নীল যবনিকা। শেষ পর্ব
ছ মাস কেটে গেছে। শীত আর নেই। বসন্ত কখন এলো, কখন গেল এবারের মত কেউ খবর রাখেনি। এবারে গ্রীষ্ম ভীষণ তেজী। সব জায়গায় তাপপ্রবাহ। অনেক দেশে বনে আগুন ধরে গেছে, হাজার হাজার ঘর জ্বলে গেছে, পশুপাখী যারা পালাতে পারছে না তারা পুড়ে মরছে। দেশে লোকে মরছে কি না কেউ অত খবর রাখে না, রাজনীতিতে সরগরম চারদিক। আশু স্যারের ঘরসংসার যেমন চলার চলছে, পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। মার সঙ্গে মনে হয় ফোনে কথা নয়, আশুতোষ মাথা ঘামান না। কেমন একটা তাল কেটে গেছে, সকালে বেড়াতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, স্কুলের ভার দিয়ে দিয়েছেন শ্রাবণীকে, পঁচিশ বছরের তরুণী, পড়াতে ভালোবাসে, আর কম্পিউটারও শিখেছে। পার্থর কম্পিউটারও ব্যবহার হচ্ছে। মাঝে একদিন মাথা ঘুরে গিয়েছিল বাথরুমে। সবই প্রায় ঠিক কিন্তু হার্টে সামান্য ব্লক আছে, সাবধানে থাকতে বলেছেন ডাক্তার।
একদিন সকালে হঠাৎ বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই ঢুকে পড়লেন দুজন উর্দিধারী ও তিনজন ভদ্রলোক।
-আমরা একটা তদন্ত করতে এসেছি সরকারী সংস্থা থেকে। আশুতোষ সরকার কে? আপনি?’
নীলিমা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, ভয়ে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন কথোপকথন।
-হ্যাঁ আমিই আশুতোষ সরকার।
-আপনার নামে বেআইনী বিদেশী মুদ্রা পাচারের অভিযোগ আছে। লাইসেন্স ছাড়াই এনজিওর থেকে অর্থ নিয়েছেন, ও যন্ত্রপাতি আমদানি করছেন, অনৈতিক ও দেশ বিরোধী প্রচার করে অবোধ শিশুদের বিপজ্জনক শিক্ষা দিচ্ছেন। FERA, FEMA আর আরটিকল ২৮। আপনার আলমারির চাবিগুলো দিন, প্যান আধার সব ডকুমেন্ট, যতগুলো মোবাইল আছে, আর বেআইনী আমদানি করা ল্যাপটপ, যেটা আপনি বিদেশ থেকে পেয়েছেন, সেটা দেখান।
তিনজন লোক তিনটে ঘরে ঢুকে গেল, চাপা স্বরে নীলিমার অস্ফুট আপত্তি শোনা গেল, তারপর দেখা গেল একজন নীলিমার পিছন পিছন আসছে, হাতে লাঠি না রিভলভার সামনে থেকে বোঝা গেল না। নীলিমা একটা সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন।
-আপনাকে ডাকলেই আমাদের দফতরে চলে আসবেন।
পুরো বাড়ী তছনছ করে, যাবতীয় ফোন ডকুমেন্ট এবং পার্থর ল্যাপটপ নিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোকেরা। ফোন গুলোর জন্য আপত্তি জানাতে তাঁরা বলে গেলেন,
-আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন না ফোনগুলো যাবে, কোনটা ভালো। শিক্ষিত সম্মানিত লোকের ভান করে আপনারা দেশের ক্ষতি করে চলেছেন, লজ্জা করা উচিত আপনাদের।
🍂
আশুতোষ এসব শুনেছিলেন, টিভিতে দেখেছিলেন, সত্যি কেমন হয়, সেটা আজ দেখলেন। তাঁর মুখচোখ লাল, নীলিমার দৃষ্টি দেখে তিনি মরমে মরতে থাকলেন। নীলিমার চোখে আতঙ্ক, এখনো যেন রিভলভার ছুঁয়ে আছে পিঠে, তিনি কোন কথা না বলে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। আশুতোষ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কালো টিভির পর্দায়। পার্থ কিনে দিয়েছিল ৬৫ ইঞ্চি টিভি। দেখিয়েছিল কতখানি আকাশ দেখা যায় এই টিভিতে। কতখানি অন্ধকার দেখা যায় সেটাও আজ দেখলেন। ভদ্রলোকেরা গেটের বাইরে আর একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল, হ্যান্ডশেক হল, তারপর চারদিক ফাঁকা। হাতটা আশুতোষের চেনা, হাতে সোনার বালাটা দেখেছেন পতাকা তুলতে। সেই নেতা। স্কুলে তাঁদের মহান লীডারের ছবি টাঙ্গাতে বলেছিলেন, আশুতোষ রাজী হননি। হয়ত তাই।
ভাবনার অথৈ সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে, রাত্তিরে আশুতোষ আর পারলেন না। শীত করে উঠল, কিন্তু এখন তো আকাশ আগুন ঢালছে, আরো গভীর থেকে উঠে আসা সেই শীত, সঙ্গে দরদর করে ঘাম, বুকের মধ্যে যেন গড়িয়ে পড়ল ল্যান্ডস্লাইডের মত দিনের সব কষ্ট, যন্ত্রণা, প্রতিবাদ, ক্ষোভ।
“ফাদার সিরিয়াস ইন আইসিইউ। ইয়োর প্রেসেন্স ইস রিকোয়েস্টেড। কল ব্যাক মম”
এই মেসেজ যখন ফোনে পৌঁছল পার্থ তখন সেমিনারে ব্যস্ত । বিশ্ব এআই প্রযুক্তি সম্মেলন। বক্তৃতার বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধি ও কম্পিউটার বিপ্লব। বড় বড় কোম্পানীর এআই ডিভিশনের চাঁইরা, সরকারী পদাধিকারীরা ও অনেক ঝকঝকে সব ছাত্রছাত্রী। পার্থর কথা তারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে।
‘কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আজ পৃথিবীকে বেঁধে ফেলে তৈরি করেছে এক গ্লোবাল ভিলেজ। এক সময় কিছু বামপন্থী অর্থনীতিকরা এর বিরোধিতা করতেন, বলতেন অটোমেশান মানুষের জব নিয়ে নেবে, গরীব দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর আজ দেখুন? একটা গরীব দোকানদারও ব্যবহার করছে ইউপিআই, জিপে ইত্যাদি। একসময় ট্রেনের সিট বুকিং করার জন্য আমার ইন্ডিয়ান বাবা ভোর থেকে রেলস্টেশনে গিয়ে লাইন দিতেন আর আজ? তেমনি আজ যারা চীৎকার করছেন এআই সব চাকরী খেয়ে নেবে, সেই বামপন্থী অর্থনীতিকদের বলি, আপনারা আমাদের সেমিনারটা শুনুন, তারপর কিছুদিনের জন্য ছুটি নিন।‘
প্রচুর হাসি উঠল এই কথা শুনে। পার্থ বলতে থাকল,
-আর এসব সম্ভব কারণ পৃথিবীর সব কম্পিউটার এখন এক তথ্যের ক্লাউডের সভ্য, সব তথ্য সেখানে, সব গণনা হয় সেখানে, আর সেইখানেই যদি এআইকে জুড়ে দেওয়া যায় তৈরি হবে একটা একক ইন্টেলিজেন্স যার নখদর্পণে থাকবে সব কিছু। ভাবুন সব কিছু কত সহজ হয়ে যাবে। আপনি অসুস্থ হলে, আপনার মুখ ও শরীর স্ক্যান করবে এআই, বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেবে এআই, আপনাকে ওষুধ খাওয়ার রিমাইন্ডার দিয়ে যাবে। এমারজেন্সী হলে মুহূর্তে ড্রোন চলে যাবে, তাতে থাকবে মেডিকাল পারসোনেল, যদি হার্ট এটাক হয়, সেখানেই আপনার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে যাবে। আপনি কোথাও যেতে চান, এআই খুঁজে বার করবে সবচেয়ে সুবিধার রুট ও ক্লাস, আপনার ফোনে চলে আসবে একটি কিউআর কোড। আপনি এয়ারপোরটে গিয়ে শুধু সেটা দেখাবেন, কোন চেক-ইন নেই, কোন বোর্ডিং পাস নেই, শুধু আপনার মুখ ট্রেস করে যাবে এই এআই, নির্বিঘ্নে চলে যাবেন হিউস্টনে থেকে কলকাতা।“
এই সময়েই ফোনটা বেজে ওঠে । এখনো এআই সেভাবে চালু হয় নি, কাজেই লেকচার শেষ করে, ফোন থেকেই বুকিং করে, হিউস্টন-ফ্রাংকফুরট-কলকাতা।
বাবার ওপর যতই রাগ থাক, ও অন্য ইন্ডিয়ানদের মত অকৃতজ্ঞ নয়। ও জানে মার ওকে এখন কতটা দরকার।
লিন্ডাকে সব বুঝিয়ে বিকেল চারটের মধ্যে পার্থ তৈরী, লিফটের ট্যাক্সিও এসে গেছে বাড়ির কাছে, তখন মেসেজ বাজল টুং করে। due to unavoidable system malfunction, your flight QR714 is delayed. standby for further announcements.
পার্থর মনে তুমুল আলোড়ন, তার ওপর এই মেসেজ দেখে অসহায় ভাবে লিন্ডার দিকে চাইল। লিন্ডা ওকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিল। বলল, চলেই যাও এয়ারপোরটে, সামান্য কিছু গোলমাল, যেতে যেতে ঠিক হয়ে যাবে।
এয়ারপোরটে ঢুকেই পার্থ চমকে গেল ভীড় দেখে। এত মানুষ এই এয়ারপোরটে? ঠিক ছোটবেলায় দেখা শিয়ালদা স্টেশনের মত অসংখ্য প্যাসেঞ্জার গিজগিজ করছে, দাঁড়িয়ে আছে গাদা লাগেজ নিয়ে। চেক ইন কাউন্টারে উপচে পড়া ভীড়, কাউন্টারের মেয়েটার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া লাগিয়েছে একজন ইটালিয়ান, মেয়েটা অসহায় ভাবে ভিডিও মনিটারের দিকে আঙ্গুল দেখাচ্ছে আর বলছে স্ক্রীন অফ ডেথ স্ক্রীন অফ ডেথ।
পার্থ তাকিয়ে দেখল অপারেটরদের চেকইন করার সব কটা টারমিনালের রঙ আকাশের মত নীল, আরে সবগুলোতেই একটা দুঃখের ইমোজি । গোটা এয়ারপোরটের সবার মুখের ওপর যেন আঁকা ব্লু স্ক্রীন অফ ডেথ, মৃত্যুর নীল যবনিকা।
এক কোণে মাটিতেই ধপ করে বসে লিন্ডাকে খবর দিল। তারপর মাকে ফোন করল। মার বদলে এক পুরুষ গলা, বললেন, আমি সর্বেশ ধর বলছি, তোমাদের পাশের ফ্ল্যাট থেকে, আশুতোষদা এখন আইসিইউতে আছেন, লাইট ভেন্টিলেশানে, অব্জারভেশানে আছেন।
পার্থের গলাটা একটু কেঁপে গেল, ‘ঠিক হয়ে যাবেন? কি বলছে ওরা?
-কিছুই বলছে না, সেরকম কিছু হলে খবর দেবে। তুমি আসছ?
-হ্যাঁ বেরিয়ে পড়েছি, কিন্তু কি সব গোলমাল হয়েছে প্লেনের বুঝতে পারছি না দেরী হবে হয়ত। আপনি একটু মাকে দেখবেন।
ফক্সনিউজ খুলে দেখতে থাকল ফোনে। এটাও না আবার বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে বড় বড় করে লেখা বিশ্বজোড়া উইন্ডোস টারমিনাল ডাউন, নেটে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। টেররিসট আক্রমণ না রাশিয়া বা চীনের সাইবার এটাক তদন্ত চলছে। অনেক উত্তেজিত মানুষ প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে। কারো অপারেশন কিন্তু হাসপাতাল তার মেডিকাল ডকুমেন্ট ডাউনলোড করতে পারছে না, কারো মা ভেন্টিলেটরে, তার প্রেস্ক্রিপশান ডাউনলোড করা যাচ্ছে না।
পার্থ কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। এত আধুনিক ইন্টারনেট, ক্লাউড, এআইএর যুগে এমন গোলমাল কি করে হতে পারে? ইন্ডিয়া হলে নয় বোঝা যেত। তা বলে ইউএসেতে? মাথা কটকট করছে, পার্থ স্টারবাক্সের দিকে এগোলো একটা এসপ্রেসোর জন্য। দোকানের সামনে বিরাট জটলা, সবাই কফি চাইছে, কিন্তু সব কাউন্টার বন্ধ, সিস্টেম অন হচ্ছে না, সব জায়গায় শুধু মৃত্যুর নীল যবনিকা আর দুঃখের ইমোজি।
এক্সট্রা স্ট্রং টাইলেনল আর একটু জল খেয়ে পার্থ আবার লিন্ডাকে ফোন করে। ফোনে অনেক পরে আওয়াজ শোনা যায় লিন্ডার। ভীষণ উত্তেজনা ও ভয় তার গলায়। কিছু বলার আগে লিন্ডাই বলে ওঠে,
-সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হতে যাচ্ছিল, খুব জোর বেঁচে গেছি। আভেন থেকে বার করার সময় হাত থেকে ট্রেটা কার্পেটে পড়ে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। তাড়াতাড়ি ৯১১ ডায়াল করতে গেলাম কিন্তু কেবল মেসেজ এলো ‘অল নেটওয়ার্কস আর ডাউন, প্লীজ ওয়েট’ কোনরকম করে ফ্রীজের ঠান্ডা জলের বোতল ঢেলে আগুন নিভিয়েছি, কি হয়েছে জানো?
৯১১ বন্ধ, আজ কি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? এলিয়েনরা ছাড়া কারা এরকম করতে পারে, আমাদের সব নেটওয়ার্ক ক্লাউড ভীষন ভাবে সিকিউরিটি দিয়ে মোড়া, কি করে এমন হতে পারে? লিন্ডাকে শান্ত হতে বলে, নিজের অবস্থাটা জানায়। ‘লিন্ডা আই লাভ ইউ, টেক কেয়ার।‘ বলে ফোন ছেড়ে দেয়।
ক্লাউড থেকে অজানা মেঘনাদের নাম জানা যায়। জানা যায় এটা কোন এটাক ফ্যাটাক নয়, প্রোগ্রাম লেখার ভুল, সেই ভুল ঢুকে গেছে সব কম্পিউটারে। সব কটাকে একটা একটা করে চালু করতে হবে ম্যানুয়ালি, অনেক দিন লাগবে সব ঠিক হতে। পার্থর অসহায় লাগে। ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে গেছে, পরাজিত সৈনিকের মত বাড়ী ফেরার ট্যাক্সি ধরে এয়ারপোর্টের বাইরে থেকে, শর্ত ক্যাশ পে করতে হবে, কারণ অনেক ক্রেডিটকার্ড আর কাজ করছে না।
বাড়ী ফিরে পার্থ বুক শক্ত করে নিয়ে ফোন করল দেশে। আবার সর্বেশবাবু ধরলেন। খারাপ খবরের আশঙ্কায় পার্থর বুক গুড়গুড় করছে।
-আজ সকালে উনি নরমাল ওয়ারডে এসেছেন, ডক্টর মৈত্র বলেছেন এবারের মত বিপদ কেটে গেছে, দুএক দিনের মধ্যেই বাড়ী চলে যাবেন।
-হাসপাতালে কোন সমস্যা হয়নি ইন্টারনেটের জন্য?
-তা কেন হবে? ও আপনি সাইবার এটাকের কথা বলছেন? না এখানে সব লোকাল ডাটা রাখেন এনারা, কোন অসুবিধে হয় নি। তুমি ভেব না।
ঘরের কার্পেট আদ্ধেক পোড়া, অর্ধেক ভিজে, লিন্ডাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুমু খেল পার্থ।
টিভিতে বলছে ক্রাউডস্ট্রাইক ঠিক হতে আরো এক মাস লাগতে পারে। কিন্তু এখন আর ওর মনে ক্লাউড নেই, নীল যবনিকায় খুশির অদৃশ্য ইমোজি।
1 Comments
যারা গেছে তাদের ফিরতেই হবে
ReplyDelete