বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৪
আম
ভাস্করব্রত পতি
'অ'য় অজগর আসছে তেড়ে
আ'য় আমটি আমি খাবাে পেড়ে'....!
এ ছড়া বাংলার আপামর শিশুর কাছে অন্যতম জনপ্রিয় ছড়া। অক্ষর জ্ঞান হওয়ার আগেই শিশুদের মুখে শোনা যায় এটি। আমের আদি বাসস্থান ভারত। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় আম দেখেছিলেন এবং খেয়েছিলেন। সম্ভবত তখন থেকেই আম ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দেশে। কবি আমির খসরু আমকে "নাঘজা তারিন মেওয়া হিন্দুস্তান" অর্থাৎ "হিন্দুস্তানের সবচেয়ে সুন্দর ফল" বলে উল্লেখ করেছিলেন। মৌর্য সম্রাট অশোকের নির্দেশে তাঁর সাম্রাজ্যের রাস্তায় বট এবং আমের চারা রোপন করা হয়েছিল ছায়া এবং ফলের জন্য। চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে এসে ভারতের আমের কথা প্রচারিত করেন। মরোক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪ শতকে আমের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। মোগল সম্রাট বাবরের বাবরনামাতে আমের প্রশংসা করা হয়েছে। শের শাহ সুরি মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে হারিয়ে এই বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ চৌসা জাতটির উদ্বোধন করেছিলেন বলে জানা যায়। আকবর শাহবাগে এক লক্ষ আমের চারা লাগিয়ে বিশাল আমবাগান তৈরি করেছিলেন সেসময়। ভারতের বাইরে শ্রীলঙ্কা, উগান্ডা, ভিয়েতনাম, ইজরাইল, মিশর, থাইল্যান্ড, চিন, সুদান, বাংলাদেশ, মেক্সিকো, কেনিয়া, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় আম জন্মায়।
আম্রমুকুল
আম হল ভারতের জাতীয় ফল। ফিলিপিন্সেরও জাতীয় ফল। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ। শ্রীপ্রিয়, পিকপ্রিয়, নৃপপ্রিয়, অনিপ্রিয়, কামশর, কান্তদূত, মাধবদ্রুম, কামবল্লভ, মধুলী, মদিরাসখ, ভৃঙ্গাভীষ্ট, সীধুরস, কোকিলােৎসব, মদাঢ্য, কামাঙ্গ, মধ্বাবাস, ষটপদাতিথি, পিকরাগ, প্রিয়াম্বু, সুমদন, রসাল, মন্মথালয়, মাকন্দ, অম্লফল, চুত, কীরেষ্ট, বসন্তদ্রু, মধুদ্রত, গন্ধবন্ধু, অম্র, কোকিলাবাস ইত্যাদি হল আমের সমার্থক নাম। এছাড়াও এই আমকে ওড়িয়াতে আম্বতাম্ব, অসমিয়াতে অম্বজ, ফার্সিতে আম্বা, কন্নড়ে মাবিন ফল, গুজরাটিতে আম্বাে, সংস্কৃতে আম্র, আম্রতাম্র, চ্যুত, মারাঠীতে আম্বা, আঁবা এবং তেলুগুতে মাবিডি বলা হয়। আর Anacardiaceae পরিবারের এই আমের বিজ্ঞানসম্মত নাম Mangifera indica। আমের আরও কিছু প্রজাতি হল --
Mangifera amba
Mangifera anisodora
Mangifera austroyunnanensis
Mangifera balba
Mangifera cambodiana
Mangifera domestica
Mangifera equina
Mangifera gladiata
Mangifera kukulu
Mangifera laxiflora
Mangifera linnaei
Mangifera maritima
Mangifera mekongensis
Mangifera montana
Mangifera oryza
Mangifera rostrata
Mangifera rubra
Mangifera sativa
Mangifera siamensis
গাছ ভর্তি আমের মুকুল
বাংলা সাহিত্যে ভুরি ভুরি আমের কথা উল্লিখিত হয়েছে। একটি জনপ্রিয় লোকছড়া প্রায়ই শোনা যায় শিশুদের মুখে --
'আমপাতা জোড়া জোড়া
মারব চাবুক ছুটবে ঘোড়া....'।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ফাল্গুন' কবিতায় উল্লেখ করেছেন আমের মুকুলের কথা --
'ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল,
ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল'।
যতীন্দ্রমোহন বাগচী তাঁর 'ফাল্গুনে' কবিতাতেও সেই আম্রমুকুলের প্রসঙ্গ এনেছেন --
'এসেছে ফাগুন, এসেছে আবার মধুমাস,
আম্রমুকুলে আঙিনা যে গেল ভরে'।
আম্রমুকুল চন্দ্রের প্রতি উৎসর্গীকৃত। সরস্বতী পূজায় পবিত্র ফুল হিসেবে আম্রমুকুল দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। কিন্তু শিলাবৃষ্টি, কুজ্ঝটিকা, খরা কিংবা কুয়াশা আমের মুকুলের চরমতম শত্রু। গাছভর্তি আমের মুকুলের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে এগুলির আক্রমণে। যদিও অন্যান্য গাছের মুকুলের তেমন ক্ষতি হয়না এইসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। তাইতো লোককথায় শোনা যায় --
'যত কুয়া আমের ক্ষয়,
তাল তেঁতুলের কিছু নয়'।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'শেষের কবিতা'তে লিখেছেন, 'আমের মাঝখানটাতে থাকে আঁটি, সেটা মিষ্টিও নয়, নরমও নয়, খাদ্যও নয়। কিন্তু ঐ শক্তটাই সমস্ত - আমের আশ্রয়, ঐটেতেই সে আকার পায়'। রামনারায়ণ তর্করত্ন 'কুলীন কুলসর্বস্ব' গ্রন্থে বলেছেন,
'লোকে বলে আম ফুরালে আসি,
বয়স ফুরালে কাঁদতে বসি'।
আবার এক জায়গায় কবিগুরু লিখেছেন,
'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি।
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ। ...
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক। ...
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে। ...
আমের বোলে ভরে আমের বন। ...
মোদের খেতে তখন ফোটে শন'।
আম হল গ্রীষ্মকালীন ফল। তাই নজরুল ইসলাম 'পল্লীজননী' কবিতায় লিখেছেন,
'রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল'।
সুকুমার রায়ের লেখা 'গ্রীষ্ম' ছড়ায় পাই --
'আম পাকে, জাম পাকে, ফল পাকে কত যে,
বুদ্ধি যে পাকে কত ছেলেদের মগজে'।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে। তিনি তাঁর 'কুড়ি বছর পরে" কবিতায় লিখেছেন, -- 'হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে
একরাশ পাতার পিছনে সরু সরু
কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের, ঝাউয়ের— আমের'।
আবার 'তুমি' কবিতায় লিখেছেন, 'আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে প'ড়ে আছো তুমি'। অন্নদাশংকর রায় তাঁর 'পেয়ারা পেয়ারের ফল' ছড়ায় লিখেছেন,
'আম বলো জাম বলো কাঁঠাল বা লিচু
মরসুম চলে গেলে থাকে নাকো কিছু'।
'কাঁচা আম' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
'তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্দুরে।
যখন দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে'।
আমের বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটি লৌকিক ছড়ার সন্ধান মেলে --
'মাঘে বোল, ফাগুনে গুটি, চৈত্রে কাটি কুটি
বৈশাখে আটি, জৈষ্ঠ্যে চুষি'। (ঢাকা)
আবার আর একটি পই প্রবাদেও আমের কথা রয়েছে --
'মাঘে জনম তার ফাল্গুনে চায়
চতির বাদে তারে কিছু কিছু খায়।
খায় তারে বৈশাখ আর জইঠে
ইলোরার ৩৪ তম গুহায় একটি আম গাছের নিচে জৈন দেবী অম্বিকার চিত্র খোদাই করা আছে। এই আমের কথা ভারতের প্রাচীন কাব্যের মধ্যেও মেলে। কৃত্তিবাসী 'রামায়ণ' এ পাই 'পূর্ণ স্বর্ণকুম্ভোপরি শোভে আত্মসার'। রাবণের লঙ্কাপুরী থেকে হনুমান ভারতে প্রথম আমগাছ নিয়ে এসেছিলেন। রামায়ণ অনুসারে একদিন হনুমান যখন সীতার কাছে যাচ্ছিলেন, তখন এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফাতে লাফাতে একটি আমগাছের উপর বিশ্রাম করতে থাকে। তখন সেই গাছের আম খেয়ে এতোটাই খুশি হয় যে সেই আমের আঁটি ছুঁড়ে দেন সমুদ্রের জলে। সেই আঁটি ভাসতে ভাসতে চলে আসে ভারতে। এবং তা ভারতে অঙ্কুরিত হয়। কাশীরাম দাসের 'মহাভারত'-এ রয়েছে-'পলাশ চম্পক আম্র অশোক কেশর'। কবি ভারতচন্দ্র রায় লিখেছেন, 'হায় বিধি পাকা আম দাঁড়কাকে খায়'। খনার বচনে আছে, 'আমে ধান, তেঁতুলে বান'। তেমনি 'চৈতন্য ভাগবত' এবং মাণিক গাঙ্গুলির 'শ্রীধৰ্ম্মমঙ্গল' কাব্যে পাই - 'ধান্য দধি আম্রসার'। 'লায়লা মজনু' কাব্যেও রয়েছে- 'কাকের মুখেত যেন সিন্দুরিয়া আম'। 'সদুক্তিকর্ণামৃত' গ্রন্থে পাই 'একদ্বেষু রসালশাখিযু মনাগুন্মীলিতং কুড়মলৈঃ.....'। চরকের লেখায় আছে, 'আম্রং বালং রক্ত পিত্তকরং মধ্যং তু পিত্তলম পক্কং বর্ণকরং মাংসশুক্র বলপ্রদম'। অর্থাৎ কচি আম রক্ত পিত্তকর, ডাঁসা আম পিত্তকর, এবং পাকা আম বর্ণ, মাংস, শুক্র ও বলদান করে।
হিন্দু সংস্কৃতিতে আম, আমকাঠ, আমপাতা অত্যন্ত মাঙ্গলিক সামগ্রী। জামাইষষ্ঠী, অম্বুবাচী, দশহরা সহ নানা উৎসবে পাকা আম কেটে দিতে হয়। যেকোনো পূজার যাগজজ্ঞতে সমীধ হিসেবে আমকাঠ লাগবেই। আর পূর্ণঘট স্থাপনের সময় আম্রপল্লব (আমসার) দিতেই হয়। গনেশ চতুর্থী, শ্রীপঞ্চমী, গৃহপ্রবেশ, নতুন খাতা, অক্ষয়তৃতীয়া ইত্যাদি পূজা ও উৎসবের সময় বাড়ির চারিদিকে দড়িতে আমপাতা ঝুলিয়ে মঙ্গল কামনার রেওয়াজ রয়েছে বাঙালি সংস্কৃতিতে। হিন্দু সমাজের লোকজন বিশ্বাস করে, বাড়িতে ছেলে সন্তান জন্মগ্রহণ করার সাথে সাথে নতুন আমপাতা গজায়। তাই বাড়িতে ছেলে হলে বাড়ির দরজায় দরজায় আমপাতা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এই পবিত্র আমপাতা বাড়িতে বিয়ের সময় দরজায় দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নবদম্পতির পুত্রসন্তান কামনা করে। শিবের সঙ্গে দেবী পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল আমগাছের তলায়। আর তাই এখনও ছাতনাতলা সাজানো হয় আমপাতা দিয়ে। হিন্দুপুরাণ অনুসারে আমগাছ হল ইচ্ছাপূরণ বৃক্ষ। ভগবান প্রজাপতির অবতার। এই গাছ ভালোবাসা ও উৎসর্গের প্রতীক। একবার গৌতম বুদ্ধকে একজন একটি আমবাগান উপহার দেন। সেই বাগানের আমগাছের তলায় বুদ্ধদেব বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই থেকে আমগাছও পবিত্র হিসেবে পরিগণিত বৌদ্ধদের কাছে।
পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন এলাকায় আমের ফলন ভালোই হয়। এরাজ্যের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ছাড়াও দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই কম বেশি আমের ফলন হয়। মেদিনীপুরের লোকেরা আমকে বোষ্টমের সাথে তুলনা করে বলে -- 'এতটুকু ডালে, বৈষ্টম দোলে'। এই আমগাছকে কেন্দ্র করে পাই আমগেছিয়া, আম্বি, আমডুবি, আমতলিয়া, আমতলা, আমগেছ্যা গ্রামনামগুলি। আম এখন অত্যন্ত অর্থকরী ফসল। হয়তাে মালদার মতাে আম অন্যত্র ফলেনা। তবুও যথেষ্ট পরিমাণে আমগাছ রয়েছে বিভিন্ন জেলায়।
বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নামের আমের দেখা মেলে। সেসব নামের কোনও ইয়ত্তা নেই। সেগুলির স্বাদ, আকার, আয়তন, গন্ধ এবং বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর। সেইসব আমের জনপ্রিয় নাম হিসেবে ফজলি, নাক ফজলী, হিমসাগর, মল্লিকা, মঞ্জিরা, জুলী, বৈশাখী, কলাবতী, রত্না, মায়া, নীলম, নীলাম্বরী, মালতী, শ্যামলতা, আম্রপালি, রাজলক্ষী, মাধুরী, জগৎ মোহিনী, সুন্দরী, সিঁদুরকৌটা, আলফানসো, দশেরা, চৌসা, কোহিতুর, ল্যাংড়া, বোম্বাই ল্যাংড়া, হীরালাল বোম্বাই, বোম্বাই, বোম্বে সায়া, বোম্বে গ্রিন, ব্যাঙ্গলোরা, পাটনাই, বৃন্দাবনী, বেনারসি, সূর্যপূরী, পলকপুরী, ভোজপুরী, শিবভোগ, রাজভোগ, দুর্গাভোগ, বাতাসাভোগ, রাখালভোগ, মালসাভোগ, গুটি লক্ষ্মণভোগ, লক্ষ্মণভোগ, কালীভোগ, বাদশাভোগ, গোপালভোগ, কিষেনভোগ, সাঁইভোগ, কৃষ্ণভোগ, কালুয়া গোপালভোগ, জিতুভোগ, ফারুকভোগ, দাদাভোগ, মিশ্রীভোগ, কর্পূরীভোগ, রাজভোগ, মোহনভোগ, সীতাভোগ, নিলম, মূলগোয়া, কারাবাউ, কেঊই সাউই, কেন্ট, পাহুতান, ত্রিফলা, গুঠলি, লখনা, আদাইরা, কাঁকুড়ে, দলদলে, আশ্বিনা, হাড়িভাঙ্গা, লখনা, আড়াইসেরি, কানাইবাঁশি, ভেজা, খির্সাপাতি, কাঁচামিঠে, ফুরফুরে, স্বর্গসুধা, বর্ণচোরা, বৌপাগলি, বউ ভুলানী, ছুঁচামুখী, বোতলমুখী, মৌচাক, পদ্মমধু, মধুকুলকুলি, মধুমনি, মধুমালতী, মধু চুষকী, চোষনকাঠি, রসগোল্লা, পেঁপেতলি, লংজাম, খাসকেল, চিনিখাস, সরিখাস, গোলাপখাস, চন্দনখাস, বেলখাস, বড়ো সাঁই, লঘুজাম, টুরটুরি, পুতুলে, পচামানিক, মানিকআশ, কলম সুন্দরী, মোহাম্মদ ওয়ালা, বনারাজ, খান বিলাস, জাফরান, রুইমুড়ো, ইলশে পেটী, কলম বাজি, ইয়াকুতিয়া, তৈমুরিয়া, জাহাঙ্গীর, কাওয়াশজি প্যাটেল, সাবিনা, সারুলী, ম্যাডাম ফ্রান্সিস, বিশ্বনাথ চ্যাটার্জি, কালা পাহাড়, মানজানিল্লো নুনেজ, শামসুল সামার, দিলসাদ, নোশা, জালিবাম, বাগান পল্লি, মালিহাবাদ, এঁসে, সিঙে, গুলাবজামুন, আলম শাহী, সামার বাহিশ্ত, নাজুকবদন, রুমানি, কাকরহিয়া সিকরি, পাথুরিয়া, সামার বাহিশ্ত, তোহফা, মিঠুয়া, জিলাপি কাড়া, মিছরিদানা, মিছরি দমদম, তিলে, মন্ডা, মতিমন্ডা, লাড্ডু, লেবু, কলা, আনারস, সফেদা লখনৌ, সফেদা, কুমড়া জালি, কলামোচা, পেয়ারাফুলি, বেগমফুলি, তোতাফুলি, তালতুলি, দুধ কুমার, দুধ কুমারী, দুধে মালদা, দুধিয়া, দুধস্বর, মহানন্দা, সুবর্ণরেখা, সিন্ধু, পুকুরপাড়, কর্পূরা, হারিবাড়ি, হুসনে আরা, বাংলা ওয়ালা, মোম্বাসা, রোসা, পাঁচনম্বর, দোফলা, লতা, জহুরী, জালিখাস, কালিয়া, বড়বাবু, খোড়া, ইয়ার চারা, রসকি জাহান, ওকরাং, বাদামী, চকচকা, ছাতাপোরা, বালিশ, গৌড়মতি, ক্ষুদি ক্ষিরসা, কেলেপাহাড়, সবজা, কাস্তে, মুণ্ডমালা, আষাঢ়ে, টরজেল, নেকো, ভূগোল, বাউনিলতা, রাঙামুড়ী, টিয়াকাটি, কাজিপসন্দ, সফদরপসন্দ, রাণীপসন্দ, মহারাজপসন্দ, আজিজপসন্দ, শোভাপসন্দ, কাদেরপসন্দ, সিদ্দিকপসন্দ, বিলুপসন্দ ইত্যাদির নামোল্লেখ করা যায়।
আমগাছ প্রায় ৩০-৪০ মিটার (১১৫-১৩০ ফিট) লম্বা এবং সর্বোচ্চ ১০ মিটার ব্যাসার্ধের হয়ে থাকে। আম গাছ বহু বছর বাঁচে। মাও সে তুংয়ের ভালবাসার প্রতীক হিসাবে চিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল আম। আদিবাসীদের বিয়ের সময় কোথাও কোথাও বরকনে আমগাছকে কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে। তারপর বিবাহের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। বিয়ের সময় বর আমগাছের ডালে সিঁদুর দান করে এবং সেই গাছকে জড়িয়ে ধরে। আর অন্যদিকে কনে মহুয়া গাছে সিঁদুর দিয়ে জড়িয়ে ধরে। ওড়িশায় বাসি বিয়ের দিনে আমপাতা দিয়ে বরের দাঁত মাজার রীতি পরিলক্ষিত হয়। কচি আমপাতা দুই ঠোঁটের মধ্যে রেখে বিশেষ শব্দের বাঁশি তৈরি করে ছোটরা।
যেকোনো পূজার্চনায় নৈবেদ্য হিসেবে পাকা আমের স্থান অন্যতম। আর ফল হিসেবে আমের গুরুত্ব অপরিসীম। কাঁচা ও পাকা -- দুই ধরনের আমই রসনাপ্রিয়। ছোট ছোট কাঁচা আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে নুন লঙ্কা মিশিয়ে রোদে রেখে চাঁট বানিয়ে খাওয়ার মজা যে নেয়নি, তাঁর ছোটবেলা ম্যাড়মেড়ে কেটেছে। কাঁচা আমের কাসুন্দি, আচার, চাটনি, আমসি (আমসঁটা) বাঙালির জিভে লেগে থাকে সবসময়। আর পাকা আমের আমস্বত্ব তো অসাধারণ। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি ....'। অনেকেই ভাত খাওয়ার সময় আম এবং দুধ মিশিয়ে খায়। অথর্ববেদে এই খাদ্যকে বলে 'সোমধারা'। যা কিনা শক্তিবর্ধক। আমের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি, ডি, অ্যাসকর্বিক অ্যাসিড, পেস্টিডিন, গ্যালাকটোসাইড, UDP Glucosepyrophosphorylase, ADP Glucosepyrophosphorylase, Ethyigaliate, Phenol, Starch ইত্যাদি।
আম খুব উপকারী ফল। উদরাময়, গলাব্যাথা, অজীর্ণ, আমাশয়, শ্বেতপ্রদর, পোড়া ঘা, অকালে দাঁত পড়ে যাওয়া, বমিভাব, অকালপক্কতায়, রক্তপিত্ত, অতিসার, প্লীহা বৃদ্ধি পা ফেটে যাওয়া, নখকুনি, চুল উঠে যাওয়া, চুলে খুসকি, খোস পাঁচড়া, বহুমূত্র ইত্যাদি রোগের নিরসনে আমের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
'এ তো সহজ কথা,
অঘ্রানে এই স্তব্ধ নীরবতা
জড়িয়ে আছে সামনে আমার
আমের গাছে;
কিন্তু ওটাই সবার চেয়ে
দুর্গম মোর কাছে।
বিকেল বেলার রোদ্দুরে এই চেয়ে থাকি,
যে রহস্য ওই তরুটি রাখল ঢাকি
গুঁড়িতে তার ডালে ডালে
পাতায় পাতায় কাঁপনলাগা তালে
সে কোন্ ভাষা আলোর সোহাগ
শূন্যে বেড়ায় খুঁজি'।
---- আমগাছ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
🍂
0 Comments