পর্ব -৩
তনুশ্রী ভট্টাচার্য
পাশ্চাত্য ধ্রূপদী সাহিত্য অধ্যয়ন করা মাইকেল আদ্যন্ত ভারতীয় বা দেশীয় থিমকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে বিদেশী ফর্ম কে সুচারু ভাবে মিলিয়ে দিলেন।
আঙ্গিকে ছন্দে গঠনে।শর্মিষ্ঠা নাটকে স্বদেশচেতনার অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে। কৃষ্ণকুমারী নাটকে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যায়। কৃষ্ণকুমারীর পাঁচজন পাণিপ্রার্থী। কৃষ্ণকুমারী যাঁকেই বরমাল্য দেবে বাকী চারজন ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর পিতার রাজ্য আক্রমণ করবে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে পিতার রাজ্যের সুরক্ষার জন্য কৃষ্ণকুমারী আত্মাহুতি দিলেন। দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়া যখন দেশপ্রেমের নির্ণায়ক তখন কৃষ্ণকুমারী এক ট্র্যাজিক চরিত্র হয়ে উঠেছেন।উৎপল দত্তের মতে এটি একটি সার্থক ট্রাজেডি এবং এর মধ্যেই দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রেম ফুটে উঠেছে ।
বীরাঙ্গনা পত্র কাব্যে ১১ জন নারীর মনের কথা লিখেছেন চিঠির আকারে । তারা তাদের দয়িতকে বা স্বামী বা প্রেমিককে চিঠি লিখছে। রোমান কবি ওভিডের পত্রকাব্য অনুসারে এ কাব্য নির্মিত। বাংলায় প্রথম। পৌরাণিক নারীদের হৃদয় সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁদের আদ্যপান্ত এক রক্তমাংসের মানবী এঁকেছেন।
তাদের ব্যথা বেদনা আশা নিরাশা অঙ্কন করছেন।আজ ফেমিনিজমের কথায় আমরা আবেগতাড়িত হই। কিন্তু একশ ষাট সত্তর বছর আগে এই মনন চিন্তন এক বৈপ্লবিক ধারণা নি:সন্দেহে বলা যায়। দেশপ্রেম ত কেবল একপেশে ধারণা নয়,অর্ধেক নর বা অর্ধেক নারীর কথাও তিনি সাহসের সঙ্গে লিখেছেন। সেখানে কৈকেয়ী শকুন্তলা শূর্পনখা জনা দেবযানী চিঠি লিখছেন তাঁদের দয়িত বা স্বামী বা প্রেমাস্পদকে। সবথেকে বিতর্কিত সোমের প্রতি তারার প্রেম নিবেদন।গুরু বৃহস্পতির পত্নী তারা শিষ্য সোমকে প্রেম নিবেদন করছেন --সেই চিঠি সে যুগে নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু মধুসূদন নারীর হৃদয় উন্মোচিত করেছেন। তিনি নারী মুক্তি সমর্থন করতেন।যখন এই সব শব্দবন্ধ প্রচলিত হয় নি তখনই তিনি এই ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি করছেন। পৌরাণিক কাহিনীর এই বিনির্মাণের ধারা আজো অব্যাহত এবং এর পূর্বসূরি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
🍂
সনেটের ক্ষেত্রে দেখি দেশপ্রেম,মাতৃভাষা প্রেম জন্মভূমি প্রেম একাকার। বঙ্গপ্রীতি কেন্দ্রিক সনেটগুলোতে যে নিবিড় আবিলতায় বঙ্গভূমির রূপ ও বিস্তার বর্ণনা করা হয়েছে তা রূপসী বাংলার আদি রূপ। অনেকেই জীবনান্দের রূপসী বাংলার মুখবন্ধ বলছেন এগুলোকে।
আমরা জানি তখন দেশ থেকে দূরে থাকি তখনই দেশের প্রতি হৃদয় উদ্বেল হয়। বন্ধু গৌর দাসের একটি চিঠিতে বাগেরহাট কথাটি ছিল। সেই উল্লেখে মধুসূদনের মনটা হু হু করে উঠলো। তাঁর শৈশব স্মৃতি জেগে উঠলো।গ্রামের সবকিছু তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। যে সনেট শৈলীতে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন তা বাংলায় লিখলেন চতুর্দশপদী কবিতা। বিষয় বেছে নিলেন জন্মভূমির পল্লি প্রকৃতির বৈচিত্র্য। এখানেও বিষয় আদ্যন্ত বঙ্গীয় এবং গঠন কাঠামো পুরোপুরি পাশ্চাত্য। আরেকটি সনেট লিখেছিলেন পুরুলিয়ার কাশীপুর রাজবাড়িতে একবার গিয়েছিলেন। সেখানে একটি মন্দির এবং পুরুলিয়ার রুক্ষ প্রকৃতি কেন্দ্র করে একটি সনেট লিখেছিলেন খ্রিস্টদাস নামে। মোট ১০১ টি সনেট রচনা করেছিলেন। সনেট গুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় -- কবি ও কবি খ্যাতি, পৌরাণিকী, দেশের স্মৃতি, প্রেম বিবিধ। কপোতাক্ষ নদ, নদীর তীরে শিব মন্দির, কোজাগরী, শ্যামাপাখি, কেউটিয়া সাপ, বট বৃক্ষ, ভারতভূমি ,নদী তীরে প্রাচীন দ্বাদশ শিব মন্দির, শ্রী পঞ্চমী ,আশ্বিন মাস, বিজয়া দশমী, লক্ষ্মীপূজা, সায়ংকাল প্রভৃতি সনেটে হিন্দু জীবনের রীতি নীতি কে তুলে ধরেছেন। জন্মভূমির প্রতি অনুরাগের নিদর্শন।
পৌরাণিক চরিত্র সীতা উর্বশী হিড়িম্বা রুক্ষ্মিণী তাঁর সনেটের বিষয় হয়ে উঠেছে।
কবি ও কবি খ্যাতি নিয়ে রচনা করেছেন বাল্মিকী কালিদাস জয়দেব কৃত্তিবাস কাশীরাম দাস ভারতচন্দ্র ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ত আছেনই, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি প্রথম আই সি এস ----দেশের এই মানুষ গুলির প্রতি এই সনেট নিবেদন পরোক্ষে তাঁর দেশপ্রেমের আবেগকেই সূচিত করে।
এইভাবে নতুন ছন্দ নতুন আঙ্গিকে বাংলা ভাষাকে সাবালক করে তোলা বা বিশ্বসাহিত্যের সমকক্ষ করে তোলাই তাঁর মতো সাহিত্য স্রষ্টার দেশপ্রেম---বলাই যায়।
তাঁর দেশপ্রেমকে আমরা মাপতে পারি না। কেবল তাঁর অমিত প্রতিভা অধ্যবসায় এবং চিন্তনমননের দ্বারা আলোকিত হতে পারি।
(সমাপ্ত )
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
1 Comments
তনুশ্রী ভট্টাচার্যের মাইকেল মধুসূদনের ওপর লেখাটি যথেষ্ট ভালো একটি লেখা । ধন্যবাদ লেখিকাকে ।
ReplyDelete