জ্বলদর্চি

সাধু রামচাঁদ মুর্মূ (সাঁওতালি সাহিত্যের কবিগুরু, শিলদা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০২
সাধু রামচাঁদ মুর্মূ (সাঁওতালি সাহিত্যের কবিগুরু, শিলদা) 

ভাস্করব্রত পতি

'খেলোনড্ লাগিৎ নওয়া মঞ্চ
জানামেনক মানমি গেচং
আমাঃ হালে নওয়া শিরজন
অডে গেতাম দায়া চং'-- সাধু রামচাঁদ মুর্মূ
(এই পৃথিবীটা সুন্দর করে সাজানোর জন্যই মানুষ জন্ম নিল। তোমার এই সৃষ্টির মহিমা সত্যই অতি সুন্দর। এটা তোমার দয়ারই দান।) 

পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ব্লকের শিলদার কামারবান্ধি গ্রামে ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১৬ ই বৈশাখ (১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন সাধু রামচাঁদ মুর্মূ। বাবা ছিলেন মোহন মুর্মূ ওরফে টুডু এবং মা কুনি মুর্মূ। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট। বাকিরা হলেন দুই দাদা দুবরাজ মুর্মূ, ধনঞ্জয় মুর্মূ, দিদি মুগলি মুর্মূ এবং তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর দুই স্ত্রী। প্রথম জন মানকা মুর্মূ এবং দ্বিতীয় জন পুটি মুর্মূ। ১৯৫৪ এর ১৫ ই ডিসেম্বর (১৩৬০ বঙ্গাব্দের ১৯ শে অগ্রহায়ণ) তাঁর মহাপরিনির্বাণ ঘটে। জীবৎকালে তাঁর কোনও লেখা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর যাবতীয় সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পরে। 

প্রথম পাঠগ্রহণ শুরু গ্রামের স্কুলে। সেটা ১৯০৬ সাল। অত্যন্ত মেধাবী রামচাঁদ এল পি পাশ করার পাশাপাশি ইউ পি পাশ করে ভর্তি হন ভীমপুর এম ই স্কুলে। পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে নানা কারিগরি বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু মিশনারী পরিচালিত ভীমপুর এম ই স্কুলের কোনও অনুমোদন ছিলনা। ফলে রামচাঁদের পড়াশোনা আটকে যায়। আসলে অর্থ খরচ করে অন্য স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য তাঁর পরিবারের ছিলনা। ফলে আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি নিজের উদ্যোগে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। শানিত করতে থাকেন নিজের কলম। আর ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেন সাঁওতাল সমাজের রীতি নীতি, সংস্কৃতি আর ভালো দিক, খারাপ দিক। মুখে মুখে কবিতা, গান লিখতে পারতেন চমৎকার। সুরও দিতেন। সেসময় পরাধীনতার ভারত। তাই বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী জনসভায় দেশপ্রেমের গান গাওয়ার জন্য ডাক পেতেন তিনি। বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষায় প্রচুর গান,  কবিতা, নাটক, আধ্যাত্মিক প্রবন্ধ লিখেছেন পরবর্তীতে। যদিও তখন অলচিকি লিপি তৈরি হয়নি। তাঁর লেখায় সাঁওতাল সমাজের কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সোচ্চারিত হয়েছে বারবার। সাধু রামচাঁদ মুর্মূর লেখা গানে নিখুঁতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় শিকারিয়া, দং, ঝিঙা ফুলিয়া, লুহুরী, বাহা, কারাম, লুতুর চাপো, পাতা, ঝিকা, লাঁগড়ে, রাঁবড়ারিৎ, খেমটা ইত্যাদির বাজনা ও সুললিত সুরের ঝংকার। 

সাধু রামচাঁদ মুর্মূ বুঝেছিলেন যেকোনো জাতির বিকাশ সম্ভব সেই জাতির ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের মাধ্যমে। আর মাতৃভাষা ছাড়া জাতির বিকাশ অসম্ভব। ফলে এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিবিড় সাহিত্য সাধনায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। বলতে গেলে ১৯৩৫-১৯৩৬ নাগাদ কবির যথার্থ আত্মপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে। আসলে সাঁওতাল সমাজের কুসংস্কার, অনাচার, অধর্ম, কুধর্ম তাঁকে খুব ব্যাথিত করে তুলেছিল। নারী নির্যাতন, মান সম্মান, ইজ্জত লুঠ তাঁকে জর্জরিত করেছিল বেদনায়। বিপথে পরিচালিত সাঁওতাল সমাজকে সঠিক পথে আনতে তিনি তাঁর কলমে জন্ম দিয়েছিলেন অসংখ্য লেখা। যা তাঁকে পরবর্তীতে সাঁওতালি কথা সাহিত্যের 'কবিগুরু' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 

সাঁওতালি ভাষা লেখার জন্য একটা লিপি তিনি তৈরি করেন ১৯২৩ সালে। যা 'মঁজ দাঁদেরা আঁক' (মহেঞ্জোদাড়ো) নামে পরিচিত ছিল। এই লিপির সঙ্গে হরপ্পায় প্রাপ্ত অনেক লিপির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে অনেকের অভিমত। প্রায় ৩৭৩ পৃষ্ঠার একখানি বড় বাঁধানো খাতায় এই লিপিতেই তিনি লিখেছেন তাঁর 'ঈশ্বরড়' বইটি। কিন্তু সেসময় তা প্রচারের অন্তরালে থাকায় এই লিপি মান্যতা পায়নি। পরবর্তীতে ওড়িশার রঘুনাথ মুর্মূ কর্তৃক তৈরি 'অলচিকি' লিপিকেই মান্যতা দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। 

১৯৯৭ সালে কবির জন্মস্থানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদিবাসী কল্যাণ বিভাগের সৌজন্যে প্রতিষ্ঠিত হয় কবির আবক্ষ মূর্তি। এখানেই ২০১০ সাল পর্যন্ত তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে কবির জন্মদিন পালিত হয়েছিল। ২০১১ থেকে কবির জন্মজয়ন্তী পালন বন্ধ হয়ে যায়। ২০০২ তে সাধু রামচাঁদ মুর্মুর নামে রাজ্য সরকার পুরস্কার ঘোষনা করে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ১৯৯৮ সালে তাঁর রচনাসমগ্র প্রকাশ করে 'সাধু রামচাঁদ মুর্মু অনলমালা' নাম দিয়ে। ২০১৮ সালে ঝাড়গ্রাম জেলায় প্রতিষ্ঠিত ঝাড়গ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ২০২১ থেকে কবির নামেই নামকরণ করা হয় 'সাধু রামচাঁদ মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয়'। ইতিমধ্যে এখানে পঠনপাঠনের কাজ শুরু হয়েছে। 

তিনি কিন্তু 'সাধু' বা 'সন্ন্যাসী' ছিলেননা কখনও। আসলে তাঁর বাগড়াম্বরহীন জীবন লোকজনের চোখে পড়েছিল। ভোগ বিলাসবহুল জীবনযাপন থেকে শত যোজন দূরে থেকে নিজেকে সাধু সন্ন্যাসীদের মতো নিরাসক্ত, নির্লোভ এবং নিরাকার জীবন অতিবাহিত করতেন। নিমজ্জিত থাকতেন সাঁওতালী সাহিত্য চর্চায় বুঁদ হয়ে থাকতে। তাঁর এই নিরলস এবং নির্মেদ সাহিত্য নির্মাণের খবর পৌঁছায় তৎকালীন বাংলার রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজুর কানে। তিনি নিজের আগ্রহে রামচাঁদ মুর্মূর সাথে সাক্ষাৎ করতে ১৯৫০ সালে চলে আসেন কামারবান্ধি গ্রামে। সাথে ছিলেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক কে পি মেনন (IAS)। সেখানে এসে সাঁওতালী সাহিত্যের মহাকবির সহজ সরল জীবন যাপন এবং কর্মপদ্ধতি দেখে তাঁকে 'সাধু' উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে তিনি সবার কাছে 'সাধু রামচাঁদ মুর্মূ' নামেই পরিচিত হয়ে আসছেন। এই সময় সাধু রামচাঁদ মুর্মূ নিজের লেখা গান 'দুলাড়িয়া পেড়া সাহেব' গেয়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন ---
"দুলাড়িয়া পেড়া সাহেব -- এগো বাবা জহার জহার মনে রেয়াড় জিউয়ি সাগেন জাঙ্গা ধুড়ি 
কোদর কাতে নণ্ডেম কটা কেৎ।
সেরমা রাজাঃ মান্দ্রাতে ধারতি রেপে মারাং আকানা-- মাহামাহিম জেলেঞ জিউয়ি -- ঞাম কাতে 
মারাং আকা তাঁহেন তাবন পে।
সোতোঃ সুমুং জিউয়ি তালে -- আলে লেলহা সাডি নিসার্ত্তি 
মেনাং লেয়া আপে রেনাঃ উমুল রেগে 
দায়া কাতে মান্দ্রা আলেপে।
জমাঃ ওঁ - আঃ বানুঃ তালে - চেতে তেলে আতাং মেয়া হো 
মনে সুতাম জিউয়ি গালাং বাহা মালা 
আঁজলে কাতে আতাং তালে মে"।
এটির বঙ্গানুবাদ করলে হয় --
হে প্রিয় অতিথি, শ্রদ্ধা ভরা নমস্কার নিও 
শুভ শীতল মনপ্রাণে তোমার পদধূলি এখানে দিলে 
এটা তোমার পবিত্র প্রেমেরই প্রতীক।
ভগবানের দেওয়া দানে এ ধরণীতে মহান হয়ে আছে মহা মহিমময় দীর্ঘায়ু প্রাণ নিয়ে 
আরও অতি মহান হয়ে বেঁচে থাক।
আমরা অতি গরীব, অতি দীন, অতি অবোধ 
ক্ষুদ্র মন ও প্রাণ নিয়েই তোমার মত মহান মানুষের 
ছত্র ছায়ায় বেঁচে আছি।
ভাল খাদ্য ও পানীয় আমাদের নেই 
কি দিয়ে আপ্যায়ণ করবো?
সরল অন্তরের সুতো দিয়ে গাঁথা মালাখানি দিলাম 
দয়া করে প্রীতি ভরে গ্রহণ কর।

কবি রামচাঁদ মুর্মুর লেখা গ্রন্থগুলি ছিল সাঁওতাল সংস্কৃতির নাচগান সামাজিক কাজের নিয়ম নীতি বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস। এরকমই একটি বিখ্যাত বই 'সারি ধরম সেরেঙ পু্ঁথি' (৩ খণ্ড) [ প্রথম খণ্ড ১৯৬৯ সালে, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৭২ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়]। দ্বিতীয় একটি বই 'সংসার ফেঁদ' (বিশ্বের ফাঁদ)। এটি মেচেদার মারাংবুরু প্রেস থেকে ১৯৮২ সালে ড. সুহৃদ কুমার ভৌমিকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৯৮৫ সালে সাঁওতাল জাতির সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্ম বিষয়ক 'ঈশরড়' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কবির লেখা 'অনলদহ অনড়হেঁ' এর দুটি ২ টি সংস্করণ। কবিতা বিষয়ক এই বইটির প্রথমটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ এ এবং দ্বিতীয়টি ১৯৯৬ তে। 'সাধু রামচাঁদ উইহার বাথান' সংগঠন থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এছাড়াও সাঁওতাল জাতির সৃষ্টি তত্ত্ব বিষয়ক 'লিটা গোডেৎ' (জমসিম বিন্তী) গ্রন্থটি ১৯৭৯ তে প্রকাশিত হয়। 'সাধু রামচাঁদ উইহার বাথান' সংগঠন এটির প্রকাশক। যদিও এর দ্বিতীয় খণ্ডের পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। সাধু রামচাঁদ মুর্মূর লেখা বহু পাণ্ডুলিপির খাতা বহু মানুষ প্রকাশের জন্য যে যাঁর নিয়ে চলে যায়। পরবর্তীতে তা কেউ ফেরত দিয়ে যায়নি। সেগুলির প্রকাশও করেনি। ফলে সারাজীবন ধরে লেখা অসংখ্য পাণ্ডুলিপির সংখ্যা আর হদিস আজ আর পাওয়া যায় না। 

ঝাড়গ্রামের সাধু রামচাঁদ মুর্মূ বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, মহাকবি সাধু রামচাঁদ মুর্মুর যাবতীয় সাহিত্যকর্ম বাংলা ও অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হবে। রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের সবুজ সঙ্কেতও মিলেছে। উচ্চশিক্ষা দফতরের অধীনস্থ ‘ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’-এর সঙ্গে যৌথভাবে ওই অনুবাদের কাজ হবে। ইতিমধ্যেই সাধু রামচাঁদ মুর্মুর ওপর গবেষক এবং বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নিয়ে অনুবাদ কমিটি গঠিত হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর, ২০২২ এ উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে অনুমোদনপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। এই অনুমোদনপত্রে জানানো হয়েছে, ইনস্টিটিউট অফ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে এই কাজ করবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। (তথ্যসূত্র -- আনন্দবাজার অনলাইন সংস্করণ, ২৪ শে নভেম্বর ২০২২)। 
সাধু রামচাঁদ মুর্মূ বিশ্ববিদ্যালয়, ঝাড়গ্রাম

প্রবন্ধকার রামেশ্বর সরেণ খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাধু রামচাঁদ মুর্মূকে। তিনি তাঁর বর্ণনায় লিখেছেন, "আমার প্রথম পরিচয় ১৯৪২-৪৩ সালে। তখন আমার বয়স ৬ (ছয়) বছর মত। সত্য সনাতন ধর্ম অবলম্বনে লেখা তাঁর "সারিধরম সেরেঞ” গানের গায়ক হিসাবে। আমার গ্রাম ঝটিয়াড়া (ডাকঘর বেলপাহাড়ী, জেলা মেদিনীপুর) প্রায়ই যেতেন। গান শেখানোর আখড়া তৈরি করেছিলেন। রাত্রিবেলা গানের আসর বসতো। বাজনার তালে তালে নাচের আসরের আখড়ায় গান গেয়ে শেখানোই সাঁওতালী সংস্কৃতিতে পদ্ধতিগত প্রথা। সাধু রামচাঁদ মুরমু শুধু লেখক নন, গীতিকাব, সুরকার ও ভাল গায়কও ছিলেন। তাঁর লেখা সমস্ত গানের নিজস্ব বহু বিচিত্র সুর বেঁধে দিয়ে গেছেন। তাঁর দেওয়া সুর পরিবর্তন করা বা বিকৃত করা অন্যায় ও ঘোরতর অপরাধ বলে মনে করি। মাদল ও বাঁশী বাজানো নিখুঁতভাবে জানতেন। এটা আমি দেখেছি। তখন বয়সে ছোট হলেও তাঁকে নাচগান পরিচালনা করতে দেখেছি। পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পেয়েছি। সুমধুর ও সুমিষ্ট গানের প্রভাবে তাঁর শিষ্যত্ব নেওয়ার অনুপ্রেরণা অন্তরে অনুভব করেছি। পরে পরে অধিকাংশ গানের সুর জেনে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি"।

🍂

Post a Comment

0 Comments