জ্বলদর্চি

হরপ্রসাদ সাহু (কবি, প্রকাশক, গ্রন্থকার, মহিষাদল) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৬
হরপ্রসাদ সাহু (কবি, প্রকাশক, গ্রন্থকার, মহিষাদল) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি কবি। অসংখ্য কবিতার জন্ম হয়েছে তাঁর কলমের আঁচড়ে। এই বাংলার কবিমহলে হরপ্রসাদ সাহু এক অতি পরিচিত নাম। কিন্তু মূলতঃ তিনি প্রকাশক এবং লেখক। 'বাকপ্রতিমা'র অন্তরালে যে মানুষটিকে খুঁজে পাই, তা তিনিই। প্রকাশক মানেই অসংখ্য বই প্রকাশ করবেন -- এতে অন্যথা কোথায়? কিন্তু হরপ্রসাদ সাহু যেন ভিন্ন ধারার প্রকাশক। সেই ভিন্নতর সাহিত্য সত্বার খোঁজে লালিত এবং পালিত হরপ্রসাদ সাহুর জীবন বৈচিত্র্য। 

একাধারে কবি, অন্যদিকে আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতিপ্রেমী এক আদ্যোপান্ত নিখাদ মানুষ। এই আপাত সত্যটি তেমনভাবে প্রচারিত হয়নি হয়তো। অথচ 'বাকপ্রতিমা'র ছায়াতলে তিনি বারবার প্রমাণ দিয়েছেন তাঁর ইতিহাসপ্রেমী মানসিকতার। শুধু নিজে লিখতেননা, অন্যকে লেখার উৎসাহদানে তিনি ছিলেন অগ্রগন্য। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অবাধ পদচারণা এই লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসের জগতে তুলে ধরেছেন মেদিনীপুরের ইতিহাস। বর্ণনা করেছেন লুকিয়ে থাকা সংস্কৃতি। আর গর্বিত করেছেন মেদিনীপুরের মাটি। 

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল থানার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে ১৯৫৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মা অমলা সাহু এবং বাবা বিভূতিভূষণ সাহু। অতি সাধারণ পরিবারে তাঁর বড় হওয়া। এম.এ, বি.এসসি, বিএড, ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্রে স্পেশাল বি.এ. পাশ করেও সরকারি চাকরি জোটেনি। এতে অবশ্য থেমে থাকেনি তাঁর সাহিত্যচর্চা। সেইসাথে আইটিআই থেকে মোটর মেকানিক্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছেন। সংসারের হাল ধরেছেন একহাতে, অন্য হাতে কলম ধরেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। থমকে যাননি তিনি। নানা সামাজিক উত্থান পতনকে সঙ্গী করে তাঁর অবাধ পথচলা। আপোষহীনভাবে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে আর অবিচল থেকেছেন নিজের কর্মতৎপরতার প্রতি। 

তিনি বর্তমানে দিল্লির আইসিএসসিই বোর্ডের অধীন একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সেখানেই খুঁজে পেয়েছেন জীবনের রসদ। কবিতা তাঁর মননে। কবিতা তাঁর হৃদয়ে। এই কবিতা দিয়েই তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু। তাই সর্বাগ্রে রাখেন নিজের কবিসত্তাকে। কবিতার প্রতি ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখেন সবসময়। তাঁর পরিচালিত 'বাকপ্রতিমা' নামে একটি অব্যবসায়িক গ্রন্থ প্রকাশনা থেকে তিনশোর বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এযাবৎ। এই 'বাকপ্রতিমা'র ব্যানারে প্রকাশ করেছেন লক্ষ্মীকান্ত পালের 'মল্লভূম সংস্কৃতির একাল ও সেকাল', 'কোতুলপুর : ইতিহাস ও সংস্কৃতি', সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্যের 'পরগনা কাশীজোড়া', 'পাঁশকুড়া পরিক্রমা', 'ষোড়শ জনপদকথা', 'পাঁশকুড়ার গৌরব', পাঁশকুড়ার জনপদ', হরিসাধন গোস্বামীর 'স্থাননামের অন্তরালে', ড. প্রবালকান্তি হাজরার 'বিতত মনন', সংকর্ষন মাইতির 'পুরী মাহেশ ও মহিষাদলের রথ', অধ্যাপক হরিপদ মাইতির সম্পাদিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামী নীলমণি হাজরার ডায়েরি', সুশীল কুমার সামন্ত সংকলিত 'কথায় কথায় বলা কথা' ইত্যাদি। এইচ ভি বেইলির 'মেমোরাণ্ডা অব মিডনাপুর ১৮৫২' বইটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন প্রয়াত নগেন্দ্রনাথ রায়। ১৯৯৮ সালে এই বইটির প্রকাশনাও করেছিল 'বাকপ্রতিমা'। নাম ছিল 'উনিশ শতকের মেদিনীপুর'। এই ধরনের বই সাধারণত প্রকাশকরা প্রকাশ করতে চায়না। কিন্তু হরপ্রসাদ সাহু হলেন অন্য ধারার প্রকাশক। তিনি যথার্থ ইতিহাস পটিয়সী মানুষ। তাই লেখককূল ছুটে যায় তাঁর কাছে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত মহিষাদলের বুকে বসবাস করে কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যে অন্তহীন প্রকাশনার কাজ তিনি করে চলেছেন সুচারুভাবে, তা অন্যতম দৃষ্টান্ত বৈকি। 

হরপ্রসাদ সাহুর প্রথম কবিতার বই 'আঁধি ও আনন'। এছাড়াও আরও অসংখ্য কবিতার বই লিখেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৬ টি। কবিমনের নিগূঢ় নির্যাস এইসব বইয়ের পাতায় পাতায়। আঁধি ও আনন (১৯৯৩), পরিযায়ী কথা (১৯৯২), আড়ালে দুঃখিত হই (২০০১), তবুও তোমার কাছে আসি (২০০২), মেঘে মেঘে বেলা যায় (২০০৪), পথ ভুলে যাই পথে (২০১০), ঐকাহিক কবিতা (২০১৩), তোমার মন নাই কুসুম (২০১৩), চোখের বাহিরে (২০১৪), অরব কান্নার পদাবলি (২০১৫), মৃত্যুলিপি (২০১৭), এবং একটি গাধা (২০১৭), রূপ লাগি আঁখি ঝুরে (২০১৯), বিষফোঁড়া ও অন্যান্য কবিতা (২০২০), আমার আমিকে বলি (২০২১) এবং নিপাতিত ধ্বনিরেখা (২০২১)। কবিমহলে তাঁর লেখা প্রতিটি কবিতা তাঁর মননশীল ভাবনা আর সাহিত্যবোধের পরিচায়ক রূপে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও দুটি গদ্যগ্রন্থ 'শিশুচন্দ্রিকা' (২০২০) ও 'লৌকিক ঈশ্বর' (২০২০) লিখেছেন। 

ব্যক্তিগত নিবন্ধের বই হিসেবে লিখেছেন 'আমার কথা আমাদের কথা' (২০১৮) এবং 'ব্যক্তিগত ১৬' (২০১৮)। মোট ১৭ টি সম্পাদিত গ্রন্থের প্রকাশ হয়েছে তাঁর সুদক্ষ হাতে। এছাড়াও মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকার তথ্যমূলক আঞ্চলিক ইতিহাসগ্রন্থ লিখেছেন পাঁচটি। প্রতিটি বই নিবিড় তথ্যানুসন্ধান এবং নিরলস ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। সেইসব আঞ্চলিক ইতিহাসের বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'আমাদের মহিষাদল' (২০০৫), 'আমাদের হলদিয়া' (২০০৮), 'আমাদের পাঁশকুড়া' (২০১০), 'আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর' (২০১৪), 'আমাদের নন্দকুমার' (২০১৯), 'একনজরে মহিষাদল' (২০২০), 'আমাদের নন্দীগ্রাম' (২০২৫) ইত্যাদি। হরপ্রসাদ সাহুর 'আমাদের পূর্ব মেদিনীপুর' গ্রন্থটি বিভিন্ন সংবাদপত্র ও গুণীজনদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। ১৪১১ তে প্রকাশিত 'আমাদের মহিষাদলে'র ভূমিকা লিখেছেন ড. প্রনব রায়। একজন সত্যিকারের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হরপ্রসাদ সাহু এখানেই অকপটে লিখেছেন, 'যে কোনও ব্যক্তির তাঁর দেশের ইতিহাস তথা পৃথিবীর ইতিহাস জানার আগে, তিনি যেখানে বসবাস করেন, সেই স্থানের ইতিহাস জানা একান্ত দরকার। নতুবা তাঁর ইতিহাসজ্ঞান খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। এ যেন নিজস্ব শিকড় বা মাটি আড়ালে রেখে ডালপালা পাতা ফুল নিয়ে গবেষণা করার সমতুল'। এই লেখাটিই জানিয়ে দেয় লেখকের ইতিহাসপ্রেমী মানসিকতার পরিচয়। ড. প্রণব রায় লিখেছেন, 'তাঁর রচনাটি আদ্যোপান্ত পড়ে আমাদের ধারণা হয়েছে, গ্রন্থের কোনওখানেই তিনি স্বদেশীয় অকারণ ভাবানুভূতি বা জাত্যাভিমানকে প্রশ্রয় দেননি, বরং তাঁর অঞ্চলের আসল ইতিহাসকে উদ্ধার করে পাঠকের কাছে পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন'। 

সম্পাদনার কাজে হরপ্রসাদ সাহু হলেন জেলার মধ্যে অন্যতম এক ব্যক্তিত্ব। একজন সফল সম্পাদকের যা যা গুণ থাকা জরুরি, তা তাঁর মধ্যে রয়েছে। তাই তিনি একজন সফল সম্পাদক। হরপ্রসাদ সাহুর সম্পাদিত পত্রিকাগুলি হল 'সুরঞ্জনা' (১৯৮০ থেকে ১৯৯৫), 'চর্যাপদের হরিণী', 'লোককৃতি' (১৯৯৬ থেকে ২০১৭), 'লোককথা' (২০০৮ থেকে ২০১৭) এবং 'সাহিত্য সমাচার'। তাঁর সম্পাদিত এই 'লোককথা'তে (তৃতীয় সংখ্যা, ১৪১৫) তিনি লিখেছেন, 'গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা লোকপ্রবাদ, লোককথা, লোকাচার, লোকবিশ্বাস, লোকপ্রথা, লোকধর্ম, লোকভাষা, লোক উৎসব, অনুষ্ঠান, লোকক্রীড়া, লোকগান, লোকযান, লোকচিত্রকলা, লোকনৃত্য, প্রভৃতি সংগ্রহ করা, সংরক্ষিত করা এবং সেগুলোকে সার্বিক দৃষ্টি কোন থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে বাংলা ও বাঙালির তথা ভারতের প্রকৃত ইতিহাস রচনায় সহযোগিতা করাই লোকসংস্কৃতি চর্চার অন্যতম বিষয় হওয়া দরকার'। 'মহিষাদল স্মরণিকা'র সম্পাদনায় ছিলেন হরপ্রসাদ সাহু। তাঁর সম্পর্কে অধ্যাপক হরিপদ মাইতির বয়ান, 'এই স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের সিংহভাগ কৃতিত্ব হরপ্রসাদের। দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে যেভাবে নিরন্তর গবেষণার কাজ করে যাচ্ছেন হরপ্রসাদ, তা অনেকে জানেননা। লেখা সংকলন করা থেকে, প্রেস নির্বাচন করা, প্রত্যহ কলকাতায় ছুটাছুটি করা, প্রুফ দেখা -- সব করেছে হরপ্রসাদ'। কাজের প্রতি এহেন নিষ্ঠা এবং ডেডিকেশন -- সত্যিই বিরল। 

একক প্রয়াসে তিনি সম্পাদনা করেছেন 'মেদিনীপুরের নির্বাচিত কবিতা' (২০০৫), 'এবং কবিতা হলদিয়া' (২০১৮) এবং 'মহিষাদল ইতিবৃত্ত' (২০১৬)। তিনি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন 'শতবর্ষে সুশীল কুমার' (প্রধান সম্পাদক, ২০১০), 'পরানসখা বন্ধু হে আমার' (২০১২), 'মহাজীবনের আলো' (২০১৫), 'শতক শেষের বাংলা কবিতা' (২০০০), 'শ্রেষ্ঠ নাম কবিতা সংগ্রহ' (২০১০), 'পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হেরিটেজ তথ্যপঞ্জি' (২০১২), 'আমরা সবাই রাজা' (২০০৭-১০১৪) এবং 'নির্বাচিত লোককৃতি' (২০১৭)। শুধু তাই নয়, তাঁর সম্পাদনার সিলেবাসে রয়েছে অসংখ্য অভিধান গ্রন্থও। সেগুলির মধ্যে 'আসা যাওয়ার দিনগুলি' (২০০৩), 'বাংলা লেখকপঞ্জি' (২০০৩), 'ঠিকানা মেদিনীপুর' (২০০৯), 'মেদিনীপুর রচক অভিধান' (২০১৬), 'মহাজীবন পঞ্জিকা' (২০২০), 'অনাগরিক শব্দাবলি' (২০২১), 'মহিষাদলি চরিতাভিধান' (২০২১) উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, বইমেলা কমিটির উদ্যোগে প্রকাশিত বহু স্মরণিকা প্রকাশের ভার পড়ে তাঁরই কাঁধে। সেক্ষেত্রেও তাঁর অনবদ্য ভূমিকা ছিল নজরকাড়া। সযতনে ছাপার অক্ষরে তুলে দিয়েছেন সেসব স্মরণিকা। যা পরবর্তীতে গবেষকদের কাছে হয়ে উঠেছে অমূল্য সম্পদ। যেমন -- 'প্রাক্তনিকা' (২০০৭, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭), 'মহিষাদল স্মরণিকা' (২০০৬, ২০০৯), 'পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বইমেলা স্মরণিকা' (২০১৫), 'মহিষাদল বইমেলা স্মরণিকা' (২০১৬, ২০১৭, ২০১৮), 'গোপালপুর হাই স্কুল হীরকজয়ন্তী স্মরণিকা' (২০০৬) ইত্যাদি। 

তিনি তাঁর কাজের গুণে যেসব সম্মাননা পেয়েছেন সেগুলির মধ্যে উল্লেখ্যনীয় 'তাম্রলিপ্ত সম্মান' (২০২৫), 'সৃজন সম্মাননা' (২০০৪), 'মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন অ্যাকাডেমি সম্মান' (২০১০), 'খড়গপুর বইমেলা সাহিত্য সম্মান' (২০১৫), বালিভূমি সম্মান, ঋষি বঙ্কিম স্মারক সম্মান, মালীবুড়ো স্মারক সম্মান, কাঁথি বইমেলা স্মারক সম্মাননা ইত্যাদি। অপরিসীম ধৈর্য আর কাজের প্রতি প্রবল অনুরাগ তাঁকে করে তুলেছে মেদিনীপুরের যথার্থ মানুষ রতন। তাই এসব সম্মাননা প্রাপ্তি তাঁর কাজের প্রকৃত মাপকাঠি নয়। তিনি চান কাজ করে যেতে। তাঁর সিলেবাসে থমকে যাওয়ার কোনও পাঠ্যপুস্তক নেই। পুরস্কার, সম্মাননার আবর্তে নয়, তিনি থাকতে চান তাঁর কাজের মধ্যে। হরপ্রসাদ সাহু লোকসংস্কৃতির গহিন অরণ্যে বিচরণ করতে ভালোবাসেন। শুধু কবি নন তিনি। শুধু প্রকাশক নন তিনি। আসলে তিনি মেদিনীপুরের একজন ধুলোমাটি মাখা লোকগবেষক মানুষ রতন।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments