বার্লিনের ডায়েরি
২২পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(টিয়ার গারটেন পার্কের পরবর্তী অংশ।)
সেদিন ভার মুক্ত মনে বেড়ানোয় ছিল প্রাণ খোলা আনন্দ। ঈশ্বর বোধহয় শ্রীময়ীর কাতর নিবেদন স্বর্গ থেকে শুনেছিলেন,এবং হঠাৎই উড়ো কালো মেঘ যেমন দল বেঁধে এসেছিলো তেমনি তারা দলে দলেই নিরুদ্দেশে পাড়ি দেওয়ায় সুনীল আকাশ বিস্ফারিত চোখ মেলে হেসেছিল। অবিরাম হিম শীতল হাওয়া বইছে কিন্তু ঋষভ শ্ৰী কোনো পরোয়া নেই ,খুশির জোয়ারে ভেসে দ্বিগুন আনন্দে পশুরালয়ের সর্বত্র ঘোরাঘুরি শুরু করেছিল।পন করেছে একটা আনাচ কানাচ ও ঢুঁ মারা থেকে বাদ দেওয়া চলবে না। চোখের সামনে জেব্রা দের আস্তানা পেরিয়ে সম্বর ,চিতল হরিণ এমনকি চলার পথে সুগন্ধি কস্তূরী মৃগ দের বন্য গাছ গাছালি ভরা বাসস্থান টি দেখা হলে সামনেই এক কাঠের ট্রেল ধরে হেঁটে প্রথমেই হাতী শালায় পৌঁছেছিল। খোলা নীল আকাশের তলে অনেকটা জায়গা জুড়ে লোহার তারের উঁচু প্রাচীরসম বেড়ায় ঘেরা খাঁচা। দুই জোড়া বিরাট চেহারার শ্লেট কালারের বিশাল হস্তী দম্পতি রাজা রানীর মত দুলকি চালে ঘুরছেন।
সামনের চওড়া করিডোর দিয়ে বিশাল এক ট্রাক ভরা খাবার ঢুকেছে যেন ,বিরাট মহল্লার বড়ো সরো এক সব্জি বাজার। যত রাজ্যের নানা প্রকার রাশাকৃত শাক সব্জি ,বিশেষ করে দেশের কলাগাছের মত দেখতে লালচে কাঁচা কলার কাঁদি সমেত গাছ গুলো ! শ্রীময়ী কে বেশ চিন্তায় ফেলে। এখানে কোথায় এত কলা গাছ হয় ? এবং যন্ত্রের সাহায্যে টুকরো করে সেই খাদ্য বস্তু তাদের বড়ো বড়ো চৌবাচ্চার মত কাঠের গামলা গুলোতে পরিবেশিত হচ্ছে। ও দের বিশাল প্রস্থর খন্ডের মত দেহের আড়াল থেকে টুক করে ছোট্ট বাচ্চা দুটো হাতী সুর দুলিয়ে পা তুলে দিব্যি দাঁড়িয়ে দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য,কত রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে কসরৎ দেখাতে ব্যস্ত। তাদের খেলা দেখলে বেশ বোঝা যায় ওরা রীতিমত ট্রেনিঙ প্রাপ্ত। একটু পরেই একটা ফুটবল গড়িয়ে নিয়ে তাদের খেলা শুরু হলো । | সারা জায়গাটা জুড়ে যেন দুটি ছোট্ট ছেলে হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। এদিক ওদিকে ছুটছে খাওয়ার ইচ্ছে বিন্দু মাত্র নেই ।
পেংগুইন পরিবার
এখান কার পথের প্রতিটি বাঁকে বা মোড়েই সতর্ক বার্তায় লেখা আছে যথাসাধ্য নীরবতা পালন করার নির্দেশ ,পশুদের টিজিং না করা বা কোনো খাদ্য দ্রব্য না দেওয়া। ঋষভ বলে এখানকার দর্শনার্থীরা,কত সুশৃঙ্খল সভ্য ,ওরা পশু পাখিদের বিরক্ত করে না। ওদের শান্তি বিঘ্নিত করতে জোরে চেঁচিয়ে কথা বলে অকারণে হুল্লোড় ও সৃষ্টি করে না। ..
বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতিতে সুসজ্জিত টিয়ারপার্কের পশুরালয় গুলোতে ঘুরে দেখতে গিয়ে শ্রীর মনে হলো এক অভাবনীয় ভয়ঙ্কর সুন্দরের সান্নিধ্যেএসে পরেছে । বাঘ ভালুক গন্ডার সিংহ প্যান্থার চিতা নেকড়ে জাতীয় প্রভৃতি সাংঘাতিক হিংস্র। ওরা হিংস্র ভয়ঙ্কর জানোয়ারের দল যে এমন এক আশ্চর্য্য মনোহরণকারী হবে, তা কখনো শ্রীময়ীর কল্পনাতে ও আসেনি। ইতিমধ্যে পাশের এক জঙ্গলে ঘেরা কৃত্রিম পাহাড়ের অন্ধকার গুহা থেকে বিশাল দেহী কালো হলুদ ডোরা কাটা গায়ের বাঘ মশাই রোষকষায়িত নেত্রে কয়েকবার হুঙ্কার ছেড়ে তার দর্শন প্রার্থী দের সচেতন করে দিয়ে গেলেন। এখানেও গভীর পরিখা কাটা ,এপারে ও সেই উঁচু জাল ঋষভ বলে ,এই বাঘ টি দেখ ,--এটি হলো ভারতীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার প্রজাতির।,
বাঘ সিংহ ,চিতাবাঘ,জাগুয়ার ,প্যানথার চারটি বিশালকায় শক্তি শালী পশু সদস্য দের মধ্যে এই শ্রেণীর বাঘ টি সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ,ফেলিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। পশুরালয়ের এই অঞ্চল বাঘেদের আড্ডা |.তারা সবাই তাদের স্বতন্ত্র ভূমিতে আপন শৌর্য্যে বিরাজমান। এখানে সাইবেরীয় ,মালয়েশিয়ার এবং সুমেত্রীয় বাঘেদের দেখা গেল। চিতা , জাগুয়ার,প্যানথার দের গুহা ও পাশাপাশি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ,| কালো কুচকুচে প্যানথার দুজনের যেন লড়াকু মর্জি ,এদের লাঞ্চে সম্ভবত আজ হরিণ ছিল কারণ দূর থেকেই দেখা গেল একটি হরিণের ঠ্যাং নিয়ে লড়াই চলছিল। শ্রীর মনে অদভুত এক প্রশ্ন আসে যে পশুদের এতো যত্ন করে রাখা হচ্ছে তাদের আহারের জন্যই আবার প্রতিদিন কত পশু কে মারা হচ্ছে। ,ঋষভ বলে খাদ্য আর খাদকের সম্পর্ক ,ওরা মাংসাশী প্রাণী ছাগল ,গরু ভেড়া শুয়োর হরিণ ওদের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন যোগান দিতেই হবে সে যেখান থেকেই হোক আসবেই।
চিতা
আরেকটি এমনই এক কৃত্রিম পাহাড়ের গুহা গাত্র থেকে উদয় হলেন কুচকুচে কালো লোমশ ,পালোয়ান টাইপের পুরুষ ভাল্লুক সোজা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । ভাল্লুকের ডেরায় এসে কার্ডের গায়ে নামটা খেয়াল করে ঋষভ বলে দেখ , আমুর বাদামী ভাল্লুক লেখা আছে , আর এক জায়গায় উসুরি বা কালো গ্রিজলি নাম। আরেকটি গুহার সামনে ভাল্লুকটির নাম লেখা আছে কামচাটকা। কিছুদিন আগেই ঋষভ এক বিদেশী শিকারী লেখকের গল্পে পড়েছিল কামচাটকা উপদ্বীপের নামানুসারে এই ভালুকটি নামকরণ করা হয়েছে। কিছু বিরল প্রজাতির মেরু ভালুক বা শ্বেত ভালুক আছে ,যারা ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে চলেছে পৃথিবী থেকে | খুব চেষ্টা চলছে তাদের বংশ বৃদ্ধি করানোর এবং প্রজনন ঘটানোর। সবচেয়ে আশ্চর্য্য লেগেছিল পোলার বিয়ার দেখে। কৃত্রিম বরফের পাহাড় ,বরফের গুহায় মেরুভালুক বা পোলার বিয়ারের দু তিনটে বাচ্চা সমেত মা ভাল্লুকটি ।দুই তিন মাসের ভালুক ছানা দু টি লোমশ এক কুকুরের বাচ্চার মত দেখতে। সাদা ধবধবে মা টি এর সাথে হালকা গোলাপি রঙের বাচ্চারা বেশ খেলে বেড়াচ্ছে। ওদের দেখভাল করার জন্য সদা সতর্ক চিড়িয়াখানার কর্মীটি টাইমলি বাচ্চাদের বটল ফিডিং করিয়ে যাচ্ছে।
ঋষভ বলে তেমনি আছে বিরল প্রজাতির পাখি ,সরীসৃপ আর আর্কটিক নেকড়ে। পর পর গুহা বা বন দেখে চলেছি---কোথাও কৃত্রিম নদী বা ঝর্ণা, কোথাও উঁচু নীচু পর্বত শ্রেণীগাত্রে গুহা কোথাও সমতল কোথাও বা গভীর অরণ্য |.এরই মাঝে চলেছে মেঘ রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা মাঝেমাঝেই কনকনে শীতল হাওয়ার ঝাপ্টায় দিশেহারা লাগে | কিন্তু এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃস্টি করে বন্যদের বনেই অপরূপ সুন্দর করে রাখা হয়েছে তাকে মন প্রাণ ঢেলে উপভোগ না করলে কিছুতেই মন ভরবে না । এবার আরো একটি লম্বা ট্রেল পার হলে বাঁ দিকে বেঁকে এক জলাশয়ে ডোবায় নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে ভুষো কালো পাথরের খন্ড। ঝুপ ঝুপ করে শব্দ হওয়ায় চমকে শ্রী তাকিয়ে দেখে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই নয় কাদায় ভরা ডোবায় নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে তিনটি জলহস্তী, ওরা একটি ফুটবল নিয়ে জলকেলিতে মত্ত । এদের মধ্যে একজন আবার একটি বড় আস্ত বাঁধাকপি কে বিরাট হাঁ মুখ করে একবারে গেলায় ব্যস্ত।
আবার এগিয়ে একটু উঁচু ঢিবিতে বসে থাকা এক লাল পান্ডা কে দেখে সানগ্লাস খুলে উৎসাহী চোখে শ্রীময়ী তাকাতেই বিপন্ন প্রজাতির জায়েন্ট পান্ডার যমজ বাচ্ছা দুটোর আপন মনে গাছের ডাল ধরে খেলা ওর মন কেড়ে নিয়েছিল। গাইড ম্যাপেই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে লেখাছিল এই বিরল প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ থেকে কর্মীবৃন্দর কর্ম তৎপরতা ,ওদের নার্সিং ঘন্টা মিনিট মেপে খাওয়ানো ,তাপমাত্রা ইত্যাদির দেখভাল। রাস্তা পার হয়ে শুকনো পাতা ওড়ার সাথে ঋষভ পেঙ্গুইনের খাঁচার সামনে এসে হেসে অস্থির। শ্রী কে বলে দেখো কেমন আশ্চর্য্য ব্যাপার !খাঁচার গায়ে লেখা এরা সমকামী পেঙ্গুইন। সমকামী দুইপুরুষ পেঙ্গুইন দম্পতি একটি সাদা গোল পাথর কে ওদের ডিম ভেবে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে মাতৃ স্নেহে লালন করছিল। ওদের কান্ড দেখে উপস্থিত জনতারাও হতবাক , এযে ভারী মজার ব্যাপার ।
এরপরে ক্যাঙ্গারুর ঘর। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে তারা সদ্য এসেছে। ক্যাঙ্গারু কেমন করে পেটের থলি তে তার শাবক টিকে অপত্য স্নেহাদরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে সেখানে বেশ খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে থাকাতে দেখাগেল ক্যাঙ্গারু সপরিবার বাচ্চা তার থলিতে ভরে এনে বিশেষ দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে যেন সদলবলে গুড আফটার নুন জানাচ্ছে ।
🍂
পথ ও শেষ হয় না খাঁচার ও শেষ নেই। ওরা ব্যাঙ জাতীয় উভচর প্রাণী দের ডেরায় চলে এল। এদের মধ্যে সাইরেন সালামান্ডার ও নিউট এরা লেজ যুক্ত উভচর এদের কাউডাটা বলে। এবার কচ্ছপের রাজত্বে ঢাউশ দেহ নিয়ে কয়েক জন নিশ্চিন্তে নিদ্রা মগ্ন। কয়েকজন আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে গুটিগুটি নড়া চড়ায় ব্যস্ত নিজের অচলায়তন খোলসের মধ্যে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। চলার পথেই পড়লো স্বচ্ছ এক নীল জলের হ্রদের বুক চিরে ফোয়ারার জল সাঁইসাঁই করে অনেক উঁচু পর্যন্ত উঠে হ্রদের মধ্যেই আছড়ে পড়ে ছোট্ট ছোট্ট তরঙ্গে এগিয়ে চলেছে। .শ্রী আনন্দে মশগুল ,বালিকা সুলভ উল্লাসে ঋষভের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে সেখানে। এবং আরো অবাক জলের মধ্যেই পার্কের স্লিপের মত করা , তিন চারটে ডলফিন মিউজিকের তালে খেলছে নাচ্ছে। ওরা স্লীপ চড়ে নীচে নামছে উঠছে। , ওদের রুপালি শরীরে সূর্যের আলো পড়ায় মনে হলো তরল রূপালী স্রোত গড়িয়ে চলেছে। নয়ানাভিরাম সে দৃশ্য যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। শ্রী বলে তিতির থাকলে বেশ হতো। .
. অসংখ্য প্রজাতির কীট পতঙ্গ প্রজাপতির জন্যও পার্ক এ বিশেষ একটি অংশে কৃত্রিম পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে ফল ফুলের সাথে নানা রূপ অর্কিডের বাগান বানিয়ে সংরক্ষন করা হয়েছে মৌমাছি ,শুঁয়োপোকা ,মনার্ক প্রজাপতি,মাকড়সার ছাড়াও বহু বিচিত্র ধরণের পতঙ্গ মথ গুটিপোকা গঙ্গাফড়িং জাতীয় বিশেষ ধরণের কীট পতঙ্গ। এখানে নানা উপায়ে সংগ্রহ করে তাদের রক্ষনা বেক্ষণ ও পরিচর্য্যা করে সংখ্যা বৃদ্ধি করে তোলা হচ্ছে।
কৃত্রিম পাহাড়
এবারে এসেছিলাম এখানের আর একটি প্রধান উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় পৃথিবীর বৃহত্তম য়্যাকুরিয়াম দেখতে। সংরক্ষিত এই মাছের একোরিয়াম দেখার জন্য আলাদা মূল্যের টিকিট কাটতে হয়েছিল। মনে পড়ে বেশ লম্বা লাইন দেখে হতাশ হয়ে সবার শেষে দাঁড়িয়ে শ্রী ভাবছে বুঝি শুধুই দাঁড়ালাম কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লাইন ফাঁকা হয়ে গেল। সেখানে ৫৬২ টি প্রজাতির মাছ রয়েছে। মাছের সংগ্রহ শালায় নানা রকম রঙিন মাছের দল কাঁচের ঘর আলো করে খেলে বেড়াচ্ছে গোল্ডেন ফিশ ,টাইগার ,ফাইটার , সোর্ডটেল, ষ্টার ,সার্ক,স্যামন সার্ডিন , রেডবেলি পিরানা পর্ন জেলি ফিশ কত রকমের মাছ যে পরিচিত এবং অপরিচিত মাছের খোঁজ পেয়েছিলাম তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি শীল দের ঘরে বিশাল জায়েন্ট শিল দু টি চোখ বুজে যেন দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে এখন দিবানিদ্রা দিতে ব্যস্ত। কুমীরের চৌবাচ্চায় আধবোজা চোখে গোটা ছয় সাত কুমির মুখ হাঁ করে আছে অথবা ঘুমভেঙ্গে নিশ্চিন্তে রোদ পোহাচ্ছে।এখানেও বিশাল আকারের কচ্ছপ গুলোও আপন মনে নিঃসাড়ে কালো পাথরের মত পরে আছে। দেড়শো দুশো বা তার ও বেশী দু তিন জনের বয়স লেখা আছে তারা নিশ্চিন্তে সুখ নিদ্রা মগ্ন। শ্রী একাকী আপন মনে হাসে চোখ বুজলেই এখনো ও যেন দেখতে পায় উন্মুক্ত নীল জলের ঝর্ণা ধারায় ডলফিনের সেই ভুবন ভোলানো নাচ। আহা !তিতির যদি সঙ্গে থাকতো তাহলে বেশ হতো।
0 Comments