জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ২২/স্বপন কুমার দে

 চিত্র- শুভদীপ ঘোষ
এক মুঠো রোদ
পর্ব- ২২


স্বপন কুমার দে

আজ এই অফিসে সম্পূরকের শেষ দিন। জানুয়ারির শেষ অর্থাৎ একত্রিশ জানুয়ারি। সম্পূরক, তার কাজের সব দায়িত্ব বড়সাহেবকে বুঝিয়ে দিয়ে, আলমারির চাবি হ্যান্ড ওভার করে দিল। পরদিন থেকে এখানে সে আর আসবে না। এতদিনের পুরানো অফিস, পুরানো সহকর্মীরা আগামীকাল থেকে প্রাক্তন হয়ে যাবে। একটা অন্য ধরনের মনখারাপ তাকে তখন আচ্ছন্ন করছিল। এরপর অন্য অফিস, অন্য সহকর্মী। কত নতুন মুখ, নতুন অভিজ্ঞতা জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে। জীবনের এটাও একটা অভিমুখ। পয়লা ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আগামীকাল সে পুরুলিয়া শহরের অফিসে জয়েন করবে।

সহকর্মীরাও সহজে তাকে ছাড়ল না। সবাই মিলে একটা ফেয়ার ওয়েলের ব্যবস্থা করল। সম্পূরককে নিয়ে ভালো ভালো কথা বলা হল। অসীমবাবুও তাঁর ছোট্ট বক্তব্যে সহকর্মীর প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা ব্যক্ত করলেন। অনেক স্মৃতিচারণ করা হল বড়সাহেবের গলা ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠল। কেবল রূপসা একটা কথাও বলল না। সম্পূরকের ভাষণে সকলের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল।

অসীমবাবু আবারও একবার তাদের বিয়েতে আসার জন্য সম্পূরককে অনুরোধ করলেন কিন্তু অনেক লুকানো ব্যথা সম্পূরকের মনের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগল  যে আগুন বাইরে এলে হয়তো অনেক কিছুই পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারত, তা কেবল মনের মধ্যে গুমরে গুমরে নিজেকেই পোড়াতে থাকল।

একটা শূন্যতাবোধ গ্রাস করে সম্পূরককে। বড় একা লাগে। এ বোধের প্রকাশ নেই, কিন্তু তার অভিব্যক্তি নিষ্ঠুর আক্রোশে কেবলই নিজেকে পোড়াতে থাকে। নিজের চারপাশে বৃত্ত রচনা করে। তাই এ জ্বালা কাউকে বলা যায় না অথচ যন্ত্রণা কমে না। মন এখান থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। সে চাইছিল, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় এখান থেকে বিদায় নিতে। তবুও দেরি হল। সম্পূরকের সঙ্গে রূপসার কোনও কথা হয়নি, কেবল নীরব অভিমান তীব্র ধিক্কারে রূপসার ভাবী সম্পর্কের ওপর আঘাত করতে লাগল।

সেই সন্ধ্যায় সম্পূরকদের বাড়িতে চায়ের আড্ডাটা জমল না। সবাই আছে, চায়ের সঙ্গে পাঁপড় ভাজা, মুড়িমাখা সবই আছে অথচ আড্ডার মেজাজটাই নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবা বুঝতে পারলেন, বৌমা আজ চায়ে চিনি দিতেই ভুলে গেছে।
" বৌমা, গত মাসে আমি সুগার টেস্ট করিয়েছিলাম তো?"
" হ্যাঁ বাবা।"
" রিপোর্টে কি আমার ব্লাড সুগার বেশি দেখাচ্ছিল?"
" না তো।"
" ওহ্, তাহলে তোমার শাশুড়ি মা কি চিনির কৌটাতে চাবি দিয়েছে?"
এতক্ষণ পরে সুদেষ্ণা বুঝতে পারল। বুঝতে পেরেই লজ্জা পেয়ে গেল।
" না বাবা, তাড়াহুড়োতে আমিই চিনি দিতে ভুলে গেছি।"
🍂
" বুঝলি দালু", উদ্দালককে এই নামেই ডাকেন অমরেশবাবু, " চায়ে যেমন চিনি না দিলে ভালো লাগে না, ঠিক তেমনই সম্পর্কের মধ্যে চিনি না থাকলে জমে না। বাঁধনটা আলগা হয়ে যায়। এই যে তোদের মা আমাকে নিয়ে সারাদিন খিটখিট করতেই থাকে সেটা ওর আসল রূপ নয়, ভেতরে ভেতরে একটা মিষ্টি রসের পাক থাকে। আমি ঠিক সময়ে খাওয়া দাওয়া করছি কিনা, কোথাও কিছু অনিয়ম করছি কিনা, সময়ে ওষুধ খাচ্ছি কিনা-- এসব বিষয়ে বুড়ির তীক্ষ্ণ নজর আছে। দাম্পত্যের আসল মজা সেটাই।" হাতের পাঁপড় ভাজার বাকি অংশে কামড় দিলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। দালু অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে রইল। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, " কিন্তু বাবা, তুমি যাই বলো, মায়ের কাছে তুমি চিরদিনই হেরো বাঙালি। তর্কে কোনোদিন জিততে পারোনি। হেরেই চলেছো।"
" জিততে আমার বয়েই গেছে।" বলেই আবার চায়ের কাপে চুমুক দেন," বুঝলি দালু, বাবা হয়ে তোকে একটা টিপ দিচ্ছি। তুই আগে ভেবে দেখবি, জিতলে লাভ, না হারলে লাভ। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। তবে হ্যাঁ, ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলার সাহসটা থাকতে হবে, তা সে যত কঠোরই হোক, নইলে সংসারের ছন্দটাই নষ্ট হয়ে যাবে।"
" তোমার এইসব আজে বাজে কথা বলাটা বন্ধ হবে? কাল আমার ছেলেটা অতটা দূরে চলে যাবে, আর ওনার এখন হাসি ঠাট্টা করার বাতিক উঠেছে!" মণিদীপা হঠাৎই ধমকে ওঠেন অমরেশকে। অমরেশ চুপ হয়ে যান, মণিদীপার চোখে জল।
" কাল চলে যাবে সমু।সেখানে কোথায় থাকবে , কী খাবে তা নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই, আর ওদিকে...."
" তা তোমার একার ছেলে যখন, তুমিই সবটা দেখো, আমাকে আবার টানছ কেন বাপু? সমু কোয়ার্টার পেয়েছে বলে আমি জানি। তুমি বরং এক কাজ করো,কিছুদিন সমুর ওখানে থেকে যাও, তারপর নাহয় ভাবা যাবে। এদিকটা আমিই সামলাই।"
" এই প্রথম একটা কথা ঠিকঠাক বললে। আমি কিছুদিন সমুর কাছেই থাকি। আমি বরং এবার দুজনের ব্যাগ গুছিয়ে রাখি। তুমি হাসি ঠাট্টা চালিয়ে যাও। তোমার আর কি কোনো দায়িত্ব আছে?" রাগ দেখিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সমুর ঘরে গিয়ে দেখলেন, একটা বড় ট্রলি ব্যাগে জিনিসে ভর্তি। খুলে দেখলেন, তাতে সমুর চার জোড়া প্যান্ট জামা,ঘরে পরবার নতুন ট্রাউজার, টি শার্ট, তোয়ালা, এমনকি বিস্কুট, নাস্তা প্যাকেট, কিছু ফ্রুটস্ রাখা আছে। মণিদীপার চোখ গেল পাশের আর একটা নীল রঙের নতুন ব্যাগের উপর।
" সমু আরও একটা ব্যাগ কিনে এনেছে? দেখি তো আরও কী নিয়েছে?" বলেই ব্যাগ খুলে অবাক। তার নিজের পাঁচটা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, গামছা, সাবান ব্রাশ,টুথপেস্ট, কাপড় মেলার নাইলন দড়ি ইত্যাদি।

ওখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন ।এসে বললেন, " সত্যি আমার বড় বৌমার তুলনা নেই। আমাকে না জানিয়ে আগে থেকেই সব গুছিয়ে রেখেছে।"
সুদেষ্ণা অবাক হয়ে বলল," আমি আবার কী গুছিয়ে রাখলাম মা? মন্টিকে নিয়ে বেড়াতে গেছলাম। এই তো সবেমাত্র ফিরলাম।"
" তাহলে নিশ্চয়ই সমু গুছিয়ে রেখেছিল?"
না মা, তুমি তো জানো, তুমি ছাড়া ব্যাগ গোছানোর ক্ষমতাই আমার নেই।"
মণিদীপা এবার সোজাসুজি অমরেশের দিকে চেয়ে রইলেন। অমরেশ তখন মিটিমিটি করে হাসছেন।
" বুঝেছি, এই বুড়োর কান্ড! আমাকে না জানিয়ে আগে থেকেই সব প্ল্যান করে রেখেছে। কখন কখন সমুর ব্যাগ, আমার ব্যাগ, আমাদের খুঁটিনাটি জিনিসগুলো গুছিয়ে রেখেছে। আমার ব্যাগ ছিলনা বলে বাজার থেকে ব্যাগ কিনে এনেছে। এদিকে দেখছো এখন কেমন মিটিমিটি হাসছে। মিটমিটে শয়তান কোথাকার!" বলতে বলতেই তার ছোখে জল এসে গেল। স্বামীর ভালোবাসায় আপ্লুত মণিদীপার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠল, মণিদীপার অনন্দাশ্রু দু'গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তিনি আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন।
অমরেশবাবু একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন স্ত্রীর দিকে। ধরা পড়ে গিয়ে বললেন," বৌমা, আর এক চা নিয়ে এসো তো। এবার আর চিনি দিতে ভুলো না।"
শাশুড়ি মা বললেন," বৌমা, আজকে দিচ্ছো দাও, কিন্তু পরের দিন থেকে আর দ্বিতীয় বার চা করে দেবে না। তোমার ওপরেই তোমার শ্বশুরের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। একটুও অনিয়ম যাতে না করে সেটা দেখবে।"
বৌমা বলল, " ঠিক আছে মা,তাই হবে।"

Post a Comment

0 Comments