জ্বলদর্চি

দেশপ্রেমের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ/চিত্রলেখা দত্ত

দেশপ্রেমের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ

চিত্রলেখা দত্ত

"Amidst all tribulations and terror
The trumpet sounds to hearten 
those that despair and droop 
And guide all people in their
paths  of peril and pilgrimage
Thou dispenser of India's destiny
victory victory victory to thee"     
      - Rabindranath Tagore           
                                       
অনন্য স্বদেশ ভাবনায় জাগরুক হয়ে আমৃত্যু যিনি স্বদেশ নির্মাণের সাধনা করে গেছেন, তাঁর বিচিত্র ভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে হতাশাগ্রস্ত ভারতকে উজ্জীবিত করা --তিনি আর কেউ নন স্বয়ং দেশপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জীবনের মানোন্নয়নে তাঁর শিক্ষা ও দেশপ্রেম প্রায়োগিক ভূমিকা গ্রহণ করে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীর অঙ্গন থেকে।

  বাঙালির জীবন ও মানসে তাঁর গভীর উপস্থিতিতে মনে হয় তিনি সর্বদা বিচরণ করছেন দেশজুড়ে, দেশের মানুষের হৃদয় জুড়ে। গোটা দেশে যখন বিভাজনের রাজনীতি চলছে ,ধর্ম নিয়ে মেরুকরণ চলছে ,বিপুল শক্তি নিয়ে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তখন রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাঁর "Nationalism"প্রবন্ধ খানি তার দিক নির্দেশ করে।

  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব যাঁর দেশপ্রেম সংগীতের মূর্ছনা তোলে জাতীয় সংগীত হিসেবে। তাঁর বিরোধী পক্ষ যখন তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে সন্দিহান, তাঁকে ইংরেজ শাসকের সমর্থক হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছে, তাঁর চরিত্র গঠন ,নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তখন তিনি নিজের সমর্থনেই উল্লেখ করেছেন-- স্বাধীনতা আন্দোলন যেন ক্ষমতা দখলের লড়াই।এই লড়াইতে সাধারণ মানুষ কতটা উপকৃত হবে সে বিষয়ে তাঁর সংশয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে নয়। তাঁর লন্ডন যাত্রা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কিন্তু  ভারতবর্ষের আধুনিকতার রূপ হিসাবে তিনি পশ্চিমের ধারণা, রাজনীতি এবং প্রযুক্তিকে  ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ইতিহাসের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় একে কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর মতে প্রত্যেক উপনিবেশ নিজেদের শরীরে ইউরোপের দেওয়া ক্ষতচিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে অসংখ্য ইউরোপীয় ধারণা কারণ ইউরোপ সভ্যতার মাপকাঠি। প্রতিযোগিতার মধ্যে হিংসার মিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদ  তা অভিশাপ বলেই তিনি চিহ্নিত করেছেন।

  জাপান চীন প্রভৃতি দেশে তাঁর Nationalism বিষয়ক বক্তব্যের বিরোধিতা হয়েছিল তাকে তিনি যুক্তির  ক্ষুরধার আঁচড়ে তাঁর রচিত রাজনৈতিক উপন্যাস "গোরা "(১৯০৯) "ঘরে বাইরে "(১৯১৬)  "চার অধ্যায়"(১৯৩৬) প্রভৃতিতে সমালোচনামূলক আক্রমণ করেছিলেন।

  রাজনৈতিক চিন্তার মূল স্রোতে প্রবেশ না করেও তাঁর লেখা দেশপ্রেমের গান স্বদেশী স্বাধীনতাকামীদের অনুপ্রেরণার উৎস ছিল। তাঁর গানে অনুপ্রেরণা পেতেন স্বয়ং গান্ধীজী। আবার কারাগারে বন্দী বিপ্লবীদের কাছে তাঁর গান ছিল বেঁচে থাকার প্রেরণা ।এখনো তাঁর স্বদেশ চেতনায় রাঙ্গা গান বেজে ওঠে। যুগে যুগে তা আরো প্রসারিত হবে বলেই মনে হয়--
        " ও আমার দেশের মাটি
     তোমার পরে ঠেকাই মাথা।"

  আসলে জাতীয়তাবাদ আর স্বদেশচেতনা সম্পূর্ণ আলাদা। উগ্র জাতীয়তাবাদকে কখনোই তিনি প্রশ্রয় দেননি ।জাতীয়তাবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন-"A nation is understood in the sense of a political and economic union of a people and in that aspect a whole population as humans when organised for a mechanical purpose"

  তাঁর বিচারের দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি স্বতন্ত্র। দেশপ্রেম একেবারে প্রাকৃতিক জীবনের রস থেকে উঠে আসে যার শিকড় বিস্তৃত হয়ে থাকে পরিবেশ ও জন্ম পরিচয়ের বাতাবরণে। তাঁর দেশপ্রেম ভারতের অগণিত মানুষের বিচিত্র জীবন ধারণকে একই খাতে বইয়ে দেওয়ার ভাবনা অথবা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সেই সময় ব্রিটিশ রক্তচক্ষুর মাঝে দাঁড়িয়ে তাই অগণিত জনগণের জন্য লিখতে পারেন "রাশিয়ার চিঠি" যেখানে কার্ল মার্কসের দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজতন্ত্রের পথ ধরে। তাঁর দেশপ্রেম কোথায় দাঁড়িয়ে আছে তার এক আশ্চর্য নমুনা যখন তিনি বলেন-"চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হওয়ার সময় নেই ;দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সবচেয়ে কম খেয়ে, কম্ পরে, কম শিখে,বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম ,সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান"।
আরো দেখি যখন তিনি বলেন   -"তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে"।

  নিরন্ন ভারতবর্ষে যখন ইংল্যান্ড পরিপুষ্ট হয়েছিল তখন তারা মানুষকে অমানুষ করে রেখে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তা অনিবার্য বলে মেনে নেননি। তিনি তাঁর দেশপ্রেমের কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন শ্রীনিকেতনে সমাজতন্ত্রের ভাবনায় পুষ্ট হয়ে। যে সমাজে অস্পৃশ্যতা ব্যাধি হয়ে থাকে, যে সমাজে শিক্ষা তলানি পর্যন্ত পৌঁছায় না, যে সমাজে শিক্ষার নাম কেবল সার্টিফিকেট আর পাস করা সেই সমাজের মানুষ নিতান্তই অসহায়। প্রয়োজন বিপুল উদ্যম, বিপুল শিক্ষাবিস্তার। রবীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে তার  উপলব্ধি করেছিলেন।

  আবার যখন 1905 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ তুমুল আকার ধারণ করেছে লর্ড কার্জনের তর্জনী ঘিরে সেই সময় রাখি বন্ধন এর মত উৎসব মহামিলনের উৎসব হয়ে ওঠে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। তাঁর রচিত গান সমানভাবে প্রাসঙ্গিক বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে। হাতে হাত রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকে ছুঁড়ে দেওয়া প্রতীকী প্রতিবাদ রাখীযন্ধন। একজন মানুষের ডাকে সারা বাংলা এক হয়েছিল সেদিন  -তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 16 ই আগস্ট রাখি পরিয়ে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের উদাহরণ গড়ে তোলা হয়। এই" জাতীয় সম্মেলনের মহা দিনে" তাই গাওয়া হয়--
"বাংলার মাটি বাংলার জল 
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পূণ্য হউক পূণ্য হউক পুণ্য হউক হে ভগবান"

  পাঞ্জাবের জালিয়ান ওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ত্যাগ করলেন স্যার উপাধি। ভাইসরয়কে লিখলেন- "আমার শত শত দেশবাসীর হয়ে আমি প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং এই প্রতিবাদ করার সমস্ত দায়িত্ব গ্রহণ করছি।"-এই মহান ত্যাগ তার প্রচন্ড দেশপ্রেমের উজ্জলতা বহন করে।

  তাঁর অকৃত্রিম মানবতাবোধ থেকে উঠে এসেছে দেশপ্রেম। পূজা পর্যায়ের একটি গানে তিনি বলেছেন---"বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও"।
জগতের আনন্দযজ্ঞে ভারতীয়ত্বের শুভ চেতনার বিশ্বায়ন ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। আধুনিক দুনিয়াযর বিশ্বায়নে স্থায়ী ছাপ রেখেছে তাঁর দেশপ্রেম। তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে উঠি---
"জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে 
ভারতভাগ্যবিধাতা"
প্রণাম গুরুদেব। জন্মদিনের শুভক্ষণে তোমার দেশপ্রেমে, তোমার শিক্ষায়, তোমার সম্প্রীতির চেতনায় জেগে উঠুক ভারতবাসী এবং প্রিয় দেশ। মুছে যাক গ্লানি ,ভেদাভেদ। তোমার স্মরণে তাই মন বলে-
"হে মোর  চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে"।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments