জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প—জাপান (এশিয়া)/ইঁদূর রাজকুমারির বর /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোক গল্প—জাপান (এশিয়া)
ইঁদূর রাজকুমারির বর
চিন্ময় দাশ

অনেক কাল আগের কথা। জাপানের কিয়োতো শহরে থাকত এক ইঁদূর রাজা। সে রাজার মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনই বুদ্ধিমতী। রাজার মনে ভারি গর্ব তার মেয়েকে নিয়ে।
দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স হোল। আহা, চোখ ফেরানো যায় না, সে মেয়ের দিকে তাকালে। রাজার সে দিকে মন নাই। তার একটাই ভাবনা, মেয়ের বর পাওয়া যাবে কোথায়?
শেষমেষ একদিন দরবার ডেকে দিল রাজা। মন্ত্রী, আর পারিষদগণ সকলে সভায় হাজির। রাজা তার মেয়ের রূপ-গুণের খতিয়ান দিয়ে, বলল—আমার মেয়ে সাধারণ ইঁদুর নয়। আমার মেয়ে যেমন রূপবতী, তেমনি বুদ্ধিমতী আর গুণবতীও।
--তো, মেয়ের তো বয়স হয়েছে বিয়ে দেবার। আমার ইচ্ছা, আমার মেয়ের বর হবে এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষটি। এবার তোমরা সবাই বলো, কে সেই ছেলে?
পারিষদবর্গের তো কাহিল অবস্থা। তারা সবাই মাথা নাড়তে লাগল। লেজ নাচাতে লাগল। গভীর চিন্তা করতে লাগল। কে হতে পারে, দুনিয়ার সব চেয়ে শক্তিশালী? কোথায় থাকে সে?
অনেক সময় বাদে, পারিষবর্গের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ ইঁদুরটি এগিয়ে এসে, বলল—আমার বিচারে সূর্যই হলো সব চেয়ে ক্ষমতাবান। সুর্য থেকেই আলো পাই আমরা। উত্তাপ পাই। সূর্যই হোল আমাদের জীবনের উৎস। এমনকি, আমাদের এই যে দেশ জাপান, তার সম্রাটের পোষাকেও সূর্যই তো অবস্থান করে।
রাজার বেশ মনে ধরল কথাটা। মাথা নেড়ে বলল—খুব ভালো কথা বলেছ। সূর্যের সাথেই বিয়ে দেব আমার মেয়ের।
রাজার কথা সবে শেষ হয়েছে, একজন পারিষদ দু’পা এগিয়ে এল। বলল—কিন্তু সূর্যই কি সবার চেয়ে ক্ষমতাবান? তাহলে, মেঘ কী করে সূর্যকে ঢেকে দেয়? আমার মনে হয়, মেঘ সূর্যের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান।
রাজার বেশ পছন্দ হোল কথাটা। বলল—তাই তো! ঠিকই বলেছ। তাহলে, সূর্য কেন? মেঘের সাথেই বিয়ে হবে আমার মেয়ের।
রাজার কথা শুনে, আর একজন পারিষদ এগিয়ে এল—তা কেন? বৃষ্টির ক্ষমতা তো মেঘের চেয়ে বেশি। মুষল্ধারা বৃষ্টি ঘন কালো মেঘকেও মুছে দিতে পারে। এ কথা সবাই আমরা জানি।
রাজা বলল—তাহলে বৃষ্টির সাথেই বিয়ে হবে আমার মেয়ের।
এবার চতুর্থ এক ইঁদুর উঠে দাঁড়াল। বলল—তা কেন, রাজামশাই? বৃষ্টি ঘন মেঘকে মুছে দিতে পারে, সে কথা ঠিক। কিন্তু যতো মুষলধারেই বৃষ্টি হোক না কেন, বড় একটা কামোউ গাছের কোন ক্ষতিই করতে পারে না সে।
রাজা এ কথায় রাজি। বলল-- তাহলে, কামোউ গাছের সাথেই বিয়ে দেব মেয়েটার। 

🍂

পঞ্চম একজন লাফিয়ে উঠল এ কথা শুনে। বলল—ক্ষমতার কথাই যখন বিচার করছি আমরা, সেখানে বাতাসের কথা আলোচনা করছি না কেন? যত বড় গাছই হোক না কেন, ঝোড়ো বাতাস কিন্তু এক ঝটকাতেই তাকে ভেঙে শুইয়ে দিতে পারে। তাহলে, কে বড়? 
রাজা বলল—এটা কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ। বাতাসই হবে আমার মেয়ের বর।
এবার পরের একজন উঠে দাঁড়াল—না, রাজামশাই। বাতাসের চেয়ে  ক্ষমতাধর হোল আমাদের এই মাটির পৃথিবী। বাতাসের যত ক্ষমতাই থাক, মাটির কোন ক্ষতি করতে পারে না। তাহলে তো আমরা বেশ বুঝতে পারছি, মাটির চেয়ে বড় কেউ নাই এই দুনিয়ায়।
একথা শুনে, রাজা লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছে, সপ্তম পারিষদ উঠে বলল—আমার কিন্তু মনে হয় না, পৃথিবী অপরাজেয়। তারচেয়ে বড় আর কেউ নাই। 
রাজা বলল—বলো কী হে? পৃথিবীর চেয়েও বড় কেউ আছে এই দুনিয়ায়! কে সে?
--কেন? আমাদের কাঠের প্রাসাদ। সপ্তম বলল—কিংবা ধরুন, একজন গরীবের একটা কাঠের কুঁড়েঘর। যদি ভেঙে পড়ে, তাহলে মাটিকে, মানে পৃথিবীর খানিকটা হলেও অংশকে তো সে বন্দি করে রাখতে পারে। 
রাজা বলল—এত ক্ষণে বুঝেছি, কাঠের ঘরই হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমাবান। কাঠের ঘরের সাথে মেয়ের বিয়ে দেব আমি।
আলোচনা শেষ। ফয়সালা হতে যাচ্ছে, মন্ত্রী উঠে দাঁড়াল। বুড়ো বয়েস তার। রাজার ঠিক পাশেই তার আসন। এতক্ষণ সব শুনছিল মন দিয়ে। একটি কথাও বলেনি মুখ ফুটে। 
বুড়োর মুখে ইয়া লম্বা এক জোড়া গোঁফ। গোঁফ নাচিয়ে, মন্ত্রী বলল—একটু সবুর করা যাক। কুঁড়েঘর হোক বা প্রাসাদ, কাঠের বাড়ির চেয়েও বেশি শক্তি ধরে, এমন কেউ আছে কি না, সেটা একবার ভেবে নেওয়া দরকার। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। বিশেষত আমাদের রাজার মেয়ে। রূপে গুণে এই দুনিয়ার সেরা মেয়ে সে। 
পারিষদবর্গ তেমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। রাজারও মুখ গম্ভীর। তেমন কাউকে মনে পড়ছে না রাজারও। 
রাজা বলল—তেমন কে আছে বলো তো? তেমন কেউ যদি থেকে থাকে, তার সাথেই মেয়ের বিয়ে দেব।
মন্ত্রীর মুখে মুচকি হাসি। বলল—আমাদের সকলের চোখের সামনেই আছে তেমন ক্ষমতাবান। আমাদের সবার ঘরে ঘরেই আছে তেমন যুবকের দল। যারা এক রাতেই বড় একটা কাঠের প্রাসাদকেও,কেটে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে। একজন যুবক ইঁদুরের চেয়ে, বেশি ক্ষমতা ধরে, তেমন কেউ আছে না কি এই দুনিয়ায়? কেউ নাই। 
রাজার তো খুশি ধরে না। পারিষদগণও খুশি। সবাই মিলে আনন্দ কোলাহলে দরবার ভরিয়ে তুলল। 
রাজা বলল—থামো সবাই। আমার একটা শেষ কথা বলবার আছে। 
সবাই উৎসুক। এই ফয়শালার পর, আর কোনও কথা চলে না কি? সবাই চুপ করে গেল।
রাজা বলল—শোন হে, মন্ত্রী। তোমার ঘরেই তো আছে একটি যুবক ছেলে। তার সাথেই বিয়ে দেব আমার মেয়ের। 
আনন্দে মন্ত্রীর তো মুখে কথা সরছে না। রাজা বলল—মুখে কথা নেই কেন তোমার? 
মন্ত্রী বলল—রাজার ফয়শালায় আমি আর কী বলব?
--আচ্ছা বেকুব তো তুমি। এতে দুজনেরই দুটো লাভ হোল, মাথায় ঢুকছে না তোমার? 
মন্ত্রী আমতা আমতা করে বলল—দুজনেরই লাভ হোল? সেটা কী রকম? 
রাজা বলল—তোমার লাভ হোল, ছিলে বেতন খাওয়া মন্ত্রী। হয়ে গেলে রাজার বেয়াই। লাভ হোল না?
মন্ত্রী তো আহ্লাদে আটখানা। তার মুখের হাসি যেন দরবারের মাটিতে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। একটু সামলে নিয়ে, জানতে চাইল—মন্ত্রীর লাভ তো বুঝলাম। কিন্তু রাজার লাভ? সেটা কী রকম? 
রাজা বলল—লাভ তো রাজারই হোল বেশি। আমার মেয়ে, আমার বুকের ধন। সে আমার ঘরেই রইল। বাইরে দূরে পাঠাতে হোল না তাকে। ও তুমি বুঝবে না হে। ঘরে মেয়ে থাকলে বুঝতে। মেয়েকে অন্যের ঘরে পাঠানো কত কষ্টের।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল রাজার মেয়ের। রাজ্যশুদ্ধ সবাই ভোজ খেলো সেই বিয়েতে। 
পরে, সেই জামাই ইঁদুরই যে দেশের রাজা হয়েছিল—একথা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না কাউকে।

Post a Comment

0 Comments