জ্বলদর্চি

শ্লীলে-অশ্লীলে জীবনের মহারথী কালকূট' - সমরেশ বসু /প্রসূন কাঞ্জিলাল

শ্লীলে-অশ্লীলে জীবনের মহারথী কালকূট' - সমরেশ বসু

প্রসূন কাঞ্জিলাল


স্নেহশীল দাদা মন্মথ বসুর কাছে ছোট্ট সমরেশ ছিলেন ‘প্রবলেম চাইল্ড’। স্কুলের পড়াশুনোয় একেবারে মন ছিল না। বাকি সব কিছুতেই ছিল প্রবল উৎসাহ। থিয়েটার করা, বাঁশি বাজানো। এমনকী ছবি আাঁকার হাতটিও বেশ পাকা। কিছু দিন ফুটবল নিয়ে মাতামাতি চলল, তো তার পরেই শুরু হল ব্যায়ামাগারে যাওয়া। গঙ্গায় সাঁতরানো। ক্লাস নাইন হল কি শুরু হল গোপন ধূমপান। প্রেম। আর ক্লাস টেনে-এ উঠতে না উঠতেই নৈহাটির ভিটে ছেড়ে প্রেমিকা গৌরীকে নিয়ে পিঠটান। সোজা আতপুর। সংসার জীবনের অকাল বোধন। তাঁর আবাল্য বন্ধু, সহপাঠী, পরবর্তী জীবনে এক প্রাবন্ধিকের কথায়, 'সমরেশ যা কিছু করেছে সারা জীবনে, তার মূল কথা হল কেটে বেরিয়ে পড়া। ... মধ্যচিত্ততার দায়ভাগ ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া। অমরনাথ যাত্রা, মোটর রেসে যোগ দেওয়া, মরুভূমিতে তাঁবু নিয়ে চলে যেতে চাওয়া - সব কিছুর মূলে রয়েছে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা।’ বিবাহিতা, স্বামী পরিত্যক্তা, তাঁর থেকে বয়সে বড় গৌরীকে নিয়ে ঘর বাঁধার মধ্যেও রয়েছে সেই একই রকমের চ্যালেঞ্জ।
   আতপুরে সমরেশের জীবন এক বড় বাঁক নেয়। জগদ্দল-আতপুরের শ্রমিক পাড়া, জীবিকার জন্য লড়াই নৈহাটির কাঁঠালপাড়ার দিনযাপনের থেকে বহুলাংশেই আলাদা। ইছাপুরের বন্দুক কারখানায় একটা চাকরি পেলেন। তাও কিনা আঁকতে জানেন বলে। এ অঞ্চলের কিংবদন্তি নেতা তখন সত্য মাস্টার। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন। ওঁর কাছেই সমরেশের রাজনীতির পাঠ। সমরেশকে ছবি আঁকা থেকে লেখালেখির জগতে নিয়ে আসেন তিনিই। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে, সত্য মাস্টারের সঙ্গে সমরেশের সাক্ষাৎ বাংলা সাহিত্যেরই এক মাইল ফলক। এক শোচনীয় বিস্ফোরণে সত্য মাস্টারের মৃত্যু হয়।
   দুশোরও বেশি ছোট গল্পর মধ্যে সমরেশ বসুর লেখা প্রথম গল্পটি হল ‘আদাব’। প্রায় একশোটি উপন্যাসের মধ্যে প্রথমটি ‘নয়নপুরের মাটি’।
  ১৩৭৪ সনে শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘প্রজাপতি’। তাকে অশ্লীল বলে নিষিদ্ধ করার আর্জি জানিয়ে ১৯৬৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি মামলা করেন এক তরুণ আইনজীবী অমল মিত্র। সমরেশ বসুর পক্ষে সেই মামলার প্রথম ও প্রধান সাক্ষী হন সাহিত্যিক অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসু।
  সমরেশ বসুর প্রয়াণ ১৯৮৮ সালের ১২ই মার্চ। ১৯৮৭ সাল, সমরেশ বসুর দীর্ঘ প্রতীক্ষিত রামকিঙ্কর বেজ-এর জীবনভিত্তিক সুদীর্ঘ উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে। মাস ছয়েকের মধ্যে উপন্যাস বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছে। সমরেশ বসু যাদবপুরে থাকতে এলেন তাঁর পুত্র নবকুমার বসু'র কাছে। তখন তাঁর শরীর ভাল যাচ্ছে না। দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এ দিকে বিগত আট-দশ বছর ধরে সমরেশ প্রায় চিরুনি তল্লাশির মতো তন্নতন্ন করে রামকিঙ্করের জীবন, মেধা-মনন ও সময় সম্পর্কে তথ্য আহরণ প্রায় সম্পূর্ণ করে এনেছেন। আর ঠিক সেই সময়ই শরীর বাধা হয়ে দাঁড়াল। নবকুমার তখন প্রান্তবাসী। নবকুমার বসু ও তাঁর স্ত্রী রাখি বসু দু’জনেই চিকিৎসক। যাদবপুরে নবকুমার বসুর শ্বশুরালয় সংলগ্ন জমিতে একটি ছোট নার্সিংহোম রয়েছে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ তাঁরাই করতেন। ওই নার্সিংহোমে বিদেশ থেকে নেবুলাইজার পাম্প সহ আরও বেশ কিছু উন্নত যন্ত্রপাতি তাঁরা এনেছিলেন। সেই সময় সমরেশ বসুর চিকিৎসা করতেন কলকাতার নামী চিকিৎসকরা। সমরেশের শ্বাসকষ্টের জন্য ওগুলো ব্যবহার করা হত খ্যাতনামা ডাক্তারদের পরামর্শে। মানুষটা বেশ স্বস্তি পেতেন তাতে, আর তাঁর পরিবারও।
   'দেখি নাই ফিরে’-র শেষ কয়েকটি কিস্তি সমরেশ লিখেছিলেন তাঁর পুত্রের নার্সিংহোমে বসে। খামে করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে নবকুমার নিজে গিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সাগরময় ঘোষের হাতে দিয়ে আসতেন। লেখকের শারীরিক অবস্থার জন্য সম্পাদকের মুখে উদ্বেগের ছায়া নবকুমার পড়তে পারতেন। সমরেশের তখন সান্ধ্য আড্ডা, কিঞ্চিৎ মদ্যপান সবই প্রায় বন্ধ। শুধু ডাক্তারদের বারণের জন্য নয়, ও সবে তাঁর আর ইচ্ছে নেই সেটা সকলেই বুঝতে পারতেন। সকলে চেষ্টা করতেন যতটা সমরেশকে যত্নে রাখা যায়, নিয়মে রাখা যায়। পুত্র নবকুমার বসুর ভাষায়, "কারণ তিনি আমার বাবা হলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সাহিত্যিক সমরেশ বসু, তিনি কালকূট— বহু জনের কাছের মানুষ। তাঁর সুচিকিৎসা করা আমার বড় দায়িত্ব।"

🍂

   রামকিঙ্কর বেজ ছাড়া সমরেশের মাথায় তখন আর কিছু ছিল না। কোথায় যেন একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলেছিলেন। জীবনধর্মী উপন্যাস লেখার একেবারে পরিকল্পনাপর্বে সত্যজিৎ রায় পরামর্শ দিয়েছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখার জন্য। সমরেশ ভেবেছিলেন, কিন্তু স্থিতধী হয়েছিলেন নিজের ভাবনা ও উপলব্ধির উপর। মানুষ এবং শিল্পী হিসেবে রামকিঙ্কর অনেক বলিষ্ঠ চরিত্র বলে সমরেশ মনে করেছিলেন। তিনি বলতেন, ‘‘রামকিঙ্কর‌‌‌‌‌‌‌‌ যেন এক বিশাল ঠাকুরের মূর্তি আমার ঘাড়ে... বিসর্জন দিতে পারব, না কি দিতে গিয়ে আমিই তলিয়ে যাব...ভাবি মাঝে-মাঝে।’’ আরও একটি কথা বলতে শুরু করেছিলেন, ‘‘শান্তিনিকেতন এবং তখনকার নানান লোকজন সম্পর্কে যে সব তথ্য পেয়েছি ... কাহিনী ঘটনা হিসাবেও সে সব সাগরদা দেশে ছাপতে পারবেন কি না কে জানে?’’ 
তৃতীয় পর্ব  ‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলা’য় শুরু হচ্ছে রামকিঙ্করের পূর্ণ যৌবন কালের কথা। এই বারেই তো সেই সব কথা আসবে। নবকুমার বলেছেন, "আজ ভাবি, ঈশ্বরের কী বিচিত্র বিচার! এই তৃতীয় পর্ব সূচনার গোড়াতেই বাবার কলম থেমে গেল। অসমাপ্ত থেকে গেল বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী নির্মাণ। জানতে পেরেছিলাম ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসের পাঁচটি পর্বের নামকরণ করেছিলেন এই রকম, ‘আরক্ত ভোর’, ‘সকালের ডাক— বিশ্বঅঙ্গনে’, ‘রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ বেলা’, ‘ছায়া দীর্ঘতর’ এবং ‘অন্ধকারের আলো’। 
রামকিঙ্করের জীবনের গতি ও চলন অনুযায়ী ওই নামকরণ ও পর্বভাগ।"
   নবকুমার জানিয়েছেন, "সমরেশ বসুর জীবনের শেষ দিকের কিছু দিন আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। কোনও এক অজানা কারণে এই তৃতীয় সন্তানটিকে কৃতজ্ঞ করতেই বুঝি খ্যাতনামা মানুষটি আমাদের কাছে থাকতে এসেছিলেন। বাবা হিসেবে তাঁর সঙ্গে আমার কোনও দিনই আদিখ্যেতা মেশানো মাখোমাখো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বাবা-মা’র চরম দারিদ্র্য আর কষ্টের জীবনের চারটি খুদে সহযাত্রী ছিলাম আমরা চার ভাইবোন।" 
 কেমন ছিল সেই সব দিন?
উত্তর ২৪ পরগনার শ্যামনগর এবং জগদ্দলের মধ্যবর্তী গঞ্জ এলাকা, আতপুর। একটি আধা বস্তির দেড় কামরা টালির চালের নীচে ছিল সমরেশ বসুর পরিবারের ছ’টি প্রাণীর বসবাস। ঘরের চেয়ে বাইরে-বাইরে ঘুরে বেড়ানোতেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। কেননা টালির ঘরের ফাটা মেঝের উপর জলচৌকি রেখে দোয়াতে ডোবানো কলম দিয়ে সমরেশ লিখতেন। ঘরের উলটো দিকে একফালি খোলা বারান্দায় তোলা উনুনে (ভাঙা বালতির উপর মাটি লেপে বানানো) তাঁর স্ত্রী গৌরী বসু রান্না করতেন। মাঝে মাঝে দু’-চার পাতা লেখা কাগজ নিয়ে সমরেশ উঠে যেতেন স্ত্রী'র কাছে। উবু হয়ে বসে, লেখা পড়ে শোনাতেন গৌরীকে। তিনি মতামত দিতেন লেখা শুনে।
   গৌরী বসু সন্তানদের মাঝেমধ্যেই স্মরণ করিয়ে দিতেন, ‘‘তোদের বাবা একজন লেখক।’’ 
কিন্তু লেখক কী বস্তু! নবকুমার জানিয়েছেন, "সেই ছোট বয়সে কোনও ধারণা ছিল না এই ‘লেখক’ শব্দটি সম্পর্কে। অথচ বাবার সেই পরিচয় দিতে গিয়ে মায়ের চোখেমুখে একটা গৌরবের আলো যাতায়াত করত। এখন কেন যেন মনে হয়, আমার অবচেতন মনে সেই গৌরবের আলোর প্রতিফলন ঘটেছিল। পরবর্তী কালে, হয়তো সেই আলোতেই আমি ব্যক্তি ও লেখক সমরেশ বসুকে একটু একটু করে আবিষ্কার করেছিলাম, আবিষ্কার করেছিলাম আমার বাবাকে।"

আতপুর থেকে নৈহাটিতে সপরিবারে চলে আসেন সমরেশ। জীবনের পরিবর্তন এল। তাঁরা নৈহাটিতে চলে আসার কিছু দিন পরেই ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল নৈহাটি সিনেমা হলে। সমরেশ তখন মোটামুটি পরিচিত মানুষ। তাঁর লেখা ‘গঙ্গা’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবি করার জন্য সেই সময়ের বম্বের চিত্রপরিচালক বিমল রায় চিত্রস্বত্ব কিনেছেন। তাঁদের জীবন যাপনে তখনও এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেনি। তাঁর স্ত্রী যেন সেই সময় থেকেই একেবারে দশভুজা হয়ে সংসারটির হাল ধরেছিলেন। যার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য, ‘ও মানুষটাকে শুধু লেখা ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে না-টানা।’ রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে জেল থেকে ফিরে এসে যখন ‘ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরি’র চাকরিটি খোয়ালেন, তখন চারটি শিশুসন্তান থাকা সত্ত্বেও গৌরী বসু সমরেশকে বলেছিলেন, ‘‘যা হওয়ার হবে, কিন্তু তুমি আর চাকরি করতে যেও না।’’ ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়! চাল নেই, চুলো নেই, চাকরি নেই, ছ’জনের সংসার, তার মধ্যে চারটি কচি ক্ষুধার্ত মুখ সব সময়ে হাঁ-করে রয়েছে। এরই মাঝখানে একজন স্ত্রী তাঁর স্বামীকে বলছেন, ‘‘তুমি লেখো! চাকরি করতে হবে না‍!’’ পাগলামি না কি আত্মবিশ্বাস! ভালবাসা না কি মরণঝাঁপ!জায়া-জননী-বন্ধু-কমরেড, কে এমন ভাবে পাশে দাঁড়ায়!
  সমরেশ বসু কিন্তু আর ফিরে দেখেননি। ফিরে দেখার সময় তাঁর ছিল না। ছিল শুধু কয়েকজন সহৃদয় বন্ধু। কেউ পুরনো জামাকাপড় এনে দিতেন ছেলেমেয়ের জন্য। কেউ কলাটা-মুলোটা দিয়ে যেতেন। এক গ্রাম্য গোয়ালা গৌরীকে বলেছিলেন, ‘‘পয়সা দিতে পারবে না বলে বাচ্চাদের দুধ বন্ধ করে দেব! অত অভাব আমার এখনও হয়নি! দুধ দেওয়া আমি বন্ধ করব না। যে দিন পয়সা হবে, সে দিনই দিও।’’ গৌরী বসু গান শেখাতেন। জামাকাপড় সেলাই করতেন। দেশভাগের পর মুসলমান পরিবারের পরিত্যক্ত টালির চালের দু’কামরা ঘরের একটিতে সংসার। দ্বিতীয় কামরাটি গৌরী পুরো ছেড়ে দিয়েছিলেন সমরেশকে। ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মানুষটা সারা দিন লেখে’ সেই জন্য। সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গৌরী বসু তখন রীতিমতো পরিচিত মফস্বল অঞ্চলে।
   নৈহাটির বাড়িতে যে-ঘরে বসে সমরেশ লিখতেন, তার মেঝে ফুঁড়ে টালির চালের গোল ফাঁক দিয়ে উঠে গিয়েছিল এক সুদীর্ঘ নারকেলগাছ। ও ভাবেই তৈরি হয়েছিল সেই বাড়ি। অতীতে ওই অঞ্চলের নাম ছিল নারকেলবাগান। ঘর ঘেঁষা ঝোপ-জঙ্গল আর এঁদো পোড়ো জমি মিলিয়ে ছিল কাঠা তিনেক। নবকুমার তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন, "ওই টালির ঘরের মধ্যেই দেখেছি, বাবার উপন্যাস ‘গঙ্গা’ নিয়ে নির্মিত ছবির ইউনিট চলে এসেছে। ত্রিবেণীতে আউটডোর করতে এসে ওঁরা চলে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। স্ক্রিপ্ট পড়া হল। রাজেন তরফদার, দীনেন গুপ্ত, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা রায়, রুমা গুহঠাকুরতা, নিরঞ্জন রায়, সলিল চৌধুরী, সীতা মুখোপাধ্যায় প্রমুখ সংলাপ বলছেন আর বাবা নিজে তাঁদের উচ্চারণ ঠিক করে দিচ্ছেন। সলিল চৌধুরী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে লাগলেন, মা-এসে গলা মিলিয়েছিলেন। হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ। মুহূর্তে পরিচালক রাজেন তরফদারের নির্দেশে সকলে ছুটলেন ন্যাচারাল পরিবেশে, আলো-মেঘ-বৃষ্টিতে শ্যুট করতে। বাবাও ছুটলেন ধুতিতে মালকোঁচা মেরে। এখনও যেন কানে শুনতে পাই, বাবা মাকে চেঁচিয়ে বলছেন, ‘‘বুড়ি, (মায়ের ডাকনাম) আমিও যাচ্ছি। কখন ফিরব জানি না, চিন্তা কোরো না।’’ আমরা তখন নেহাতই ছোট, কিন্তু বিপুল উৎসাহে সব দেখছি, আত্মস্থ করে ফেলছি।"
  ২৩শে মার্চ ২০১৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসু স্মরণে শ্রী সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন -
"সমরেশ বসুকে আমি প্রথম দেখি জলপাইগুড়িতে। প্রথমে দেবেশ রায়ের বাড়িতে, পরে কার্তিক লাহিড়ীর মেসে। স্কুলের শেষ দিকের ছাত্র হলেও বাবুপাড়া পাঠাগারের সদস্য হিসেবে ‘বিটি রোডের ধারে’, ‘শ্রীমতী কাফে’ পড়ে ফেলেছি। কৌতূহল নিয়ে দেখতে গিয়েও কাছে ঘেঁষতে পারিনি। দূর থেকে দেখেই আমার এক বন্ধু বলেছিল, লোকটা সিনেমায় নামলে উত্তমকুমার বিপদে পড়ে যেত। সেটা সম্ভবত উনষাট সাল।
  ওঁকে সামনাসামনি দেখি, কথা বলি চৌষট্টিতে। তখন ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ বেরিয়ে গিয়েছে। খুব হইচই হচ্ছে। শ্লীল, অশ্লীল নিয়ে আমরা মাথা ঘামাইনি, দেখেছিলাম ‘বিবর’য়ে সমরেশ বসু অন্য রকম গদ্য লিখলেন। বুদ্ধদেব বসুর পর এত স্মার্ট বাংলা গদ্যের সন্ধান পেয়ে আমরা মুগ্ধ। সেই সময় আমাদের এম এ ক্লাসের ছেলেরা একটি পত্রিকা বের করেছিল। আমাদের মনে হয়েছিল সেই পত্রিকায় সমরেশ বসুর লেখা থাকা উচিত। সেটা এমন বয়স যে আবেগ আকাশ স্পর্শ করে বসে থাকে। জেনেছিলাম তিনি থাকেন নৈহাটিতে, আসেন হ্যারিসন রোডের ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে। হানা দিলাম কয়েক জন। জানলাম সমরেশ বসু পুজোর লেখা লিখছেন গ্রে স্ট্রিটে অধ্যাপক হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বসে।
কী এমন দূর?
চলে গেলাম সেখানে। মিনিট দশেক পরে তাঁর দেখা পেলাম। পাজামা, পাঞ্জাবি পরনে, সামনে লেখার কাগজ কলম, উত্তমকুমারকে হারিয়ে হাসলেন, ‘‘কী ব্যাপার ভাই!’’
আমরা নিবেদন করলাম। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “বেশ, পারিশ্রমিক কত দেবে?”
আমরা স্তম্ভিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন ছাত্র সাহিত্যকে ভালবেসে কাগজ বের করছে, তেমন বিজ্ঞাপন নেই, বিক্রির টাকাও পাওয়া যায় না, আর্থিক ক্ষতি ওই ভালবাসায় ভুলে থাকছি। আর ইনি পারিশ্রমিক চাইছেন? আমরা সেটা বোঝাতে চাইলাম। আবার হাসলেন তিনি, “আমি তো ভালবেসে লিখছি না। আমাকে ভাবতে হবে, কষ্ট করে লিখে কাগজ ভরাতে হবে, তাই তার বিনিময়ে নিশ্চয়ই পারিশ্রমিক চাইব।”
এক বন্ধু খেপে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি তা হলে টাকার জন্য লেখেন?”

“নিশ্চয়ই। যাকে ভালবাসি না তাঁর সঙ্গে শুতে বাধ্য হলে নিশ্চয়ই টাকা চাইব।”

আমরা ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেই ছায়া ছায়া বিকেলে কয়েক জন তরুণ সমরেশ বসুর মুণ্ডু চিঁবিয়েছিলাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা দিলে পারিশ্রমিক চাইতেন না। তেইশ বছর আগে যিনি চলে গিয়েছেন তাঁকে নিজেদের ইচ্ছায় সাজিয়ে সমরেশ বসুকে ছোট করতে চেয়েছিলাম।
   সমরেশ বসুর স্নেহভাজন হলাম দার্জিলিঙে গিয়ে। আমি গিয়েছিলাম তখনকার বিখ্যাত ছোট গল্পকার বরেন গঙ্গোপাধ্যায়, লেখক অভ্র রায়ের সঙ্গে বেড়াতে। উঠেছিলাম স্টেশনের পাশে কালীবাবুর হোটেলে। সস্তার হোটেল। দুপুরে খেয়ে দেয়ে ম্যালে গিয়েছিলাম। সুন্দরী-অসুন্দরীদের ভিড় দেখছি, ঘোড়ার ওপর প্রবীণার আতঙ্কিত মুখ দেখে মজা পাচ্ছি। এক দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী সাদা প্যান্ট এবং সাদা কোট পরে চলে গেলেন কুকুরকে চেনে বেঁধে। এ সব দৃশ্য কলকাতায় দেখা যায় না।
   এই সময় দেখলাম, কমপ্লিট স্যুট পরা, হাতে ছড়ি, মাথায় ফেল্ট হ্যাট এক জন খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে কাছে এসে বললেন, “কবে এলে বরেন?”
বরেনদার চোখ বড় হল,“এ কি সমরেশদা, আপনি?”
গলা নামালেন তিনি, “খুব খারাপ দেখাচ্ছে?”
“না না। দারুণ লাগছে।” আলাপ হল। শুনলাম পুজোর উপন্যাস লিখতে এসেছেন ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার জন্য। উঠেছেন আমাদের হোটেলের নীচে, লুইস জুবিলি স্যানেটোরিয়াম হোটেলে। হঠাৎ আমায় বললেন, “আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যাবে ভাই?”
এরকম সুযোগ কেউ ছাড়ে? যেতে যেতে শুনলাম দার্জিলিঙের এক সাংবাদিকের বাড়িতে সাহিত্য সভায় তাঁকে কথা বলতে হবে। শ্রোতারা রীতিমতো শিক্ষিত। বাড়িতে ঢোকার আগে নির্দেশ দিলেন, “তুমি ওই দরজার পাশের চেয়ারে বসবে। মাঝে মাঝে রাস্তায় নজর রাখবে। তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গোটা দশেক ছোট গল্প বেরিয়েছে, আনন্দবাজারের রমাপদ চৌধুরী পাত্তা দিচ্ছেন না। উপন্যাস লিখিনি, তাই লেখক হিসেবে কোনও পরিচিতি তৈরি হয়নি।
  সমরেশদাকে স্টেজে তুলে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। প্রথমে শ্রোতারা প্রশ্ন করবেন। সমরেশদা উত্তর দেবেন। তার পর ওঁর বক্তৃতা। অত্যন্ত দেড়শো জন সুবেশ নারী পুরুষ বসে প্রশ্ন করতে লাগলেন। হঠাৎ এক জন ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা আপনি আর একটা ‘গঙ্গা’ লিখছেন না কেন?”
     শোনা মাত্র সমরেশদা গৃহকর্তাকে নিচুু গলায় কিছু বলতেই তিনি ব্যস্ত হয়ে তাঁকে নীচে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। সবাই বুঝল টয়লেটে গেলেন সমরেশদা। খানিক পরে আমি রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখলাম বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে সমরেশদা হাত নেড়ে আমাকে ডেকে আড়ালে চলে গেলেন। চুপচাপ বেরিয়ে এসে দ্রুত হেঁটে ওকে ধরতে প্রায় ক্যাপিটাল সিনেমা হলের কাছে পৌঁছে গেলাম।
“কী হল! এ ভাবে চলে এলেন?”
“বিরক্তিকর। প্রশ্ন করছে আরেকটা ‘গঙ্গা’ লিখলাম না কেন? বৌ সঙ্গে থাকতে কি কেউ জিজ্ঞাসা করে আর একটা বিয়ে করছেন না কেন? অশিক্ষিত।” সমরেশদা রীতিমতো উত্তেজিত। জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ভাবে বাইরে এলেন?”
“ওদের টয়লেটে জমাদারদের জন্য পিছন দিকে ঘোরানো সিঁড়ি আছে। তাই দেখে সুবিধে হয়ে গেল। তোমার তো আজ কোনও কাজ নেই, চলো আমার সঙ্গে জলা পাহাড়ের দিকে। ওখানে মেমসাহেব অপেক্ষা করছেন,” সমরেশদা বললেন।

সেই রাত্রে আমি ছাড়া পেয়ে, কালীবাবুর হোটেলে চলে এলেও সমরেশদাকে সেখানে পান এবং ভোজন করতে হয়েছিল।
  প্রচণ্ড ঠান্ডায় লেপের তলায় শুয়ে ভাবছি আর একটা সোয়েটার পরলে ভাল হয়। হঠাৎ তখনই বন্ধ জানালায় শব্দ হল। ঢিল ছোড়ার শব্দ। খানিক পরে আবার। বরেনদা এবং অভ্র রায়কে ডাকলাম। কাঁপতে কাঁপতে জানালা খুলে দেখলাম পুরো শহরটা গভীর কুয়াশায় ডুবে আছে। কানা ডাইনির চোখের মতো রাস্তার আলো জ্বলছে, যার তেজ নেই বললেই চলে। তখনই চোখে পড়ল বাঁ হাত পাশাপাশি সোজা করে রেখে ডান হাতে পাথর কুড়োচ্ছে যে মানুষটা, তাঁর লক্ষ্য এই হোটেলের জানালা। বরেনদা চাপা গলায় বললেন, “সমরেশদা না? এখন রাত বারোটা, ওখানে কী করছেন?’’
  যা কিছু শীতবস্ত্র ছিল, সব শরীরে চাপিয়ে আমরা রাস্তায় নেমে দেখলাম বরেনদার অনুমান সত্যি। অভ্র রায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি এখানে কী করছেন?”
জড়ানো গলায় সমরেশদা বললেন, “পেছনের লোকটা ছিনতাই করতে চাইছে। কালীবাবুর হোটেলে ঢিল ছুড়ছি অথচ তোমরা ...!”
  এ বার লক্ষ করলাম, দূরে আপাদমস্তক ঢেকে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করে তাকে কাছে ডাকলে লোকটা এগিয়ে এসে হাতজোড় করে যা হিন্দিতে বলল, তার সারমর্ম হল, এই সাহেবকে হোটেলে পৌঁছে দিতে হুকুম দিয়েছিলেন মেমসাহেব। কিন্তু রাস্তায় নেমেই কেন যে দৌড়োতে শুরু করলেন তা সে বুঝতে পারছে না। লোকটাকে ভাল কথা বলে বিদায় দিয়ে সমরেশদাকে হোটেলে পৌঁছতে গেলাম। রাস্তাটা এত ঢালু যে স্বাভাবিক অবস্থায়ও শরীরের ব্যালান্স রাখতে অসুবিধে হয়। আমি আর অভ্র রায় ওঁর দুটো হাত ধরেছিলাম। নামতে নামতে আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন সমরেশদা। বরেনদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা বরেন, আমি কী রকম লিখছি?”
“দারুণ। তিন ব্যানার্জির পরে তো আপনিই,” বরেনদা বললেন।
“ভ্যাট। মিথ্যে কথা,” চিৎকার করে উঠলেন সমরেশদা, “তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণের ধারে কাছে যেতে পারিনি। কিছুই লিখিনি। কিছুই না,” তাঁর গলা ধরে এল। বুঝলাম খুব চেষ্টা করছেন কান্না চাপবার। হোটেলের দরজা বন্ধ ছিল। অনেক শব্দ করে দারোয়ানকে জাগিয়ে সেটা খোলার ব্যবস্থা করলে সমরেশদা আমাদের খাওয়াতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর শরীর আর পারছিল না বুঝে ওঁকে দারোয়ান ঘরে নিয়ে গেল। আমরা ফিরে এলাম কালীবাবুর হোটেলে।
ঘুম আসছিল না। ঠিক করলাম বাকি রাতটা আড্ডা মেরে কাটিয়ে সূর্য ওঠা দেখব। দেখে ঘুমোব। ঘরের পেছনে যে ব্যালকনি ছিল সেখানে গিয়ে অভ্র রায় লক্ষ করছিলেন সূর্য উঠতে কত দেরি। রাত যখন সাড়ে চারটে, তখন ব্যালকনিতে গিয়ে তিনি চেঁচিয়ে ডাকলেন আমাদের। নীচে সমরেশদার হোটেল। সব ঘর অন্ধকার। শুধু একটি ঘরে আলো জ্বলছে। মাঝে মাঝে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। অভ্র বললেন, “ওটা নিশ্চয়ই সমরেশদার ঘর।” বরেনদা বললেন, “দূর। যা অবস্থা ছিল তাতে সকাল দশটার আগে ঘুম ভাঙবে না।” আমি বললাম, “চলো, গিয়ে দেখা যাক।”
   নেই কাজ তো খই ভাজ। আমরা হাজির হয়ে দেখলাম হোটেলের দরজা তখন খোলা হচ্ছে। ভেতরে ঢুকে দোতলার সেই ঘরটার দরজায় নক করলাম। দরজা খুলতেই আমরা হতবাক। পাটভাঙা পাঞ্জাবি, পাজামা। সদ্য স্নান করা সমরেশদা আমাদের দেখে হেসে বললেন, “আরে! তোমরা! সারা রাত হুল্লোড় করেছ নাকি?”
“আপনি কী করছেন?” গলার স্বর দুর্বল ছিল।
“এই তো একটু লিখতে বসেছি। ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে’। বারোটা অবধি লিখব।”
“ঠিক আছে লিখুন। বারোটার পর আসব।”
“তা হলে দুপুরে এখানেই খেয়ে যাবে,” তিনি দরজা বন্ধ করলেন।
কোন শক্তি একজন মানুষকে এই ক্ষমতা দিতে পারে? রাত পৌনে একটায় জ্ঞান হারানো যে শরীর বিছানায় গিয়েছিল সেই শরীর চার ঘণ্টার মধ্যে তাজা হয়ে স্নান করে হাসি মুখে লিখতে শুরু করে কী ভাবে?
হোটেলে ফিরে এসে বরেনদা বলেছিলেন,“এই জন্যই মানুষটার নাম সমরেশ বসু।”
   তারাশঙ্কর থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দুদের যুগ, তার মাঝখানে ছিলেন সমরেশ বসু। ছিলেন ওই দুই যুগের মধ্যে সেতু হিসেবে। ওঁর জীবনযাপন, ছেলেমানুষের মতো মাঝে মাঝে আচরণ ইত্যাদি দেখে ওঁকে বলতাম আপনার উচিত ছিল ফরাসি দেশে জন্মানো। হেসে বলতেন, “নৈহাটিকেই প্যারিস ভেবে নাও।” এক রাতে ফোন করে বললেন, “আমি আর পারছি না, কাল সকালে তুমি অবশ্যই আসবে।” সার্কাস রেঞ্জের বাড়িতে গেলে বললেন, “তুমি তিষ্যরক্ষিতার নাম শুনেছ? বাঃ, গুড। এই বইগুলো নিয়ে যাও। এটা চিনের এক জন পরিব্রাজকের লেখার অনুবাদ। সম্রাট অশোক-তিষ্যরক্ষিতা আর কুণালকে নিয়ে দারুণ উপন্যাস হয়। আমি চেষ্টা করে দেখলাম হচ্ছে না। তুমি লেখো।”
  ‘শরণাগত’ উপন্যাসটি আমি সমরেশদাকে উৎসর্গ করেছিলাম। শেষের দিকে একটু অভিমানী হয়ে পড়েছিলেন। ভুল বুঝতেন সহজেই। আবার তা শুধরেও নিতেন। কিন্তু ওঁর মতো বিচিত্র বিষয় নিয়ে আর কোনও লেখক বাংলা ভাষায় উপন্যাস লেখেননি। শেষের দিকে লেখা , ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসটি লিখতে পারলে পৃথিবীর যে কোনও ঔপন্যাসিক গর্বিত হত।
লেখা ছাড়া সব ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করতেন সমরেশদা। নইলে মধ্য ষাটে কেউ চলে যায়!"
   সমরেশ বসুর জীবননদী বয়ে চলেছিল জোয়ার-ভাঁটায়। পড়েছে বাঁকের মুখেও। কিন্তু থেমে যায়নি। উত্তরোত্তর গতিও সঞ্চারিত হয়েছিল। না, তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি  প্রতিভাবান এই লেখকের পাশে দাঁড়ায়নি। তাঁর কলমের উষ্ণতা পার্টি ব্যবহার করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক প্রয়োজনে। কিন্তু তাঁর সংসারটি কী ভাবে টিকে থাকবে, তার কোনও হদিশ নেয়নি দল। দিশাহারার মতো লেখক পৌঁছে গিয়েছিলেন, আনন্দবাজার পত্রিকার কানাইলাল সরকার, সাগরময় ঘোষের কাছে। সূচনা হয়েছিল জীবনভর সম্পর্কের বাঁধনের। কমিউনিস্ট পার্টি পরবর্তী কালে আজীবন বিদ্রুপ করেছে এবং নেতিবাচক সমালোচনা করেছে সমরেশ বসুর। এমনকী মৃত্যুর পরেও তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু’ বলে পার্টির কাগজে দীর্ঘ নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। নবকুমার জানিয়েছেন, "অথচ ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, নৈহাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বাড়িতে আসতেন নিয়মিত এবং বাবা-মা দু’জনেই যথেষ্ট চাঁদা দিতেন তাঁদের!"
   মানুষটার ব্যক্তিজীবনেও পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। বদল তো স্বাভাবিক। পরিবর্তন যে প্রকৃতিরই নিয়ম। সমরেশ বসু ব্যক্তি এবং লেখক, উভয় দিক দিয়েই যে ব্যতিক্রমী সন্দেহ নেই। তা ছাড়াও কোথায় যেন এক বিপরীতধর্মিতার জটিল রসায়ন, যাকে হয়তো প্যারাডক্সিক্যাল ইমোশন বলা যায়,  ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মানুষটার মধ্যে। সাহিত্যে যাঁর কোনও ফাঁকি নেই, জীবনে তাঁর অদৃশ্য ফাঁক রচিত হয়ে যাওয়াই কি নিয়তি! না, রচিত তো হয়ে যায় না, রচনা করা হয় বলেই রচিত হয়। এই রচনাই কি মনস্তত্ত্বের জটিল রসায়ন? আপাতদৃষ্টিতে যে আচরণ বা সম্পর্কের কোনও ব্যাখ্যা মেলে না, মনে হয় চূড়ান্ত বৈপরীত্যে ভরা, অথচ সে দিকেই তীব্র গোপন আনুগত্যের আশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়া...কী জানি, বারবার নানা ভাবে, তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করেও মনে হয়েছে, সমরেশ বসুর জীবনকাহিনীতে সে যেন এক বিস্মিত বিভ্রান্ত অধ্যায়। জীবনশিকারি লেখক তিনি, নিজেকে সে ভাবেই চিনিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, ‘‘সাহিত্যের থেকে জীবন বড়।’’ সেই মানুষই কবুল করেছেন, ‘‘কাঠ খেয়েছি, আংরা বেরুবে।’’ কোথাও অনুতাপ ছিল কি? বা কিঞ্চিৎ আত্ম-তিরস্কার?
   হ্যাঁ, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন ও বাস্তববাদী, আত্মবিশ্বাসী লেখকটির আরও একটি সম্পর্কে ভেসে যাওয়ার অপরিণামদর্শিতার অধ্যায় সেটি। সম্পর্ক-রচনার পাত্রীটির সঙ্গে তাঁর তো রুচি-সংস্কৃতি-বুদ্ধিমত্তা কোনও কিছুরই মিল ছিল না। অথচ নিশির ডাকের মতো টানে ষাটের দশকে নিত্য ছুটে যেতেন পূর্ব কাঁঠালপাড়ার সেই বাড়িতে। যেখানে থমথম করত এক মধ্যযুগীয় পরিবেশ। বড় দালানকোঠা, ছাদে কড়িবরগা, জানালায় খড়খড়ি, ছাদ থেকে জলনিকাশির বাঘমুখ নালা, বড় ইঁদারা, ফাটা চাতাল… নবকুমার লিখেছেন, "আমাদের মামার বাড়ির সেই নিঝুম পরিবেশে খ্যাতিমান লেখকটি ছুটে যেতেন, একমাত্র একটি যুবতীর আকর্ষণে! যে আকর্ষণে ধারাবাহিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাঁর পুত্র-কন্যারা। অসম্মানে, গ্লানিতে বিধ্বস্ত-ছারখার-ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর সেই ‘বুড়ি’!"
   একটা গোলমাল বিভ্রান্তি লেগেই থাকে। অথচ দিন যায় তার পরেও। লেখকের খ্যাতি-সুনাম-স্বাচ্ছন্দ্য... কোনও কিছুই পড়ে থাকে না, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মানুষটা যেন পাঁকাল মাছের মতো। কাদা-পাঁকের মধ্য দিয়ে চললেও, তাঁর গায়ে আলোর ঝলকানি। ছেলে-মেয়ে স্ত্রীকে ফেলে পাতলেন কলকাতায় নতুন সংসার, দ্বিতীয়া স্ত্রী। স্বচ্ছলতা। অপেক্ষাকৃত অধিক বয়সে আর একটি সন্তানলাভ!

"অ্যাই, তোর ছোটমাসি তোর বাবার কে হয় রে?" — শ্রদ্ধার মানুষটিকে নিয়ে পাড়ার বন্ধুর কাছ থেকে ছুটে আসা এই বাঁকা প্রশ্ন সে দিন ছোট ছেলেটির কাছে ছিল বিরাট এক ধাক্কা। রসসিক্ত ইঙ্গিতটিও যে মিথ্যে ছিল না! সাহিত্যিক সমরেশ বসু ও তাঁর শ্যালিকা ধরিত্রীর প্রবল প্রেম। সমরেশ তখন চার সন্তানের পিতা। কল্যাণীতে স্ত্রী গৌরী বসু ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভরা সংসার। সে সময়ই ছোট শালির সঙ্গে শরীর-মনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সমরেশ। গৌরী ছিলেন বাড়ির বড় মেয়ে, আর ধরিত্রী ওরফে টুনি সবচেয়ে ছোট, প্রায় সমরেশের মেয়ের বয়সিই, সমরেশ বসুর বড় মেয়ে বুলবুলের চেয়ে মোটে কয়েক মাসের বড়! সেই ধরিত্রীকে বিয়ে করে প্যারালালি কলকাতায় দ্বিতীয় সংসার পাতেন সমরেশ।

সমরেশের শ্বশুরবাড়ি ছিল রক্ষণশীল পরিবার। অন্দরমহলে বাইরের পুরুষের খুব একটা যাতায়াত ছিল না। কিন্তু বড় জামাইয়ের অবাধ প্রবেশ। সেই সূত্রেই ক্রমশ দানা বেঁধে ওঠে টুনি আর সমরেশের সম্পর্ক। লোকলজ্জার কথা ভেবে, চাইলে হয়তো সব দায় ঝেড়ে ফেলে তিনি বেরিয়ে আসতেই পারতেন, কিন্তু সে পথে হাঁটেননি সমরেশ
শ্যালিকাকেও স্ত্রীর মর্যাদাতেই ঘরে তুলতে চান তিনি। কিন্তু হিন্দু বিবাহ আইনে এই বিয়ে সম্ভব ছিল না। অসম্ভবকে সম্ভব করলেন গৌরী— সমরেশের স্ত্রী, ধরিত্রীর দিদি। সমরেশের দ্বিতীয় বিবাহে সম্মতি দিলেন। বুক ফেটে গেলেও মেনে নিলেন নিজের বোনের সঙ্গে স্বামীর বিয়ে।
  সমরেশের জীবনের এই সব অলোচিত অংশে আলো ফেলেছেন তাঁর ছোট ছেলে, সাহিত্যিক নবকুমার বসু। 
কোনও রকম রাখঢাক না রেখে ‘ছিন্ন পাতার তরণী’ প্রবন্ধে (‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০০৮) জানিয়েছেন, বাবাকে নিয়ে কত রকমের মন্তব্য, বাড়তি কৌতূহল তাঁকে শুনতে হয়েছে— ‘সমরেশ বসুর আর একটা বউ আছে (ছিল) বুঝি?’ আরও অনেক কদর্য কথাবার্তা।

পারিবারিক টানাপড়েন আর ছেলেবেলায় নবকুমারের নিজের মধ্যেকার উথালপাথাল অনুভূতির কথাও স্মৃতি থেকে বলেছেন: ‘রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বাবা-মার চাপা ক্ষুব্ধ কথা কাটাকাটি, কখনো ভেঙে পড়া মা-এর কান্না। বুক ঢিপঢিপ করে।... উন্মেষ হওয়ার সেই বয়সে দুটি ব্যাপার সহ্য হত না কিছুতে। মা-এর চোখে জল, আর বাবার অন্য নারী গমন। সে নারী তো আবার পর-ও নয়। কিন্তু তার ভূমিকা, আর লেখক মানুষটিরও তার ডাকে তীব্রভাবে শারীরিক সাড়া দেওয়া, ভেতরে-ভেতরে ওলোটপালট করে দিচ্ছে।’ ‘চিরসখা’ উপন্যাসেও প্রোটাগনিস্ট ‘বিভাস চৌধুরী’র মধ্যে সম্ভবত সমরেশ বসুর জীবনের ছবিই আঁকতে চেয়েছেন নবকুমার।
  কেমন রসায়ন ছিল সমরেশের দুই স্ত্রীর সঙ্গে? গৌরী বসুর মৃত্যুর পর তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার ভিতরে পুঞ্জীভূত অন্ধকার আবর্তিত হচ্ছে। তথাপি আমি সকল সত্তা দিয়ে অনুভব করছি, এ অন্ধকার মহান, অনির্বচনীয় তার রূপ।... এই অন্ধকারে একাকী আমি নিজেকে আবিষ্কার করছি, আর তাঁকে দেখবার চেষ্টা করছি।’ এ কথা অনস্বীকার্য, সমরেশের জীবনে গৌরী বসুর অবদান ছিল বিরাট। পরবর্তী জীবনে সম্ভবত অনেকটাই ধরিত্রীর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন সমরেশ। তবে, দ্বিতীয়া ধরিত্রীকে ‘ট্র্যাজিক চরিত্র’ বলে মনে করেছেন নবকুমার, কারণ বাধ্যতই নাকি তাঁকে নানা ভাবে ‘আমিই আসল বউ’ প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হত।

সমরেশ-ধরিত্রীর একমাত্র ছেলে উদিত বসু অবশ্য সমরেশের অসংগঠিত জীবনকে পরম মমতায় বেঁধে রাখতে তাঁর মায়ের অপরিহার্যতার কথা বলছেন। ‘বয়সজনিত কারণে বা দূরত্ব বেড়ে যাওয়ায়’ গৌরী দেবীর পক্ষে তা হয়তো আর সম্ভব হচ্ছিল না বলেই তাঁর ধারণা। (‘কালকূট বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’, ২০১১)

সন্দেহ নেই সমরেশ বসুর জীবন বিতর্কিত ও ব্যতিক্রমী। তাঁর জীবনে কেচ্ছা ছিল, কেচ্ছা থেকে না-পালানোর মতো মহত্ত্বও ছিল।

অন্য সংসারটির দায়ভার তখন দিনে দিনে কমে আসছে। না, কমেও যেন কমছিল না। জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্বশুরালয়ে, তা সত্ত্বেও কোথায় যেন টানাপড়েন ছিল। জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবিকা সন্ধানে নেমেও পিতৃনির্ভরশীল এবং বিবাহিত। নবকুমার ডাক্তারির ছাত্র এবং হস্টেলবাসী, কনিষ্ঠা কন্যাও পাঠরতা। আর সর্ব অর্থে সমরেশ বসুর অর্ধাঙ্গিনী, কমরেড ও জীবনসঙ্গিনী গৌরী বসু তখন নৈহাটির বাড়ি আর বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে গড়ে তোলা শিক্ষায়তন ‘ফাল্গুনী’ নিয়ে হাঁটছেন ক্লান্ত পদক্ষেপে। শরীরে ভাঙন, তবুও চলেছেন।

সমরেশ কিন্তু তখনও নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে নৈহাটি যেতেন। তাঁর উপস্থিতিতে প্রাণময় হয়ে উঠত বাড়ির পরিবেশ। সান্ধ্য আড্ডা বসত দোতলায় সমরেশের ঘরে। কোনও সময় পুত্র নবকুমারও শামিল হতেন সেই আড্ডায়। নৈহাটি-ভাটপাড়া-হালিশহর-কাঁচড়াপাড়ার সমরেশ-ভক্তরা এসে জুটতেন তাঁদের বাড়িতে। কোনও সময় সমরেশ-গৌরী দু’জনে বসে কথা বলতেন। গৌরী বসু তার মধ্যেও খেয়াল করতেন, লেখকের চোখেমুখে পরিশ্রমের ছাপ। মানুষটার বয়সও তো বসে নেই! গৌরী পুত্র নবকুমারকে বলতেন, ‘‘খুব ধকল যাচ্ছে লোকটার!’’ আর কী আশ্চর্য, তার মধ্যেই ঝলসে ওঠার মতো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, গোয়েন্দা কাহিনি, কিশোর কাহিনি লিখছেন। ‘দেশ’-এ ধারাবাহিক ‘কোথায় পাব তারে’ ‘যুগ যুগ জিয়ে’ লিখেছেন। ‘বিবর’ পর্যায়ের পরে নক্ষত্রের মতো রচনা ‘বাথান’, ‘টানাপোড়েন’, ‘তিন পুরুষ’, ‘শিকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়়া’। কালকূট ঝুঁকেছেন মানস ভ্রমণের দিকে: ‘পৃথা’, ‘জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য’, ‘শাম্ব’… না, মানুষটাকে ঠিক মেলাতে পারি না। মনে হয়, বৈপরীত্যের মধ্যেই জীবনের আকাশ ছুঁতে চান এক ব্যতিক্রমী শিল্পী।
   নবকুমার লিখেছেন, "আমি সেই হস্টেল জীবন থেকেই বিচ্ছিন্ন, প্রান্তবাসী। এক শহরে থেকেও পাড়ের কিনারা ধরে হাঁটি। ১৯৮০-তে মাতৃবিয়োগের পর থেকেই মনে হতো, বাবা মানুষটা সব কিছুর মধ্যে, সব কিছু নিয়েও বড় নিঃসঙ্গ। একটু-একটু করে আবার যোগাযোগ হতে লাগল বাবার সঙ্গে। আমার স্ত্রী ও আমি তখন পায়ের তলায় মাটির সন্ধান করছি। প্রতিদিনের রোজগার থেকে বাঁচিয়ে ঘর উঠছে একটু-একটু করে। বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়। জিজ্ঞেস করি, ‘সন্ধেবেলা কী করছ? চলে এসো না এখানে!' ...’’
  পিতা-পুত্রের মধ্যে কথা হতো ঘরবাড়ি-সংসার-অতীত-দায়দায়িত্ব-একাকীত্ব আর রামকিঙ্কর নিয়ে। মনে হত, মানুষটা যেন একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতেন পুত্রের কাছে এসে।
                              
বোধহয় একঘেয়েমি এসে যাচ্ছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল আড্ডায়, ক্লাবে। খ্যাতিমান মানুষদের দায় বেশি, নিঃসঙ্গতা তাঁদের অনিবার্য। মনে হত, যেন লেখার জন্যই নিজেকে আরও গুটিয়ে নিচ্ছিলেন বাইরে থেকে। সমরেশ বারবার বলতেন, ধারাবাহিক উপন্যাস মানে তো মেল ট্রেন, চলতে শুরু করলে থামানো যাবে না।
                               
১৪ই জুন ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসুর স্মৃতিচারণে গুলজার লিখেছিলেন -
"সমরেশদা’র সঙ্গে আলাপ তো অমৃত দিয়ে। তিনি যে সন্ধানে বেরিয়েছিলেন, আমি তা পড়েই আমার ভাণ্ড পূর্ণ করে ফেলেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ ধারাবাহিক ভাবে বেরোত। আর বিমলদা প্রতিটি কিস্তি মন দিয়ে পড়তেন। বিমলদা চেয়েছিলেন ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ সিনেমাটা ওঁর জীবনের মহান কীর্তি হোক। ম্যাগনাম ওপাস। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এই সিনেমার চিত্রনাট্য থেকে কুম্ভমেলার শুটিং, অনেকটাই আমি করেছিলাম। আর যোগস্নানের দিন বিমলদা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন অমৃতলোকে।
  এই বইটার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে ছিলাম। আর তাই কোনও অজানা টানেই সমরেশদার সঙ্গেও জড়িয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে। অমৃতকুম্ভ-র অর্ধেক তৈরি হওয়া ও না-হওয়ার অনেক যন্ত্রণা ছিল, বিমলদার চলে যাওয়ার কষ্ট তো ছিলই, সমরেশদার সঙ্গে আলাপ হয়ে যেন সে সব যন্ত্রণার একটু হলেও উপশম হল। দেবু সেন আমায় প্রথম আলাপ করিয়ে দেয় ওঁর সঙ্গে। আমার যে বাঙালি ক্ল্যান ছিল, দেবু ছিল তার মধ্যমণি। ও আমার মধ্যে অনেকটা বাঙালিত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে।

এক মাথা ঝাঁকড়া চুল আর অপূর্ব একটা হাসি, এটাই ছিল সমরেশদা’র ট্রেডমার্ক। ওঁর সম্পর্কে যে সম্মোহিত ছিলাম, সে ব্যাপারটা কাটতে সময় লাগল মিনিট দশেক। তার পরেই বন্ধু-বন্ধু দিশেহারা। অমন সাদাসিধে মানুষ আমি কমই দেখেছি। জমে গেল জীবন আর বন্ধুত্ব যাপন। কলকাতায় এলেই প্রবল আড্ডা। নতুন কী লিখেছেন, কী লিখবেন, কোন ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছে— সব কাটাছেঁড়া চলত।

ওঁর একটা গল্প বেরোল, ‘অকাল বসন্ত’। এক কথায় যাকে বলে, দুরন্ত! আমার ভারী লোভ হল গল্পটা নিয়ে সিনেমা করি। কিন্তু স্ক্রিপ্ট করতে গিয়ে দেখলাম একটু অদলবদল হলে ভাল হয়। সমরেশদা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা, একটু চেঞ্জ করতে পারি কি?’ দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, বায়োস্কোপ করতে গেলে ও-সব একটু-আধটু করতে হয়।’ কিন্তু সেই সিনেমা হতে আরও অনেক দেরি হয়েছিল নানা কারণে। তার আগে আমি সমরেশদার আরও একটা ছোট গল্প ‘পথিক’ নিয়ে তৈরি করে ফেললাম অন্য একটা সিনেমা, ‘কিতাব’। গল্পটা ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় বেরিয়েছিল। ওই সিনেমাটার সূত্রেই প্রথম আমার উত্তমবাবুর সঙ্গে আলাপ।

কিন্তু আমি তো হাল ছাড়িনি। ‘অকাল বসন্ত’ বার বারই আমায় তাগাদা দেয়। শেষে টেলিভিশনে রিলিজ করে দিলাম সিনেমাটা। নাম হল, ‘নমকিন’। আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় সিনেমা।

সমরেশদা’র গল্পে যে একটা আশ্চর্য টান আছে, সেটা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সমরেশদা’র আরও একটা গল্প আছে ‘আদাব’, পড়ার পর ভাবলাম এটা নিয়ে সিনেমা করতেই হবে। কিন্তু চিত্রনাট্য তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম বড্ড ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তো ছোড়নেওয়ালা নই। তখন দূরদর্শনে ‘কিরদার’ নামে একটা টেলিসিরিয়াল করছিলাম। আমি ‘আদাব’ গল্পটাকে সেই সিরিয়ালের জন্য বাছলাম।

‘আদাব’ গল্পের শেষে এক জন হিন্দু ও এক জন মুসলিম একে অন্যের থেকে বিদায় নেয় ‘আদাব’ বলে। কিন্তু আসলে তো তা হয় না। কেউ কারও থেকে বিদায় নেওয়ার সময় উর্দুতে ‘খুদা-হাফিজ’ বলে। আমি সমরেশদাকে বললাম, ‘এটা তো হয় না সমরেশদা।’ উনি বললেন, ‘আরে এক জন মুসলিম আর এক জনকে বিদায় জানাচ্ছে, তাই আদাব বলেছে। ওটা তো একটা উর্দু শব্দ, না কি!’ আমি বললাম, তা ঠিক, কিন্তু আদাব শব্দের মানে তো অন্য। মানে তো অভ্যর্থনা। বিদায় নেওয়ার সময় একদম একটা উলটো শব্দ বলা চলে কী করে? সমরেশদার উত্তর, ‘আরে ওই নিয়ে তুমি অত ভেবো না। তোমায় বায়োস্কোপে বদল করতে হলে করে নাও।’

আমিও তা-ই করলাম। গল্পের নাম দিলাম ‘খুদা-হাফিজ’। সেই মর্মে সিরিয়াল হল। পরে ওই সিরিয়ালের চিত্রনাট্য থেকে একটা নাটকও লিখেছিলাম ওই নামে। আমার মনে হয়, আমি বাংলায় যত ছোট গল্প পড়েছি, হিন্দিতে বোধ হয় তত পড়িনি।

সমরেশদার সঙ্গে এই সখ্য আস্তে আস্তে ইয়ার-দোস্তিতে বদলে গেল। কলকাতা গেলেই বেপরোয়া ছুটির আমেজ। আমি যদিও লিমিটেড বেপরোয়া, কিন্তু সমরেশদা ছিলেন সত্যিকারের বেপরোয়া। বাঁধন এক বার ছাড়লে তাঁকে বাগে আনা মুশকিল।জীবনের প্রতি এই অ্যাটিটিউডই ওঁকে এ রকম অদ্ভুত লেখার ক্ষমতা দিয়েছিল, ভাবনার ইন্ধন দিয়েছিল। ওঁর প্রথম জীবনের কষ্ট করে লেখার কথা শুনেছি। তা-ই ভাবি, লেখার প্রতি যদি ওই বাঁধনছাড়া টান না থাকত, তা হলে বাংলা সাহিত্য গরিব হয়ে যেত অবশ্যই।
  সমরেশদা যদি মেপেজুপে জীবন চালাতেন আর লেখার সময় বাঁধ ভাঙতে চাইতেন, তা হলে কোনওটার প্রতি জাস্টিস হত না। সমরেশদা’র মতো মানুষরা আসলে বাউন্ডুলে বলেই জীবনকে কখনও পানাপুকুর থেকে, কখনও জমিদারবাড়ির খিলান থেকে, কখনও ট্রাক ড্রাইভারের ডেরা থেকে তুলে এনেছেন। ভবঘুরে হয়েই যদি সাহিত্যে আরও কিছুকাল আনাগোনা করতেন তো বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হত। অন্তত ‘দেখি নাই ফিরে’ শেষ তো হত! এ অপ্রাপ্তি তো মিটবে না কোনও দিন।"
                            
ব্যতিক্রমী মানুষ ও লেখক সমরেশ বসু প্রয়াত হন ১২ মার্চ, ১৯৮৮ সালে। তাঁর লেখনী থেমে গেল যাত্রা অসম্পূর্ণ রেখেই। কিছু করার নেই। স্বয়ং বিধাতার সৃষ্টিও তো অসম্পূর্ণ। তবুও কালের বিচারে কিছু স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় তাঁর সৃষ্টি-বৈচিত্র নিয়ে। নিরন্তর আলোচনায় ভেসে থাকেন সৃষ্টিকর্তাটিও। এমনকী রয়েছেন মৃত্যুর এত বছর পরেও!

 ‘অশ্লীলতা’ - শব্দটা কোনদিন পিছু ছাড়েনি সমরেশ বসুর। ‘অশ্লীলতার দায়’ তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল জীবনভর। তাঁর উপরে ‘অশ্লীল লেখক’ - এই ছাপটা যেন স্থায়ীভাবে বসে গিয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, তাঁর ও জর্জ বিশ্বাসের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি নেওয়া যেতে পারে। ‘কলকাতার ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ঘর’টিই ছিল কিংবদন্তীসম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ‘জর্জ বিশ্বাসের’ সাম্রাজ্য। সেখানে একবার ‘জর্জের’ সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতে গিয়েছিলেন ‘সমরেশ বসু’ও। ‘মায়া সেন’ তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। ‘জর্জ’ পা তুলে বসে ছিলেন। ঘরে ‘সমরেশ বসু’ ঢোকার পরও পা নামাননি। ‘মায়া সেন’ এ দিকে ইশারা করেই যাচ্ছিলেন, পা নামাতে। কিন্তু তিনি কিছুতেই আর পা নামাননি। শেষে চলেই গিয়েছিলেন ‘সমরেশ বসু’। ‘মায়া সেন’ তাঁকে গাড়িতে চাপিয়ে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘‘জর্জদা, আপনি এটা কী করলেন?’’ ‘জর্জ’ বলেছিলেন, ‘‘যে এত অশ্লীল গল্প লেখে, তাঁকে আমি পছন্দ করি না।’’ এখানেই শেষ নয়, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দে শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর উপন্যাস ‘প্রজাপতি’। সেটাকে ‘অশ্লীল’ বলে ‘নিষিদ্ধ’ করার আর্জি জানিয়ে ১৯৬৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করেছিলেন তরুণ আইনজীবী ‘অমল মিত্র’। সমরেশ বসুর পক্ষে সেই মামলার ‘প্রথম ও প্রধান সাক্ষী’ হয়েছিলেন সাহিত্যিক অধ্যাপক ‘বুদ্ধদেব বসু’।
কিন্তু কি কারণে সমরেশ বসু আজও নিরন্তর আলোচনায় ভেসে থাকেন? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর হল - ‘বিতর্ক’। ‘বিতর্ক’ শুধুমাত্র তাঁর ‘ব্যক্তিগত জীবন’ নিয়েই নয়, ‘বিতর্ক’ আছে তাঁর বেশ কিছু লেখা নিয়েও। ‘সাহিত্যের গুনগতমান’ আছে কি নেই, সেই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে যে প্রসঙ্গ আজও ‘সমরেশ বসুর লেখা’ নিয়ে উঠে আসে, সেটা হল ‘অশ্লীলতা’! ‘এখানেই শেষ নয়, সমরেস বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে ‘অশ্লীলতার অভিযোগ’ উচ্চ আদালতে পৌঁছেছিল, এবং সেই সময়ে দিনের পর দিন সংবাদ মাধ্যমে তা শিরোনামে ছিল। ইতিহাস বলে, কোনও কোনও বইয়ের কারণেই মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী সামনের রাস্তা কেটেছে, সেই পথেই তাঁর  সমাজ, সভ্যতা এগিয়েছে। আবার কিছু কিছু বইকে মানুষ ‘একমাত্র সত্য’ বলে ধরে নিয়ে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। কোনও বইকে কিছু মানুষ ক্ষতিকর মনে করে নিষেধের দাবি তুলেছেন, ‘লেখকের শাস্তি বা নির্বাসন’ চেয়েছেন। এর ফলে সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক-পাঠিকারা যেমন পেয়েছেন ‘শ্রেষ্ঠ’, ‘মহৎ রচনা’ নামে বেশ কিছু বই; তেমনই পেয়েছেন ‘বাতিল’, ‘ক্ষতিকারক’ বলে দাগানো কিছু বই। ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের ‘শারদীয়া দেশ’ পত্রিকায়।  ১৯৬৮ সালে ‘কলকাতা হাইকোর্টের তরুণ আইনজীবী’ ‘অমল মিত্র’ ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে ‘অশ্লীলতার অভিযোগে’ ‘নিষিদ্ধ’ করার আবেদন করে আদালতে মামলা করেছিলেন। আবেদনকারী তাঁর পক্ষে ‘৮ জন সাক্ষী’র নাম দিয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে লেখক ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’ এবং ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক’ ‘আশুতোষ ভট্টাচার্য’র নামও ছিল। তবে তাঁদের দু’জনের কেউই আবেদনকারীর পক্ষ নিয়ে সাক্ষী দিতে আদালতে উপস্থিত হননি। কলকাতা ‘চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে’ অভিযুক্ত হয়ে আদালতে হাজির হয়েছিলেন সমরেশ বসু এবং ‘দেশ’ পত্রিকার তৎকালীন ‘প্রকাশক ও মুদ্রাকর’ ‘সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত’। অভিযুক্ত সমরেশ বসুর পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন ‘বুদ্ধদেব বসু’, ‘নরেশ গুহ’র মতো ব্যক্তিরা। আদালতে, লেখক সমরেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, ‘প্রজাপতি’ একটি অশ্লীল উপন্যাস, যেটি ‘সাহিত্যের পবিত্রতা’ নষ্ট করছে এবং ওই উপন্যাস পড়ে অল্প বয়সী পাঠকেরা উচ্ছন্নে যাচ্ছেন! আবেদনকারী ‘অমল মিত্র’র অভিযোগ ছিল, সাহিত্য সমাজমানসে ‘নৈতিকতা’ তৈরি করে কিন্তু 'প্রজাপতি' তার জায়গায় ‘যৌনতা’ ও ‘নারী পুরুষের কামনা’ সৃষ্টি করছে। অভিযোগকারীর প্রশ্ন ছিল, তাহলে এই উপন্যাসটির ‘সাহিত্য মূল্য’ কোথায়? সমরেশ বসুর পক্ষে সাক্ষী ‘বুদ্ধদেব বসু’ আদালতে জানিয়েছিলেন, তিনি সেই লেখায় ‘অশ্লীলতা’র বদলে ‘সমাজ বাস্তবতার ছবি’ই পেয়েছিলেন। তাঁর পাল্টা বক্তব্য ছিল, সাহিত্যে ‘শ্লীল-অশ্লীলতা’ মাপার দাড়িপাল্লাটা কোথায়? যদি থাকে তাহলে তো ‘রামায়ণ-মহাভারতের’ মতো বহু ক্ল্যাসিকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠতে পারে। ‘নরেশ গুহ’র বক্তব্যও ছিল প্রায় এক।  কিন্তু 'প্রজাপতি' নিষিদ্ধ করার মামলায় সেবার অভিযোগকারীই জিতে গিয়েছিলেন। সেই মামলার রায় বেরিয়েছিল ১৯৬৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর। অর্থাৎ ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি ওইদিন ‘অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ’ ঘোষিত হয়েছিল। আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, ‘অশ্লীল উপন্যাস’ লেখার জন্য লেখক সমরেশ বসুকে কোনও মতেই অব্যাহতি দেওয়া যায় না, তা তিনি যত বড় লেখকই হোন না কেন। আদালত লেখক সমরেশ বসুকে ‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা’ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করেছিল। আদালত লেখককে ‘২০১ টাকা জরিমানা’ এবং অনাদায়ে ‘দু’মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ’ দিয়েছিল। প্রকাশকেরও একই সাজা হয়েছিল। আদালতের রায়ে, ‘দেশ শারদীয় সংখ্যা’র (১৩৭৪ বঙ্গাব্দ) ‘১৭৪ থেকে ২২৬ পৃষ্ঠা’ পর্যন্ত নষ্ট করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। খুব অবাক করা ঘটনা হল যেদিন সমরেশ বসুর উপন্যাসটি ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছিল ও তাঁকে তার জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, সেই দিনটি ছিল সমরেশ বসুর ৪৪তম জন্মদিন। ঘটনাটি সেখানেই সমাপ্ত হয়নি। লেখক ও প্রকাশক, কেউই হার মানতে রাজি হননি। ‘জরিমানার টাকা’ সেদিনই জমা দেওয়া হলেও এবং মামলাটিকে ‘উচ্চ আদালতে’ নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। যদিও ‘কলকাতা উচ্চ আদালত’ও ৫ বছর পরে তার রায়ে ‘ব্যাঙ্কসাল কোর্টের রায়’ই বহাল রেখেছিল। শুধু তাই নয়, বিচারপতি মামলাটিকে ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতে’ নিয়ে যাওয়ার অনুমতিও নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও হাল ছাড়েন নি লেখক ও ‘দেশ’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৯ সালে মামলাটি ‘সুপ্রিম কোর্টে’ উঠেছিল। পরের বছর ‘সুপ্রিম কোর্ট’ ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটির অনুবাদ চেয়েছিল। অনুবাদটি যদিও বা জমা পড়েছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফের ১৯৮৫ সালে সেটিকে ‘সুপ্রিম কোর্টে’ পেশ করা হয়েছিল। ওই বছরেরই ২৪শে সেপ্টেম্বর ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ে’ বলা হয়েছিল, ‘প্রজাপতি’ অশ্লীল নয়, এবং উপন্যাসের উপর থেকে সমস্ত ‘নিষেধাজ্ঞা’ প্রত্যাহার করা হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের কোনো উপন্যাস নিয়ে ১৭ বছর ধরে কোন মামলা চলা ছিল সেই প্রথম। শুধুমাত্র ‘প্রজাপতি’ নয়, সমরেশের ‘বিবর’ উপন্যাসটিও অশ্লীলতার দায়ে পড়েছিল। নিজেই সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে সমরেশ বসু একবার বলেছিলেন, ‘‘নিজের এবং অনেকের লেখা পড়েই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলাম এবং আমার ধারণা, বাঙালি পাঠক সমাজেও তার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল৷’’ একজন ঔপন্যাসিক হিসেব সেই সময় ঠিক যেন শান্তি ছিল না তাঁর মনের গভীরে৷ সালটা ছিল ১৯৬৫৷ ‘সাগরময় ঘোষ’ তাঁকে পুজোর জন্য একটি উপন্যাস লিখতে বলেছিলেন৷ সমরেশ বলেছিলেন, ‘‘সব প্রচলিত প্রথা ভেঙে দিতেই এবার আমি লিখতে চাই৷’’ তারপরেই তিনি বলেছিলেন, ‘‘অবিশ্যি কেবল প্রচলিত প্রথাকে ভাঙার কথাই তো চিন্তা করিনি৷ চিন্তার জগতেও একটা ওলটপালট চলছিল৷’’ তাঁর সেই ‘প্রথা ভাঙার কাহিনী’ ও সেই ‘চিন্তা জগতের ওলট-পালটের আখ্যান’ হয়ে থেকেছিল ‘বিবর’৷ উপন্যাসটি বই হয়ে বেরোবার পরে, সেই ‘বিবর’-এর ‘উৎসর্গপত্র’টিই কি ভারি অস্বস্তিকর হয়ে ঠেকেছিল পাঠক-পাঠিকার মনে? ‘নম্র’, ‘রম্য’, ‘শ্রদ্ধেয়’ কিংবা ‘স্নেহার্থী’ - ভিন্ন ভিন্ন শব্দমালাকে গ্রহণ না করে সেই বইয়ের ‘উত্‍সর্গপত্রে’ কি ‘আমি-ই’, ‘আমি-ই’ মানে ওই ‘আমি’ নামক পাঠকটিই লক্ষ্য ছিল সমরেশের? বইটি কি উৎসর্গ করা হল ‘আমাকেই’? ‘আমাকেই’ কি বলা হয়েছিল ওই শব্দাবলি ওই বাক্যবন্ধ - ‘‘আচ্ছা, আমরা যদি সবাই, সত্যি কথা বলতে পারতাম ...৷’’ পাঠক, বাক্যের শেষোক্ত ওই ‘ত্রিবিন্দু চিহ্ন’ও যে সেই ‘উত্‍সর্গপত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ ছিল৷ সেই ‘ত্রিবিন্দু চিহ্ন’ই তো পরবর্তী পৃষ্ঠার লক্ষে পাঠক-পাঠিকাদের এগিয়ে দিয়েছিল৷ তাই ওই ‘ত্রিবিন্দু চিহ্ন’কে সঙ্গ করেই শুরু হয় উপন্যাসের প্রথম লাইনটি৷ পাঠক-পাঠিকা বুঝতে পারেন, উপন্যাস শুরু হয়ে গিয়েছে ওই পূর্বপৃষ্ঠাটি থেকেই …৷ মানে প্রথম লাইনটাই দাঁড়াল, ‘‘আচ্ছা, আমরা যদি সবাই, সত্যি কথা বলতে পারতাম কিংবা আচ্ছা ব্যাপারটা কি এই রকম নাকি, যে, এক তুখোড় চতুর একগুঁয়ে জেদি আর অব্যর্থ শিকারি, একটা বাঘকে মারবার জন্যে, একটা বাঘকে ফাঁদে ফেলে মারবার জন্যে, যেন একটা নধর পুষ্ট ছাগলকে, রাতের অন্ধকারের বনে গাছের তলায় বেঁধে রেখে দিয়েছিল৷’’ চকিতে চমক লাগে দুই বাক্যের ধাক্কাতে৷ আমাদের সবচেয়ে বড়ো ‘মিথ্যা’টাই তো এটা৷ শিকারকে ধরার জন্য শিকারি পাতে ফাঁদ, শিকার ফাঁদকে নিজের শিকার ভাবে অথচ বেচারা শিকার জানেও না যে তাকেও লক্ষ্য করে আছে শিকারি! সে ওই ফাঁদকেই নিজের শিকার ভেবে তার চার দিকে ঘুরে ঘুরে তার দিকে নানা কৌণিক অবস্থানকে স্থির করে কখনও দূরত্বটাকে কমিয়ে বাড়িয়ে পাতে ওত৷ তার লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে … অথচ ওই শিকারের গল্পটা তো বলেননি ঔপন্যাসিক৷ কারণ, এর পরেই শুরু হয়েছে, ‘অবাধ দেহলীলার বর্ণনা’৷ ‘দেহলীলা’ কী ভাবে ক্রমশঃ বদলে যায় এক শিকার আর শিকারির কাহিনীতে তার এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর আখ্যান শুরু হয়ে যায় - ‘‘আয়নার প্রতিবিম্বেই নীতার শ্যাম্পু করা রুক্ষ চুলের দিকে তাকালাম৷ যে চুলের গোছা, একটু আগেই আমি বিলি কেটে কেটে ঘাড় থেকে তুলে ওর মাথার ওপর দিয়ে লুটিয়ে দিয়েছি৷ নীতাও উপুড় হয়ে রয়েছে৷ আমিই উপুড় করে দিয়েছি৷ ... ওর সমস্ত দেহটাই দেখা যাচ্ছে৷ ওর মেদহীন সুগঠিত খোলা পিঠ, এত সুন্দর আর এত স্বাস্থ্যপূর্ণ, শিরদাঁড়ার মাঝখানটা যেন দুপাশ থেকে ঢালু হয়ে নেমে এসে একটা তীক্ষ্ণ গভীর রেখায় আঁকা পড়েছে৷ নিটোল কোমল ফর্সা পিঠ, জামা নেই৷ পিঠটা যেন ক্রমাগত ত্রিভুজের রেখায় কোমরের দিকে নেমে গেছে৷’’ ‘উত্তেজনার শিহরণ’ যখন পাঠক-পাঠিকার মনে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়ে চলে তাঁর স্নায়ুতে তন্ত্রীতে, তখনই ক্রমশঃ ভাঙতে থাকে রহস্য৷ সেই শরীর এক সদ্য নিহত যুবতীর শরীর বর্ণনা৷ পাঠক-পাঠিকা সেই বর্ণনা শুনে শিহরিত হচ্ছে যাঁর দৃষ্টিকোণে, সেই বীভত্‍স মানুষটিই সেই যুবতীর হত্যাকারী৷ কিছুক্ষণ আগে, ‘রমণের উদ্দামলীলা’র মধ্যেই যাঁর কনুই ধীরে ধীরে চেপে ধরেছিল ‘নীতা’র গলা৷ খুন বটে, তবে পরিকল্পিত খুন নয়৷ চার দিকের প্রতি সুতীব্র ঘৃণা কী ভাবে ফাঁদ- শিকারিকে তার অজান্তেই শিকার করে নেয় - সমরেশ বসুর ‘বিবর’ বোধহয় তারই ‘জটিল আখ্যান’৷ সেই জটিলতার ‘বিবর’-এই একে একে সেঁধিয়ে যায় ‘নীতা’র প্রতি প্রচণ্ড ‘আসক্তি ও ঘৃণা’ আর ‘অনাসক্তি’ যেমন, তেমনই চাকরিটার প্রতিও তাঁর একই সঙ্গে জমেছিল তীব্র ‘অনাসক্তি আর ঘৃণা’৷ নানা ধরনের মিথ্যার মাঝখানে মিথ্যেটাকে মানতে মানতে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ক্রমশঃ মানতে না-পারার উপন্যাস সেটি৷ ‘বিবর’ ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর হয়ে ওটা একটা মানুষের একটা প্রত্যাখ্যান-বৃত্তান্ত৷ পণ্যভিত্তিক আর আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সেই কাহিনীটাও সমাজের খণ্ডবিচারের মানদণ্ডে ‘অশ্লীল’ অভিধায় আখ্যাত হয়েছিল! এক বার তাই না সমরেশ লিখেছিলেন, ‘‘জীবনে যদি অন্ধকার থাকে, তাকে অন্ধকারেই রাখতে হবে কেন? আলোয় আনতে গেলে পেচক শৃগাল চিত্‍কার করবে৷ করুকই না৷ তবু অন্ধকারে যেন না থাকতে হয়৷’’ এ তো এক প্রবল ঔচিত্যের ধারণা৷ যাকে আমরা ‘ঘৃণাবাসি’৷ এই সূত্রেই উল্লেখ্য যে, ‘সাহিত্যে অশ্লীলতা’ নিয়ে তথাকথিত নীতিবাগীশদের উদ্দেশে এক বার এক প্রলয়ংকরী কথা শুনিয়েছিলেন সমরেশ বসু, তাঁর স্বল্পপঠিত এক প্রবন্ধে, যার নাম ‘আর রেখো না আঁধারে’ আর যার বিষয় ছিল ‘বাংলা সাহিত্যে অশ্লীলতা’, তিনি লিখেছিলেন - ‘‘আসলে সাহিত্যে অশ্লীলতা খুঁজে যারা বিচলিত, শুচি শুচি করে মরছে, তারা জীবনের ক্ষেত্রে পাপসৃষ্টির প্রতি চোখ ফিরিয়ে রাখতে চাইছে৷ তারাই সেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যে তারা জীবনে যা খুশি করবে আর পাপবোধের কথাও দিনান্তে একবার মনে স্থান পাবে না৷ সেই জন্ম পুণ্যবানেরা এমনকি সত্যের চেহারাকেও ভয় পায়৷’’ এর পর সেই ভয়ংকর ‘সাবধানবাণী’ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি, ‘অশ্লীলতার জয়ঢাক পিটিয়ে’ যে মূল ব্যাপারটাকে তাঁরা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন, তাকেই তিনি বলেছিলেন ‘আত্মদর্শনের আতঙ্ক’!


তবে শুধুমাত্র কি ‘সাহিত্যের অশ্লীলতা’, তাঁর ‘ব্যক্তিজীবনের কেচ্ছা’, তাঁর ‘অসংগঠিত জীবন’ - বহু ‘বক্রোক্তি’, ‘আদিরসাত্মক’, ‘ব্যাঙ্গাত্মক’, ‘কঠিন প্রশ্নের’ সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সন্তানদের।

তথ্যসূত্র: ------

১- ‘ছিন্ন পাতার তরণী’, নবকুমার বসু, ‘সমরেশ বসু বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’ পত্রিকা (২০০৮)।
২- ‘কালকূট বিশেষ সংখ্যা’, ‘শব্দ’ পত্রিকা (২০১১)।
৩- সমরেশ বসু: জীবন ও সাহিত্য, বারিদবরন চক্রবর্তী, শিলালিপি (২০১৪)।
৪- ১৫ই জুলাই ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসুর পুত্র শ্রী নবকুমার বসু'র লেখা প্রবন্ধ।
৫- ১৪ই জুন ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসুর স্মৃতিচারণে গুলজারের লিখিত প্রবন্ধ।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ই মে ২০১৫ সাল।
৭- ২৩শে মার্চ ২০১৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী সমরেশ বসু স্মরণে শ্রী সমরেশ মজুমদারের লিখিত প্রবন্ধ।
৮- কথাসাহিত্যে সমরেশ বসু: সামগ্রিক মূল্যায়ন, ঝুমা রায়চৌধুরী, পূর্বাশা (২০১২)।
৯- নিজেকে জানার জন্যে: প্রবন্ধ-নিবন্ধ সমগ্র, সমরেশ বসু, পূর্বাশা (২০১৩)।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments