জ্বলদর্চি

'কীলকলিপিতে ভূমি ও ভূমা' নিয়ে কলম ধরেছেন শ্রীচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়

'কীলকলিপিতে ভূমি ও ভূমা' নিয়ে কলম ধরেছেন শ্রীচেতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' কাব্যগ্রন্থটি পড়ে পাঠক হিসেবে আমার সামান্য বোধগম্যতায় যেটুকু ধরা দিয়েছে তা প্রকাশের জন্য কলম ধরলাম।

কাব্যগ্রন্থের নামকরণ প্রথমেই আমার ভাবনার রসদ হয়ে ওঠে। শেষ পাতায় পেলাম উক্ত নামে একখানি কবিতা।  চিন্তনের অতলে তলিয়ে যা আত্মস্থ করতে হয়—  তা যেন কীলকলিপির মতই খানিক দুর্বোধ্য, বোধের গভীরে যাওয়ার মত দক্ষ সাঁতারু হতে হবে, খুঁড়ে দেখার অদম্য প্রয়াসেই গড়ে ওঠে জনান্তিকে ভূমি ও ভূমা।
বুঝলাম, নামকরণই ইঙ্গিত দিচ্ছে তল খোঁজার চেষ্টায় স্থিতধী হতে হবে।

ফিরে এলাম প্রথম কবিতায়।

'আমাদের সব ভালোবাসা দুহাত পেতে চেয়ে নেওয়া', 'আত্মস্বীকার' শীর্ষক কবিতায় আমিও নতজানু হলাম এই কবির এই ভাবনার কাছে।

একের পর এক কবিতায় মগ্ন হতে গিয়ে যা খেয়াল করলাম, তা হল বেশ কিছু ক্ষেত্রে জ্যামিতিক চিত্রণে ভাবনা যাপন ও কথন। যেহেতু জীবনের হিসেব তাই
'ত্রিভুজ কে দুভাগ করো।
সংখ্যা :তিন'

ঠিকই তো!

'জীবন কখনও মিলবেনা জেনেও যাত্রা'।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
আবার 'মহাকবির ব্যঞ্জনা' কবিতায় কবি আঁকেন ত্রিভুজের মাঝে বৃত্ত, সে বৃত্ত থেকে জয়ধ্বনি অনুরণিত হয় পৃথিবীর। ব-দ্বীপেও সেই ত্রিভুজেরই আভাস, আসলে এই তিন বাহুর মাঝে বোধহয় কোনও এক পাপশূণ্য কল্পলোক আছে। কবির মতে ওই জগতের কেন্দ্র খুঁজে পাবেন মহাকবি, কোনও গাণিতিক সূত্র নয় সে পথে যেতে প্রয়োজন ব্যঞ্জনার।  

কবিতাগুলি হাতছানি দেয় নিজের যাপনকে প্রশ্নের মুখে দাঁড়ানোর।
'বাহ্যজ্ঞানের সিঁড়িতে আত্মমগ্ন পায়ের ছাপ, রাত্রি নামে কখনও বা, নক্ষত্রকোলাহলে বিলীন হয় অনিবার্য  স্বর্ণসন্ধানী আমাদের আয়ু।'
শাশ্বত সত্যকে আবারও উপলব্ধির প্রতিবিম্বে পেলাম যেন। ভাষাশৈলীর দক্ষতাও নজরে পড়ার মতো।
স্তব্ধ করবে  'সংজ্ঞার বিপরীতে' কবিতা।।

'চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয়।'
'সময়ই বলবে, বলামাত্রই,ইতিহাস ভুল হল'।

কালের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া সব ঘটমান বর্তমান 'ইতিহাস' নামে থেকে যায়। সত্যতা যাচাইয়ের দায় নেয় শেষ পর্যন্ত সময়ই।

একটি কবিতা- 'মাঠ পেরোচ্ছে শুকুন মান্ডী'। শালুক পাতায় জল-জীবনকে দেহে নিয়ে সমাজের সকল প্রতিকূলতা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার সময়, দু পায়ের মাঝে যেন কল্পলোকের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, সময়কে আমি পেলাম আত্মীয়সম 'অপেক্ষার বাউল' রূপে, বাস তার আর এক পৃথিবীতে।

কবি মানুষের সৃষ্টিকে মানুষের কাছে পৌঁছনোর ব্রতচারী। তাঁর কবিতাতেও পাই ধর্ম, বর্ণ সব কিছুর সীমানা পেরিয়ে  'মানুষের কথা মানুষকেই বলতে হয় বেশি করে।'

কবিতারা আমার কাছে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। বোধকে সঙ্গী করে তাদের আত্মস্থ করার বাসনায় আমি মুখোমুখি হয়েছি কবির জীবন সম্পর্কিত ধারণার,অপূর্ব তার প্রকাশ।

থামলাম, কবিতা-ঋতরূপ। কবি যখন পিতা। তখন তাঁর আত্মজকে নিজ সত্তায় খুঁজে নেওয়ার অপরূপ প্রয়াস বাধ্য করে কবিতাটি বারবার পড়তে।

'এ সেই অবশ্যম্ভাবী জলাধার।
মায়ার শরীরে রূপক আমার সন্তান।
যেখানে লুকিয়ে আছে আলোকবর্তিকা,
শেষ নিশ্বাস।'  

নিজের রক্তবাহীর প্রতি বোধের প্রবহমানতা দেখবার এ যেন এক অপূর্ব কাব্যিক প্রকাশ। ভাবনার দোরে করাঘাত করে গেল কবিতাগুলি।
মানুষ হয়ে মানুষেই আস্থা রাখব, অনাস্থার মাঝেই। আশা খুঁজে নেবো নিরাশা পেরিয়ে।

জীবনের জয়গান গাইব আন্ধকারের শেষে আলো আছে নিশ্চিত, জেনেই। আমি এমনই বার্তা পেলাম কীলক লিপিতে লেখা কবির জীবনবোধের পাতা থেকে।
🍂

Post a Comment

0 Comments