জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৬/ বিজন সাহা

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৬ 

বিজন সাহা 

কানাল ভোলগা দন 


সারেপতা থেকে আমরা গেলাম ভোলগা নদীর তীরে। এখানে নদী তীরে লেনিনের এক বিশাল স্ট্যাচু। এটাই লেনিনের সবচেয়ে উঁচু মূর্তি। উচ্চতার দিক থেকে দ্বিতীয় মূর্তিটি দুবনায়। দুটোই দুই কানালের শুরুতে। দুবনায় মস্কো কানালের শুরুতে লেনিনের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এই কানাল মস্কো নদীকে ভোলগার সাথে যুক্ত করেছে। এখানে, ভোলগাগ্রাদের ভোলগা তীরে লেনিন দাঁড়িয়ে আছেন ভোলগা দন কানালের মুখে। এই কানাল ইউরোপীয় রাশিয়ার দুই বৃহৎ নদী ভোলগা ও দনকে সংযুক্ত করেছে। যেহেতু লেনিনের স্ট্যাচুর কথা উঠল, প্রথমেই এর বর্ণনা দিয়ে নিই। স্ট্যাচুর নীচেই বিস্তারিত লেখা আছে এ সম্পর্কে। তবে কানাল উদ্বোধন করার সাথে সাথেই এই স্ট্যাচু এখানে বসানো হয়নি। ১৯৫২ সালের ২৭ জুলাই এই কানালের নামকরণ করা হয় ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নামে আর কানালের প্রবেশ পথে ৩০ মিটার উচুর বেদীর উপর ২৪ মিটার উঁচু স্তালিনের স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়। ভাস্কর ইয়েভগেনি ভিকতরোভিচ ভুচেতিচ ও স্থপতি লিওনিদ মিখাইলোভিচ পলিয়াকভের তৈরি এই স্ট্যাচুর জন্য  বিশেষ ধরণের তামা উত্তোলন করা হয়। ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে স্তালিনের কাল্ট ধ্বংস করার অংশ হিসেবে এই স্ট্যাচু সরিয়ে ফেলা হয় যার পরবর্তী ভাগ্য সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। আর এর পর থেকে বেদীটি মূর্তিহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মন্ত্রীসভায় শূন্য বেদীতে লেনিনের স্ট্যাচু প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আবারও দায়িত্ব পড়ে ভাস্কর ভুচেতিচ আর স্থপতি পলিয়াকভের উপর। প্রথমে সেখানে লেনিনের আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের প্রস্তাব এলেও পরবর্তীতে বাম হাতে বিখ্যাত টুপি নিয়ে হেঁটে চলা লেনিনের মূর্তির পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মনুমেন্ট তৈরি কাজ শুরু হয় ১৯৬৯ সালে আর মহান নেতার ১০৩ বছর পূর্তি সামনে রেখে ১৯৭৩ সালের ২০ এপ্রিল লেনিনের স্ট্যাচুর উদ্বোধন করা হয়। জননী জন্মভূমি ডাকছে মূর্তির মত একই টেকনোলজি এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। ৩০ মিটার উঁচু বেদীর উপর স্থাপিত কংক্রিট, স্টিল ও পাথরের তৈরি ২৭ মিটার উঁচু লেনিনের মূর্তি সহ মনুমেন্টের সার্বিক উচ্চতা ৫৭ মিটার।  

ভোলগা তীরে দিলীপ

স্থপতি পলিয়াকভের নেতৃত্বে অনেক খ্যাতনামা স্থপতিদের পরিকল্পনায় নির্মিত  ভোলগা-দন কানাল তার যাত্রা শুরু সারেপতা অঞ্চলে যেখানে ভোলগা নদী উপত্যকা বরাবর  স্রোত ও  বরফ প্রবাহ থেকে ভালভাবে সুরক্ষিত। এখানে এরগেনি পাহাড়ের পাদদেশে সারপি নদী ধরে সে চলে গেছে দনের দিকে। পরবর্তীতে কানাল মিলিত হয় চেরভ্লিনা নদীর সাথে। এখানে নবম লকের পেছনেই ভারভারভ জলাশয় শুরু। এরপর কানাল নেমে গেছে দন নদীর দিকে। এরপর কানাল বেরেস্লাভ জলাশয় হয়ে হয়ে পড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কারপভ জলাশয়ে যার আয়তন ৪২ বর্গ কিলোমিটার। সেখান থেকে কানাল কালাচ অন দন শহরের পাশে ১৩ নম্বর লক পেরিয়ে দন নদীতে পড়ে। 


প্রাচীন কাল থেকেই ভোলগা ও দন নদীর মধ্যে বাণিজ্যিক ও সামরিক পথ বিরাজমান ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩৮ সালে বসপোরান রাজ্যের সময়ে দনের ব-দ্বীপে তানাইসের সুরক্ষিত জনপদের উপস্থিতি সেই স্বাক্ষ্যই দেয় যে এটা ছিল যথেষ্ট সুরক্ষিত ও জনপ্রিয় রুট। দনের বাম তীরে সারকেল দুর্গ থেকে তখন ভোলগার বানিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণ করা হত। আধুনিক কালে ভোলগার সাথে দনকে সংযুক্ত করার প্রথম প্রচেষ্টা শুরু হয় ষোড়শ শতকের মধ্যভাগে। ১৫৬৯ সালে তুরস্কের সুলতান দ্বিতীয় সেলিম, যিনি আস্ত্রাখান অভিযান করেন, কাসিম পাশাকে ২২ হাজার সেনা সহ দনের এই এলাকায় পাঠান দুই নদীর মধ্যে সংযোগকারী কানাল তৈরি করার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। তবে তিন মাস চেষ্টার পর সুলতান এই পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। এরপর প্রথম পিওতর উদ্যোগ নেন অনুরূপ কানাল তৈরি করার। তবে তিনি চেয়েছিলেন সরাসরি ভোলগা ও দন সংযুক্ত না করে ভোলগা ও দনের দুই উপনদী কামিশিনকা ও ইলোভলাকে সংযুক্ত করতে। এই প্রজেক্টের পলিচালক ছিলেন ইয়োহান ব্রেক্কেল নামে এক বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার। তবে অচিরেই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে রাশিয়া থেকে পালিয়ে যান। এরপর ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার জন পেরি সেই কাজে হাত দেন। কিন্তু ১৭০১ সালে রাশিয়া সুইডেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে অর্থাভাব দেখা দেয়। এভাবেই সেই পরিকল্পনার অকাল মৃত্যু ঘটে। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের আগে পর্যন্ত এই দুই নদীকে সংযুক্ত করার জন্য ৩০ টির বেশি প্রোজেক্ট হাতে নেয়া হয়, কিন্তু কোনটিই সাফল্যের মুখ দেখেনি। সে সময় রেলপথের অনেকটাই ছিল ব্যক্তিমালিকানায়। রেলপথের মালিকদের বিরোধিতা ছিল এসব প্রোজেক্ট ব্যর্থ হবার অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়া সেসময় জাহাজ চলাচল করতে পারত শুধু মাত্র বসন্ত কালে যখন নদী থাকত জলে ভরপুর। তাই সেটাকে অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক মনে করেননি।     

🍂
১৯২০ সালে গোয়েলরো নামে খ্যাত রাশিয়ার বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে আবারও দুই নদী সংযুক্ত করার কথা ভাবা হয়। তবে সেই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ১৯৩০ এর দশকের মধ্য ভাগে। আর ১৯৪০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত মন্ত্রী সভায় কানাল তৈরির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টি করে। ১৯৪৩ সালে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ শেষে আবার এর কাজ শুরু হয়। কানালের জন্য রুট তৈরির নেতৃত্ব দেন সেরগেই ঝুক যিনি এর আগে বেলামোর-বাল্টিক এবং মস্কো-ভোলগা কানাল নির্মাণে  নেতৃত্ব দেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে মস্কো-ভোলগা কানালের শুরু দুবনায়, সে সম্পর্কে আমরা পরে বিস্তারিত বলব।  ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর সোভিয়েত মন্ত্রীসভার রেজুলেশন পাশ করা হয় আর খনন কার্য শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৫২ সালের ৩১ মে ভোলগা ও দনের জল পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আর ০১ জুন ১৯৫২ সালে কানালে শুরু হয় জাহাজ চলাচল।  

খোলা বাজারে টোম্যাটো ওজন করছেন এক বাবুশকা

কানালের মুখে আমাদের সময় কাটে মূলত লেনিনের স্ট্যাচুর পাদদেশে। পরিত্যক্ত না হলেও এই স্ট্যাচু এখন অনেকটাই অবহেলিত। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছিল লেনিনের মূর্তি। আমি তখন রুশ বন্ধুদের ঠাট্টা করে বলতাম তোমাদের দেশে যত লেনিনের মূর্তি আছে ভারতে তত শিব লিঙ্গ নেই। যে লেনিন সারা জীবন ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন, নাস্তিকতা রাষ্ট্রীয় আদর্শে পরিণত করেছেন, নিয়তির পরিহাসে তিনি নিজেই ভগবানে পরিণত হয়েছেন তাদের অনুসারীদের কাছে। বেশ কিছু সময় আমরা সেখানে কাটালাম ছবি তুলে। দুয়ারে সেপ্টেম্বর। ঠাণ্ডা না হলেও গরম নয় মোটেও। দেখলাম এক মহিলাকে ভোলগায় সাঁতার কাটতে। আমারও বেশ কিছু দিন ভোলগায় সাঁতার কাটা হয়নি। তবে সাহস করে নামা হল না। দিলীপ আর দেমিদের কয়েকটি ছবি নিলাম। এরপর গেলাম শহরের দিকে। পথেই পড়ল খোলা বাজার। এখানে গ্রীষ্মে অনেকেই নিজেদের খামারের শাক-সব্জি বিক্রি করে। সাধারণত দেদুশকা-বাবুশকা মানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এসব করেন। আমি দুবনায় অনেক সময় দরকার না থাকলেও এদের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনি। অনেক আগে দামাদামি করতাম। সেভা আমার সাথে থাকলে বেশ রাগ করত, বলত, বাবুশকা এত কষ্ট করে এসব ফলিয়েছে, আর তুমি দামাদামি করছ। ভাবখানা এই যেন আমি কষ্ট করে উপার্জন করছি না। এখন আর দামাদামি করি না, বিশেষ করে বিকেলের দিকে যদি খুব বয়স্ক কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি চেষ্টা করি তাঁর কষ্টটা একটু হলেও লাঘব করতে। সেখানে অনেক বলে কয়ে তাঁদের কিছু ছবি নিলাম। টুকিটাকি কেনাকাটাও করলাম তাঁদের কাছ থেকে। এক মহিলা, মনে হয় আর্মেনিয়ান, কিছুতেই ছবি তুলতে দেবেন না। আর দিলীপ নাছোড়বান্দা, ছবি তুলবেই। শেষ পর্যন্ত আমি টোম্যাটো কিনব বলে তাঁকে সেটা ওজন করতে বললাম আর এই সুযোগে দিলীপ দূর থেকে কিছু ছবি নিল, আমি নিজেও তাঁর ছবি তুললাম। মনে হয় এই প্রথম সাধারণ লোকজনদের সাথে আমাদের সরাসরি কন্টাক্ট হল। এবার পথে নামার পালা। পরবর্তী গন্তব্য আস্ত্রাখান – যেখানে ভোলগা মিশেছে কাস্পিয়ান সাগরের বিশাল জলরাশির সাথে। যেহেতু আমাদের ফিরতি পথ ভোলগাগ্রাদ হয়েই, ঠিক হল সেসময় এখানে আরেক রাত কাটিয়ে দেখে নেব শহরের না দেখা কিছু অংশ।   

ভিডিওতে সারেপতা ও ভোলগা দন  

https://www.youtube.com/watch?v=zf-uT9E3PH4

ছবিতে সারেপতা ও ভোলগা দন  

http://bijansaha.ru/album.php?tag=263 

Post a Comment

0 Comments