উদয়ের পথে
ত্রয়োবিংশতি ও শেষ পর্ব
মলয় সরকার
আমি যে সারা পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরি, তাতে লক্ষ্য করেছি, হৃদয়বৃত্তিতে সমস্ত মানুষ, জাতি এক সূত্রে গাঁথা। অনুভব করেছি তারা এক ভাবেই হাসে কাঁদে, আনন্দ করে, ভয় পায় , ভালবাসে ইত্যাদি।তখনই আমার কাছে তারা সবাই এক হয়ে যায়। আমি সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে তফাত খুঁজে পাই না, তা সে সব রকম প্রভেদ থাকা সত্বেও। কোথাও যেন বিশ্বমানবতাকে অনুভব করতে পারি।আমি তখন হারিয়ে যাই বিশ্বমানবের মধ্যে। গর্ব অনুভব করি যে, আমি ওদেরই একজন।
এবার বলি ,আমার জাপানে আসার মূল কারণ । আমি দেখেছি কবিগুরু তিনবার এখানে ভালভাবে এসেছেন।জাপানকে আত্মস্থ করেছেন।জাপানী মানুষ ,তাদের চরিত্রের উৎকর্ষতা,শিল্প,সাহিত্য,সংস্কৃতি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন যদিও প্রধানতঃ তিনবার ১৯১৬, ১৯২৪ ও ১৯২৯ এ। তবু জাপান ছুঁয়েছিলেন পাঁচবার বলেই ধরা হয়, কারণ ১৯১৬ ও ১৯২৯ এ ফেরার পথে নেমেছিলেন জাপানে। এখানকার আর্ট, শিল্প, কলার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন । শুধু তাই নয়, এখানকার বিজ্ঞান, গবেষণা, উন্নতি, শিল্প চর্চা ইত্যাদিতেও তিনি ছিলেন আসক্ত।এর তো নিশ্চয়ই কিছু কারণ ছিল।এদিকে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এখানে এসে জাপানী মেয়ের কাছে মন দিয়ে ফেললেন, এরও নিশ্চয় কিছু কারণ ছিল। আর নেতাজী যে এসেছিলেন, তার কারণ যদিও অন্য, তবু একটা কারণ তো ছিলই।
সেগুলো খুঁজতেই অনেকটা এখানে আসা।
আমরা যদি আরও পিছিয়ে যাই, দেখতে পাব, ভারতের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক আজকের নয় , কেউ কেউ বলেন খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক বা চতুর্থ শতকে ভারতের সঙ্গে জাপান বা পূর্ব এশিয়ার সাথে নৌবাণিজ্যের সম্পর্ক ছিল।
কিয়োটোর ট্রেনে স্ত্রী -কন্যা
আর ঐতিহাসিক যা তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, ঐ নারাতে ( যেখানে আমরা ঘুরে এলাম) সেখানে তোদাইজির মন্দিরে, যে বিশাল বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে, সেটির যখন চক্ষুদান পর্ব হয়, সেটি করেন ভারতীয় বৌদ্ধ সন্যাসী বোধিসেনা ৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে। অর্থাৎ ভারতের সাথে জাপানের সম্পর্ক আজকের নয়। এই বোধিসেনাই জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে গিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
আমাদের হিন্দু ধর্মের থেকেও সেখানে কিছু প্রভাব রয়ে গেছে, যদিও আজ জাপানে আসল হিন্দু ধর্ম খুব কমই চর্চা হয়। এখানে যে সাতজন প্রধান দেবতা তার মধ্যে চারজনই হিন্দু ধর্মের সঙ্গে জড়িত। যেমন, Benzaitensama (সরস্বতী), Bishamon (Vaiśravaṇa বা কুবের), Daikokuten (Mahākāla/শিব), এবং Kichijōten (লক্ষ্মী)।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, In my opinion, if all our rich and educated men once go and see Japan, their eyes will be opened.
জাপানে তরুণ প্রজন্ম রাস্তাঘাটে বেশিরভাগ সময় ই-বই নয়, ছাপা বই পড়ে
শুধু তাই নয়, বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি স্বামী বিবেকানন্দের এক আলাদা ভালবাসা ছিল, যার জন্য , অনেকেই জানেন, বেলুড় মঠ বা পরবর্তী কালের মন্দির গুলিতে বৌদ্ধ রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। আসলে আমার মনে হয়, বিবেকানন্দ ছিলেন প্রধানতঃ কর্মবাদের প্রবক্তা , তাই জাপানীদের কর্মবাদের চরিত্র তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
এবার আসি এক মজার কথায়। রাসবিহারী বসু যখন লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেন, তখন তাঁর উপর বৃটিশ গোয়েন্দাদের কঠোর নজর পড়াতে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুর নামের ছদ্মবেশে জাপানে পালিয়ে আত্মগোপন করলেন। সাময়িক আস্তানা গাড়লেন টোকিও তে। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সেখানেও খোঁজ লাগাতে উনি সেই আস্তানা ছেড়ে অনেক ঘন এবং ঘিঞ্জি বসতিপূর্ণ এলাকা শিনজুকুতে নাকামুরা বেকারির কাছে আত্মগোপন করলেন ।এখানেই আলাপ হল বেকারির মালিক সোমার পরিবারের সঙ্গে। ধীরে ধীরে আসক্ত হলেন Aizo Soma এবং Kotsuko Soma র বড় মেয়ে তোসিকোর সঙ্গে। একসময় বিয়েও হল ১৯১৮ তে।
তিনি শেখালেন তাদের ভারতীয় মুরগীর ঝোল বা চিকেন কারি। তারা খুব ভক্ত হয়ে পড়ল এই চিকেন কারির। তাদের হোটেলেও এটা জনপ্রিয়তা লাভ করল।
মাত্র ৭ বছরের মধ্যে এই সংসার ভেঙে পড়ে তোসিকোর টিউবারকুলোসিসে মৃত্যুর পর। বছর দুয়েক পর তিনি সোমা পরিবারের পাশে এসে দাঁড়াতে তাঁদের বেকারির উপরে একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন, যেখানে অন্যান্য জাপানী খাবারের সঙ্গে ভারতীয় চিকেন কারিও পরিবেশিত হত। এটিতে আকর্ষিত হতে হতে একসময় এটি জাপানে Indo karii নামে খ্যাতি লাভ করে।
পরবর্তী কালে এই চিকেন কারি জাপানে এতই প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে যে এটি সবার কাছে “Taste of love and revolution” নামে খ্যাতি লাভ করে। পরবর্তী কালে এই রেস্টূরেন্ট পাব্লিক লিমিটেড কোম্পানীতে পরিণত হয়। টোকিও কেউ বেড়াতে এলে এখানে আসা একেবারে বাঁধা ছিল ভারতীয় খাবারের স্বাদ নেওয়ার জন্য। আজকের জাপান নাকি রাসবিহারীকে বিপ্লবী বলে চেনে না , চেনে , চিকেন কারির জনক বলে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
নেতাজির সাথে জাপানের সম্পর্ক অবশ্য রাজনৈতিক। সেখানে অন্য কোন প্রভাব কাজ করেনি। সেখানে যদিও সম্পূর্ণটাই ছিল রাজনীতির খেলা, এবং সে ব্যাপারে আমি কোন বিশেষ মতামত দিচ্ছি না। সত্যি সেখানে বন্ধুত্ব ছিল, না ,প্যাঁচ কষাকষির ব্যাপার ছিল সেটা অন্য ব্যাপার । তবে প্রাথমিক ভাবে জাপানের বন্দী ভারতীয় সৈন্য যে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বীরত্ব দেখিয়েছে, এ ব্যাপারে জাপানের সাহায্যই উনি মেনে নিয়েছিলেন, এটা সত্য। গান্ধীজি ও নেহেরুজী যদি তাঁর সঙ্গ দিতেন, তাহলে কি হত, আজকে আর বলা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী তোজো প্রাথমিক ভাবে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন ঠিকই, সেটা অবশ্য নিজের স্বার্থে।
সে যাক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যদিও কিছু রাজনীতি হয়েছিল জাপানে, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে কবিগুরু জাপানীদের রীতিনীতির ভীষণভাবে সমর্থক ছিলেন।তিনি বলতেন, “West is dangerous for Japan is not the imitation of the outer features of the West, but the acceptance of the motive force of Western nationalism as her own”. তাঁর ন্যাশনালিজম সম্বন্ধে মন্তব্য নিয়ে যদিও অনেক জল ঘোলা হয়েছিল, তবু ওকাকুরা , টমি কৌরা বা কাজুও আজুমা এঁদের রবীন্দ্র প্রীতি বা ভারতপ্রীতি যে ভারত জাপান সম্পর্কের অনেক উন্নতির জন্য দায়ী এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। পাশ্চাত্যের আগ্রাসন নীতি বা যান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী নীতির তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী।
আসলে নোগুচির মত আমেরিকাবাসী শিক্ষিতদের পশ্চিম সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের ধারণা পছন্দ হয় নি।সেটাই ছিল সমস্যার মূল।
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ জাপানের মর্মমূলে কি লক্ষ্য করে এত প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেটা অনুভব করাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য।
জাপানীরা সৌন্দর্য্যের সাধনা শুধু তো করে নি , শিল্প, কৃষি, বিজ্ঞানসাধনা, সাহিত্য, বা আর্টের বিভিন্ন ধারাকে তারা নিজেদের উৎকর্ষসাধনার উন্নত স্তরে নিয়ে গেছে।
আজ যদি আমরা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ধরি , আমাদের পরিচিত হারুকি মুরাকামি ছাড়াও নাতসুয়ো কিরিনো,কোবো আবে, বানানা ইয়োশিমোতো,ইয়োকো ওগাওয়া ইত্যাদিরা তো ঊজ্বল নক্ষত্র।
ওদিকে আমরা বাঙ্গালী সিনেমা পিপাসুরা তো কুরোসাওয়ার নামে পাগল। তা ছাড়াও তাকাশি মিকে, তাকেশি কিতানো, ওজু ইয়াশুজিরো ইত্যাদিরা তো সিনেমা জগতে জ্যোতিষ্ক।
আমি হাড়ে হাড়ে অনুভব করলাম যে, আমাদের রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ একশ’ বছর আগে যে সুরধ্বনি শুনেছিলেন জাপানের আকাশে বাতাসে, আজ এত বছর পরেও আমার কানেও সেই সুরের অনুরণন হল।
নারার মিউজিয়াম
আমার জাপান যাত্রা সার্থক হল।আমিও আজ স্বামী বিবেকানন্দের মত বলি, যদিও আমি রবীন্দ্রনাথ, বা বিবেকানন্দ নই, এবং জানি কেউ আমার কথা শুনবে না, তবু মনে হয়, যদি ভারতবাসী বা নিদেন ভ্রমণপিয়াসী বাঙালীরা, কিছু মানুষ জাপান ঘুরে আসতে পারত, হয়ত তাদের চরিত্রে কিছু পরিবর্তন হতে পারত, যা ধীরে ধীরে হয়ত অদূর না হলেও সুদূর ভবিষ্যতে সামগ্রিক ভাবে কিছু উন্নতি ঘটাতে পারত আমাদের দুর্ভাগা দেশের।যে দেশ দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ৩৫৫০০০ ( তিনলক্ষ পঞ্চান্ন হাজার ) হারিয়েছিল বা এক কথায় যার কোমর ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং ১৫ই আগস্ট ১৯৪৫ যাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল, তারাই দ্রুত এসে গেলে পৃথিবীর ব্যবসাক্ষেত্রের প্রথম সারিতে। অথচ আমরা আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই বা আরও গভীরতর অন্ধকারে।
যাঁরা এতদিন আমার সঙ্গে পথ চলাতে সঙ্গ এবং উৎসাহ দিয়েছিলেন, সকলকে আমার আন্তরিক ভালবাসা। সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাই জ্বলদর্চি পত্রিকা এবং তার সম্পাদককে এই পথ চলায় সাহায্য করার জন্য।
0 Comments