ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
মানুষের স্মৃতি তো খানিক উলের গোলার মতো, খুলতে খুলতে বুনতে বুনতে এগিয়ে যায়। সৃষ্টিসুখের মাধুর্যে লৌকিক দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেই।
আজকের এই বদ্ধ ঘরের বাতাসের বিষন্ন নীরবতা যেন বৃদ্ধার মনের আগলও খানিক খুলে দিল, অসুস্থতার বিস্মৃতি পেরিয়ে মনে ভাসতে লাগলো প্রথম দেখা হাওড়া ইষ্টিশান।
তখন ভোর প্রায় হয় হয়। কয়লার গাড়ি ধুসধুস শব্দ তুলে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই লাল জামা পরা বেহারী কুলীরা সব ছুটে আসে, যাত্রী সংখ্যা নগন্য হলেও লাটবহর ছিল ঢের।
তারই মধ্যে চোখে পড়ে বড় দাদা দাঁড়িয়ে আছেন সাদা ফতুয়া আর ধুতি পরে! তাঁরা ট্রেন থেকে নামতেই এগিয়ে এসে নিয়ে গেলেন ইষ্টিশানের বাইরে ভাড়া করে আনা ঘোড়ার এক্কাগাড়িতে। সেখান থেকে খিদিরপুর,তাঁদের পারিবারিক অস্থায়ী বাসস্থান। পথে যেতে যেতে স্মৃতি মেদুরতা… রাস্তার পাশের গ্যাসের আলো, হোস-পাইপ দিয়ে গঙ্গাজলে রাস্তা ধোওয়া, পথের ধারের দোকানে সিঙারা-অমৃতির সুগন্ধ, হিং-কচুরীর মৌতাত… সব, সব রয়ে গেছে অবিকৃত, শুধু বদলে গেছে বিরজার জীবন;বর্ণময়তার উচ্ছলতা থেকে শুভ্রতার নিঃস্বতায়।
এই সব অবান্তর দোলাচলের মধ্যেই দিনের বিশ্রামের ঘোর কাটিয়ে শুরু হয়েছিল তীর্থযাত্রার প্রস্তুতি। সন্ধ্যেয় ছিল ট্রেন।সে ট্রেন আবার ছাড়বে শিয়ালদা থেকে,সে ইষ্টিশান নাকি হাওড়ার একেবারে উল্টো দিকে,ওখান থেকেই ভারতবর্ষের উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার ট্রেন ছাড়ে, এমনই বলছিলেন দাদা। তখনকার দিনে তো এখনকার মতো রিজার্ভেশন ব্যবস্থা ছিলনা, আর থাকলেও জানা ছিল না মধ্যবিত্ত মানুষজনের। তবে তখন গাড়ি বা ট্রেনে এখনকার মতো ভীড়ও তেমন থাকতো না।
অগত্যা ঢের আগে ইষ্টিশানে পৌঁছে সেকেন্ড ক্লাশের মেয়েদের কামরায় উঠে গুছিয়ে বসেছিলেন পিসিমা এবং বিরজা;জলের কুঁজো, পানের বাটা, মুড়ির টিন, বড়োদাদার এনে দেওয়া কলকাত্তাই রসগোল্লা আর পয়োধির হাঁড়ি…সব রাখা হয়েছিল তাদের কাছেই। দাদা উঠেছিলেন পাশের পুরুষদের কামরায়। ট্রেন ছাড়া অবধি বড়োদাদা সঙ্গে ছিলেন, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছিলেন, কিছু শুনছিলেন বিরজা, কিছু শুনছিলেন না। তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে তখন পাহাড়ের আহ্বান।
🍂
কয়েকদিন আগে জলপানির টাকা পেয়ে বড়োভাইপো তাঁকে উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ভ্রমণ অমনিবাস বইটি কিনে দিয়েছিল। পড়তে পড়তে কল্পনেত্রে যা যা দেখেছিলেন বিরজা, বাস্তবের সঙ্গে তা কি মিলবে! স্বপ্নে দেখা সেই মেঘের পাহাড়, কলস্বরা নির্ঝরিনীর গান, আকাশছোঁয়া বড় বড় গাছগুলির তলা দিয়ে হাঁটার সময়কার সোঁদাগন্ধী আদিমঘ্রাণ প্রাণ ভরে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব তখন তাঁর সমস্ত হৃদয়। সাধারণ ট্রেনের সাধ্য কি তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার!
ক্রমে ট্রেন ছাড়ে, মুখে চোখে এসে লাগে কালো কালো কয়লার গুঁড়ো,পোড়া গন্ধ, ধাতব ধুসধুস শব্দ। পিসিমা নাক সিঁটকোন, বিরজা তাঁকে বিছানা পেতে শুইয়ে দেয় সীটে। তাঁর পায়ের কাছে জানলার ধারটিতে এসে বসে নিজে।
কামরাতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা আরও সব মেয়ে মানুষেরা যে যার মতো গল্প জুড়েছে ততক্ষণে, কেউ এদেশের, কেউ বা অন্য রাজ্যের।কেউ যাচ্ছে, কেউ ফিরছে নিজের ভূমে। তাদের ভাষা-ভঙ্গিমা আলাদা হলেও এই কয় ঘন্টা তারা সহযাত্রী, এক অর্থে বন্ধুও। অনেকে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও শুরু করে দিয়েছে,অনেকে খাওয়া-দাওয়া।বিচিত্র গন্ধ, বিচিত্র শব্দের এক হরেকরকমবা। বিরজা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন…
তখনকার ট্রেনের বডি এবং সীট দুইই ছিল কাঠের, জানলাগুলো তাদের কলকাতার বাড়ির মতো খড়খড়ি দেওয়া;ওদিকে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, কামরার মধ্যে মিটমিটে আলো। ভেতরের দৃশ্যাবলীর দিকে চোখ সরিয়ে খড়খড়ি ফাঁক করে বিরজা তাকালে বাইরের দিকে।
বাইরে তখন রাত নেমেছে,ঘন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।তবু ঐ সরসর সরে যাওয়া অবয়বহীন অন্ধকার বিরজার মনে কতো যে কি চিন্তার জপমালা গেঁথে চলেছিল, সে ইষ্টমন্ত্রের ধ্বনি উচ্চারণ বোধহয় দেবতা পুরুষের কানেও যাচ্ছিলো না। কেবল খানিকটা ঝিমুনি, খানিকটা জাগরণে অদ্ভুতভাবে কাটছিল সময়।
বাংলা ছাড়ার আগে, কি জানি কি এক ইষ্টিশানে, নাম বোধহয় আসানসোল হবে, খানিকক্ষণ গাড়ি দাঁড়ালে। দাদা জানলার কাছে এসে তাঁর এবং মায়ের খবর নিয়ে গিয়েছিলেন,বিরজা দরজার কাছে এসে ছোট বৌদিদির বানিয়ে দেওয়া লুচি-তরকারী আর মিষ্টি কলাপাতায় মুড়ে তাঁকে পৌঁছিয়ে দিলেও নিজেরা প্রায় কিছুই খেলেন না। প্রথম কথা, ওভাবে সবার সামনে বসে খাওয়ার অভ্যাস তখনও ছিল না, সেই প্রথম ঘরের বাইরে এতদূর যাওয়া… তার ওপরে ছোঁয়া-ছুঁয়ি, হাত ধোওয়া ইত্যাদি ছুৎমার্গ ছিল দুজনের মধ্যেই।
এমনকি, পরের সারাদিনও ঐ একটু-আধটু মুড়ি-চিঁড়ে-দই-মিষ্টি খাওয়াই ছিল প্রায় ষোলোশো কিমি রাস্তার খাদ্য। তবে পরের সকালে পাটনা ইষ্টিশানে যখন গাড়ি থামে, দাদা খুব ভালো চা খাইয়েছিলেন, ঘীয়ের গন্ধমাখা মালাই চা! চা পাতা-মহিষের দুধ-এলাচ-চিনি দিয়ে বানানো এমন চা আগে কখনো খাওয়া হয়নি তাদের। তাছাড়া ঠোঙায় ভরা ঠেকুয়া, প্যাঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদিও সেই প্রথম গৃহস্থ বাঙালিনীর মুখে ওঠে, যদিও পিসিমা সারা রাস্তা পানদোক্তা নির্ভর হয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
যাহোক, যাত্রাপথের প্রায় আড়াই দিন এবং রাতের সময়টুকুতে পরপর চলে যায় পাটনা, মুঘলসরাই, লখ্নৌ, বেরিলি… কতো মানুষ ওঠেন কতোজন নামেন। চোখের সামনেই ধীরে ধীরে চারপাশের পরিবেশ-গাছপালার আকৃতি বদলাতে থাকে, আবহাওয়াও শীতল হতে শুরু করে।পিসিমার জন্য তূষের চাদর বের করতে হয়। বেরিলি ইষ্টিশানে দেখা করতে এসে দাদা বললেন,
-’বিরজা!ঘোমটা খুলে একবার বাইরে তাকাও’
চমকে তাকালে মেয়ে! এ কেমন কথা বলছেন,ভদ্রঘরের মেয়ে,বাইরে ঘোমটা খুলবেন কেন!’
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকাতেই আঙুল দেখালেন দূরে…
-’ওমা! ওগুলো কি গো! বড়ো বড়ো হাতির মতো! না না সবুজ সবুজ মেঘের মতো ধূ ধূ শ্যামলিমা ছাড়িয়ে হঠাৎ উঁচু হয়ে যেন আকাশকে ছুঁতে চাইছে! ওর নামই বুঝি পাহাড়!’ অবশেষে তাহলে স্বপ্ন সত্যি হলো তাঁর!
মাথার আঁচল খসে পড়লো বিশ্ময়ে, এমনও হয়!
আনন্দের আতিশয্যে ট্রেন থেকে নেমে পড়ার উপক্রম হলো, দাদা নিবৃত্ত করলেন।
-’উহু। না। না। ট্রেন এখুনি ছেড়ে দেবে। আমি আমার কামরায় গেলাম। প্রায় এসে গেছি আমরা।’
ট্রেন ততক্ষণে সত্যিই বাঁশি বাজিয়েছে, চোখে মনে বাজছে গতির সুর… (ক্রমশঃ)
0 Comments