জ্বলদর্চি

রানী পুতুল : হাওড়া জেলার হারিয়ে যাওয়া এক লৌকিক শিল্প /রাজীব শ্রাবণ

রানী পুতুল : হাওড়া জেলার হারিয়ে যাওয়া  এক লৌকিক শিল্প 

রাজীব শ্রাবণ 


সাধারণ ভাবে ক্ষুদ্রায়তন মূর্তিকেই পুতুল বলে। ছোটদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু পুতুল। রানী পুতুল  হাওড়া জেলার অন্যতম বিখ্যাত পুতুল।বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির বা টেরাকোটার মতো মনে হলেও এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পুতুল।কুম্ভকার পরিবারের মেয়েদের প্রথাগত শিল্প। অনেকেই আবার একে " বেনেবৌ" বলে।
এই পুতুল তৈরি করবার সময় প্রথমে দুটি খোলে ছাঁচ করে নেওয়া হয়। তার পর সেই দুটি অংশকে পুড়িয়ে নিয়ে পুতুল তৈরি করা হয়। এই ধরনের পুতুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এদের পা থাকে না। কোমরের নিচের অংশ ঘাগড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। পুতুলের চুল কোঁকড়ানো। কখনো কখনো মুকুটও পরানো হয়। সম্পূর্ণ পুতুল তৈরি হওয়ার পর অভ্র মেশানো গোলাপি রঙ করে করা হয়।

বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটি বা টেরাকোটার মতো মনে হলেও আদতে এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার পুতুল।
কিন্তু রানীর সঙ্গে ‘নাড়ির’ যোগ কোথায়? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাচ্ছে, শিল্পী থেকে পুতুল-গবেষক প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন যে,মূলত কোনো রক্তমাংসের রানীই এই পুতুলের আদর্শ। আর সেই পথ ধরেই ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে এই পুতুলের নামকরণ বা প্রচলন সম্পর্কিত বিশেষ তথ্য উঠে আসে। ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার ভারতপ্রীতি তৎকালীন সমাজের বহু মানুষকেই মুগ্ধ করেছিল। রদ করেছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র শাসন।

🍂

রানির এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতবর্ষের বহু মানুষ। যার প্রভাব ভারতের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যেও।লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে,দক্ষিণ পাতিহাল ও জগৎবল্লভপুরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের পুতুল শিল্পীরা যে পুতুল বানালেন তার মধ্যে নিয়ে এলেন রানী ভিক্টোরিয়ার দেহ-চুলের গঠন।আর এভাবেই হাওড়া জেলার সংস্কৃতিতে স্থান করে নিলেন কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা রানী ভিক্টোরিয়া।

       রাণীপুতুলের ইতিহাস  অনুসন্ধান করে যতদূর জানা  যায় এই পুতুলের ইতিহাস নিয়ে অনেক মত চালু আছে। কেউ কেউ বলেন এটি কাল্পনিক রানী। রূপকথার। আবার অনেকে একে বাস্তবসম্মত একটি রানীর অবয়ব বা  গড়ন বা সাজ বলে মনে করেন। আবার অঙ্গে আছে রাজকীয় বর্ণ লেপন। রানী পুতুলে  ব্রিটিশ আমলের ছাপ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে রাণী ভিক্টোরিয়ার অবয়ব বলে মনে করেন। পুতুলের গোলগাল মুখ সেটাই ইঙ্গিত করে।
        পুতুল তৈরির কৌশল ও বর্ণনা- প্রথমে দুটি খোলে ছাঁচ করে নেওয়া হয়। এর পর সেই দুটি অংশকে পুড়িয়ে নিয়ে পুতুল তৈরি করা হয়। এই ধরণের পুতুলের পা থাকে না। কোমরের নিচের অংশ ঘাগড়া দিয়ে ঢাকা থাকে। পুতুলের চুল কোঁকড়ানো। কখনো কখনো মুকুটও পরানো হয়। সম্পূর্ন পুতুল তৈরি হওয়ার পর অভ্র মেশানো গোলাপি রঙ করে করা হয়। তবে সেটা পরিশ্রমসাধ্য ।
    বিপনন- মূলত বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হয়। দেওয়ান সাহেবের মেলা, জঙ্গল বিলাস পীরের মেলা,ভাইখাঁ পীরের মেলা, ফতেয়ালী শাহের মেলা,ঝিখিরা ও চণ্ডীপুরে রথের মেলা, মূলোকালীর মেলা ইত্যাদি সব বড় বড় মেলাতেই বিক্রি হয়।
    বর্তমান অবস্থা- শ্যামপুরের দুর্গাপুর, সীতাপুর ও ঘুঘুবেশিয়া, উলুবেড়িয়ার তুলসীবেড়, তাঁতিবেড়িয়া কুমোররা এই ধরনের পুতুল তৈরি করে। তবে সেই ৬'' উচ্চতার পুতুল তৈরি হয় না। চার ইঞ্চি মাপের হয়।নকসা ভোঁতা হয়ে গেছে।আন্দুলের কাছে পুইল্যা, বাঁটুল, সড়িয়ালা-,আমতার বালিপোতা, জগৎবল্লভপুরের পাতিহাল, মুন্সীরহাটের নরেন্দ্রপুরে এই শিল্প পশ্চিম আকাশের প্রায় অস্তগামী সূর্যর আলোর মতো  আছে। কোন ক্রমে টিকে আছে। বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্প আজ শিল্পী দিবাকর পালের হাত ধরে বেঁচে আছে। বর্তমানে জগৎবল্লভপুরের শিল্পী দিবাকর পাল পরিবার পরম্পরায় আজও বানিয়ে চলেছেন এমন রানি পুতুল।
বাংলার বুকে বিভিন্ন রকমের পুতুলের প্রচলন আছে। যদিও কালের নিয়মে আজ বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয়েছে ইতিহাসের পাতায়, মিউজিয়ামের টেবিলে। ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপের যুগে গ্রাম বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে পুতুলখেলা শৈশবও। অন্যতম রানী পুতুল। শিল্পপাগল মানুষের হাতে ধরে হাওড়া জেলার শিল্প,সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাকে যা বহন করে নিয়ে চলেছে। 
         
তথ্যসূত্র—
 ১।  লোকায়ত হাওড়া- তপন কর   ২।পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পী সমাজ-  তারাপদ সাঁতারা  ৩। হাওড়ার লোকচর্চা- ড. অবন্তী রায় ৪। Handcrafted heritage products from Bengal for connoisseurs of the world today..৫। বিশ্ব বাংলা। বাংলার পুতুল (PDF)  ৬। উইকিপিডিয়া ৭। রানি পুতুল"। বংদরশন
৮। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকা

Post a Comment

0 Comments