ৎসারিৎসিনের রক্ষীবাহিনীর বীরদের প্রতি
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৩
বিজন সাহা
ভোলগাগ্রাদের কথা
গত পর্বে আমরা ভোলগাগ্রাদের শৈশবের কথা বলেছি। ১৭৫০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল ছিল রুশ সাম্রাজ্যের ভারোনেঝ অঞ্চল এবং যাযাবর, মধ্য এশিয়া ও ককেসাসের খানদের রাজ্যের মধ্যে বাফার জোন। এই সময় পর্যন্ত ৎসারিৎসিন ছিল সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক সীমান্ত শহর। তবে রুশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে এসব এলাকায় শান্তিপূর্ণ জীবন ফিরে আসে। ১৭৭৫ সালে ৎসারিৎসিন বর্ডার লাইন ও ভোলগা অঞ্চলের কসাক বাহিনী বিলুপ্ত করে রুশ সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব আজোভ ও মাজদক বর্ডার লাইনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। শুরু হয় ৎসারিৎসিন ইতিহাসের নতুন পর্যায়। শহরের আশেপাশে নতুন নতুন উপশহর গড়ে উঠতে থাকে। ১৮২০ সালে শহর উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা গৃহীত হয়। এ সময় রাশিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে কৃষকরা ৎসারিৎসিন অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে আসতে থাকে। রাশিয়ার নাগরিক ছাড়াও সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার আমন্ত্রণে জার্মান অভিবাসীরা এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করে। সাথে করে তারা নিয়ে আসে নতুন প্রযুক্তি, আনে নতুন সামাজিক রীতিনীতি। এই এলাকায় অবস্থিত সারেপতা-অন-ভোলগায় প্রথম স্কুল, ফার্মেসি, কফি হাউজ গড়ে ওঠে, এখানেই প্রথম চাষ করা হয় আলু, সর্ষে, তামাক। এখানে ১৮১২ সালে প্রথম ফ্যাক্টরি তৈরি হয়। এটা ছিল সর্ষের তেল ভাঙ্গানোর কারখানা যা এখনও কাজ করছে। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৎসারিৎসিনে মূলত ফুড ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপ করতে থাকে ফলে এখানে লবন শিল্প এবং মৎস্য শিল্পের পাশাপাশি তরমুজ চাষের সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে। এখানকার বনিকেরা রাশিয়ার বিভিন্ন স্থানে লবন, সর্ষে, তরমুজের মধু, লবনাক্ত ও শুটকি মাছ সরবরাহ করত। কিন্তু ঘন ঘন খরা, তীব্র শীত ও পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে এই এলাকার কৃষিকাজ সব সময়ই বিপদজনক ছিল। এমনকি আমাদের সময়েও এই অবস্থার খুব একটি পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে এই এলাকার লোকজন প্রায়ই বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যেত – এসব কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল নৌকার গুণ টানা, বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দ্রব্য সরবরাহ করা যাদের আধুনিক রূপ হয়তো ট্রাক ড্রাইভার।
স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের স্মরণে এক সৈনিক১৮৬১ সালে দাস প্রথা বিলুপ্ত হলে শহরে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়। ১৮৬২ সালে ভোলগা – দন রেল লাইন তৈরি হলে এলাকার অন্যান্য শহরের তুলনায় ৎসারিৎসিনের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৮৬৮ সালে মস্কো এবং বাল্টিকের সাথেও রেল যোগাযোগ শুরু হলে ৎসারিৎসিন গুরুত্বপূর্ণ ট্র্যান্সপোর্ট জংশনে পরিণত হয়। ১৮৯৯ সালে ৎসারিৎসিন রেলপথে কাস্পিয়া ও কৃষ্ণ সাগরের সাথে সংযুক্ত হয়। সংক্ষিপ্ততম পথে কাস্পিয়ার তেল, দনবাসের কয়লা ও উরালের মেটাল সরবরাহ করার কারণে ৎসারিৎসিন এই এলাকার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সময় জলপথেরও ব্যাপক উন্নতি ঘটে। গুণটানা মানুষের জায়গায় আসে ককেসাস ও মারকুরি নামে যন্ত্রচালিত জাহাজ, ১৮৭৮ সালে যাতায়াত শুরু করে প্রথম তেলবাহী ট্যাঙ্কার জরোয়াস্টার। সে সময় বিভিন্ন ইংলিশ ও ফ্রেঞ্চ ফার্ম এখানে কাজ করতে শুরু করে।
১৯১০ সালে পাদ্রী ইলিওদোরের উদ্যোগে ৎসারিৎসিন অর্থোডক্স- মোনার্ক উগ্রবাদী গ্রুপ ব্ল্যাক হান্ড্রেডদের রাজধানীতে পরিণত হয়। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে ৎসারিৎসিনে আলেক্সান্দর নেভস্কি সাবর নামে বিশাল গির্জার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এই গির্জার পবিত্রকরণ উৎসব হয় ১৯১৮ সালে। কিন্তু ১৯৩২ সালে এই গির্জা ধ্বংস করা হয় আর ২০২১ সালে মানে আমাদের ভ্রমণ কালে পুনরায় নির্মাণ করা হয়। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পরে রাশিয়ার ঐক্যে ফাটল ধরে। বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতা দখল করে অপেক্ষাকৃত সংহত ও প্রয়োজনে সশস্ত্র আক্রমণে প্রস্তুত দলগুলো। এখানে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল শক্তিশালী নেতৃত্ব। ৎসারিৎসিনে এমন নেতা ছিলেন এরমান ও মিনিন। তারা ১৯১৭ সালের ২৭ অক্টোবর (৯ নভেম্বর), মানে বিপ্লবের মাত্র দুই দিন পরে এখানে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়। যেহেতু শহরে তখন অনেক কলকারখানা ছিল, তাই প্রলিতারিয়েতের সংখ্যাও কম ছিল না। তারা স্বাভাবিক ভাবেই বলশেভিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ফলে বিপ্লবের প্রায় সাথে সাথেই এখানে সোভিয়েত ব্যবস্থা স্থাপিত হয়।
ভোলগাগ্রাদ আসার পথেই আমি জেমসের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। জেমস বাংলাদেশের ছেলে। এখানেই পড়াশুনা করেছে। ও এসেছে আমার এক বছর আগে ১৯৮২ সালে। ঐ ব্যাচের অনেকেই আমার বন্ধুদের বন্ধু, ফলে এদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। জেমস ছাড়াও লেনিনগ্রাদের শিহাব, কিয়েভের নিশীথ আর মস্কোর নীলরতন – সবাই ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী। ফলে ছাত্রজীবনে এদের সাথে ভালো যোগাযোগ ছিল। আমার মত জেমসও রাশিয়ায় থেকে যায়। তাই আমি ঠিক করলাম ভোলগাগ্রাদ যখন যাচ্ছি, ওর সাথে দেখা করি। আর সম্ভব হলে ওর সাহায্যে স্থানীয় জার্মানদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। দিলীপ নিজেই আগ্রহী ছিল সম্রাজ্ঞী ইয়েকাতেরিনার আমলের জার্মানদের সাথে দেখা করে তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে। তবে আমি এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে ভোলগা এলাকার জার্মানদের কাজাখস্তানের স্তেপ এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে এদের অনেকেই জার্মানি ফিরে যায়। কাজাখস্তানের কথা যখন উঠল তাহলে আবার একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। এর আগে এ নিয়ে কিছুটা বলেছি। ১৯৮৩ সালে আমি মস্কো আসি। ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মে ছাত্র নির্মাণ দলের সাথে কাজ করতে যাই কাজাখস্তানে। আসলে সেই সময় ছাত্ররা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যেত। কেউ কেউ যেত ইংল্যান্ডে ভারতীয় রেস্টুরেন্টে কাজ করতে। ভারতীয় রেস্টুরেন্ট নাম হলেও বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যেত সিলেটিদের রেস্টুরেন্টে। ওদের নিয়ে অনেক গল্প আছে। সিলেটের ভাষা বাংলা থেকে একটু অন্য রকম। ওরা নিজেদের সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলত। মস্কো থেকে যারা যেত ওরা ইংরেজি অতটা ফ্লুয়েন্ট বলতে পারত না। তাই রেস্টুরেন্টের মালিকেরা ওদের বলত – বাংলা জান না, ইংরেজি জান না কাজ করবে কীভাবে? এই নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। আবার মস্কো থেকে দেশে ফেরার সময় বিমানে ওদের সাথে দেখা হত। তখন এরোফ্লতের বিমান লন্ডন থেকে যাত্রী নিয়ে মস্কো হয়ে ঢাকা যেত। এরোফ্লত ছিল তুলনামূলক সস্তা বিমান। তাই অনেকেই সেটা ব্যবহার করত। ইংল্যান্ড থেকে আসা সিলেটি ছেলেরা আমাদের সাথে গড়গড় করে ইংরেজিতে কথা বলত। কিন্তু ঢাকায় ল্যান্ড করার আগে যখন ফর্ম ফিল আপ করতে হত, বলত – ভাই ফর্মটা একটু ফিল আপ করে দেন। পরে জেনেছি ওরা ইংরেজি ফ্লুয়েন্ট বললেও পড়াশুনার সাথে এদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল, তাই আমাদেরই এগিয়ে আসতে হত ওদের সাহায্যে। অবশ্য এতে লাভও হত। ১৯৮৭ সালে মনে হয়, দেশে ফেরার সময় বিমানে ছিলেন মহিলা পরিষদের বিশাল ডেলিগেশন। তারা মস্কো থেকে ঢাকা ফিরছিলেন। অনেকের সাথে ছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল। মস্কো থেকে আমাকে বলা হয়েছিল ওনার দেখাশুনা করার। তিনি যখন প্লেনে পান খেতে চাইলেন লন্ডনের এই বাচ্চারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। যাহোক ফিরে আসি জার্মানদের কথায়। কাজাখস্তানে আমরা গেছিলাম একটা গ্রামে। সেটা ৎসেলিনোগ্রাদ থেকে কিছুটা দূরে। সে সময় ৎসেলিনোগ্রাদ ছিল ছোট এক মফঃস্বল শহর।
আলেক্সান্দর নেভস্কি সাবরসোভিয়েত আমলে বিভিন্ন ধরণের যুগান্তকারী কাজ করা হয়েছিল, তাদের একটি ছিল কাজাখস্তানের মরুভূমি বসবাসের উপযোগী করে তোলা। এর উপর সোভিয়েত নোবেল বিজয়ী লেখক মিখাইল শলোখভের একটি উপন্যাস আছে – পদনিয়াতিয়ে ৎসেলিনি বা অহল্যা ভূমি উদ্ধার। বর্তমানে সেই ৎসেলিনাগ্রাদ কাজাখস্তানের রাজধানী আর তার নতুন নাম আস্তানা। যে গ্রামে আমরা কাজ করতাম সেটা ছিল বেশ বর্ধিত এক গ্রাম। এটা সাবখোজ – সভিয়েতস্কোয়ে খজাইস্তভা যাকে বলা চলে কালখোজের যমজ ভাই। সেই গ্রামে কয়েক শ পরিবারের বসবাস। আমরা সারাদিন কাজ করতাম, বিকেলে যেতাম ক্লাবে সিনেমা দেখতে অথবা ডিস্কো নাচতে। ক্লাব ছিল স্থানীয় ছেলেমেয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ। তখনও আমি রুশ আর জার্মানদের মধ্যে পার্থক্য খুব একটা ধরতে পারতাম না, আমার কাছে সবাই ছিল সাদা চামড়ার মানুষ। তাছাড়া আমাদের সাথে আরনি ও কার্ল নামে পূর্ব জার্মানির দুই ছেলে কাজ করত। স্থানীয়রা ওদের মতও ছিল না। পরে একদিন আমরা আমাদের ক্যাম্পের সামনে এক বাড়ি যাই ওদের কিছু কাজ করে দিতে। এটা ছিল কাজাখ পরিবার। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তারা আমাদের রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকেন। ওদের মুখেই শুনি ওরা ছাড়া গ্রামের সবাই জার্মান, যুদ্ধের সময় স্তালিন ওদের এখানে নির্বাসনে পাঠায়।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments