চতুর্দশ পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
তারপরের দিনগুলি বেশ কেটে গেল, হেসে খেলে, কাজকর্ম শিখে। বাপের বাড়িতে তেমন গল্প গুজবের অবকাশ ছিলনা বিরজার, তাদের বাড়িটি ছিল গ্রামের একটেরে, বাড়ির মানুষজনও ছিলেন একটু গোঁড়া। তাছাড়া বাড়িতে ছোট দাদা ছাড়া সমবয়সী কেউ ছিলও না। তাই হয়তো কাজকর্ম শেষে তার সঙ্গে বই পড়তে বসতো তারা, বেশ কেটে যেত সময়।
এ বাড়িতে তার কোন উপায় ছিলনা।
এ বাড়িতে সবসময় লোকজন হৈ হৈ করছে, গল্প করছে, ঝগড়া করছে, কাজ করছে, সবার মধ্যেই কেমন যেন ব্যস্ত-সমস্ত ভাব।
এসে অবধি নববধূ অবাক হয়ে সেসব দেখতো, শ্বাশুড়ী মাও এখানে এসে কেমন গুছিয়ে রান্না করছেন, খেতে দিচ্ছেন, ঘোমটা দিয়ে পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন…
গ্রামে গঞ্জে এসময় অষ্টম প্রহর বা চব্বিশ প্রহর জুড়ে হরিনাম সংকীর্তন হয়, সেখানে মালসা ভোগ পাঠাতে হয়, বিশেষভাবে। শ্বাশুড়ীমা-খুড়িমা মিলে বাড়ির নতুন বৌটিকে তার তালিম দিলেন…
এছাড়াও,বছরের শেষ দিনটির আগের দিনে বাংলার ঘরে ঘরে সকালবেলা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে আঁশবটি ছুঁয়ে সারা বছর সুস্থ থাকার কামনা,ঘেঁটুফুল সাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায়, সন্তানের কল্যাণে শিব পুজো এবং ষষ্টীব্রত পালন ইত্যাদি লোকাচার পালিত হয়। বিরজার জানা ছিল সেসব।
শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখলে, নতুন জলভরা কলসে কাঁচাবেল এবং আরও যা কিছু ফল-পাকুড় সাজিয়ে ব্রাহ্মণকে দান করা হচ্ছে। ননদিনীর সঙ্গে সেও এই ব্রত পালন করলে এবং শিখলে,
“ক্ষ্যাপার সাত, ক্ষেত্র তেরো;আর সব বারো- বারো”-অর্থাৎ শিব পুজো শুরু করলে পরপর সাত বছর অবশ্যই করতে হবে, দূর্গার ব্রত করলে তের বছর। সত্যিই, এতো বড়ো দেশ আমাদের, কতো কতো তার আচার-বিচার। শিখতে জানতে হয়তো একটা গোটা জীবনই কেটে যায়।
অতঃপর,নীলষষ্টির সকালে যখন সবাইকে নিয়ে বাটা সাজিয়ে টুকটুকে লালপাড় গরদশাড়িটি পরে মা দেবদেউলে গেলেন, কী সুন্দর লাগছিল তাঁকে! যেন সত্যিকারের দুগ্গা মা! ঘোমটার আড়াল থেকে মায়ের কোলের কাছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে বসে হাঁ করে দেখছিল সে। মা আর সব প্রতিবেশিনীদের ডেকে ডেকে তাকে দেখাচ্ছিলেন, ঠুতনী ধরে সবাই আদর করছিল তাকে, ভালো লাগছিল বেশ। তবে,গোল বাধলো খানিক পরে। মেয়েমহলের মধ্যেই কে যেন বলে উঠলো,
-’তা, হ্যাঁ গা বৌমা! তোমার বৌ কাজ কাম কিছু পারে! নাকি শুধুই পুতুল!’
-’কি যে বলো খুড়িমা! এত্তোটুকু মেয়ে… ! তবে কাজে ওর আগ্রহ খুব।’
মনে আছে, তারপরেই বুড়ি সরাসরি তাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল,
-’ও নাতবৌ! বামুন ঘরের মেয়ে তো;বল দেখি, নীলের বারে কিসের প্রদীপ জ্বালে!’
তখনকার দিনে, নতুন বৌকে, তা সে যত ছোটই হোক না কেন, প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করার একটা প্রবণতা ছিল গিন্নীবান্নীদের; আজকের পাকাগিন্নী বিরজাসুন্দরী বোঝেন, আগামী জীবনের অযুত সমস্যা এবং রুক্ষতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তার সুকুমার মন টিকে আঘাত সহ করার জন্য তার প্রয়োজনও ছিল।
কিন্তু তখনকার বিরাজ তো এতো বুঝতো না। কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যা, বাড়িতে পুজো পাঠের চল তো ভালোই, প্রতি বছর এই দিনে ওই তো জ্যাঠাইমার পুজোর জোগাড়ে সঙ্গে থাকে। ও তো জানে, নীলের বারে ধুতুরা ফলের বীজের খোল দু ফাঁক করে ফালা করে দীপ জ্বালিয়ে বলতে হয়,
“শিবের ঘরে দিয়ে বাতি, জল খায় গো পুত্রবতী’’
ও তো জানেই এসব। কথা বলতে ছোট্টো থেকেই ভালোবাসে, সুযোগ পেয়েই তড়বড়িয়ে বলতে শুরু করলে,
‘আমাদের বাড়িতে তো জোড়া শিবের থান আছে, শীতলা মন্দির আছে, ঠাকুর পুকুর আছে। তার পাড়ে বড় বড় শালবল্লী বেঁধে তলায় আগুন জ্বালিয়ে হিঁদোলা হয় এমন সব চৈত্র শেষের দিনগুলিতে,মেলাও হয়, আমরা সবাই দল বেঁধে মেলা যাই। তারপরেতারপরে, নীল ষষ্টীর দিন ঠাকুর পুকুরে বান ভিজিয়ে জিভফোঁড়া হয়, সে এক দারুণ ব্যাপার। মানুষের জিভে গর্ত করে শিক গাঁথা হয়, তেমন অবস্থায় বেশ খানিকটা পথ গিয়ে বিশালাক্ষী মন্দিরের পুকুরে শিক খোলা হয়। সারা পথ রক্তে ভিজে যায়,আমার না ওসব দেখে বড়ো কষ্ট হয়, তাই দেখিনা কখনো। তবে এটাও সত্যি, কেউ কিন্তু ব্রত রেখে আজ পর্যন্ত অসুস্থ হয়নি।’
🍂
কচি মুখে এসব পাকা পাকা কথা শুনতে শুনতে পাড়ার অন্যান্য মেয়ে-বৌরা আরও কতো কি বলাবলি করছিল।ওদের মধ্যে আরও কারো কারো নিজের বা আত্মীয়বাড়িতেও গাজন, জিভফোঁড়া এসব হয়।
তারই মধ্যে ঐ ঠাকুমার আবদারে,বাবার বাড়িতে যেভাবে করতো, সেভাবেই ওখানকার মন্দিরের পাশের ধুতুরা ফল কাঠারি দিয়ে কেটে, প্রদীপ বানিয়ে বাড়ি থেকে আনা কাপাস তুলোর লুটি পেড়ে তা দিয়ে সলতে পাকিয়ে ঘীয়ে ডুবিয়ে উপস্থিত সব মায়েদের দীপ জ্বালিয়ে দিলে পরিপাটি ভাবে, সবাই ধন্য ধন্য করেছিল, আশীর্বাদও করেছিল। যদিও এসব করতে করতেও ওর মন তখন পড়েছিল, বাপের বাড়ির পুজোয়। ওখানেও তখন নিশ্চয়ই পুজো হচ্ছে… বৌদিদি, খুড়িমার তো রান্না বান্না,ঘরকন্নার অনেক কাজ;জ্যাঠাইমা কি একা পুজোর সব কাজ করে উঠতে পারছে! কষ্ট হচ্ছে না তো জ্যাঠাইমার! নীলের বারে জ্যাঠাইমার সঙ্গে পুজো সেরে এসে ফল পাকুড় সাজিয়ে ফলাহার নৈবেদ্য সাজানোর কথা মনে পড়ছে খুব…
আরও মনে পড়ছে ওদের জোড়া শিব মন্দিরের কথা, শেতলা থানে মানত পুজোর কথা,মন্দিরের পাশেই পলাশ ফুলের গাছটির কথা;এই সময় কমলা কমলা থোকা থোকা ফুলে যে আগুন লাগিয়ে দেয় আশেপাশে,তার ডালে বসে লাগাতার কুহু কুহু ডেকে যায় কোকিলের দল…
ওদের ছেড়ে এসে বড়ো মনে পড়ছে ওদের কথা।
হায় রে নারী জীবন! এক বাড়িতে জন্ম,বেড়ে ওঠা, আরেক বাড়িতে যাপন সারা জীবন। তারই মধ্যে বয়ে নিয়ে যেতে হয় হাসি কান্না, সুখ-দুঃখের ভার।
0 Comments