জ্বলদর্চি

চার সখা সমাচার /রবীন্দ্র বন্ধুত্ব---প্রথম পর্ব /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

চার সখা সমাচার
রবীন্দ্র বন্ধুত্ব---প্রথম পর্ব
তনুশ্রী ভট্টাচার্য 


প্রিয়নাথ সেন

"আয় তবে সহচরি হাতে হাতে ধরি ধরি"--- সহচরী না হোক কবির  সহচর বেশ কয়েকজন ছিলেন এবং তাদের হাত ধরে ধরে কবির কবিতা গান গল্প নাটক উপন্যাস চিত্রশিল্প প্রভৃতি সৃষ্টির প্রদীপ খানি ঘুরে ঘুরে বেড়াতো তার অনেক পরিচয়ই পাওয়া যায়  কবির   জীবন চরিতে এবং অবশ্যই জীবনস্মৃতিতে। শুধু  কাব্যজগৎ নয়  কবির  সাংসারিক পারিবারিক জীবন জমিদারি জীবন  ঠাকুর কোম্পানির মালিক হিসেবে ব্যবসা ইচ্ছুক জীবন  শিলাইদহ পতিসর সাজাদপুরে থাকাকালীন চাষবাসে তীব্র মনোযোগী এক কবির জীবন --- বহুমুখী সব ক্ষেত্রেই এই বন্ধুদের সখ্যতা সাহচর্য কবিকেও সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যিক ,কবি  রবীন্দ্রনাথের  রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও তাঁদের অবদান নেহাত কম নয়। নিখাদ বন্ধুত্ব এক বিরল জিনিস এই পৃথিবীতে । তিনি অনেক শত্রুতাও   পেয়েছেন ,তবুও  হীরক খণ্ডের মত উজ্জ্বল কিছু বন্ধুত্ব তাঁর জীবনে আছে। সেই কয়েকজন বন্ধুর কথায় এই পর্ব সাজিয়েছি যার কেন্দ্রে আছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং পরিধিতে আছেন বেশ কয়েকজন বন্ধু। কেন্দ্র না থাকলে অবশ্য পরিধির অস্তিত্ব আমরা পাই না আবার পরিধিও কেন্দ্রকে সূচিত করে। তেমনি তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব কেমন করে গড়ে উঠেছিল তাই নিয়েই এই পর্বের অবতারণা। আজকের বন্ধু প্রিয়নাথ সেন যাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে একটি পুরো অধ্যায় রেখেছেন বন্ধুত্বের র মর্যাদা স্বরূপ।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন প্রিয়নাথ সেন একজন পন্ডিত প্রবর বহু ভাষাবিদ এবং সাহিত্যের সাত সমুদ্রের একজন নাবিক। জার্মান ভাষা সাহিত্য, ফরাসি সংস্কৃত ইংরেজি ও বাংলা ভাষা সাহিত্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ এবং  প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি। সাহিত্যের রাজপথ থেকে গলি পথ পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল তার সচ্ছন্দ যাতায়াত এবং তাঁর সম্পূর্ণ সাহচর্য রবীন্দ্রনাথ নিজে উপলব্ধি উপভোগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন "সন্ধ্যা সঙ্গীত" লেখার কালে এই প্রিয়নাথ সেনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছেন। বলছেন যখন তিনি ভগ্নহৃদয় লেখেন তখন প্রিয়নাথ বাবুর থেকে এতটা প্রশংসা পাননি। বস্তুত প্রিয়নাথ সেনের কাব্যিক বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণে  রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট বিশ্বাস সমীহ থাকতো। সেজন্য সমস্ত লেখা  প্রথমেই প্রিয়নাথ সেনের হাতে তুলে দিতেন এবং তার সুচিন্তিত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের  জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। শুধু তাই নয় প্রিয়নাথ সেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথের এইসব লেখা নিজে পড়তেন এবং অন্য মানুষদেরও পড়িয়ে তাদের মতামত নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানাতেন। এখানে বলতেই পারি আজকের যুগে যখন আমরা লাইক কমেন্ট শেয়ার এর আশায় থাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন কিছু পোস্ট করার পরে রবীন্দ্রনাথও কিন্তু সেই একই লাইক কমেন্ট শেয়ার এর আশায় থাকতেন তাঁর নিজের লেখাটি প্রিয়নাথ সেনের হাতে তুলে দেওয়ার পরে। এবং একজন শুভানুধ্যায়ী হিসাবে প্রিয়নাথ বাবু রবীন্দ্রনাথের এইসব লেখার কাটাছেঁড়া করতেন ত্রুটি গুনাগুন বিচার করতেন এবং বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ এতে যথেষ্টই সমৃদ্ধ হতেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন সেই সময়ে প্রিয়নাথ সেনের সাহচর্য না পেলে তাঁর কাব্য জমির আবাদে ফসলের ফলন কতটা হতো বা  কাব্যের বর্ষা কতটা ঝরঝরিয়ে নামত তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
শুধু কাব্যের বলয়ের বন্ধুত্বই নয় প্রিয়নাথ বাবু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাংসারিক পারিবারিক জীবনের একটা ঢাল। নানা  ঝড়ঝাপটায় রবীন্দ্রনাথ যখন অস্থির হতেন এই প্রিয়নাথ বাবু তাঁকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতেন কবিকে সুরক্ষা দেওয়ার কান্ডারী হয়ে উঠতেন।স্ত্রীর মৃত্যু সন্তানদের মৃত্যু সন্তানদের রোগ জ্বালা মেয়েদের বিয়ে বিয়ের আগের সমস্যা বিয়ের পরের সমস্যা বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি পারিবারিক সমস্ত ঝঞ্ঝায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে আগলে রাখতেন। ছাতার মতো সুরক্ষা দিতেন ।
শিলাইদহ পতিসর সাজাদপুরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ নানাবিধ উদ্ভাবনশীল কাজে নিজেকে  নিযুক্ত করতেন।এইসব কাজের  গুণাগুণ বিচার করে সঠিক বেঠিক বিচার করে প্রিয়নাথ সেন মতামত দিতেন এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ সেই মতামতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতেন। জ্যোতিদাদার মতো রবীন্দ্রনাথেরও ইচ্ছা হল ব্যবসা করার। খোলা হল ঠাকুর কোম্পানি। এই কোম্পানি পাট চাষের উদ্যোগ নিল। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হলেন ।লোকসান করলেন এই কোম্পানি চালাতে গিয়ে। দেনার দায়ে জর্জরিত হলেন। উদ্ধারকারী হিসেবে এগিয়ে এলেন প্রিয়নাথ সেন। নিজে দায়িত্ব নিয়ে একেবারে ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওর সুদ মেটান তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার আসলের ধার মেটান-- এইভাবে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত দেনা  তিনি মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের গায়ে এইসব বিড়ম্বনার আঁচ টিও লাগতে দেননি। এইসব দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকতেন এই পণ্ডিতপ্রবর বন্ধু প্রিয়নাথ সেন।
অনেক বিষয়ে ব্যুৎপত্তির মত ফলিত জ্যোতিষ চর্চায় প্রিয়নাথ সেনের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সঙ্গে তাঁর একবার তর্ক হয়েছিল যে ফলিত জ্যোতিষ এর সারবত্তা  আছে কিনা। প্রিয়নাথ বাবু ফলিত জ্যোতিষ  চর্চা করতেন অর্থাৎ হাত দেখা কষ্টি বিচার এগুলিতে সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও এই হাত দেখা কোষ্ঠী বিচারে বিশ্বাস  করতেন। প্রিয়নাথ বাবু রবীন্দ্রনাথের কোষ্ঠী বিচার করে যা যা লিখে দিয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল । মীন রাশি মীন লগ্নের-- "লগন চাঁদা" ছেলে রবির কোষ্ঠী বিচারের যে হদিস পাওয়া যায় সেখানে অবশ্য শুধু সাফল্য নয় অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা মৃত্যু শোক এর কথাও বলা ছিল। প্রিয়নাথ সেনের কুষ্টি বিচার ছিল অভ্রান্ত নির্ভুল। একটা চিঠিতে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ প্রিয় বাবুকে লিখছেন আপনার কাছে আমার ছেলে মেয়ের যে কোষ্ঠীগুলি আছে তা তাড়াতাড়ি বিচার করে যদি পাঠিয়ে দেন তো ভালো হয়-- রথীর মা অস্থির হচ্ছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের কোষ্ঠী বিচারের জন্যেও রবীন্দ্রনাথ এই বন্ধুকেই ভরসা করতেন। 

🍂

প্রিয়নাথ বাবু রবীন্দ্রনাথের থেকে সাত  বছরের বড় ছিলেন কিন্তু তাতে তাঁদের সখ্যতায় কোন বাধা তৈরি হয়নি কারণ দুজনেরই মনের কলসটি টি ভর্তি থাকত  কাব্য রসে।। রবীন্দ্রনাথকে জানতে গেলে, গোটা মানুষটাকে জানতে গেলে প্রিয়নাথ সেনের বন্ধুত্বের কথা , সেই দিনগুলোর গড়িয়ে যাওয়ার কথা ও জানতে হয় যার জন্য জীবনস্মৃতিতে একটি পুরো অধ্যায় তিনি রচনা করেছেন। আসুন --এই কবিপক্ষে সেই সব বন্ধুদের কথা পড়ি ,পড়ি আরো একবার জীবনস্মৃতি-- নিজেদের জীবন ধন্য করি। আমরাও যদি রবির বন্ধু হয়ে উঠতে পারি অথবা রবি যদি সত্যি সত্যি আমাদের প্রাণের সখা হয়ে ওঠেন তবে তো সেই পুরনো দিনের কথায় ফিরে যেতেই পারি।

Post a Comment

0 Comments