জ্বলদর্চি

প্রেম ও বিরহের কবি প্রিয়ংবদা দেবী /ঈশিতা ভাদুড়ী


প্রেম ও বিরহের কবি প্রিয়ম্বদা দেবী 

ঈশিতা ভাদুড়ী


উনিশ এবং বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে প্রিয়ম্বদা দেবীর উজ্জ্বল উপস্থিতি আমরা পেয়েছি। গত শতকের শুরুতে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রেণু’প্রকাশিত এবং বিখ্যাত হয়েছিল সনেটধর্মী কবিতার জন্য। একাধিক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা প্রিয়ম্বদার শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘চম্পা ও পাটল’ প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে, তাঁর মৃত্যুর (১৯৩৫) চার বছর পর। এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি হিসেবে সেকালে তিনি প্রসন্নময়ী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু এবং কামিনী রায়ের সার্থক উত্তরসূরি। 

"ঝড়ের মুখে, পাখীর বাসা যেমন টলমল / যেমন নলিনদলে জল, / ক্ষণিকের রঙীন জীবন, / তেমনি চপল, তেমনি চপল..." - প্রিয়ম্বদা দেবীর এই গানটিতে সুরারোপ করেন চারণকবি মুকুন্দদাস। এই গানটি এতই বিখ্যাত হয় যে, পরে এই গানটিকে মুকুন্দদাসের বলেই অনেকে ভুল করেন।

বিরহ, বিচ্ছেদ এবং বিয়োগ-বেদনার করুণ রসই ছিল তাঁর কবিতার প্রাণপ্রবাহ। প্রিয়ম্বদার কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী’পত্রিকায় মনোনীত করেছেন, প্রশস্তি সহযোগে তাঁর কবিতার আলোচনাও করেছেন। প্রিয়ম্বদাও কবিকে নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। অনেকে বলেন কবির কাব্যশৈলীর এক আশ্চর্য প্রভাব ছিল প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতায়। জানা যায়, এক সময়ে ভুলক্রমে প্রিয়ম্বদার কবিতা রবীন্দ্রনাথের নামে প্রকাশিত হয়ে যায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের কাব্য-সঙ্কলন ‘লেখন -এ প্রিয়ম্বদার পাঁচটি কবিতাও স্থান পেয়ে যায় সঙ্কলনকারীদের ভুলেই। 

প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতায় রবীন্দ্রনাথের ছায়া ছিল একথা যদিও অস্বীকার করা যায় না, তবু তাঁর কবিতা স্বকীয়তা হারিয়ে একেবারে অন্ধ রবীন্দ্রানুকরণ হয়ে উঠেছিল একথাও মনে করা ঠিক নয়। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘প্রিয়ম্বদা’-র কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য রচনার সহজ ধারায়, অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে বলে প্রসাদগুণ। শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘চম্পা এবং পাটল’(পারুল ফুল)-এ সঙ্কলিত আটত্রিশটি কবিতা রচিত হয়েছে ১৯১৬ থেকে ১৯২৯ সাল অবধি সময়কাল জুড়ে। তিনি বিভিন্ন স্বাদের কবিতা লিখে গেছেন। 

‘শতবর্ষ পরে’কবিতায় তিনি লিখেছিলেন “… নারী মোরা সব চেয়ে তব কাছে ঋণী, / করুণায় সবাকারে লইয়াছ জিনি, / কোথাও ছিল না স্থান, সহিয়াছি অসম্মান / চিতে যার চিতানল জ্বলে, তারেও সঁপিয়া চিতানলে। / সতীধর্ম হত যে প্রচার, অন্যায়ের সেই অবিচার, / তুমি করেছিলে দূর ওগো মহাপ্রাণ, / কখনো যাওনি ভুলে সত্যের সম্মান…”- এখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে নারীচেতনা সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট সজাগ ছিলেন।

আবার ‘নিঃসঙ্গ’ কবিতায় কবি লিখেছিলেন – “মনের সাগর পারে নির্জনের দেশ, / সেথা আমি নিঃসঙ্গ একেলা, / তরল জীবন 'পরে লহরী অশেষ; / কত বর্ণ ভঙ্গি কত; সংগীতের মেলা! / আমার উষর তটে, গুল্ম বীথিকায়, / বায়ুর হিল্লোল নাই, পাখি নাহি গায়! / নীরবে ভাসিয়া যায় উষার রক্তিমা, / নিঃশব্দে নিবায় দীপ নিশীথ চন্দ্রিমা…”

তাঁর ‘মাতৃহৃদয়’কবিতাটিতে কবি পৃথিবী মায়ের কাছে মাতৃহৃদয়ের বিশালতা, গভীরতা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেয়েছেন। সন্তানের বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় কবি কাতর হয়ে আছেন। বেদনাহত কবিমন কিছুতেই এই বিয়োগ ব্যথা সহ্য করতে পারছেন না। কবি তাই ধরিত্রী – মাতার কাছে বলেছেন। পৃথিবী মাতা যেন তার বক্ষে কবির সন্তান বিচ্ছেদ যন্ত্রনার কান্নাকে বিলুপ্ত করে দেন। কবি ধরিত্রী জননী কে প্রশ্ন করেছেন যে শত – সহস্র সন্তানের বিয়োগ যন্ত্রনা সহ্য করে পৃথিবী কিরূপে স্থির আছে, সেই রহস্যই কবি ধরিত্রীর কাছে শিখতে চেয়েছেন। ধরিত্রী মায়ের কাছে কবির এই আকুলতাই প্রকাশ পেয়েছে।  

তিনি দুঃখবাদী কবি হিসেবে গণ্য হয়ে উঠলেও স্পর্শকাতর, আবেগপ্রবণ ও কল্পনাশ্রয়ী এই কবি মূলত সৌন্দর্যের কবি ছিলেন। কবি কখনও দুঃখের কাছে পরাজয় স্বীকার করেননি। 

তাঁর বহু কবিতাই প্রেম এবং রোম্যান্টিক চেতনায় ভরপুর – “তুমি মোরে করেছ কামনা, / আমি আনমনা / দেখি নাই চেয়ে-তুমি যে না পেয়ে, / চলে গেছ কতখানি দূরে, / আজি তব বাঁশরির সুরে / পড়ে গেল মনে, আজি কেমনে / তোমারে ফিরাব বল আর?”

জীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল যে প্রেম ফুলের মতনই সুন্দর ও ক্ষণস্থায়ী। তাই ফুল ঝরে যাওয়ার পরেও বাতাসে গন্ধ ভরে থাকে, সেরকমই ভালোবাসার পাত্র হারিয়ে গেলেও প্রেমের সুর হৃদয়-মাঝে লেগে থাকে। তাই তিনি সেই প্রেমের স্মৃতি ও প্রেমের বেদনার কবিতা লিখেছেন একের পর এক। প্রেমের অজানা রহস্যের প্রতি বিস্ময় মিশ্রিত ভাবনার প্রকাশ হয়েছে তাঁর ‘রেণু’ সংকলনের বিভিন্ন কবিতায়। 

প্রিয়ম্বদা দেবীর কবিতার প্রথম ও প্রধান লক্ষণ ছিল মিতভাষিতা এবং সংস্কৃতকাব্যরীতির ধারা। উনিশ শতকের অন্যতম মহিলা কবি হিসেবে আজও তাঁর নাম উচ্চারিত হয়।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments