জ্বলদর্চি

বাবার চিঠি ২/ইতি তোমার স্নেহের বেলা/অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবার চিঠি ২

ইতি তোমার স্নেহের বেলা

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

ডাকযোগে চিঠি পাওয়ার আনন্দ গত শতাব্দীতেও ছিল অত্যন্ত আনন্দের। প্রতীক্ষা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান শিক্ষা যা বর্তমান সময়ে আমরা হারিয়েছি। দূরে থাকা প্রিয়জনের সাথে সংযোগ স্থাপন ও রক্ষায় চিঠি ছিল অপরিহার্য আবার নিকটজনের কাছে গোপন কথা বলার একটা উপায়। চিঠি বহন করত প্রাণের কথা, মনের ব্যাথা, আনন্দগাথা। চিঠি তাই কখনো হয়ে উঠেছে কাব্য, সাহিত্য অথবা ছবি। কর্মব্যস্ততায় দূরে অবস্থানকালে পিতারা সন্তানদের অভাব যেমন বোধ করত তেমনই সন্তানেরা পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হত। সেসময় চিঠি হয়ে উঠত যোগাযোগের বাহন। এরকমই কিছু চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে যার আদুরেনাম বেল্‌। মাধুরীলতা তখন বিবাহিত এবং রীতিমত সংসারী। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন মেয়ে অসুস্থ হবার পর। মাত্র পাঁচটা চিঠির হদিস পাওয়া গেছে। এই আলোচনায় মাধুরীলতার লেখা চিঠির কথাও থাকবে।

দশ বছরের ভবতারিণী, পরিবর্ত নাম মৃণালিনীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের তিন বছরের মাথায় ১৮৮৬ সালে ২৫ অক্টোবর তাঁদের প্রথম সন্তান বেলা জন্মায়। ঠিক যেন মোমের পুতুল, যেমন রঙ তেমন অপরূপ সুন্দর চেহারা। জন্ম থেকেই বেলা তার বাবার স্নেহ, যত্ন ও আদর পেয়ে এসেছে। এ নিয়ে ভাইবোনেদের মধ্যে কম রসিকতা হয় নি। লেখালেখি জীবনে অনেকটা সময় তখন থেকেই ব্যয় করলেও স্নেহময়ী কন্যার পরিচর্যা নিজে হাতে করতে পছন্দ করতেন বিশেষ করে যখন সপরিবারে বেড়াতে যেতেন। আবার যখন পরিবার ছেড়ে বিদেশ গেছেন তখন মেয়ের চিন্তায় কাতর হন তিনি, স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এক পিতৃহৃদয়ের ব্যকুলতার প্রকাশ দেখা যায়। ‘কাল রাত্তিরে বেলিটাকে স্বপ্নে দেখেছিলুম – সে যেন ষ্টিমারে এসেচে – তাকে এমনি চমৎকার ভাল দেখাচ্ছে সে আর কি বলব।’ বেলা তখন প্রায় চার বছরের, নতুন নাম হয়েছে মাধুরীলতা। মাধুরীলতার ভাই রথীন্দ্রনাথ তখন দু বছরের। পুত্র সন্তান হওয়া সত্ত্বেও বেলার প্রতি স্নেহ এতটুকুও কমেনি। পূর্ববঙ্গের কালিগ্রামে জমিদারীর কাজ দেখতে গেলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চার বছরের কন্যা বেলার চিঠি পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে স্ত্রীকে লেখেন, ‘আমার মিষ্টি বেলুরাণুর চিঠি পেয়ে তখনি বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমার জন্যে তার আবার মন কেমন করে – তার ত ঐ একটুখানি মন, তার আবার কি হবে?’

শৈশব থেকেই যেমন লেখাপড়ায় মতি, তেমনই প্রখর বুদ্ধি আর সেই সাথে স্নেহশীল স্বভাব ও দয়ার্দ্র হৃদয় মাধুরীলতার। বড় নরম তার মন। মানুষের প্রতি অকারণ নিষ্ঠুরতা তাকে পীড়া দেয় সেই ছোট বয়সেই আবার সামান্য পোকামাকড়ের প্রতিও অকৃত্রিম করুণা যা রবীন্দ্রনাথও লক্ষ্য করেন এবং ভাবেন তাঁর ছোট বয়সে তিনিও অমনি ছিলেন।

শুধু স্নেহই নয়, সুশিক্ষিত করে তোলার আয়োজনও করেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা গৃহশিক্ষক রেখে এবং বেলিকে নিজে পৃথক করে পড়াতেন। ইংরেজি পড়ানোর ব্যাপারে ভগিনী নিবেদিতার পরামর্শ নিয়েছেন, তিনজন ইংরেজ মহিলা ও একজন সাহেব নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই ‘চালচুলোহীন সাহেব লরেন্স’কে নিয়ে মাধুরীলতার বেশ কিছু উপভোগ্য চিঠি আছে। বেলার যখন আট বছর বয়স তখন থেকেই তার মধ্যে কল্পনাশক্তি ও সৌন্দর্যবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে কলম ধরেন এবং যুক্তাক্ষরহীন সুদীর্ঘ কবিতা “নদী” রচনা করেন। তার আগে বেলার ছ বছর বয়সে তিনি মিনি চরিত্র নির্মান করেন “কাবুলিওয়ালা” ছোটগল্পে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘মিনি আমার বড়ো মেয়ের আদর্শে রচিত।’ শিলাইদহে থাকাকালীন সন্ধ্যেবেলা মার্ক টোয়েনের হাস্যরস পড়ে শোনাতেন মেয়ে ও তার মাকে। শুধু পড়াশোনাই নয়, মেয়েকে গান শেখাবার ব্যবস্থাও করেছিলেন, ‘দিশী ও ইংরেজি সংগীতে’ ওস্তাদ করে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এছাড়াও কার্যকরী বা কর্মভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থাও করেছিলেন, যার মধ্যে রোগশুশ্রূষার জন্য নার্সিং এবং স্যানিটেশন বিষয়ক বইও ছিল। দেখা যাচ্ছে একজন পিতা সুপরিকল্পিতভাবে আস্তে আস্তে নিজের মেয়েকে সংসার জীবনের জন্যে উপযোগী করে তুলছেন। সামাজিক প্রথার বাইরে না গিয়ে প্রচলিত বহমান সমাজস্রোতে আদরের মেয়েকে ঠেলে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ।

এদিকে চার বছর বয়স থেকেই বেলা বাড়ির বাইরে থাকা তার আদরের প্রিয় বাবাকে চিঠিতে বাড়ির সব কথা জানাচ্ছে আর সেই সাথে রয়েছে বয়সোপযোগী ভাবাবেগ। বাবাকে লেখা মাধুরীলতার প্রথম ক’ বছরের চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়নি তবে ৭/৮ বছর বয়স থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত লেখা প্রায় সব চিঠিই প্রকাশিত হয়েছে। সেই চিঠিগুলোর থেকে কিছু অংশবিশেষ উল্লেখ করা প্রয়োজন মাধুরীলতাকে বোঝার জন্য। আসলে মাধুরীলতার যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষা থাকলেও চিরায়ত সাংসারিক জীবনের যাঁতাকলে ঢুকে গিয়ে সাংসারিক কূটকাচালির সাথে জড়িয়ে গিয়ে সে সুযোগ পায় নি নিজের দক্ষতা প্রমাণ করতে। মনের ক্ষয় দেহে বাসা বাঁধে, আস্তে আস্তে সে মৃত্যুর দিকে করুণ পথে এগিয়ে যায়। এই সময়ে আমরা পাই বাবা রবীন্দ্রনাথের কিছু চিঠি তাঁর স্নেহের ‘বেল্‌’কে লেখা। কিন্তু সেই চিঠিতে যাবার আগে মাধুরীলতাকে আর একটু চিনে নেব তাঁর লেখা চিঠি থেকে, অবশ্যই বাবাকে। 

দশ বছর বয়সেই মাধুরীলতার ভাবজগত বাঁক নিয়েছে বাবার পথে। রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন, ‘আমার মাঝিদের গান শুনিতে বড় ইচ্ছা করে। এবং বোটের ছাতে উঠিয়া নদী স্টীমার এবং বোট যাচ্ছে দেখিতে বড় ইচ্ছা করে। আজ এক গরুর বাছুরকে কাগে ঠোকরাচ্ছে, এবং দরয়ান, মালী, শোইচ সবাই আছে কেউ কাগ তাড়াইতেছে না, তাহার পর আমি মালিকে বলিলাম উহাকে লইয়া যাইতে।’ বাবার সাথে চিঠিতে রসিকতাও করতেন। শিলাইদা থেকে কলকাতায় বাবাকে লিখছেন, ‘আজ তোমার চিঠি পেয়ে খুসি হলুম। তুমি যে “departure postpone” করেছ শুনে Mr. Lawrence খুব হেসেছেন। তিনি বল্লেন, “Mr. Tagore always he is coming, but he never comes; that’s his way, I know that Miss”। বেলার আর ভাল লাগে না শিলাইদহে থাকতে। অভিমানের সুরে লেখেন, ‘তোমার একলা মনে হয় না কেননা তুমি ঢের বড়২ বিষয় ভাব্‌তে, আলোচনা কর্‌তে, সেগুলোকে নিয়ে একরকম বেশ কাটাও। আমরা সামান্য মানুষ আমাদের একটু গল্প গুজব মানুষজন নিয়ে থাকতে এক এক সময় একটু একটু ইচ্ছে করে। আর যদি তুমি এখানে এসে আর নড়্‌তে না চাও তবে তুমি যে যে মহৎ বিষয় নিয়ে থাকো তাই সব আমাদের একটু একটু দাও।’ প্রতিটা চিঠির শুরুতে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন এবং শেষে ‘ইতি বেলা’ বা ‘ইতি তোমার বেলা’ অথবা ‘ইতি তোমার স্নেহের বেলা’। এক একেকটা চিঠিতে সারাদিনের অনেক খুঁটিনাটি কথা থাকে, যেন কাজ সেরে বাবা ঘরে এসেছেন আর মেয়ে তাঁকে সামনে বসিয়ে গল্প করছেন। যেমন, ‘নীদ্দা (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র নীতিন্দ্রনাথ) সারাদিন “মাঝে ২ তব দেখা পাই” গাচ্ছেন আর বাজাচ্ছেন। আমি কিন্তু এবার ওঁর গান শুনে হাসিনি। সঙ্গীত সম্বন্ধে যে যে দেন মন দিয়ে শুনি। নীদ্দাকে ইলিস্‌ মাছ খাইয়ে ঠাণ্ডা করে রেখেছি। আমরা মার কাছে “গ্রাবু” খেল্‌তে শিখেছি। ... এবার তুমি যখন আস্‌বে তখন তোমার সাথে খেল্‌বো।’

বেলার বয়স ১৪ হলে বাবার দায়িত্ব পালনে রবীন্দ্রনাথ উঠেপড়ে লাগলেন সুপাত্রের খোঁজে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাকে সংসার জীবনে প্রতিষ্ঠিত করাতে হবে। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎকুমারের সাথে মাধুরীলতার বিয়ে হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ এমন গুণবান, মেধাবী, ঋজু স্বভাব, বিনয়ী অথচ দৃঢ় চরিত্রের জামাই পেয়ে খুশি। বিয়ের পর তিনি নিজে মেয়ে জামাইকে নিয়ে জামাইয়ের কর্মস্থল মজঃফরপুরে পৌঁছে দিয়ে আসেন। এত খুশির পরেও পিতৃহৃদয় কন্যাবিচ্ছেদে আচ্ছন্ন, বেলার শৈশবস্মৃতিতে বিভোর।

মেয়ে কেমন স্বামীর ঘর করবে সেই নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে চিন্তাগ্রস্ত তা বুঝে বেলা একটা চিঠিতে লেখেন, ‘তুমি আমাকে যা যা উপদেশ দিয়েছ আমি তা প্রাণপণে পালন কর্ত্তে চেষ্টা করব।’ এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেয়ে স্বামীর ঘর করতে যাওয়ার আগে সেই যুগে বাবা-মায়েরা যে যে উপদেশ দিতেন সংসার সুখী করার জন্য, স্বামীর চেয়ে নিজেকে খাটো করে রাখার এবং সংসারের ভালোমন্দের সব দায় স্ত্রীর সেসব কথাই তিনিও বলেছেন। সময়ের আগে তিনি যেতে পারেননি অন্তত তাঁর নিজের সন্তানের ক্ষেত্রে।          

আইন ব্যবসায়ে জামাইয়ের উন্নতি দেখে তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে শরৎকুমারকে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠান। ১৯০৯ সালে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে কোলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। ইতিমধ্যে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একের পর এক মৃত্যুর আঘাতে রবীন্দ্রনাথ জর্জরিত। বাবা দেবেন্দ্রনাথ, স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, মেজ মেয়ে রেণু, ছোট ছেলে শমী এবং মেজ জামাই সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি সকল আত্মজনকে কাছে রেখে থাকতে চেয়েছিলেন। সেই সূত্রেই বেলা আর জামাইকে তাঁর কাছে এনে রাখেন। কিন্তু তিন বছর পর শরৎকুমার বেলাকে নিয়ে অন্য গৃহে বাসা বাঁধেন এবং নিজে শ্বশুরবাড়ির সাথে আর কোনও সম্পর্ক রাখেন নি। এর কয়েক বছরের মধ্যেই বেলা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে বেলা মারা যান। শেষের দিকে বেলাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পাঁচটা চিঠি পাওয়া যায় যা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
🍂
ad

বড়মেয়ে মাধুরীলতাকে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন মেয়ে অসুস্থ হবার পর। মাত্র পাঁচটা চিঠির হদিস পাওয়া গেছে। কিন্তু বেলার উল্লেখ প্রায়শই তাঁর অন্যদের লেখা চিঠিতে দেখা যেত। বরং বেলার লেখা বেশ কিছু চিঠির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। বিশেষ করে একটা চিঠির কথা স্মরণ করাব যেখানে বেলা বলছেন যে তিনি তাঁর বাবার সকল আদেশ মেনেই স্বামীর ঘরসংসার করছেন। এই প্রসঙ্গে মজঃফরপুরে বেলার প্রতিবেশী অনুরূপা দেবীর স্মৃতিচারণা পড়া যাক, ‘বাংলার সতীদের যে আদর্শ আজও বিশ্ববন্দিত হইয়া আছে, এই বাঙালী মেয়েটিও সেই সতীলোকের যাত্রিণী। পতিভক্তির ও তদাত্মতার সে ছিল একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর সকল বিষয়েই তার তেজস্বিতার পরিচয় পাইয়াছি, কিন্তু এখানে সে ছিল কিশোরীর মতই বিনম্র ও সঙ্কোচ-কুণ্ঠিতা নববধূ।’ 

বেলাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের যে পাঁচখানা চিঠি পাওয়া গেছে তার প্রথম চিঠি লেখা হয়েছে শিলাইদহ থেকে চৈত্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দে (মার্চ-এপ্রিল ১৯১১)। চিঠির শুরুতেই তাঁর শরীর খারাপের কথা উল্লেখ করে সেটা সারাতে পদ্মার কোলে আশ্রয় নেওয়ার কথা লিখেছেন। “যেমনি এসেছি অমনি আমার সেই ভয়ঙ্কর ক্লান্তি এক মুহূর্তে কোথায় দূর হয়ে গেছে। পদ্মা আমাকে যেমন করে শুশ্রুষা করতে জানে এমন আর কেউ না।” এর পরেই মেয়ের শরীর সুস্থতার খোঁজ খবর নিতে দেখি। বাপের বাড়িতে এসে অনিয়ম করে শরীর খারাপ হয়েছে কিনা জানতে চেয়েছেন কারণ বাবার মন উতলা হয়ে আছে বেলার শারীরিক অসুস্থতার জন্যে। বিকেলের দিকে হাত পা জ্বালা জ্বালা করে জ্বর জ্বর বোধ হয়। তার জন্যে এক পুরিয়া সালফার ২০০ হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ পাঠিয়েছেন। এর পরে লিখছেন, “তুই যদি একবার কিছুদিনের জন্যে বোটে এসে থাক্‌তে পারতিস্‌ তাহলে তোর বিশেষ উপকার হত – আর আমিও কত খুসি হতুম সে বল্‌তে পারি নে। কিন্তু তোর বোধহয় কিছুতেই নড়া হয়ে উঠ্‌বে না। একবার পাঁচ ছ দিনের জন্যেও যদি আস্‌তে পারিস তাহলে নিশ্চই তোর শরীর ভাল হবে।”   

বেলার অসুস্থতা তাঁকে পীড়িত করলেও তিনি সেবিষয় বিশেষ উল্লেখ না করে তখন তাঁর বিদেশ ভ্রমণ নিয়েই বেশি কথা লিখেছেন। এর পরের দুটো চিঠি প্যারিস ও লন্ডন থেকে লিখছেন জুন ১৯১২, ফেব্রুয়ারি ১৯১৩ কেমব্রিজ থেকে লেখা চিঠিতে প্রথমেই উল্লেখ করছেন, “বেল্‌, তোর শরীর তেমন ভাল নেই শুনে আমার মন বড় উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তোকে চিঠি লিখে ত উত্তর পাই নে আর কারো কাছ থেকেও খবর পাবার সুবিধা হয় না। মাঝেমাঝে এক একটা পোস্টকার্ডে তোদের খবর দিস্‌।” এই উদ্বিগ্ন প্রকাশের পরে আমেরিকার খবর আর শেষে অন্যকথার সূত্র ধরে বেলার ‘সেবকদের’ খবর নিয়েছেন। পরের চিঠিতেও আমেরিকার খবর।       

কন্যা সন্তানের প্রতি যথাযথ সময় দিতে না পারার বেদনা কর্মসূত্রে দূরে থাকা পিতাকে কুড়ে কুড়ে খায়। সে উপশমের একটা উপায় খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক, সাহিত্যিক ও কবি পিতা। আপন কর্মক্ষেত্র তাঁকে সংসার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, সন্তানেরা নিজেদের পিতার থেকে যতটা সময় কাছে পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আবার একজন সুশিক্ষিত পিতা চেষ্টা করেন তাঁর সন্তান যেন স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এরকম না মনে করে। তাই আমরা দেখতে পাই কর্মসূত্রে বাড়ির বাইরে থাকা অন্য বাবাদের মত রবীন্দ্রনাথ নিজ পদ্ধতিতে সেই স্নেহ দিয়ে লালিত করছেন আপন সন্তানদের। এই ভিন্ন পদ্ধতি নির্ভর করছে শিক্ষা, জ্ঞান, পরিবার, সমাজ, বহির্মুখীতা ও সর্বোপরি পরিবেশের ওপর। তাই একজন তার সন্তানদের সাংসারিক শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন আবার অন্যজন সন্তানকে পৃথিবীর অন্য আরও অনেক কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আপাত বিপরীতধর্মী মনে হলেও এটা মানতেই হবে পৃথিবীও একটা সংসার, অতি বৃহৎ তার পরিমাপ।

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousMay 09, 2025

    খুব ভালো লাগলো । অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।

    ReplyDelete