নির্মল বর্মন
কথাসাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায় কল্লোল গোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯০৯ সালে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন এবং ১৯৯১ সালে ধরণীর মায়া কাটিয়ে উজ্জ্বয়িনীপুরে পাড়ি জমিয়েছেন। ভবানী মুখোপাধ্যায় সমাজের সাধারণ দরিদ্র মানুষদের জীবনালেখ্যকে পাথেয় করে তাঁর সর্বপ্রথম মুদ্রিত উপন্যাস প্রকাশ করলেন ।-
নাম তার--'স্বর্গ হইতে বিদায়'' (১৯৪০)।
দেশ বিদেশে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর রক্তচক্ষুর ছাপ ও পটভূমিকায় লিখে ফেললেন ''অগ্নিরথের সারথি" উপন্যাস। কথাকার ভবানী মুখোপাধ্যায় বাংলার সারস্বত সমাজের মন্বন্তেরর প্রেক্ষিতে লিখেছেন ''কালো রাত'' (১৯৪৬) উপন্যাস। ভবানী মুখোপাধ্যায় এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসগুলি :--
' 'কান্নাহাসির দোলা'' (১৯৫৩), 'একালিনী নায়িকা'' (১৯৪৫) ''বনজ্যোৎস্না'' প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায় ছোটগল্পের জগতে অবাধ বিচরণ করেছেন। ছোটগল্প রচনা তেও সিদ্ধহস্ত। তাঁর বিখ্যাত সংকলনগুলি :--
' 'সেই মেয়েটি'', ''চন্দ্রমল্লিকা'', ''নির্জন গৃহকোণ'' (১৯৪১), ''যথাপূর্বং'', ''বনহরিণী'' ইত্যাদি। কথাকার ভবানী মুখোপাধ্যায় সাপ্তাহিক "অমৃত" পত্রিকার পাতায় ''অভয়ংকর'' এই ভয়ঙ্কর ছদ্মনামে দীর্ঘকাল নিয়মিত ক্রমান্বয়ে সাহিত্য সমালোচনা করেছিলেন। এছাড়াও "রঙ্গবাণী", "বসুমতী" ও "যুগান্তর" পত্রিকাতেও নিয়মিত সাংবাদিকতার কাজ যত্নসহকারে করেছেন।
🍂
কথাসাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায়ের ''কান্নাহাসির দোলা'' উপন্যাসের মূল থিম মূলতঃ
"আগস্ট আন্দোলন, স্বাধীনতা প্রাপ্তি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশবিভাগ" ইত্যাদি।
বস্তুতঃ চঞ্চল সময়ের কাহিনির প্রেক্ষিত উপন্যাসের
নায়িকা মিনতি'র মুখে উপস্থাপিত । আসলে মিনতির সঙ্গে 'আগস্ট আন্দোলনের কর্মী ও সদ্য জেল ফেরত জয়ন্ত বাবুর সাক্ষাৎ । উপন্যাস নায়িকা মিনতি জয়ন্ত বাবুকে শুধু নিজের না ভেবে, দেশ ও সমাজের একজন দক্ষ সৈনিক হিসেবে বিবেচনা করেন ।
ইতিমধ্যে জয়ন্ত ও মিনতির কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে, নাম তার জয়তী। সংসার , সন্তান ও পরিবার ছেড়ে গান্ধীজীর উদার আহ্বানে জয়ন্ত দেশে সেবা র কাজে নিজেকে আত্মসমর্পণ করল। আর তখনই শুরু দাঙ্গা ও দেশবিভাগের প্রস্তুতি পর্ব। সচরাচর যা ঘটে তাই ঘটলো--১৯৪৭ সালের ২রা আগস্ট 'জয়ন্ত শান্তিসেনা-র নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার সময় ষড়যন্ত্র করে উন্মত্ত জনতা মেরেই ফেললো। ফলতঃ মিনতি'র জীবন অন্তঃসারশূন্যতা নেমে আসে । কিন্তু মিনতিকে কন্যা জয়ন্তীর জন্য বাঁচতে তো হবেই । জটিল রহস্যময় মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ''কান্নাহাসির দোলা'র পরিসমাপ্ত ঘটেছে নতুনের সম্ভাবনা, চিরন্তনী ভাবনা ও আস্তিক্যবাদী চিন্তা।
ছোটগল্পকার ভবানী মুখোপাধ্যায় এর প্রথম মুদ্রিত ছোট গল্প ''পারুল'' (১৩৩৫ এ কল্লোল,মাঘ মাস , দশম সংখ্যা)। ছোটগল্পকার হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক সুনিপুণ রূপকারের তকমা তার করায়ত্ত। এই পরম ভাবনা তাঁর গল্প ''আঁতের কথা'' তে প্রকাশিত । শিশুস্বাস্থ্যের মনস্তত্ত্বের উপর ভিত্তি স্থাপন করে করে রচনা ''বাতায়ন''! এই "বাতায়ন" গল্প সম্পর্কে প্রখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:--
"এক শিশুর দারিদ্র্য-সঙ্কুচিত জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্য লোলুপ, ঐশ্বর্যমুগ্ধ কল্পনার কুণ্ঠিত প্রকাশের কারুণ্যভরা বিবরণ। মালতী মাসি তাহার শিশু-কল্পনা রাজত্বের রানী-অফুরন্ত সম্পদের প্রতীক, শিশু মনের সমস্ত কাঙিক্ষত কামনা পূরণের ইন্দ্রজালের অধিকারিণী।”
কথাসাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায় সময়সচেতন শিল্পী ও সাহিত্য চর্চা র সুনিপুণ ব্যক্তিত্ব। সেজন্য 'বাংলার স্বদেশী আন্দোলন, মন্বন্তর, দেশবিভাগ, স্বাধীনতা' ইত্যাদি তাঁর সৃষ্ট উপন্যাসের মূল কথাসার। তিনি সমাজসচেতন শিল্পী, তাই সমকালীন সমাজ সংস্কৃতি তে বিস্মৃতপ্রায় হননি। কারণ তাঁর ''পেশা'' গল্প পড়লেই বুঝতে পারা যাবে:---, ''মড়া যোগান দেবার পেশায় নিযুক্ত অনন্তচরণ শেষ পর্যন্ত নিজের স্ত্রীকে খুন করতেও দ্বিধা করেনি"।
সামাজিক সেই সত্যের প্রকাশে শিল্পী কথাসাহিত্যিক ভবানী মুখোপাধ্যায় সমাজমনস্ক ভাবনায় চিরস্মরণীয় বাংলা কথাসাহিত্যের পাতায় হয়ে থাকলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments