জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক শঙ্করীপ্রসাদ বসু / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক শঙ্করীপ্রসাদ বসু
    
নির্মল বর্মন

গবেষক অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু বাংলা সাহিত্যের একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ও মহান মানবিক মুখ। বস্তুতঃ কালজয়ী ব্যতিক্রমী  জীবনবোধ, কার্যক্রম, গবেষণালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি  বলিষ্ঠ ভাবনায় আন্তরিক। সাহিত্যিক অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু ২১ শে অক্টোবর ১৯২৮ এ হাওড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাশ করেন। চাকরি জীবনে প্রবেশ দ্বার হাওয়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশান । পরে দীনবন্ধু কলেজ (হাওড়া), তারপর হাওড়া গার্লস কলেজে কিছু কাল পড়িয়ে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের সিটি কলেজেও কিছুদিন যাবৎ চাকরি করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকাপোক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ছিলেন।অবসর গ্ৰহন করে প্রাবন্ধিক বসু রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের স্বামী বিবেকানন্দ অর্কাইভের ডিরেক্টর । পরবর্তী সময়ে 'নিবেদিতা চেয়ার'এ বসে ছিলেন। অধ্যাপক প্রাবন্ধিক শঙ্করীপ্রসাদ বসু যৌবনে ক্রিকেট ও টেনিস খেলতে পছন্দ করতেন। প্রাবন্ধিক রূপে বসু সাহেবের কৃতিত্ব অবদান বিদগ্ধ মহলে সুবিদিত । ২০১৪ সালের ৬ জুলাই রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু মহোদয়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ''মধ্যযুগের কবি ও কাব্য'' (১৩৬২)। প্রাবন্ধিক স্বয়ং ভূমিকায়  লিখেছেন:-
"আমার উদ্দেশ্য কাব্য-সমালোচনা-সাহিত্যের ইতিহাস-রচনা নয়। সে কারণে সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাধান্য পাইয়াছেন এমন অনেক কবি আমার আলোচনার বাহিরে আছেন"।
সাহিত্যিকের ভাষারীতির মধ্যে কালজয়ী বৈপরীত্যের মধ্য দিয়ে স্বাদুতা সৃষ্টি হয়, সে বিষয়টি  গ্রন্থ রচনায় তাঁর প্রিয় শিক্ষক  জনার্দন চক্রবর্তীর ঋণ গ্রহণের সূত্রে প্রকাশিত:-                                                                        "ঋণ গ্রহণের ছাত্রকৃত্যে আমার চেষ্টার অভাব ঘটে নাই এবং ঋণশোধের অসাধ্য প্রয়াস বুদ্ধিমানের মত ত্যাগ করিয়াছি।” 
বস্তুতঃ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু'র "মধ্যযুগের কবি ও কাব্য" গ্রন্থে 'বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, বড়ু চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরাম দাস, শেখর'  বৈষ্ণব পদকর্তা ও বৈষ্ণবকবির সুনিবিড় আলোচনা অবশ্যই করেছেন, তেমনি চৈতন্যজীবনীর সুনিবিড় কাব্যকথাকার বৃন্দাবন দাস ও  কৃষ্ণদাস কবিরাজ  এর তুলনামূলক সমালোচনা প্রণিধানযোগ্য । প্রাবন্ধিক বসু বৈষ্ণব পদকর্তাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তুলনামূলক সমালোচনা মধ্যযুগের সাহিত্য সমালোচনা এই গ্রন্থে চির স্মরণীয় থাকার সুব্যবস্থা। ফলতঃ উপস্থাপন ভঙ্গি ও কালজয়ী ভাষাশৈলী আকর্ষণীয়। উদাহরণ ''কৃষ্ণদাসের কাব্যে শ্রীচৈতন্য'' শিরোনাম অধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-
              "প্রাণ জাগিলেই গান জাগে। মধ্যযুগে সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপ্ত করিয়া যেন একটা সঙ্গীতের আসর বসিয়াছিল। ঘরকে বাহির এবং বাহিরকে ঘর করিয়া বাংলাদেশের সুরোন্মত্ত মানুষগুলি বিশ্বজীবনের মহাপ্রাঙ্গনতলে সেই সুর-সভায় আসিয়া মিলিত
হইল। উপরে অনন্ত নীলাকাশ-নীল কৃষ্ণ; তাহার উপর রাধাচন্দ্রাবলী-ভুল হইল; চৈতন্যচন্দ্রোদয় হইয়াছে। বাঙালীর ভাবের উচ্ছ্বাস, রসের উল্লাস ও আনন্দের উৎসার বাধা মানে নাই। প্রাণ যে জাগিয়াছে-মহাপ্রাণ, মহাগান তো জাগিবেই।শ্রীচৈতন্যই সেই প্রাণ-বৈষ্ণব সাহিত্যই সেই গান। মহাজীবনের মহাসঙ্গীতে বাংলার একযুগের সাহিত্য মন্দ্রমুখর।"
অধ্যাপক বসু'র ''চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি'' (১৯৬০) পুস্তকটিও  'বৈষ্ণব সাহিত্যের তুলনামূলক' ভাবনা চিন্তার‌ ঐতিহ্যমন্ডিত আকরগ্রন্থ।

🍂

প্রাবন্ধিক অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বস'র ''নিবেদিতা লোকমাতা''-(চার খণ্ড ১৯৬৮) গ্রন্থটি 'নিবেদিতার জীবন ও তাঁর সেবাপরায়ণতা, আদর্শবোধ'- এর বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণী মনোভূমি অবিস্মরণীয় ।
সাহিত্যিক শঙ্করীপসাদ বসু'র ''বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ'' (সাত খণ্ড) বইটির জন্য ১৯৭৮ সালে "সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার" লাভ করেছিলেন। দেশ কাল , সমাজমনস্ক ভাবনা চিন্তার প্রেক্ষিতে _'স্বামীজীর চিন্তাধারা, আদর্শ ও কর্মপন্থা এবং সাহিত্য সৃষ্টি' বিষয়টি চিরস্মরণীয় । বর্তমান সময় ও সমাজে বিবেকানন্দ চর্চার ইতিহাস এই  স্মারক গ্রন্থ। বস্তুতঃ এই স্মারক গ্রন্থটি ছয় ছয়টি পুরস্কারে সম্মানিত ও আপ্লুত।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম কান্ডারী শঙ্করীপ্রসাদ বাবুর ''কবি ভারতচন্দ্র'' গ্রন্থটি মূলতঃ 'ভারতচন্দ্রের কবিসত্তা ও কাব্যের মূল্যায়ন' চিত্রিত। এই অভিনব মূল্যায়ন যেমন বিখ্যাত তেমনি  ভারতচন্দ্রের কাব্যপ্রতিভা'র  বিচার বিশ্লেষণও উপাদেয় ও সুস্বাদু।
 অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু'র ''সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র'' (দুই খণ্ড) পুস্তকটি 'সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে অনবদ্য গবেষণা' ও আকর্ষণীয় গ্রন্থ। অধ্যাপক বসু'র ''বাছাই ক্রিকেট'' গ্রন্থটিও ক্রিকেট রসিক জনের  নজর কাড়ে।
      সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু  আজীবন রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ বিষয়ক গবেষণা করে গেছেন। সাহিত্যের প্রতি সুনিবিড় কাজ কর্মের জন্য ১৯৭৮ এ 'সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার"পেয়েছেন। "আনন্দ পুরস্কার" -১৯৭৯,"শরৎ পুরস্কার"-১৯৮০,"বিবেকানন্দ পুরস্কার",১৯৮৬,নিউ ইয়র্কে র "বিবেকানন্দ সোসাইটি শতবর্ষী পুরস্কার",প.ব সরকারের 
বিদ্যাসাগর পুরস্কার এ ভূষিত ও আপ্লুত হলেও কালের অমোঘ আকর্ষণে ধীরে ধীরে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকার সম্ভবনা থেকেই যায়,যাকে আধুনিক ভাবনায় বলা যায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments