মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৯
কালিপদ পাল (শিক্ষক, পত্রিকা সম্পাদক, তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
সেটা ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়। কর্মজীবন শুরু করলেন সুতাহাটা জনকল্যাণ (উচ্চতর) শিক্ষা নিকেতনে। কিন্তু তিনি তো কেবল শিক্ষকতার পেশায় আবদ্ধ থাকতে রাজি নন। তাঁর চিন্তাশীল মননে তখন সাহিত্যসেবার ভিড়। নিত্য নতুন কল্পনা আর তা কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলার বাসনা। কালো অক্ষরে নিজের মনের ভাবনাগুলো লেপটে রাখার সৃজনশীল চর্চায় আবদ্ধ থাকার বাসনা।
গুরুত্ব দিলেন জনকল্যাণে। তুলে ধরতে চাইলেন এলাকার সাধারণ গ্রামীণ মানুষের আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের গতি প্রকৃতি। তিনি বুঝলেন, এসবের জন্য দরকার একটা মাধ্যম। একটা প্লাটফর্ম। তখন তিনি গ্রামের মানুষের কথা কলমের ডোগায় এনে শুরু করলেন সাপ্তাহিক 'গ্রামের ডাক' পত্রিকা প্রকাশ। সেটা ১৯৭৫ সাল।
প্রথমে সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ কালিপদ পালের। একটা দারুণ পদক্ষেপ তৎকালীন পরিস্থিতিতে। প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন রূপে নতুন নতুন সংবাদের আলোয় আলোকিত হচ্ছিল সাপ্তাহিক 'গ্রামের ডাক'। সাত বছর ধরে এভাবে চলার পর ১৯৮২ তে সাপ্তাহিক থেকে পরিবর্তিত হয়ে হল দৈনিক পত্রিকায়। প্রতিদিন সকালে পাঠকের সামনে হাজির 'দৈনিক গ্রামের ডাক'। মেদিনীপুরের ইতিহাসে এই পত্রিকা হয়ে উঠলো মাইলস্টোন। জেলার প্রথম দৈনিক পত্রিকা হিসেবে ইতিহাসে নাম উঠলো 'গ্রামের ডাক' পত্রিকার।
কালিপদ পালকে বলা যায় অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সংবাদপত্র জগতের এক একনিষ্ঠ পথপ্রদর্শক। সাংবাদিকতার দুনিয়ায় তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম। সেইসাথে শিক্ষা সংস্কৃতির জগতে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। একজন খ্যাতিমান শিক্ষক। নন্দীগ্রামের সুবদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সেটা ছিল ১৯৪০ এর ২০ এপ্রিল। দেশের স্বাধীনতা তখনও হয়নি। সেসময়কার কঠিন দিনগুলোর সাক্ষী ছিলেন তিনি। যদিও তখন তিনি নেহাতই সাত বছরের বাচ্চা। তবুও তাঁর জীবনের একটা অধ্যায়ে লেপটে ছিল স্বাধীনত্বোর ভারতের রক্তঝরা কাহিনীর দিনগুলি। ফলে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন তাঁর মননে স্থান পায় আদর্শবোধ, সততা এবং দৃঢ়তা। অন্যায়ের প্রতি তাঁর চরম প্রতিবাদ। বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ।
কালিপদ পালের বাবা তরেন্দ্রনাথ পাল এবং মা চারুবালা পাল ছিলেন অত্যন্ত গুণি এবং আদর্শবাদী। তাঁদের মধ্য থেকে যাবতীয় গুণ ছড়িয়ে পড়ে কালিপদ পালের মধ্যে। কিশোর বয়স থেকেই সাহিত্য অনুশীলনের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। কল্পনাপ্রবণ মন জন্ম দিতে শুরু করে অসংখ্য সাহিত্যালাপ।
আশির দশকের শুরুতে, সেসময়েও চলছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলন। চারিদিকে তুমুল গণ্ডগোল। তিনি ভাবলেন এই আন্দোলনের খবর পৌঁছে দেওয়া দরকার মানুষের কাছে। সেজন্যই সাপ্তাহিক থেকে পরিবর্তন করে হল দৈনিক। এই পত্রিকা প্রকাশ করা নিয়ে 'তাম্রলিপ্ত' পত্রিকার সম্পাদক জয়দেব মালাকারের মন্তব্য -- "নন্দীগ্রাম উন্নয়নের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকার নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সংবাদ ও প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দৈনিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হয় আমজনতার আবেদনে। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে প্রায় এক দশক ধরে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের গতি প্রকৃতি, পুলিশের গুলিতে ১৭ বৎসরের তরুণ সুদীপ্ত তেওয়ারির জীবন বলিদানের প্রেক্ষাপটে আত্মীয় স্বজনের আর্তনাদ, রক্তে রাঙ্গা মাটিতে প্রতিবাদের মানুষের উত্তাল উদ্দাম আন্দোলনের দীপ্ত ক্ষিপ্ততা প্রভৃতি বিষয়ে এই প্রতিবেদকের নানা প্রতিবেদন যা 'গ্রামের ডাক' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা নন্দীগ্রামের আন্দোলনকারী আমজনতার ভাষা হয়ে ওঠে। গ্রামের ডাক হয়ে নন্দীগ্রামের নয়নের মণি।"
সুতাহাটা থেকে তিনি অকুতোভয় চিত্তে 'গ্রামের ডাক' প্রকাশ করা শুরু করেন। তাঁর নির্ভিকতা এবং সাহসিকতার জন্য 'গ্রামের ডাক' পত্রিকা অফিস আক্রমণের শিকার হয়। পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয় অফিসটি। কিন্তু তিনি মেদিনীপুরের সন্তান। যাবতীয় ঝড় ঝাপটা উপেক্ষা করে, লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
'গ্রামের ডাক' পত্রিকার বিস্তৃতি ছড়িয়ে পড়ে সুদূর কলকাতাতেও। সেখানেও পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, উন্নয়ন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা -- সব ধরনের বিষয় নিয়ে কলেবরে বেড়ে ওঠে 'দৈনিক গ্রামের ডাক'। তবে সম্পাদক কালিপদ পালের মৃত্যুর পরেও পত্রিকা প্রকাশিত হত নিয়মিত। সম্পাদক হন তাঁর কৃতি শিক্ষক ছেলে কবি কৃতিসুন্দর পাল। যদিও ২০০৭ সাল থেকে পত্রিকাটি আর প্রকাশিত হয়নি। মেদিনীপুরের বুকে আলোড়ন তোলা একটা জাজ্জ্বল্যমান ইতিহাস চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পেরে।
কালিপদ পাল ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। তিনি বুঝেছিলেন রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে নিজেদের সংগঠিত হতে হবে। মজবুত করতে হবে ঐক্য। এই ভাবনায় তিনি গঠন করলেন সাংবাদিকদের পৃথক সংগঠন। যে সংগঠন সাংবাদিকদের নানা দাবি পূরণে আন্দোলনে সামিল হবে। তাই তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৫ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় গড়ে ওঠে 'ওয়েষ্ট বেঙ্গল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন'। তাই বলা যায়, তিনিই এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আজও টিম টিম করে জ্বলছে এই সংগঠনের আলোকশিখা।
একাধারে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। সমাজকে বিভিন্ন কোন থেকে দেখতে থাকা এক সজাগ নাগরিক। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন গল্প, কবিতা, নাটক ইত্যাদি। তমলুকের বুকে প্রতিষ্ঠিত প্রথম নাট্য সংস্থা 'গুডলাক ড্রামাটিক নাট্য সংস্থা'র সঙ্গে তিনি জড়িয়ে ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। অনেক নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। সেগুলি যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল। এই মহান শিক্ষক ১৯৯৯ সালে চাকরিজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কালিপদ পালের মতো বর্ণময় ও গতিশীল জীবনছন্দের আয়ু ছিল ৭১ বৎসর ৬ মাস ২৬ দিন। অবশেষে এই মহান কীর্তিমান, উদার, ভদ্র, সৎ, নির্লোভ ব্যক্তিত্বের 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' মানুষটির জীবনাবসান ঘটে ২০১১ এর ১৬ ই নভেম্বর।
🍂
0 Comments