জ্বলদর্চি

দুয়ারে জেনোসাইড /পর্ব ৫/বাসুদেব গুপ্ত

দুয়ারে জেনোসাইড
পর্ব ৫
বাসুদেব গুপ্ত 

 পাতাল প্রবেশ

সীতা নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে দাওয়ায়। আজকাল বিধবা হলে কেউ সাদা পরে না। কিন্তু শাঁখা ভাঙ্গে, সিঁদূর মোছে। সীতা কিছুই করে না। কাউকে জানায় না সেই জয়ধ্বনির কথা। জয় কোথায় জানতে চাইলে বলে, বাঙ্গালোর গেছে হোটেলের কাজ পেয়েছে। তার বাড়ীতে আসে না কোন দলের লোক। জয়দের পারটির লোক উধাও। সীতার জমি ফেরত পাবার আশাও করে না। কুয়াশা সরে গেলেও, তার ঘরের চারদিকে কুয়াশা আর উঠবে না। 

—ঐটা শালা জয় না, তোকে মালিশ করত?  
—একদম চুপ, এ নিয়ে কোন কথা নয়। 
—অত ভয়? বাবা, এখন তো হমারাহি রাজ। কেয়ার কিস কা?  
—ঠিক আছে, তোদের সেন্টারে, আমাদের তো লোকাল। ছিরুদের অবশ্য এখন হাত পেতেই খেতে হবে কতদিন। খিক খিক করে হেসে ওঠে সুদাম। 
—আচ্ছা, সীতাটাকে একদিন ইম্পোট করলে হয় না?
—খবরদার ঝুটমুট ঝামেলায় একদম না। 
—ছাড় তো। শালা পাওয়ার থেকে লাভ কি, যদি প্যার না মিলা। শোন আমি কি বলছি। কালকেই আমি পণচাত থেকে লোক পাঠাচ্ছি, আইডি চেক করতে। যাদের আইডি ঠিক নেই তাদের বলব এসে দেখা করতে। সিম্পল। 
আর তোরা আই ডি নিয়ে অত্যাচার চলবে না চলবে না বলে কদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘোর। আমার চেনা ইউটিউবার আছে বলে দেব কভার করবে।
—আমাদের বেলায় সেই ইউটিউবার। কেন পাইম টাইমে হবে না?
—না হবে না। যেমন পাটি তেমন খবর। আচ্ছা মন খারাপ করে না। পরের রাউন্ডটা আমার। সুদাম আসন্ন অভিসারের কথা ভেবে বিবশ হয়ে খাইয়েই দেয় পরের রাউন্ডটা, তার সঙ্গে অরডার দেয় মাটন চাপ তিন পাতা। 

তিন ইয়ারের দোস্তি ভাঙ্গা রাজনীতির আরাধ্যা দেবীর সাধ্য নয়। এ জোড় ফেভিকলের জোড় বলে তিনজন ঘুরে ঘুরে গান গাইতে গাইতে ভেড়ির তিন ধারে তিন গ্রামে ঢুকে যায় তিন ছায়া মূর্তির মত। 

হিসেব মত সীতা ও আরো চারজন এসে হাজির হয় পারটি অফিসে। একে একে তাদের ঘরে ডেকে কথা বলে সবুজ। তাদের কি কি ডকুমেন্ট লাগবে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সব শেষে ডাক পড়ে সীতার।   সবুজ তাকে ঘরে বসায়। হোগলার ঘর, দুটি হাতল ভাঙা চেয়ার। সবুজ নারভাস হয়ে সিগারেট ধরিয়ে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলে,
--তোর মানে তোমার তো আইডি ঠিক নেই। সব ক্যান্সেল হয়ে যাবে যে। আধার ক্যান্সেল হলে তো কোন সরকারী টাকাও পাবিনা, আর দেশ থেকে বার করে দেবে যে। 
সীতার চোখ ১০৪ জ্বরের মত ঘোর। সে কি বলবে মাথায় আসে না, থরথর করে কাঁপে। তারপর আসতে আসতে বলে
--আইডির কাগজ তো সব ওনার কাছে। উনি এলেই তো দিতে পারব। এখন তো পারব নি। 
--তাহলে দেশের বাইরে করে দেবে যে। 
--সে কোন দেশে? তারা আমায় নেবে কেন? এত লোক সবার আইডি ক্যান্সেল 
--সে কত দেশ আছে। তোর স্বামী জয় ফিরবে কবে? না কি সেও কোন বিদেশে গেছে?
দুটো বড় বড় চোখ তুলে সীতা তাকায় সবুজের দিকে। সে চোখে আগুন নেই, জলও নেই। আণবিক বোমা ফাটলে যেমন প্লাজমা হয় বিস্ফোরণের ঠিক আগে, ঠিক তেমনি তার মণির রঙ। সবুজ বেশিখন তাকাতে না পেরে চোখ ফিরিয়ে নেয়। 
সিগারেটের রিং ছাড়ে। সেই রিং ভাসতে ভাস্তে ঘুরে যায় সীতার গলায়। একে তুলতে গেলে জলদি তুলতে হবে। 
--আমাকে বললে ব্যবস্থা হয়ে যাবে আই ডির। তোর বর এখন কোথায় গেছে, ফিরবে কিনা, নাকি কারো সঙ্গে অন্য দেশে ঘর বেঁধেছে তার জন্য তুই কি বসে থাকবি? তুই বলছিস দশ দিন হয়ে গেল। বল আমি ব্যবস্থা করি। তবে এমনি তো হবে না, কিছু দিতে লাগবে। 
এবারে একটু নারভাস লাগে। জোর করে তুলে দু একবার এনেছে মাগীদের, কিন্তু এমন সোজাসুজি প্রস্তাব, জোরে জোরে সিগারেট টানে, 
--কি লাগবে বলুন। কাগজ তো নেই, ফটো তুলে দিতে পারি আর ফরমে সই সাক্ষী লাগলে ঐ পাশের বাড়ীর জেঠু আছে করে দেবে বলেছে। 
--তাতে হবে না। দেখছি আমি কথা বলে সরকারের সঙ্গে। তুই একবার আমার বাড়ি আয় আজ সাতটার সময়। ফটো নিয়ে আসবি, তোর আর ঘরের। এলে বুঝিয়ে দেব সব।
--ঠিক আছে।  বলে সীতা মাথা নীচু করে চলে যায়। আঁচলের আড়ালে লুকোন একটা জিনিষ ছিল সেটা ভালো করে কোমরে গুঁজে নিয়ে ধীর পায়ে রওনা দেয়। 

🍂

ঘরের মধ্যে আজ গান চালিয়েছে সবুজ। বাংলা সিনেমার গান। সুপারহিট। সেই বেদের মেয়ে সিনেমার পরে আর কোন গান এমন হিট হয় নি। ভিতরের ঘরে সুদাম ছিদাম বসে তাস খেলছে। দুজনেই কলকাতা ফ্যন্সী বাজার থেকে আনা জিন্স আর টি শারট পরে সেজে গুজে এসেছে। ভাল করে গায়ে গালে বগলে ও বাকী সব জায়গায় সেন্ট মেরেছে। ঘরের মধ্যে সেই সেন্টের গন্ধ ভাসছে পচা ডোবার উপরে ভাসা চাপা গন্ধের মত। 

--এসেছিস? আয় আয়। বা আজ তো দেখছি একদম বিলিতি মেম সেজেছিস, প্যান্ট সার্ট পরে, লিপ্সটিক ঠোঁটে। গলায় একটা চেন তাতে তিন্টে গোল গোল পুঁতি, লাল হলুদ সবুজ। দেখে সবুজ উত্তেজিত হয়ে যায় সীতাকে দেখে। ঠিক বুঝে গেছে মাগী আজ কি হবে। গরীব, পড়াশোনা জানে না, কিন্তু কামকাজ বুঝতে এক মিনিট লাগে না। 
--না বাবু কাজে বেরোলে ঐ শাড়ী পরে হয় না। আমার বর বলেছে। ও যেখানে আছে সেখানে মেয়েরা সব কাজ করে, সব প্যন্ট শারট পরে। 
--হা হা হা তোর বর বলেছে? কবে বলল? কোন দেশের গল্প? যাই বল আমার কিন্তু এই ড্রেসই পছন্দ। বেশ সিনেমার হিরোইন মনে হচ্ছে। 
--বর ফোন করেছিল বিকেলে। বলল যাও যা চাইছে দাও, দেখ কি বলে। সব নিয়ে যাও যা আছে। আবার কাল ফোন করবে বলল। 
--তোর বর? সে ফোন করল? তোর আবার ফোন আছে নাকি?
--হ্যা বাবু ফোন নেই? সব্বার ফোন আছে। দেশ বিদেশের সব খবর তো ফোনেই আসে। আর ফোন না থাকলে কি কারড হবে কোন? সবেতেই তো বাবুরা ফোন নম্বর চায়।
সবুজ একটু ঘাবড়ে যায়, কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। যে লোকের পা ধরে টানতে টান্তে ভাসিয়ে দিয়েছে, যে লাশ কারো অঙ্গুলি হেলনে পুলিশ পুড়িয়ে দিয়েছে কেউ দেখার আগেই, সে আবার ফোন করে কি করে?  এসব কথা বলে মেজাজটা আবার চলে যাবে। দু পেগ করে চাপিয়ে তিনজনেই বসে আছে, ঠিক টেম্পো যাতে ওঠে। ও কথা ঘোরায়
--ঠিক আছে করেছে তো ঠিক আছে, আয় ঘরে আয়। সব নিয়ে এসেছিস তো?
-- হ্যাঁ বাবু সব দেব বলেই তো এলাম। 
-- কি বলে মাইরি, মনে মনে ভাবে সবুজ। চা খাবি?
--মাল নেই? চা ঠিক জমে না। একশান সিনেমাতে কেউ চা খায়?
টাং করে মাথায় লাগে সবুজের। এতো মামলা ফিট মনে হচ্ছে, ফলটি পেকে ঝুলেই আছে, পাড়ো আর খাও, আড়চোখে সীতার বুকের দিকে চোখ পড়ে। যেন দুটো সারচলাইট ডাকছে পথহারা জাহাজকে, এসো, তীরে এস।
--মাল খাবি? খা না, অনেক আছে। আমার দুই বন্ধুও আছে, একসঙ্গে খাব বোস। 
গানটা থেমে গিয়েছিল, আবার চালিয়ে দিয়ে সবুজ ভিতরে যায় খবর দিতে, তার আর তর সয় না। 

তিনজনের কি একটা কথা নিয়ে খুব বিতর্ক শুরু হয়েছে, সীতা কান পাতে, ঠিক বুঝতে পারে না প্রথমে। তারপর কানে আসে পরিষ্কার,
--আমি আগে। আমরা বড় পারটি
--না না আমি আগে। মেজ পারটি তো কি, আমরা না সাপোট দিলে তোদের চলবে, তা ছাড়া আমাকে সবচেয়ে ভাল দেখতে। প্রথমেই ওর মন গীটার গীটার হয়ে যাবে আমি গেলে,
--ওসব জানি না, আমি সবচেয়ে বড়। আমার বাড়ি, আমি মাল খাওয়াচ্ছি, আমিই আগে। 
সীতা তার শারট খুলে ফেলে, জিন্স খুলে ফেলে। অন্তর্বাস পরে তাকে ক্যাট ওম্যানএর মত লাগে। দু হাতে দুটি অলঙ্কার যেন ঝকঝক করে ওঠে আবছা আলোয়। 

ভিতরের আলোচনা হতে হতে শুরু হয় ঝগড়া যা  হাতা হাতিতে চলে যায়। সুদামের গায়ে জোর বেশি, সে এক ঘুষি লাগায় ছিদামকে। ছিদাম চোখে অন্ধকার দেখে, সেভাবেই এক সপাটে ঘুষি চালায়, সেটা লাগে সবুজের রগে, সে ঘুরে পড়ে যায়। মারপিট করতে করতে হঠাত চোখ পড়ে পরদার আড়ালে কে দাঁড়িয়ে। 
সুদামের সম্বিত ফেরে, হাত তুলে সবাইকেই থামায়।  
--ধ্যাত কি বোকার মত আমরা মারপিট করছই, টস করলেই তো হয়। ওদিকে মাল না পালিয়ে যায়। 
তিনজনেই পর্দা সরিয়ে একবারটি দেখে। তিনজনই চোখ বড় বড় হয়ে যায় সীতাকে দেখে। এ যেন গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। দিকবিদিক ভুলে তিনজন তিনটে হায়েনার মত লাফ দেয়। 
তিনটি গুলি পর পর বেরোয় দু হাতের দুটি পিস্তল থেকে। জয় লুকিয়ে রাখতে বলেছিল লক্ষির ঝাঁপির মধ্যে। আজ কাজে দিল।  তিনটি হায়েনাই ছিটকে পড়ে যায়, তাদের হাতের মদের গ্লাসগুলো আকাশে ছিটকে ওঠে। আরো তিনটে গুলি পরপর চলতে সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। 

গলার চেন থেকে একটি মাদুলি খুলে মুখে দেয় সীতা। জয় বলেছিল ওতে সায়নাইড আছে, সাবধান। অনেক লোকের পায়ের শব্দ দৌড়ে আসছে। তার আগেই তাকে গাড়ীতে উঠতে হবে, জয় দাঁড়িয়ে আছে অনেক দূরের স্টেশানে। 

 জিরেখালির দুয়ারে এসে জেনোসাইড তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিরোধের দেখা পেয়ে অল্প থামে। তারপর কি হবে সে সময় এক মাত্র বলতে পারে। সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে দেখতে থাকে সীতার পাতাল প্রবেশ।

Post a Comment

0 Comments