জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ১১/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১১

স্বপন কুমার দে

কলেজে রেজাল্ট আনতে গেছে মল্লিকা। গিয়ে শুনল ডিপার্টমেন্ট থেকেই মার্কশীট দেওয়া হবে। সবাইকে একটা রুমে বসতে দেওয়া হয়েছে। ডিপার্টমেন্টের স্যার- ম্যাডামরা আছেন। তাদের হাত থেকেই মার্কশীট নিতে হবে। মল্লিকা ঢুকতেই সকলে তার দিকে চাইল, কলরোল উঠল। একটা বেঞ্চে বসতেই পাশে বসা বন্ধু বান্ধবীরা হাত মেলাল। এরপর একে একে মার্কশীট দেওয়া শুরু হল। মল্লিকা মার্কশীট নিতে যেতেই জোরালো হাততালি পড়ল। স্যার-ম্যাডামরাও হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালেন। মার্কশীট দেওয়া শেষ হতেই টিচারদের সঙ্গে স্টুডেন্টদের কথোপকথন শুরু হল। আজ এই ব্যাচের শেষ দিন। আর তাদের এইডাবে এখানে দেখতে পাওয়া যাবে না, সবাই যে যার বৃহত্তর কর্মপথে এগিয়ে যাবে। একটা মন খারাপের, বিষাদের ছায়া ভেসে উঠল। স্যার- ম্যাডামেরাও নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের নানারকম পরামর্শ দিলেন। তাদের পরবর্তী ইচ্ছার কথা জানতে চাইলেন।

মল্লিকার পালা এল। সে উঠে দাঁড়াল। স্যার-ম্যাডামদের প্রণাম আর বন্ধুদের ভালোবাসা জানিয়ে বলতে শুরু করল," আমি জানি না,কীভাবে শুরু করবো,কীভাবেই বা আমার না বলা কথাগুলো আপনাদের বোঝাতে পারবো। আমি আসলে 'আমি' হতে চাই। এই আমিটা যে কী, তা হয়তো নির্দিষ্ট করে বলে বোঝাতে পারছি না। আমি আমার পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। এর জন্য হয়তো একটা চাকরি চাই কিংবা ব্যবসা কিংবা অন্য কিছু।সমাজ আমাকে চিনবে, জানবে আমার পরিচয়ে। জানি, এই রাস্তাটা সোজা নয়। অনেক পরিশ্রম, অনেক লড়াই করে এগোতে হবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছতে পারি, হয়তো নাও হতে পারে। তবে লড়াই শেষ পর্যন্ত চলবে। তার আগে দরকার পড়াশোনা সম্পূর্ণ করা। এরপর আমি এম, এস, সি করবো।জানি, এটা কমপ্লিট করা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। তবে এটা আমি করবই।" কথাগুলো শেষ করে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়ল।

প্রফেসর তপেশ সেনগুপ্ত একটু পরেই ঘোষণা করলেন, " এই বছর আমাদের কলেজ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য আমরা মল্লিকাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিচ্ছি। প্রতিবছরই এই পুরস্কার দেওয়া হবে।

রেজাল্ট নিয়ে মল্লিকা যখন ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরোতে যাবে তখন ডিপার্টমেন্টের পিয়ন বিষ্ণুদা খবর দিল, " এইচ ও ডি স্যার তোমাকে ডাকছেন।"

কলেজের ম্যাথেমেটিকস্ ডিপার্টমেন্টের হেড ডক্টর বি এন সিংহ অর্থাৎ বজ্র্র নিনাদ সিংহ। সার্থকনামা পুরুষ। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির অমন বেঁটে খাটো যে সিংহের বিক্রম ধরতে পারে তা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। তাঁর স্টুডেন্টরা তো তাঁর ভয়ে জুজু থাকতই এমনকি তাঁর সহকর্মীরাও তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। কোনো বেয়াদব ছাত্রের চরম দুর্ভাগ্য না ঘটলে তাঁর রুমে ডাক পড়ত না। মল্লিকা ভাবল, সে কি কোনো অন্যায় করেছে ?  নাহলে, এমন দিনে বিশেষত তার কলেজ জীবনের শেষ বেলায় তাকে সিংহের গুহায় ঢুকতে হবে কেন ? বোতল থেকে দু'ঢোক জল খেয়ে স্যারের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বন্ধ দরজায় অল্প চাপ দিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করে জিজ্ঞেস করল," স্যার,  আসবো?"
স্যার বোধহয় কিছু একটা পড়ছিলেন। মুখটা উপরে তুলে দেখে নিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন," এসো"।

আস্তে আস্তে স্যারের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মল্লিকা। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠের মালিক নির্দেশ করলেন," বোসো "। থতমত খেয়ে বসে পড়ল সে।
" চন্দ্রমল্লিকা সামন্ত, ডিপার্টমেন্ট অব ম্যাথেমেটিকস্, নাইনটি ফোর পার্সেন্ট। খুব আনন্দ হচ্ছে, তাই না ?"
একথার কী উত্তর দেবে, বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে মল্লিকা বলল, " হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার।"
" প্রশংসায় একেবারে গলে গেছ? তাহলে আর কী? সার্টিফিকেটটা গলায় ঝুলিয়ে নাচতে থাকো। যত্তোসব। "
মল্লিকার বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভাবতে পারছে না, কী করবে, কী বলবে?
" আমি চোখের সামনে এরকম অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্কলারকে ডুবে যেতে দেখেছি। তুমি বেশি কিছু আর কী করবে? তাদেরই একজন হয়ে যাবে।" একটু থামলেন। টেবিলে রাখা গ্লাসটা তুলে নিয়ে একটু জল খেলেন।
" লোহাকে পুড়তে দেখেছো? লোহা আগুলে পুড়লে টকটকে লাল হয়ে যায়। তখন তার থেকে তাপ বেরোয়, আলো ঠিকরে পড়ে। তারপর সেটা দিয়ে তৈরি হয় হাতা, তৈরি হয় হাতিয়ার।" একটু সময় নিলেন, মল্লিকার চোখ মুখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলেন।
" আমি শুনেছি, তুমি খুব গরিব পরিবারের মেয়ে। তোমার মা মারা গেছে। তোমাকে সাহায্য করার মত কোনও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব নেই। তুমি একা।তোমার লড়াই, তোমার একার।আমরা দু'দিন বাহবা দেবো, তারপর আর ফিরেও তাকাবো না। কিন্তু তোমাকে তোমার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। একদিনের প্রশংসায় কারা আত্মহারা হবে? না, যাদের সামনে রোজ ভাতের থালাটা এগিয়ে দেবার লোক আছে, যাদের অর্থের জন্য ভাবতে হয় না, যাদের সামান্য সাফল্যে বাবা মায়েরা উপহারে ভরিয়ে  দেন, তারা। কিন্ত, তুমি তো তা নও। তোমাকে তোমার সংসার চালাতে হয়, বাবার চিকিৎসা করাতে হয়, তোমার পড়াশোনার খরচ জোগাতে হয়।তার জন্য সকাল- সন্ধ্যা পরিশ্রম করতে হয়। নিজের সুখ, বৈভব, বিলাসিতা ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনীর ব্রত ধারণ করতে হয়। তোমার পা'দুটো মাটিতেই রাখতে হবে, ভেসে গেলে চলবে না।"

🍂

স্যার একটু দম নিলেন। মল্লিকা মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্যারের দিকে চেয়ে রইল। একটি কথাও বলল না।
" তোমার লড়াইকে আমি শ্রদ্ধা করি, তাই এত কথা বললাম। অন্য কাউকে বলিনি,কিন্তু দেখলাম, তোমাকে বলা দরকার, তাই। তোমার চারপাশটা তোমার জন্য সহায়ক নয়। পাড়া প্রতিবেশীরা হিংসা করবে,তোমার দারিদ্রের সুযোগ নেবে লোভী মানুষেরা,তোমার সহপাঠীরা তোমার সাফল্যকে সহ্য করতে পারবে না। তোমার বাবা অনিশ্চয়তায় ভুগবে, তোমার ভেতরে অহরহ দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে। তোমার চলার পথ খুবই দুর্গম পদে পদে লোভ, ভয়, মোহ তোমাকে গ্রাস করতে থাকবে। তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে।ভুল সবে,ভুল করবে। মানুষকে বিশ্বাস করতে গিয়ে দেখবে, ভুল জায়গায় পা ফেলেছ।ঘরে-বাইরে প্রতিবন্ধকতার আগুনে জ্বলে পুড়বে। যত পুড়বে তত শক্তিমান হবে।আগুনে না পুড়লে তোমার ভেতরের মূল্যবান ধাতু বেরোবে কী করে ? তাই বলছি,থেমে না। ভয়ে থেমে না, প্রলোভনে থেমো না। জয় তোমার হবেই। লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে চলো।"

অধ্যাপক বই এন সিংহের ভেতরের এই শিশু মানুষটিকে আগে কেউ কখনও দেখেনি যেটা মল্লিকা এইমাত্র আবিষ্কার করলো।
" সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে আমি তোমাকে ছোট করতে চাই না। তবে একটা কথা বলে রাখি, যদি কখনও কোনও অসুবিধায় পড়িস তাহলে এই বুড়োটাকে জানাতে ভুলিস না মা।" প্রফেসর বি এন সিংহের চোখে জল, ছাত্রীর দু'চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে স্যারের পা দুটো জড়িয়ে ধরল মল্লিকা।

বাড়িতে গিয়ে মল্লিকা বাবাকে জানিয়ে দিল,এম এস সি- তে ভর্তির টাকা সে পেয়ে গেছে, আর কোনো চিন্তা রইল না।পড়ার খরচ সে নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে। অতএব কারও কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন নেই। বাবা একবার মেয়ের দিকে চেয়েই চুপ করে রইল।

সন্ধ্যেবেলায় ঘটক এসে খবর দিনু সামন্তকে বলল," সুখবর আছে। মেয়ের ফটো  দেখে ছেলের বাড়ি এক কথায় রাজি।আবার, মেয়ের রেজাল্ট শুনে তো আর দেরি করতেই চায় না। মেয়েকে একবার দেখবার জন্য উদগ্রীব। আমিই সময় চেয়ে নিয়ে এসেছি।এখন তুমি বললেই ওরা একটা দিন তোমার মেয়েকে দেখে যাবে। তোমাকে তেমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে না।সামান্য চা-বিস্কুট হলেই চলবে। তোমার আর্থিক অবস্থার কথা আমি ওদের বলেছি।ওরা কথা দিয়েছে, ওরা কিছুই নেবে না।এখান থেকে মেয়েকে সাজিয়ে নিয়ে যাবে।"
" ঠিক আছে। আমি মেয়ের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে বলছি। আপনি বরং কাল একবার আসুন।"
" আচ্ছা, আচ্ছা। এখন তবে আসি।"

টিউশন থেকে ফিরে মেয়ে বাবার মুখ থেকে শুনল,ছেলের বাড়ির অবস্থা খুব ভালো।একমাত্র ছেলে । বড় অফিসার। বাবা-মাকে দেখবার কেউ নেই। তোকে বউ করে নিয়ে যেতে চায়।
" আমি কতবার তোমাকে বলব বাবা, যে, আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের ভালোমন্দ বোঝার বয়স হয়েছে। তাই তোমাকে বলছি, তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করবে না,অন্য কাউকে বলবেও না।"
" আমি মরে গেলে তুই একা একা কী করে থাকবি ?
" তুমি থাকতে থাকতেই দেখতে পাচ্ছো, আমি কতটা কী করতে পারি। তাহলে, ভবিষ্যতের ভারটা নাহয় আমার হাতেই ছেড়ে দাও।"
" তাহলে তুই এত ভালো ছেলেকেও বিয়ে করবি না ?"
" না বাবা, এখনই নয়।"
" তবে আর কী? কাল ঘটক এলে না বলে দিই। মরণটাও হয় না আমার!"
বাবার দিকে শুধুই চেয়ে রইল মল্লিকা, মুখে কিছু বলল না।

Post a Comment

0 Comments