পর্ব -৯
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
ভেঙেছো দুয়ার...
পরের শীতে মা বুনল নীল একখানা সোয়েটার আর বাবা কিনল বাদামি রেক্সিনের বইয়ের বাক্স। ভেতরে তার আসমানী রং কাপড়ের লাইনিং। দেখো দেখো,ভেতরের ডালায় ছোট্ট একটা পকেটও রয়েছে যে! তা ভেবে দেখলে পকেটের মতো ভালো আর কিচ্ছুটি হয় না।
ঝিনি বরাবর পকেটওলা জামা বা প্যান্ট চেয়ে এসেছে দাদাদের মতো। তা দর্জিরা নাকি ছোট মেয়েদের জামা প্যান্টে পকেট বানাতে হরদম ভুলে যায়। অথচ কত দরকারি জিনিসই না রাখা যায় ওই পকেটে। দাদাদের প্যান্টের মতো পকেটের জোরদার দাবিতে খুঁজেপেতে মা পকেটওলা এক ধরনের সুতির ঝলঝলে ইজের প্যান্ট কিনে আনে অথবা নিজেই তৈরি করে দিতে বাধ্য হয়।
ঝিনি তাতেই সন্তুষ্ট। কেননা যখন মনি টেনি খোকন বাচ্চুদের সাথে দল বেঁধে তারা সেঁয়াকুল বা আশফল খেতে যায় অথবা ছোলা মটরের খেত থেকে চুরি করে আনে খেতের মালিক টের পাবার আগেই কাঁচা ছোলা আর মটরের শুঁটি সবাই ওরা ইজেরের পকেট ভর্তি করে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসে। কিংবা ঘোষেদের আম বাগান অথবা জগন্নাথ ঠাকুরের জাম তলায় কিংবা ঝিনিদের নিজেদের বাগানেরই লিচু, খেজুর,আম বা জামরুলতলায় ভোর বেলা খুঁজে খুঁজে কুড়িয়ে তোলে পাকা যে সব ফল সেসব রাখার জন্য পকেটের খুবই দরকার পড়ে।
গুলতি, আর পোড়া মাটির গুলিই বা সে রাখে কোথায় কেননা ছোড়দার পুরনো গুলতিটাও তো সে পেয়ে গেছে। বদলে অবিশ্যি ছোড়দাকে ভাঙা প্রিজমখানা দিয়ে দিতে হয়েছে।প্রিজমটা সে কুড়িয়ে পেয়েছিল বীরেন ঘোষের আমবাগানে।মস্ত লরির মতো মাঠকোঠা বাড়িটা ভাড়া দিয়ে বীরেন ঘোষ থাকে কলকাতায়।কাজেই তার খোলা আমবাগানে ছোটরা খেলে,আম কুড়োয়,দড়ি বেঁধে ঝুল খায়।তো সেখানেই কী যেন চকচক করছে দেখে সে পকেটের ঝিনুক দিয়ে মাটি খুঁড়ে পুরো জিনিসটা বার করে আনে।তেকোণা নিরেট আর ভারি কাচখণ্ডটার একটা কোণা সামান্য ভাঙা। দৌড়ে বাড়ি এসে সে রুবিদিকে দেখায়।
কতা কলি শুনবি কলাম ঝিনি!ছাতামাতা কোয়ানের থে কী কুড়োয় আনিছিস ফেলায় দে কতিছি।তারপর কী ভেবে জিনিসটা ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে মুছে সে ঝিনির হাতে দেয়।বদলে ঝুটঝামেলা না করে ঝিনিকেও ঝটপট চান করে ভাত খেয়ে নিতে হয়। এমনিতে পরিস্কার শাদা একখণ্ড কাচ বৈ কিচ্ছু না কিন্তু কাচটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গেলেই রামধনুর মতো রঙ যেন লেগে যাচ্ছে তার গায়।
জিনিসটা আসলে কী যখন দাদারাও বলতে পারলো না,সন্ধেবেলা মাস্টারমশাই বললেন এতো একটা প্রিজম।সাত রঙের আলো মিলে যে শাদা রঙ আলো তোমরা দেখো সেই আলো এর ভেতর দিয়ে গেলেই ভেঙে যায় তাই তো রামধনুর মতো রঙ দেখতে পাচ্ছো।
সেই ইস্তক ছোড়দা প্রিজমখানার জন্য অনেক তোতাইপাতাই করছে ঝিনিকে। একটা ছোট্ট আতস কাচ আর ছোট্ট বাইনোকুলার ছোড়দার আছে এখন প্রিজমটা পেলে কী নাকি গবেষণায় খুব সুবিধে হয়।ঝিনি অবশ্য রাজি হয়নি। সর্বদাই সেখানা সঙ্গে করে ঘোরে। বালিশের তলায় নিয়ে শোয়।
আরেব্বাস! রঙের কাণ্ড কারখানা সোজা ব্যাপার নাকি?বাবা হেসে বলল, এ যে দেখি রাজার কাছে যে ধন আছে ঝিনির কাছেও সে ধন আছে! তবে কিনা ভালো জিনিস ভাগ করে নিলে তা আরও ভালো হয়ে যায়। ছোড়দাকেও একটু খেলতে দিও কেমন?হেম মাথা দুলিয়ে বলে এক ঝিনিতে ঝিনঝিনালো/সাতটি রাণীর নাক কাটালো!
ঝিনি তাই শুনেই ,নিবি ছোড়দামনি? গবেষণা করে আবার কিন্তু ফেরত দিবি হ্যাঁ?ভাগ এখান থেকে তোর ভাঙা কাচ নিয়ে ! খানিক আগেই আমসত্ত্বের কৌটো পুরো ফাঁকা করার কারণে চড় থাপ্পড় খেয়ে মেজাজ খারাপ করছিল মিতু।ঝিনির কথায় হঠাৎই ক্ষেপে গেল সে। মুখ ভেংচিয়ে বলল,মন্টু বিড়ি পেয়েছে এক ব্যাঙের আধুলি!
তা সবাই যাই বলুক সত্যিই ঝিনি কুড়িয়ে পেয়েছে রূপকথার মোহরের চাইতেও যেন দামি কী একটা। আলাদীনের প্রদীপ বা ম্যাজিক কার্পেটের চাইতে এতটুকু কম যায় না।কদিন ধরে আশ্চর্য রঙের ঘোরে পড়ে গেল সে।কাচখানা চোখে লাগালেই এই পথঘাট ঘরদোর সবেতেই রঙ আর রঙ।ওই তো মা ইস্কুল থেকে ফিরছে খাতার বাণ্ডিল হাতে আর মার চওড়া পাড়ের শাদা শাড়িতেও জড়িয়ে যাচ্ছে রঙধনু।গাছগাছালি ইট কাঠ খেলনা পাতি সবকিছুতেই জাদুকাঠি ছোঁওয়ার মতোই ময়ূরকণ্ঠী এই যে রঙ লেগে আছে অথচ শাদা চোখে দ্যাখো বুঝতেই পারবে না!
তোরা আমায় বানিয়ে বলিস?স্কুল থেকে হেম ফিরতেই সে কাঁধ ধরে ঝুলে পড়ে। দাঁড়া দাঁড়া ব্যাগটা তো রাখতে দে তারপর শুনি সমস্যা।তা'লে সবাই যে বলে গল্প হলো স্রেফ গল্প চোখে দেখা যায় না যা ,মোটেও সত্যি না সেসব?অথচ এই তো দেখছ শাদা সব আর এই কাচের ভেতর সব রঙিন!তা'লে বল খেলার বড় মাঠ তারো পরে যে মাঠ তারো পরে তারো পরে কি তেপান্তরের মাঠ নেই? ময়ূরপঙ্খী,মন পবনের নাও,আ্যলিসের আজব দেশ,কোট পরা খরগোশ এসব তো আছে নাকি?এত রঙ যদি সত্যি হয় তা'লে এরা কেমন করে মিথ্যে হবে মেঝেতে পা ঠুকে ঝিনি জিজ্ঞেস করে।তার রাগি খানিক দিশেহারা চোখের দিকে শান্ত চোখ তুলে হেম বলে কে বলেছে সত্যি নয়? সব আছে। সেসব আমাদের বুকের মধ্যেই থাকে।এই যে তুই স্বপ্ন দেখিস হারিয়ে গেছিস কোন অজানা মাঠের ভেতর,ওটাই তো তেপান্তর।ওসব আছে বলেই তো স্বপ্নে দেখিস।প্রিজমের ভেতরে যেমন রং, মানুষের স্বপ্ন আর কল্পনার ভেতরে তেমন রূপকথা বুঝলি। প্রশ্নের জবাব পেয়ে সে জড়িয়ে ধরে হেমকে। বুঝলি হেম তোর গায়ে শসা শসা গন্ধ খুব ভালো। আচ্ছা হয়েছে এবার আমায় হাতপা ধুতে দে।কিছুদিন পর অবিশ্যি অবিশ্বাস্য এই রঙের খেলা সয়ে এল চোখে।
তখন ছোড়দার পুরনো গুলতি আর কাচের মার্বেলগুলোর বদলে সে প্রিজমটা ছোড়দাকে দিয়ে দিল। গুলতি দিয়ে যদিও সে পাখপাখালি মারে না।সে শুধু আম জামরুলে টিপ প্রাকটিস দেয়।যদিও পারে না কিছুই তবে পকেটে ফুটো ঝিনুক আর গুলতিখানা ভরে নিলে বেশ ভার ভারিক্কি লাগে নিজেকে তাছাড়া মণি,টেনি খোকন বাচ্চুদের মধ্যে তার গুরুত্বও বেড়ে যায়।
কাচের মার্বেলকে ওরা কেন টল গুলি বলে কে জানে ; অবশ্য নাম হলো স্রেফ নাম। খোকনের সাথে গুলি খেলতে সে চায় না কারণ থিরু,সিসকু করে করে সব পয়েন্ট পেয়ে সে গুলি জিতে নেয়। মার্বেল হেরে গরীব হয়ে যাওয়ার চে' সেগুলো পকেটে রেখে নাড়াচাড়া করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া কাচের গুলিও কম আশ্চর্যের নয়। ওগুলোর ভেতর তারার মতো ফুটকিগুলো নাকি বাতাস। ভর দুপুরে ভেতরের ওই নকশাগুলোকে আঙুলে ধরতে চেয়ে সে ইটে একখানা মার্বেল রেখে আর একটা ইট দিয়ে বাড়ি দিল।আর সোজা ইটের ঘায়ে বাঁ হাতের একখানা আঙুল থেঁতো।ব্যাথা পাওয়ার চাইতেও মায়ের বকুনি বা মার এমন জোরালো কিছুর আশঙ্কায় সে জামায় আঙুল চেপে উঠোনে দৌড়োদৌড়ি করছিল একাই। কিন্তু যতই মোছে গ্যালগ্যাল করে রক্ত তো ছাই বন্ধই হয় না।
ঘুমোসনি তুই? একলা ছুটোছুটি করছিস যে, এ কি! এখানে রক্ত কিসের ?তোর জামায় কী ওগুলো?ও মাগো!রক্ত দেখলে নাকি মার মাথা ঘোরে। চিৎকার দিয়ে মা বসে পড়ল।সবাই ছুটে এসে মার চোখমুখে জল দিচ্ছে যখন মা বললো ঝিনির আঙুল। তখন আবার গাঁদা পাতারে ডেটল তুলো রে শাদা ধুতির টুকরো রে এবং ইত্যাদি। যে মারের ভয়ে কান্না চেপে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল সে তালেগোলে সেটা অবশ্য মা ভুলেই গেছে। বাঁচিয়েছে বাব্বা!
এতসব কাণ্ডের পর রাত নামলেই ঘুমের আঠা জড়িয়ে যায় চোখদুটোতে। মাস্টার মশাই যেতেই দৌড়ে সে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ে। অনেক দিন সে রাতে খেতে উঠতেই পারে না। সে ঘুমিয়ে পড়লে
পকেট হাতড়ে বড়রা বার করে রাখে কাচের গুলি, ভাঙা প্রিজম, কচি আমের কুসি, নুড়ি পাথর, শুকনো বকুল ফুল বা কুড়িয়ে পাওয়া একখানা পালক। কাজেই বইয়ের বাক্সে পকেট তো যে সে ব্যাপার না।
বাক্সটা আমার?একবারেই আমার? নিশ্চয়ই।নতুন বইয়ের গন্ধ খুবই ভালো বাপি আর নতুন এই বাক্সটাও।আর এই যে ছোট্ট লাল নীল ছাতাটা এনেছো তার ডাঁটিতে যে প্লাস্টিকের বাঁট ওটায় আঙুল ঘসলেই একদম লজেন্সের গন্ধ বেরুচ্ছে দ্যাখো।সে তো বটেই তবে কিনা এবার থেকে ভালো করে একটু পড়তে হবে যে আর এই বাক্সে বই নিয়ে রোজ স্কুলেও যেতে হবে।তা ইস্কুলে যেতে তো খুবই ভালো কিন্তু আদিখ্যেতা মানে কী?ও তুমি কোথায় পেলে?
এই যে বাদামি বাক্সটা দেখে মা বলল মেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা?ওই আর কি একটু আদর করি তো ঝিনুকমাটাকে তাই বলেছে; বাবা ঝট করে মা'র দিকে তাকিয়ে নেয় একবার কিন্তু স্কুলে যেতে যে খুব ভালো জানলে কী করে?
মা নিয়ে গেল না সেবার? রবি ঠাকুরের ফটোয় মালা দিল। তারপর সেজেগুজে ভালো কাপড় আর ফুলের মালা পরে কী সুন্দর নাচগান করল দিদিরা। জিলিপি খাওয়ালো। তিনটে চারটে খেয়েছি। ফিসফিস করে জিলিপির দুর্দান্ত স্মৃতি বাবাকে জানাল ঝিনি।
তবে সবাই খুব গাল টেপে আর খালি খালি নাম বলতে হয়। ইস্কুলের দুটো অপছন্দ সে জানিয়ে দেয়।বটেই তো!খালি খালি গাল টেপা আবার কী? তবে কিনা কারো সাথে প্রথম দেখা হলে নাম জানতে চাইলে বলতে হয় নইলে সে তোমায় চিনবে কিভাবে বলো?মনে রাখবে কিভাবে? আর তুমি গিয়েছিলে পঁচিশে বৈশাখ রবি ঠাকুরের জন্মদিনে।তাই অত নাচগান জিলিপি টিলিপি হয়েছিল।রোজ কিন্তু অমনটা হয় না। তাছাড়া এখন থেকে তুমি যাবে ছোটদের স্কুলে ক'বছর পর তবেই মা'র স্কুলে পড়তে পাবে।
সেটা কোথায়? দাদারা যেখানে পড়ে। সেই ইস্কুলে?ঝিনুক খুবই খুশি হয়ে ওঠে। হ্যাঁ ওখানেই তবে ওরা তো পড়ে বড়দের ইস্কুলে। তুমি ওখানেই প্রাইমারি সেকশনে ভর্তি হবে।অত কিছু না বুঝলেও ভর্তি, ইউনিফর্ম, কেডস এসব শব্দের সঙ্গে নতুন নতুন আলাপ হওয়া ইস্তক ইস্কুলে যাওয়ার জন্য সে বড্ডই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
দুধ শাদা ইস্কুলের জামার ওপর মার বোনা নীল সোয়েটার আর শাদা মোজা,কেডস পরে মার সঙ্গে সে এল শাদা রঙ বিরাট এক ইস্কুল বাড়িতে। বাইরে থেকে হাটখোলায় যাবার রাস্তায় এই বাড়িটা সে অবশ্য আগে দেখেছে। ওখানেই কোথাও তার দাদারাও আছে বটে তবু ডান হাতে বইয়ের বাক্স,বাঁ হাতে মার কড়ে আঙুল আঁকড়ে মস্ত বড় লোহার গেট দিয়ে ঢোকার সময় একটু থমকে যায় সে।চলো চলো মা তার হাত ধরে টানে।গুম গুম করে কিসের একটা আওয়াজ উঠছিল ঢেউয়ের মতো।চাপা শব্দের ভাঁপ উঠছিল পাঁচিল ঘেরা পুরু দেওয়ালের বাড়িটা থেকে। সবাইকে পেটের ভেতর পুরে ইস্কুলটা যেন ঘুম ঘুম একটা দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সার সার দরজা জানলা লম্বা করিডোর পেরিয়ে মা'র সাথে একটা ঘরে ঢুকতেই ঢং ঢং করে কোথায় যেন খুব ভারি ঘন্টা বেজে উঠল।
আসুন বড়দি,এর কথাই বলছিলেন সেদিন? ধুতি পাঞ্জাবি পরা ফর্সা একজন চশমা পরে পান খাচ্ছিলেন।হ্যাঁ বিজয়বাবু। ঝিনি,প্রণাম করো ইনি তোমাদের হেড মাস্টার মশাই। ঠিক আছে ঠিক আছে কিন্তু ঘন্টা পড়ে গেল তো চলুন আমরা বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।প্রেয়ারের পরে কথা বলা যাবেখন।মনোজ !মনোজ! কালো প্যান্টের ওপর শাদা সার্ট কমবয়সী একজন এসে দাঁড়ালেন হেডস্যারের ডাকে।ডাকছিলেন স্যার?লাইনে একে নিয়ে যাও। প্রেয়ারে যাও ওনার সঙ্গে,হেডস্যার বললেন,ইনি তোমাদের অংকের স্যার। মায়ের ইশারায় তাকেও সে প্রণাম করে।
🍂
বাইরে এসে হকচকিয়ে যায় সে।দোতলা থেকে তখনো স্রোতের মতো নামছে বড় ইস্কুলের ছেলেরা। চৌকোনা মাঠের তিনদিকে ঘিরে উঠে গেছে ইস্কুলের দালান।তিন দিকের লম্বা বারান্দায় দুসারি করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সবাই। বড় ইস্কুলের গম্ভীর মাস্টার মশাইরাও লাইন করে দাঁড়াচ্ছেন।অংকের স্যার তাকে প্রাইমারি সেকশনের বাচ্চাদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। বাচ্চাদের সামনেও বেশ কয়েকজন মাস্টার মশাই দাঁড়িয়েছেন।কেউ কথা বলছিল না তবু প্রেয়ার লাইন থেকে চাপা এক গুনগুন শোনা যাচ্ছিল হঠাৎই খুব উঁচু গমগমে গলায় একজন মাস্টার মশাই গান ধরলেন ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়/তোমারই হউক জয়... বাচ্চারা এবং সমস্ত ছেলেরা একসাথে গেয়ে উঠল সেই গান। সে গান ঝিনি আগে শোনেনি কোনোদিন আর এতজনের গলা মিলেমিশে গানের নতুন শব্দ ও সুর জড়িয়ে মড়িয়ে তরঙ্গের মতো ধেয়ে এল তার দিকে।ঢেউয়ের ওঠা নামা ধ্বনি ও প্রতিধ্বনিতে ধকধক করছিল তার বুক।সে অবাক হয়ে দেখল সকাল সাড়ে দশটার রোদ্দুর কেমন প্রিজম ছাড়াই সাত রঙে ভেঙে আড়াআড়ি মিশে যাচ্ছে সমবেত প্রার্থনা গানে।কথা সুর কিচ্ছু না জেনেও আপনিই তার ঠোঁট নড়তে লাগল।
ঝিনি জানত না পরে আরও বড় হয়ে এই গান তার কাছে আসবে নতুন করে। তাদের বাবা কখনো যুদ্ধ ও দাঙ্গার নিষ্ঠুরতার কাহিনি শোনায়নি তাদের বরং নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ আদতে মানুষকে ভালবাসতেই চায় একথাই বলতো। ক্লাস এইটে উঠে হঠাৎই সে হাতে পায় আমেরিকা থেকে মুকুল কাকুর প্রকাশিত মুক্তি যুদ্ধের ওপর বইখানা। কাকু প্রতি শীতেই ঘুরে যায় নানা আশ্চর্য জিনিসপাতি নিয়ে কিন্তু সেবার নিজের লেখা একখানা বই এনে বাপির হাতে দিয়ে বললো আর তো তেমন কিছু করতে পারিনি দেশের জন্য। মলাটের মধ্যে এই তথ্যগুলো থাক অন্তত।
মূলত বিদেশি কাগজের রিপোর্টিং আর স্টিল ছবিতে ভর্তি ইংরেজিতে লেখা সে বই হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎই সেই বইয়ের নির্মম ফোটোগ্রাফ দেখে ফেলার অসহ্য কষ্ট কাউকে বলতে না পেরে এক দুপুরে সে যখন তাদের বাড়ির চারপাশে একাই দৌড়োচ্ছিল ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে ঠিক যেভাবে এক দুপুরে ছুটেছিল ইটের ঘায়ে থ্যাঁতলানো আঙুলের যন্ত্রণা নিয়ে সেভাবেই প্রশমনের কোনো শুশ্রূষা না পেয়ে সে আসলে নিজের মধ্যেই খুব জোরে দৌড়োচ্ছিল আর সন্ধেবেলা সে অংক স্যারের কাছে মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে জানতে চাইলে পরেশবাবু স্যার অল্প হাসলেন।
স্যার ওপার বাংলার ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন। এখানে এসে বয়েজ ইস্কুলে চাকরি করছেন।কথায় তাঁর সামান্য সিলেটি টান। অধ্যাপক থেকে স্কুলশিক্ষক হওয়ায় এবং বাঙাল উচ্চারণ নিয়ে সহকর্মীদের কাছে হ্যাটা হন বলে দুঃখ করেন প্রায়ই এবং পোস্ট মাস্টারের রতনের মতোই বালিকা ঝিনি তন্মুহূর্তেই জননীর পদ অধিকার করিয়া স্যারকে সান্তনা দেয় এজমালি ভাড়াঘর ছেড়ে দেখে নেবেন স্যার একদিন এ দেশেও আপনার বাড়ি হবে। কী সুন্দর স্যার,শিমুল পলাশ নাম রেখেছেন ছেলেমেয়ের!
আজকে স্যার বলতেই হবে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে দাঁতে দাঁত চেপে কাকুর বই খুলে ছবি দেখায় ঝিনি।
সেই কিশোর কালে সে প্রথম সবিস্তারে শুনবে মুক্তি যুদ্ধর কাহিনি। কিভাবে বাংলা ভাষার জন্য ছাত্র আন্দোলন প্রসারিত হতে হতে স্পর্ধা করবে স্বাধীনতার।একটি দেশ কিভাবে কিভাবে ধর্মের অনেক ওপরে রাখবে তাদের বুকের ভাষাকে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির সর্বজন শ্রদ্ধেয় দর্শনের অধ্যাপক রাজাকারদের (যার মধ্যে তাঁর কয়েকজন ছাত্রও ছিল এবং স্যার একটু বাইরে আসুন তাদের এই ডাক শুনেই আত্মভোলা মাস্টার মশাই বেরিয়ে এসেছিলেন)গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন এবং চোখ বোজার আগের মুহূর্তে বললেন "ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়/তোমারই হউক জয়..." আর শৈশবের সেই প্রথম প্রার্থনা গান দৌড়ে এসে ফেঁড়ে ফেলবে অন্ধকার রাতের দুঃসহ ভার যেন চোখের বাঁধন খুলে সমস্ত তিমির বিদার করে কী এক উদার অভ্যুদয়ে তাবৎ মৃত্যুর লয় ঘটিয়ে দিল পুরনো সেই গান আজকে তার হঠাৎ ঘনিয়ে আসা অজানা অন্ধকারের ওপার থেকে এসে সেই প্রথম সকালের শোনা সুর কথাগুলি ভর করে রোদেলা আকাশের মতোই জ্বলতে থাকবে তার ভেতর অনির্বাণ এক মোমের শাদা হয়ে।
0 Comments