জ্বলদর্চি

বিষকন্যা /পি.শাশ্বতী


বিষকন্যা

পি.শাশ্বতী


বিষকন্যা বা নাগিন-এর কাহিনি পুরাকাল থেকেই  বহুল প্রচলিত। ইতিহাসে  ‘চন্দ্রকান্ত’র গল্পও  যথেষ্ট জনপ্রিয়। এদেশে সবাক চলচ্চিত্র চালু হবার পর থেকে এযাবৎ নাগিন বিষয়ে অসংখ্য ভাষায় অসংখ্য চলচ্চিত্র বাজার মাতিয়েছে। সাহিত্য এবং সেই সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বিষকন্যা নিয়ে গড়ে ওঠা কল্প-কাহিনি আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং কৌতূহল জাগিয়ে রাখে প্রতিনিয়ত। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাহিনির ভিত্তি ও অন্তরালে থাকা ঘটনা অধরাই থেকে যায়। তেমনই কিছু গল্পকথা থেকে এই নিবন্ধে আলোকপাত করলে এনিয়ে কিছু ধারণা অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে। যদিও এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, সাহিত্য বা গল্পকথায় মূলতঃ সাপিনীকে জড়িয়ে কোনো সুন্দরী মেয়ের ছদ্মবেশই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি, কিন্তু আসলে বিষকন্যার বাস্তবিক ধারণাটি একেবারেই আলাদা। এ বিষয়ে বিদেশি কথকতা ও ভারতীয় পুরাণ এবং প্রাচীন ইতিহাস বেশ কিছু সূত্র ধরিয়ে দেয়। 

ষোড়শ শতকের এক ফরাসি আখ্যানে পাওয়া যায় তখনকার দিনে সে-দেশে সেনাবাহিনীর মতো পৃথক ভাবে গুপ্তচর বাহিনী ও বিষকন্যা বাহিনী গড়ে তোলা হতো। ওই আখ্যানে পাওয়া যায়, এক  ফরাসি রাজা রাজ্যের বাছাই করা কিছু সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে রাজ পরিষেবায় বড় করে তুলতে থাকেন। কন্যাগুলির পাঁচ-ছ-বছর বয়স হবার পর তাদের মধ্যে সম্ভাব্য সেরা সেরা সুন্দরী মেয়েকে রেখে বাকিদের যার যার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এইসব শিশুকন্যাদের কিন্তু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই তাদের পানযোগ্য দুধের সঙ্গে প্রতিদিন মিশিয়ে দেওয়া হতো খুব সামান্য পরিমাণে স্বল্প ক্রিয়া করে এমন বিষ। মেয়েগুলোর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিষের পরিমাণও বাড়ানো হতো। কিছুদিন পরে ওই মেয়েগুলোর মধ্যে মাত্র একজন ছাড়া বাকি সকলেই ধীরে ধীরে বিষক্রিয়ায় মারা পড়ল। প্রতিদিন বিষপানে বেঁচে থাকা সেই একটি মেয়ে এক সময়ে হয়ে উঠল রাজ্যের এক চোখ-ধাঁধানো সুন্দরী।

এরপর প্রতিবেশী এক রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে সেই রাজা পরাজিত হয়ে বন্দি হলে, ওই সুন্দরী ছলাকলার মাধ্যমে শত্রু শিবিরে বীণা বাজাতে গেল শত্রুপক্ষের রাজার মনোরঞ্জনের জন্য। বিজিত রাজা দেখলেন সেই মেয়ের সর্বাঙ্গ প্লাবিত হচ্ছে যেন এক আগল-ভাঙা রূপের প্লাবনে! মুগ্ধ শত্রু-রাজা তাকে ডাকলেন নিজস্ব কক্ষে সবার আড়ালে। তার পরে যেই তাকে কাছে টেনে তার ঠোঁটে রাখলেন অধৈর্য চুম্বন, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হল তাঁর। সুযোগ বুঝে, অন্যান্য সেনানায়কের মনোরঞ্জন করে সরে পড়ল সেই সুন্দরী বীণা বাদিকা। যাঁদের যাঁদের কক্ষে সেই সুন্দরী সারা রাত ধরে বিচরণ করেছে, সকলেরই পরিণাম হল একই রকম। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজার কক্ষে আবিষ্কার হল তাঁর নিস্পন্দ দেহ। একে একে অন্যান্য সেনাপ্রধানের দেহও। ত্রাস ছড়িয়ে পড়ল গোটা সেনা শিবিরে। সকলেই মনে করল, কোনো অশুভ আত্মা ভর করেছে তাদের সেনা-ছাউনিতে। সেনারা ভয়ে ত্রস্ত হয়ে যে যেদিকে পারল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করল। এই সুযোগে পরাজিত সেই রাজার অবশিষ্ট সেনারা একপ্রকার বিনা বাধায় হত্যা করতে থাকল বিপক্ষ বাহিনীর সেনাদের। অচিরেই হাতছাড়া হয়ে যাওয়া নিজের রাজ্যের অধিকার ফিরে পেলেন এক অবিশ্বাস্য জয়ের মধ্যে দিয়ে। যার নেপথ্যে থেকে গেল তাঁর এতদিনের লালিত এক সুন্দরী বিষকন্যা। 

গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টের জন্মের আগেই ভারতে বিষকন্যা ধারণার উৎপত্তি, পরে তা ছড়িয়ে যায় বিশ্বের অন্যত্রও। সম্ভোগের প্রখরতায় বিষকন্যারা সরাসরি অন্যের রক্তে ঢেলে দিত বিষ। কখনো তাদের ঘাম অথবা দৃষ্টি, কখনো শুধু নিশ্বাসেই মৃত্যু ছিল অনিবার্য। এতই প্রখর এবং তীব্র ছিল সেই বিষ যে, চোখের পলকে মিশে যেত রক্তে। বিষকন্যার এই ধারণা থেকেই হয়তো গড়ে উঠেছিল বিদেশি ভ্যাম্পায়ারের গল্প।

ভারতেই বিষকন্যাদের নিয়ে গল্পকথার নিদর্শন পাওয়া যায় সব থেকে বেশি। পৌরাণিক যুগেও বিষকন্যার ধারণা ও প্রয়োগ যে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৃষ্ণের জন্ম ও কংস-বধের আখ্যান থেকে। 

পুরানের পুতনা নামের রাক্ষসী ছিল আসলে এমনই একজন  বিষকন্যাই। মথুরার রাজা কংস বসুদেবের সঙ্গে বিয়ে দিলেন বোন দেবকীর। বিয়ের সময় দৈববাণী হল: দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান হবে অত্যাচারী কংসের হত্যাকারী। সন্ত্রস্ত কংস কারাগারে আটক করলেন বোন আর ভগ্নীপতিকে। আর দেবকীর গর্ভজাত সন্তানকে একের পর এক হত্যা করতে লাগলেন কংস। সেখানেই জন্ম হল কৃষ্ণের। জন্মরাত্রে ভগবান এসে বসুদেবকে বললেন, গোকুলে গো-পালক নন্দের স্ত্রী যশোদার কাছে তাঁদের নবজাতককে রেখে, যশোদার সদ্যোজাত কন্যাকে এনে দিতে হবে দেবকীর কোলে। এক সহৃদয় কারারক্ষীর সাহায্যে অতি সন্তর্পণে সেই কাজই করলেন বসুদেব। আর তাই, কংসের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেলেন কৃষ্ণ। 

নন্দগৃহে তিনি বেড়ে উঠছেন দাদা বলরামের সঙ্গে। এদিকে দেবকীর আরও একটি সন্তান প্রসব করেছে শুনে যথারীতি কারাগারে ঢুকে দেবকীর কোলের মেয়েকে পাথরে আছড়ে যেই মারতে গেলেন কংস, হাওয়ায় মিলিয়ে সেই কন্যা মহামায়ার রূপ ধরে বলে উঠলেন: তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।  

অহংকারী কংস মহামায়ার সেই বাণীও উপেক্ষা করলেন। যেহেতু গোকুলে তাঁর সরাসরি হস্তক্ষেপ বা আস্ফালনের জায়গা ছিল না, তাই নিজের মৃত্যুকে জয় করার প্রয়াসে আতঙ্কে মথুরার সমস্ত শিশুকে নিষঠুরভাবে  হত্যা করতে শুরু করলেন কৌশলে। এই হত্যালীলায় তিনি নিয়োগ করলেন বিষকন্যা পুতনা রাক্ষসীকে। বিষস্তন্য পান করিয়ে একে একে শিশুদের জীবন বায়ু নিঃশেষ করতে লাগল এই ছদ্মরূপী রূপসী রাক্ষসী। মৃত শিশুদের পরিবারের কাছে এই মৃত্যু রহস্য-ঘেরা হয়েই থেকে গেল। 

এক সময়ে ছদ্মবেশী পুতনার কোলে এলেন কৃষ্ণও। কিন্তু তিনি নিজেই তো বিষহরি। তাঁকে মারে কার সাধ্য! শিশু কৃষ্ণগোপাল তাঁর ছোট ছোট কচি দাঁতের ভয়ংকর পেষণে পুতনার মৃত্যু হল সেখানেই। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলো পুতনার প্রকৃত ভয়ংকরী রূপ। গোকুলবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে বুঝতে পারলেন কেন এতদিন ধরে একের পর এক গোকুলে সদ্যজাত শিশুরা অকারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সেই সঙ্গে তাঁরা এই প্রথম শিশু গোপালের ঐশ্বরিক শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে জ্ঞাত হলেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, পুরাণের এই পুতনা ছিলেন আদতে বিষকন্যাই।

এলোমেলো ভাবে প্রাচীন ভারতের কিছু আখ্যানেও ছড়িয়ে আছে বিষকন্যাদের কথা। তার অন্যতম হল, সোমদেব ভট্টের 'কথাসরিৎসাগর'। শৈশব থেকে প্রতিদিন অল্প অল্প বিষপানে পালিতা বিষকন্যাদের ব্যবহার করা হতো মূলতঃ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আর গুপ্তহত্যার প্রয়োজনে। শত্রুপক্ষ লালসার বশে বিষকন্যাদের দুর্নিবার আবেদনে সাড়া দিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন ক্ষমতাবান শত্রুপক্ষ রাজপুরুষেরা। কখনো নাচের দলে ভিড়িয়ে দিয়ে, কখনো বা উপহার হিসেবে উপঢৌকনের আড়ালে প্রাচীন ভারতে শত্রুপক্ষের দরবার বা শিবিরে এইসব ছদ্মবেশী বাঘিনীদের ঢুকিয়ে দিত চতুর প্রতিপক্ষ। তার পরেই শুরু হয়ে যেত তাদের বিষের ছোবলে কাঙ্ক্ষিত হত্যার খবর আসার অধীর প্রতীক্ষা। 

এবার যদি ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে 'অৰ্থশাস্ত্র' প্রণেতা চাণক্যও মৌর্য বংশের স্বনামধন্য রাজা চন্দ্রগুপ্তকেও এই বলে সাবধান করে বলেছিলেন—  অচেনা রমণীদের ব্যবহারের আগে জল দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে তাদের উরু। কারণ, হতেই পারে তারা বিষকন্যা!

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে আরও জানা যায়, মগধের অত্যন্ত ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ  চাণক্য রাজা ধননন্দের আচরণে মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। একটি ঘটনার ক্ষেত্রে তাঁর উপর ধননন্দের আচরণে চাণক্য অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। সেই থেকে তিনি ধননন্দের বিনাশের চিন্তায় অকূল হয়ে ওঠেন। একদিন  জঙ্গলের পথে যেতে যেতে বন্ধুদের সঙ্গে এক বালককে রাজা-রাজা খেলতে দেখে তিনি  নিজের লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন। ছেলেটিকে দেখেই ভবিষ্যতদ্রষ্টা বিচক্ষণ চাণক্য বুঝে গিয়েছিলেন, এই ছেলেই হবে তাঁর তুরুপের তাস। দাম্ভিক, প্রজা-বিদ্বেষী রাজা ধননন্দের মুখে করা  নিজের অপমানের বদলা নিতে সেই বালককেই ভবিষ্যতের মগধ অধিপতি হিসেবে তৈরি করলেন তিনি। তার পরে এক দিন ধননন্দকে যুদ্ধে হারিয়ে পাটলিপুত্রের সিংহাসনে চাণক্য এগিয়ে দিলেন প্রিয় শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে এও জানতেন, চন্দ্রগুপ্তের এই বিজিত সিংহাসন মোটেই নিষ্কণ্টক নয়। তাঁর চারপাশে অনবরতই  চলবে হত্যার ষড়যন্ত্র। বীর ও বিচক্ষণ চন্দ্রগুপ্তকে সরিরাসরি হত্যার পরিকল্পনা কেউ করবে না। বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। 

ছোট থেকেই প্রজ্ঞা আর চতুর কৌশলে চন্দ্রগুপ্তকে আগলে রেখেছিলেন চাণক্য। তাঁকে সবরকম শিক্ষার পাশাপাশি শরীরে বিষ প্রতিরোধ শক্তি বাড়াতে সেই বয়স থেকেই চাণক্য তাঁর খাবারে প্রতিদিন গোপনে সামান্য পরিমাণে বিষ মিশিয়ে দিতেন। তিনি জানতেন, রাজ-পরিবারের অন্দর অথবা বহিঃশক্তির ছলনাময় আক্রমণ থেকে বাঁচতে এ ভাবেই একদিন তৈরি হয়ে উঠবে চন্দ্রগুপ্তের শরীর। 

যেহেতু চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যর এই ব্যবস্থার কথা জানতেন না, তাই নিজের অজান্তেই সামান্য একটি ভুলে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী দুর্ভারকে। গর্ভবতী স্ত্রী-র প্রতি প্রেমাস্পদ হয়ে যেদিন না-জেনে তাঁর সঙ্গে নিজের বিষ-মেশানো খাবার ভাগ করে খেলেন চন্দ্রগুপ্ত, সেদিন এলিয়ে পড়লেন তাঁর স্ত্রী দুর্ভারা। ছুটে এলেন আচার্য চাণক্য। ততক্ষণে সব শেষ. শুধু দুর্ভারার পেট চিরে আচার্য বাঁচাতে পারলেন প্রিয় শিষ্যের পুত্রকে। মায়ের গর্ভেই এক বিন্দু বিষ তখন নীল এক টিকা এঁকে দিয়েছে সেই শিশুর কপালে। তাই তার নাম হল বিন্দুসার। 

চাণক্যের আশঙ্কা যে সত্য ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়, ধননন্দের ক্ষমতালোভী, কুচক্রী মন্ত্রী রাক্ষস গোপনে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার উদ্দেশে তাঁর কাছে পাঠালেন এক বিষকন্যাকে। কিন্তু ক্ষুরধার চাণক্য রাক্ষসের এই চক্রান্ত ধরে ফেলে চন্দ্রগুপ্তের চৌহদ্দি থেকে সেই বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন মিত্র অথচ আকাঙ্ক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বী পর্বতকের দরজায়। মারা গেলেন পর্বতক। এই পর্বতক ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্যতম। বিষকন্যাই সরিয়ে দিল চন্দ্রগুপ্তের সেই পথের কাঁটা! এই নিয়েই বিশাখদত্তের রাজনৈতিক নাটক 'মুদ্রারাক্ষস'। সেখানে অবশ্য দেখা যায় একবার বিষ ঢেলেই ফুরিয়ে যেত বিষকন্যাদের বিষ।

অনেকের বিশ্বাস, বিষকন্যা বলে বাস্তবে কোনো দিনই কোনো মানবী ছিল না। তারা শুধুই গল্পের মনগড়া সব চরিত্র! অথবা বিষকন্যারা ছিল গ্রহ-লগ্নের নির্দিষ্ট সমীকরণে জাত, যাদের বিয়ে করলে স্বামীর মৃত্যু ছিল অনিবার্য। অথচ চরক, সুশ্রুত আর ভাগবত— প্রাচীন ভারতের শ্রুতকীর্তি এই তিন চিকিৎসক উল্লেখ করেছিলেন বিষধর মহিলাদের কথা। শিখিয়ে গিয়েছিলেন, বিষের সঙ্গে লড়াই করার কৌশল। বিশদে খোঁজ দিয়েছিলেন সমুদ্রমন্থন থেকে অমৃতর আগে উঠে আসা স্থাবর ও জঙ্গম বিষের উৎস আর তার তেজ বিনাশকারী পথ্যের। বিষপ্রয়োগের প্রচলিত মাধ্যম হিসেবে এঁরা চিহ্নিত করেছিলেন মহিলাদের। রাজার বিপদের কথা বলতে গিয়ে শত্রুর চর, বিপজ্জনক আত্মীয়দের পাশাপাশি এঁরা বলেছিলেন ছলকারী মেয়েদের কথা। সাবধান করেছিলেন খাবার, দাঁত মাজার সরঞ্জাম, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার আর প্রসাধনের উপকরণে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থেকে। রাস্তা, পশুর খাবার, জল, ছায়াঘেরা জায়গা, জ্বালানি কাঠে মিশিয়ে দেওয়া শত্রুর বিষ থেকে বাঁচতে এবং বিপদ-সংকুল দুর্গম যুদ্ধপথেও রাজার কাছাকাছি সর্বক্ষণ চিকিৎসকদের রাখার কথা বলেছিলেন সুশ্রুত। আর সরাসরি সাবধান করেছিলেন ক্ষমতার লোভে রাজার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকে পড়া ভয়ংকরী বিষকন্যাদের সংস্রব থেকে, যাদের স্পর্শেই মৃত্যু ছিল নিশ্চিত।  বিষের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সুশ্রুত দিয়েছিলেন সদা-সন্দিহান হয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ। চিকিৎসা বিজ্ঞানাচার্য ভাগবত বলেছিলেন, সাধারণত মানুষের তৈরি বিষ প্রয়োগ করে থাকে স্বামীর ভালোবাসা পেতে মরিয়া ঈর্ষাকাতর স্ত্রী এবং রাজার কাছাকাছি চলে আসা শত্রুর পাঠানো বিষকন্যারা। 

বিষ চেনার উপায় জানাতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন, বিষ তৈরিতে সহায়ক হতো পশুর দেহ নির্গত বর্জ্য, আফিম, প্রতিকূল ওষুধ এবং অল্প তেজের বিষ। বিষ মেশানো খাবার চেনার উপায় ছিল  পাখিদের খাইয়ে অথবা আগুনে ছুড়ে অগ্নিশিখার রং-পরিবর্তন দেখে। তবে তাঁরা খোদ বিষকন্যা চিনে ফেলার উপায় বলে না গেলেও, লক্ষণ দেখে সম্ভাব্য চক্রান্তকারী চিনতে শিখিয়েছিলেন সুশ্রুত। কুচক্রীদের চেনার জন্য নিয়োগ করতে বলেছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আধিকারিকদের। 

সন্দেহভাজনদের মুখ-চোখের অবস্থা, উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে চুলে হাত দেওয়া, অতিরিক্ত কথা বলা, অকারণে মিটিমিটি হাসি, পা দিয়ে মাটি আঁচড়ানো, ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা, প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা— এমন সব আচরণ দেখেই বিষকন্যাদের ধরে ফেলতেন বিচক্ষণ আধিকারিকেরা। যেমন পেরেছিলেন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল। ভিনদেশি এই দার্শনিক আলেকজান্ডারের গুরু নিজের দেশে বসেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের কথা জানতে পেরে চিনেছিলেন এদেশীয় বিষকন্যাদের।   ভুবনজয়ী শাসক  আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের এই পরামর্শদাতা-গুরু অ্যারিস্টট্ল বয়সের ভারে  যখন কাহিল, তখন শুধু চিঠি লিখেই উপদেশ দিতেন শিষ্য আলেকজান্ডারকে। গোপনীয় তাঁর সেই সব উপদেশ নিয়ে সংকলিত হয়েছিল 'সিক্রেটা সিক্রেটোরাম'। সেখানেই দেখা যায়, প্রাচ্যের, বিশেষত ভারতের বিষকন্যাদের থেকে  আলেকজান্ডারকে শত হস্ত দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন অ্যারিস্টট্ল। লিখছেন, "মনে নেই, কী হয়েছিল সে-বার! যে-বার ভারতের সম্রাট তোমাকে পাঠিয়েছিল দুর্মূল্য সব উপঢৌকন, যার মধ্যে ছিল এক অপরূপা সুন্দরী! তাকে তত দিন ধরে খাওয়ানো হয়েছিল বিষ, যত ক্ষণ না সে হয়ে ওঠে বিষধর এক সাপের মতো।" অ্যারিস্টট্ল আরও লিখেছেন, তিনি সন্দেহ না করলে বিষকন্যার আলিঙ্গন আর ঘামে সেদিন  আলেকজান্ডারের মৃত্যু ছিল অবধারিত। শিষ্যকে তিনি এ-ও মনে করিয়ে দেন, অতীতে বহু রাজা শেষ হয়েছেন এই বিষকন্যাদের সংসর্গেই। 

আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পূর্বে তিনি তাঁর প্রাক্তন ছাত্রকে এইসব সুন্দরী নারীদের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিলেও সুন্দরীর হাতছানি ও তৃতীয় রিপু যেখানে নামগোত্র ভুলিয়ে দেয় সেখানে গুরুবাক্য তো কিছুই নয়। ৩২৬ খ্রিস্টাব্দে ঝিলমের যুদ্ধে প্রতিপক্ষের রাজা পুরুকে পরাস্ত করে আবার পুনরায় সেই রাজ্য তাঁকে ফিরিয়ে দিলে পুরু খুশি হয়ে এক অপূর্ব সুন্দরী নারীকে উপঢৌকন স্বরূপ আলেকজান্ডারের হাতে তুলে দেন।

নিজের শিবিরে সুন্দরী মোহিনীকে একান্তে পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন আলেকজান্ডার। সেই সুন্দরীও রপ্ত করা তার সব রকম কামকলায় শরীরমন ভরিয়ে দেন। বীর আলেকজান্ডারও ভারতীয় সুন্দরীর সেবায় পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরে যান। কিন্তু তারপর থেকেই পুরুর পাঠানো সেই বিষকন্যার শরীরী আবেদনের প্রভাবে এর পর থেকেই আলেকজান্ডারের দীপ্তি ও পৌরুষশক্তি তিলে তিলে শেষ হতে থাকে। ঘন ঘনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে ব্যাবিলন শহরে প্রচণ্ড জ্বর ও রক্ত আমাশয় রোগে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান আলেকজান্ডার। পুরু তাঁর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন এভাবেই।

লোভ আর ভোগের পরিণামের পরিণতি মৃত্যু— এই ছবি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাচীন কথকতায় বলা হয়েছে যে, বিষকন্যারা ছুঁলেই ঝিমিয়ে পড়ত কীট-পতঙ্গ, পাখিরা। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের মহিলারা ফুল-পাতা স্পর্শ করলেও সেইসব বস্তু পর্যন্ত নিয়ে পড়ত। যদিও এই বিবরণের স্বপক্ষে কোনো বাস্তব প্রমাণের কথা কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, তেমন কোনো মানব বা মানবীর শরীর-বৃত্তিয় এমন কোনো শক্তি যদি থেকেও থাকে, তাহলেও সেটা একজনের শরীর থেকে আর একজনের শরীরে রক্ত কিংবা লালা-রস ছাড়া সংক্রমিত হওয়া ছাড়া কোনো ভাবে কার্যকর হতে পারে না। ফলে সে মানুষই হোক বা গাছ, ফুল-পাতা, কীট-পতঙ্গ— যাইই হোক না কেন, তথাকথিত বিষকন্যার সংস্পর্শে এলেই মৃত্যু হবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের এই যুক্তি মেনে না নেওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা আধুনিক যুগের এইডস রোগ সম্পর্কে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শে বিশ্বব্যাপী তো এই কথাই প্রচার করা হচ্ছে যে, দৈহিক সংসর্গ ছাড়া একজন এইডস রোগীর শরীর থেকে অন্যের শরীরে এই রোগ সংক্রমিত হতে পারে না। শুধুমাত্র স্পর্শ কিংবা কাছাকাছি থাকলে এই রোগের কোনো প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়ে না।

🍂

বিষকন্যাদের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে নানা কথা লিপিবদ্ধ থাকলেও ধরা পড়লে বিষকন্যাদের পরিণতি কী ছিল, সে-নিয়ে কোথাও কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে  প্রাচীন ভারতীয় অপরাধ আর শাস্তির ধরন দেখে অনুমান করা যেতেই পারে, হয় তাদের কেটে ফেলা হতো টুকরো টুকরো করে, না হয় পুড়িয়ে মারা হতো জীবন্ত! মূলতঃ রাজপুরুষদের শরীরী আকাঙ্ক্ষার সুযোগ নিয়েই গুপ্তহত্যার সফল কৌশল হিসেবে উঠে আসে বিষকন্যারা— এমনটা মনে করার যথেষ্ট  কারণ রয়েছে। 

অষ্টম শতকের পরে ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে বিষকন্যাদের কাহিনি। লোভ আর ভোগের চিরকালীন পরিণামের ছবি হয়েই তার পরে যেন ঘুমিয়ে পড়ে তারা।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে নারীদেরকে গুপ্তচর, বিষকন্যা রূপে নিয়োগ করার রীতি মৌর্য যুগে বেশ জনপ্রিয় ছিল। অল্প বয়স থেকে খাবারে একটু একটু করে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে তাদের শরীরকে বিষাক্ত করা হতো। পরিপূর্ণ বিষকন্যা রূপে তৈরি করতে সময় লাগত ন্যূনতম আঠারো বছর। বিষের প্রভাব সহ্য করা ছাড়াও নানান ছলাকলা, কামকলা তাদের আয়ত্ত করতে হতো। প্রতিটি বিষকন্যাকেই হতে হতো চতুর, পরমা সুন্দরী, ধুরন্ধর ও তীক্ষ বুদ্ধির অধিকারিণী। প্রভাবশালী প্রতিপক্ষের কাছে তাদের পাঠিয়ে ঘায়েল করা থেকে শুরু করে নানা কার্য সিদ্ধি তাদের দিয়ে করিয়ে নিতেন রাজ-রাজারা। 

আবার এর বিপরীত রীতির কথাও জানা যায় ইতিহাস থেকে। ভারতে এক শ্রেণির নারীদের হদিশ মেলে যারা বিভিন্ন রাজ-রাজাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতা তাদের মাধ্যমে মিটিয়ে দিত। রাজাদের পারস্পরিক বিরোধিতার জন্য সাধারণ জনগণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে যেন অকারণ প্রাণনাশ না ঘটে তার দায়িত্ব নিয়েছিল ওই সব রমণীরা। এদেরও বিষকন্যা বলেই বর্ণনা করা হয়েছে। কেন, তা জানা যায় না। হয়তো প্রয়োজনে এদের গুপ্তহত্যার কাজেও লাগানো হতো। এইসব বিষকন্যাদের পৃষ্ঠপোষকতার পিছনে ছিল বিভিন্ন রাজার আর্থিক সহায়তা, অর্থাৎ রাজারা নিজেরাই নিজেদের শত্রুকে শেষ করতে অথবা নিরুপায় হয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সন্ধি করতে আগে থেকেই এদের তৈরি করে রাখত। 

তবে মূলতঃ সাধারণত এই সব মেয়েকে গুপ্তহত্যার কাজেই বেশি কাজে লাগানো হতো। এদের মানুষকে মেরে ফেলার মতো বিষ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি হলে সুযোগ মতো পাঠিয়ে দেওয়া হতো অন্যান্য রাজার দরবারে। তার প্রথম কাজ ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার বিশ্বাসভাজন হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। তারপর রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে সেই একই খাবার নিজেও খেয়ে রাজার সন্দেহ  দূর করা। তারপর যা হবার তাই হতো, রাজা বিষাক্ত খাবার খেয়ে মারা যেত, অন্যদিকে বিষকন্যারা বেঁচে ফিরে আসত কোনো ধরনের আঁচড় ছাড়াই। এছাড়াও বিষকন্যাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পাঠানোর আগে তার শরীরে অতিরিক্ত বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হতো যাতে বিষকন্যার দেহের সংস্পর্শে আসামাত্র বিষের আক্রমণে প্রতিপক্ষের মৃত্যু হয়। তাদের সঙ্গে চুম্বন কিংবা মিলনের ফলাফল তো মৃত্যু ছিলই।

ইতিহাসের এক গল্প ভাণ্ডার ভারতীয় উপমহাদেশ। প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলের বিভিন্ন সময়ের গল্প-উপকথা-ইতিহাসের ভাণ্ডার নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। আর সে কৌতূহলেই বিভিন্ন সময় আমরা খুঁজে পাই এর পরতে পরতে বিভিন্ন আকর্ষণীয় চরিত্র। এর অন্যতম একটি হল বিষকন্যা।

Post a Comment

0 Comments