনুষ্য হত্যার ঘোরতর বিরোধী। যুদ্ধ কৌশলে যদিও তিনি পারদর্শী তথাপি বহু মানুষের জীবন রক্ষার জন্য তিনি পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে কৃষ্ণ সে যুগের একমাত্র ধুরন্ধর এবং কুশলী রাজনীতিক ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসার জন্য কৃষ্ণের পরবর্তীকালে নাম হয় 'রণছোড়জী'। শ্রীকৃষ্ণ যাদবদের নিয়ে মথুরা থেকে রৈবতক পর্বতের উপরে কুশস্থলী নামক স্থানে যেয়ে দুর্গ নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। প্রবাদ মহারাজ রৈবত সমুদ্রের মাঝে এক বিস্তৃত ভূমির উপরে কুশ বিছিয়ে যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন বলে এই স্থানের নাম হয় কুশস্থলী। আবার অন্য মতে কুশ নামে মহাবলশালী এক দৈত্যের উপদ্রবে এই ক্ষেত্র ক্রমশঃ মুনিঋষিদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। কুশ এই অঞ্চলের রাজা ছিল। মুণি-ঋষিদের উপর অত্যাচার করলে কি হবে কুশ ছিল মহাশিবভক্ত। এই কুশের নাম অনুসারে এই অঞ্চলের নাম হয় কুশস্থলী। শ্রীকৃষ্ণ এত বড় একজন শিব ভক্তকে কিভাবে পরাস্ত করবেন এই চিন্তা করে তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। মহাদেব বললেন "তুমি এমনিতে কুশকে হারাতে পারবে না। সে আমার পরম ভক্ত। তবে তুমি অন্য কৌশল অবলম্বন করে তাকে পরাস্ত করতে পারো"। এই বলে শ্রীকৃষ্ণকে মহাদেব সেই কৌশল বলে দিলেন। সেই কৌশল জানার পরে শ্রীকৃষ্ণ কুশকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান করলেন। বেশ কিছুক্ষণ দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলার পরে একসময় কুশ ক্ষণিকের ভুলে মাটিতে পড়ে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে তার পিঠের উপর শিবলিঙ্গ বসিয়ে দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। আরাধ্য দেবতাকে পৃষ্ঠদেশ থেকে নামিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করার মতো মানসিকতা কুশের ছিলনা, যার ফলে সে ওখানে এইভাবে অবস্থান করার ফলে কৃষ্ণ যুদ্ধে জয়লাভ করলেন। তবে তিনি পরাজিত কুশকে বর দিয়ে বললেন যে শিবলিঙ্গ তার পিঠে রয়েছেন সেই শিবলিঙ্গ তার নামানুসারে কুশেশ্বর মহাদেব নামে প্রসিদ্ধ হবে। শ্রীকৃষ্ণ আরও বললেন "দ্বারকা মন্দিরে ভক্তরা প্রবেশ করলেই প্রথমে কুশেশ্বর শিবের দর্শন লাভ করবেন এবং কুশেশ্বর শিবের দর্শন ব্যতীত দ্বারকা ভ্রমণ পূর্ণ হবে না"। কৃষ্ণের এই আশীর্বাদে কুশ শান্তি লাভ করল। এভাবেই দ্বারকা মন্দিরের ভেতরে কুশেশ্বর শিবের স্থাপনা হল।
                                          পরবর্তী অংশ একত্রিংশতি পর্বে…………..

Post a Comment

0 Comments