জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( সপ্তপঞ্চাশত্তম পর্ব ) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( সপ্তপঞ্চাশত্তম পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা


বাড়ি ফিরতে রাত হয় সবার। ময়না ঘর - বাইর করছিল লোখার জন্য। গরমকাল মানে লোখার রাতে জলঢালা ভাত চাই। এই সময় শশা আর ঝিঙ্গার চাষ করে লোখা। ঝিঙ্গা পোড়া আর জল দিয়ে রাখা  দুপুরের ভাত, তার যে কী সোয়াদ তা লোখা ছাড়া কেউ জানে না। তবে পোড়া ঝিঙ্গাকে কাঁচা সরসার তেল আর পোড়া লঙ্কা দিয়ে মাখাতে হবে। নইলে তার সোয়াদ মাঠে মারা যায়। লোখা আসতেই তাড়াতাড়ি খাবার আসন পাতে। ছেনাগুলান আগেই খেয়ে শুয়ে গেছে। লোখাও ঝটপট জাম প্যান্ট ছেড়ে তাল চাটাইয়ের আসনে বসে পাড়ে বলে,
— দে দিখি তাড়াতাড়ি! খিদায় পেটে পিত্তি পড়ে গেল!
– কেনে!  সেখিনে কী কিছুই খেতে দেয়নি?
– ধূর! বিপদের ঘরে উসব কে কোরবে! চা বিস্কুট দিইল। কুন্তু মোদের রাক্কোসা পেটে উসবে ভরে। 
– রাস্তায় এসার সময় ত কিছু খেতে পাত্তে।
— কুনু দকান খুলা নাই। তাবাদে এতজন আছি। একা আমরা খেলে হয়! আর মেস্টার ত খেতই নি। তার ত মুড ভাল নাই। তুই ত সব জানু।
— তা জানি কুন্তু মেস্টারের মুড কেনে ভাল নাই? এগদিক দিয়ে ভাবলে তার ত ভালই হইচে।
— খজরাশালিরকথা শুন! ভেবে চিন্তে বোলুঠু! কার লিয়ে কথাটা বোলুঠু জানু!
– তমার ত সবেতেই কঁকানা স্বভাব। কি এমন খারাপ বোল্লম! মাধুর কি এমন বয়েস হইচে! এখন থিকে অই মেইছেনাটা একা থাকবে! তার উবরে কোলে একটা ছেনা আছে। কে দেখবে অকে? অই পিয়নের বউ! লোক দেখানা মড়াকান্না কাঁদেঠে। দু'দিন এসে থাকলেই, দেখবে মাগীর উৎপাত।
— তার মানে তুই বোলুঠু…
— আমি ঠিকই বোলিঠি। কিছু দিন কেটে যাউ। সবকিছু থিতু হউ। তারপর দুজনকে বুজিয়ে রাজি করানা উচিত। মেস্টার ত এখনো অকে মন থিকে চায়। দেখবে সেটাই ভাল হবে। তাবাদে কি বল দিখি, দিনকাল ভাল নয়। কার মনে কি আছে কেউ বোলতে পারবেনি। বয়সের মেইছেনা ত!
— এগদিক থিকে তুই ঠিকি বোলুঠু। কুন্তু মেস্টারকে রাজি করানা অসম্ভব। মোর দ্বারা ত বলা-ই যাবে নি।
— না রাজি হবার কি হইচে। ইসব কি আজকাল হয়নি। অ্যাকে বল মেস্টার নাকি মাধুকে ভুলতে পারেনি। তার কুনু কষ্ট সহ্য কোত্তে পারেনি। থাইলে এখন কেনে সরে যাবে? তার মানে উসব ঠাটের ভালবাসা। মুখে বোলবো ভালবাসি আর কাজের সময় সটকে পোড়ব। তমাদের ছেনা জাতটাই অইরকম।
— তুই চুপ মার দিখি। তরা ত বলে দিয়েই খালাস। সে একটা মেস্টার মানুষ। তার একটা মান সম্মান আছে। তোদের কাছে ত উঠ ছুড়ি তোর বিয়া! আগু পিছু কুনু ভাবনা নাই। অম্নি বলে আট হাত কাপড়েও মেইয়া নেংটা!
— মেইয়া এক এক সময় ঠিক কথাই বলে। মেস্টার হইচে ত কি হইচে! তারাই ত পড়ায় বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ চালু করেচে। থাইলে সেযুগে যেদি হয়,এযুগে মাস্টার কোল্লে,তার সম্মান বাড়বে বৈ কোমবেনি।
– ঠিক আছে। তোকেই থাইলে এবার তাকে বুজাতে লি যাব।
            ময়নার সঙ্গে তর্ক করলেও পরক্ষণেই লোখা চিন্তা করে। ভাবে,ময়নার কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভগীখুড়ার সঙ্গে এ নিয়ে তারও কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু সবকিছু অত সহজ নয়। লোখা তার জাতের স্বভাব জানে। অনেক ক্ষেত্রে তার জাত একেবারে নির্লজ্জ।  আবার অনেক ক্ষেত্রে তাদের আতসম্মান চরম। বিশেষ করে এইসব বিষয়ে। নিজেদের আব্রু বাগদি সহজে বিকিয়ে দেয় না। কিন্তু এখানে সম্মানহানির প্রশ্ন নেই। তবু মাস্টারের পাশাপাশি আর সকলে মেনে নেবে কিনা সন্দেহ আছে। ময়না পাশে এসে শোয়। দেখে লোখা তখনো ঘুমায়নি। বকুনির স্বরে ময়না  বলে,
— পরের চিন্তা লিয়ে নিজের শরীরটাকে কী শেষ কোরবে? তখন থিকে এখনো ঘুমাওনি। ভোরবেলা হাট যেতে হবে জানা ত!
— জানু, তোর কথাটাই ভাবছিলম। ঠিকই বোলেচু। অমনটা হলে ভালই হবে। তাবাদে জানু, আমি মাধুকে জিগ্যাস করেছিলম।
— তুমি পারও বঠে। কী জিগ্যাস কচ্ছিলে?
— অকে বোলি,তুই কথায় থাকতে চাউ মাধু?
— কী বোল্লে সে?
— এখিনকে এসতে চায়। চিৎকার করে কেঁদে বোল্লে,আমি এখিনে থাকতে পারবোনিব গো…। মেইছেনাটার  কাঁদা দেখে আর দাঁড়াতে পারলম নি। পালি এসচি। ঠিকই বোলেচ, ঢোলের ঝিউড়ি ঢোলেই থাউ। মা কালী অর কপালে সেটাই লিখে রেখেচে বোধয়। 
– লাও, এবার ঘুমি পড়।অনেক রাত হইচে।

🍂

সকালবেলা হাট থেকে এসেই মাস্টারের কাছে যাওয়ার জন্য ছটপট করে লোখা। তার ছটপটানি দেখে ময়না বলে,
—হাট থিকে এই ত এসচ। এট্টু জিরাও না। ইদিকে ত ভালই ফ্যাচাং বেঁদেচে, শুনলম।
– আবার তোর কী হইচে? কী শুনেচু?
—মোর কিছু হয়নি। হইচে ওই মাধুকে গেরামে আনা লিয়ে। অদের দিগার পাড়ার কারো মত নাই। অনেকে বলেঠে ত পিয়নের বউয়েরও নাকি ইচ্ছা নাই আনার।
– উ ঢেমনিটার কথা ছাড় দিখি! এবারে মিটিয়ে বোসলে বেখানে অর নাম লুকি দুব। তাতে মোর জরিপানা হয় হবে।
— বাইরের কুঁদুল ঘরকে এনো নি, পই পই বোলিঠি। যার মেইছেনা,সে বুজু। আর মেস্টারের কথা যেদি বল,ত তমাকে কালকেই বোলেচি। তেমন হলে উ মেইছেনাকে বিয়া করে ফাঁকে থাকতে বল। কুন্তু সত্তি কী অর বরের রোগ অর গায়ে নাই?
— সিটা ত ব্যালাড চেক কোল্লেই বুজা যাবে। দাঁড়া থাইলে সেবেলা না হয় যাব মেস্টারের কাছকে।
— সেবেলা ত যেকেই হবে। দিগার পাড়ায় মিটিং ডেকে গেছে।
             মিটিংয়ে শুরু থেকেই চিল্লাচিল্লি শুরু হয়। এবারও চুপ করে বসে থাকে ঝোন্টা। ভবতারণ সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করে। শিবা জানা সরাসরি পিয়নের বউকে জিগ্যাস করে,
– পাড়ার লোকের কথা পরে,আগে তুমি বল। মেইছেনাকে ঘরে রাখবে ত?
–আমাদেরকে ত পাড়া বাখুল নিয়ে থাকতে হবে। তারা যেমন বলবে সেটাই হবে। তাবাদে আপনারা আছেন।
— মেইছেনাটা ত তমার। নাইবা তমার পেটের হোলো। একটা লাতিও ত আছে। কি গো সুবলকা?
সুবল পিয়ন যে কিছু বলতে পারবে না, তা সবাই জানে। শিবা জানা ঝোন্টার দিকে চায়। ঝোন্টা চায় খগেন মাস্টারের দিকে। এই দুদিনেই ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা হয়েছে তার। কিছুটা বিরক্ত দেখাচ্ছে তাকে। রেগেও আছে কিছুটা। ঝোন্টা তার দিকে তাকাতেই দপ করে যেন রাগটা জ্বলে ওঠে তার। বলে,
– তুই ত কিছু বোলবিনি জানি। এত বড় অন্যায় হচ্চে অথচ তুই চুপ মেরে বসে আছু। একটা মেইছেনা তার শ্বশুর ঘরে থাকতে পারবেনি। বাপের ঘর তাকে ভিটায় তুলবেনি। থাইলে সে কুন দিকে যাবে বল দিখি?
– মোকে এসব বোলুঠু কেনে! এদের ঘর বাখুল কেউ ত চাইনি।
— তুই কি চাউ সেটা আগে সবার সামনে বল দিখি। তারপর পাড়া বাখুলের কথা হবে। তুই একটা পশাসনের লোক। পাঁোচ জাগা তুই ঘুরু। তোর বিবেচনা কী বলে আগে বল।
বেশ ফাঁপরে পড়ে যায় ঝোন্টা। লোখা আর ভগী খুড়া বুঝতে পারে,মাস্টার ঝোন্টার কাঁধে বন্দুক রেখেই শিকার করতে চায়। এই সুযোগে ভবতারণও চেপে ধরে।
– মাস্টার ঠিক বোলেচে। তুই বল,তোর কী মত।
ঝোন্টা বুঝতে পারে আগু পিছু দু'দিকেই তার মরণ। পাড়ার লোক আগে তার কাছকে গিয়েছিল। তারা বলে এসেছে মাধু যেন দিগার পাড়ায় না আসে। পাড়ার এতগুলো লোককে চটাতে চায় না ঝোন্টা। কিন্তু মাস্টারকে সে ভিতরে ভিতরে ভয় করে। সে এইটাকে নিয়ে তোলপাড় করতে পারে। তাই মেপেঝেপে বলাই তার পক্ষে শ্রেয়। কিছুক্ষন থেমে বলে,
— আমি কী চাই মেইছেনাটার ক্ষতি হউ। বাপের ঘর,শ্বশুর ঘর - দুজায়গায় যাতে থাকে সেটাই দেখতে হবে।
ঝোন্টার কথা শুনে আরেক পত্তন চিল্লান শুরুি হয়। কিন্তু শেষমেশ যে যার বাড়ি চলে যায়। 
লোখাকে আজ মুখ খুলতে হয় না। মনে মনে সে বেশ খুশি হয়। কিন্তু একইসঙ্গে রাগও হয় তার। রাগ হয় দিগার পাড়ার উপর। পাড়ার সকলে মাস্টারকে মনের সুখে গালিগালাজ করতে থাকে। মাস্টার না শুনলেও,তার কানে আসে। মাস্টারের অপমান সে গায়ে মাখতে পারে না সহজে। রাগে টরটর করে ভগী খুড়ার কাছে যায়।  নদী বাঁধের দিকে তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে,
– সবই ত শুনঠ খুড়া, তুমি কিছু বলনি কেনে? চুপ মেরে থাকলে কী হবে। তমাদের মত গেরামের মুরুব্বিরা যেদি কিছু না বল,গেরাম ত অরাজকতাপুরী হযে যাবে। গেরামের নিজের ত একটা শাসন আছে নাকি! তাও না হয় বাদ দিলম। কুন্তু এবার মেস্টারকে তুমি বুজাও। মা কালীরও বোধায় ইচ্ছা অদের মেল করানার।
– লখী! বুড়ারা অচল পয়সার মত। কাজে লাগেনি কুন্তু সহজে ফেলাতেও পারেনি। আগে গেরামের আচার বিচার আলাদা ছিল। তখন মোদের কথা চোলত। কড়া শাসন ছিল। মানা গুনা ছিল। এখন উসবের পাট উঠে গেছে। বাগদিরা কাঁচা পয়সার মুখ দেখেচে। মেইয়া মদ্দর টেম্পার বেড়েচে। মোর মত লোকেদের বাতিলের খাতায় ফেলি দিচে। আর মেস্টারের কথা যে বোলুঠু,তাকে বলাটা কী মোর সাজবে বল? যত হোক সে একটা মেস্টার। তবে শুন,ওই কালিতলায যে মা বসে আছে উ বেটিই ঢোলের সব। যা করার সব উ কোরে দিবি। মোদের দিকে দরকার লাগবেনি।

গাজনের মেলা বসেছে রাখাল মাড়য়। মাধু এসেছে বাপের ঘরে। রক্তের রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তবু শ্বশুর বাড়ির লোকেরা একটু অন্য চোখেই দেখে তাকে। মাধুর শ্বাশুড়ি এই ক'মাস কেটে গেলেও তার সঙ্গে একটা বাক্য বলেনি। সে মনে করে মাধুর জন্যই তার ছেলে মরেছে। পাড়া বাখুলে প্রায়ই সে কেঁদে কেঁদে বলে বেড়ায়,
– কুথা থিকে অই গরুখাকিটাকে আনলম গ। রাক্কোসি মোর বেটার মাথাটাকে চিবি খেলু! তোর মুখে পোক্কা পোড়বে লো। তোকে শুকুনে খাবে লো। দেখতে মুস মুসা ডান! কুন্তু অর জন্নেই মোর অমন ফুলাফাঁপুরা ছেনাটা অকালে চলে গেল গো। অ মা কালী! তুই এর বিচার কোরবি গো…
মাধু শুনে আর দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সে অন্য জা-জাউলিদের মত ঝগড়া করতে পারে না। মন চাইলেই বাপের ঘর চলে আসে। সেখানে মা- বেটায় আলাদা রান্না করে খায়। শ্বশুরের মন ভাল। লুকিয়ে চুরিয়ে সে এটা ওটা নাতির হাতে দিয়ে যায়। বাপের ঘর এলে একটু শান্তি পায় মাধু। কিন্তু মায়ের মুখ সারাক্ষণ ঝুলে থাকে। তবু শ্বশুরের ভিটার চেয়ে ভালো। সেখানে থাকলেই কত কথা তার মাথাকে ভারী করে দেয়। ছেনাটার মুখের দিকে তাকালেই আরো বেশি কান্না পায় তার। সামনে যেন শুধুই অন্ধকার। এতটুকু আলোর চিহ্ন সে দেখতে পায় না। বাপের ঘরে এলে তবু এর ওর সাথে একটু কথা বলে সব ভুলে থাকে। নদী বাঁধের বটতলায় ছেনাটাকে নিয়ে বসে। কত কথা মনে হয় তার। চোখ ভিজে আসে। পরক্ষণেই মানুষটার কথা মনে আসে। এডসের কারণ সে জানতে পেরেছে। তার এক দেওর তাকে বলেছে সব। নাইট হোটেলে প্রায়শই নাকি যেত সে। মাধু জেনেছে যখন তখন মানুষটা মৃত্যু শয্যায়। রাগবে নাকি ঘেন্না করবে বুঝে ওঠার আগে সব শেষ হয়ে যায়। এসব কথা আজ অব্দি মাধু কাইকে বলেনি। বলবেও না সে কোনদিন। সে তার ভাগ্যকে সবদিন হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। তবে এবারের যেন ভাগ্যবিধাতা তাকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

Post a Comment

0 Comments