জ্বলদর্চি

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী। পর্ব ৯। বুদ্ধি বানাবার কল /বাসুদেব গুপ্ত

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী। 
পর্ব ৯। বুদ্ধি বানাবার কল
বাসুদেব গুপ্ত

মাঝে দুদিন অনির্বাণ ব্যস্ত ছিলো নির্মাণকে নিয়ে। ওর কেয়ার সেন্টার থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল। এটা ভার্চুয়ালি হয় না। যেতে হল। ভার্চুয়াল লুপ আছে বলে ১০০০ কিমি যাওয়া আসা দিব্যি আটঘণ্টাতেই হয়ে গেল। ওর বাড়ীর কাছেই আছে ফিডার লাইন। উঠে বসে লোকেশন সেট করে দিলেই ওর চেয়ার গাড়ী বদল করে করে ঠিক জায়গায় চলে যাবে। এককালে আমাজনের গোডাউনে যে টেকনলজির শুরু সেটাই এখন পাবলিক ট্রান্সপোরটে চালু। যদিও চলাফেরা কমে এসেছে, ফুয়েলের অভাবে। 

নির্মাণের ব্রেনে একটা নতুন ইমপ্লান্ট করে একটা ভাইরাস থেরাপির প্রস্তাব দিলো মেড অফিসার। সেই ২০২০ তে বিরাট প্যানডেমিক হাওয়ার পর ভাইরাস নিয়ে গবেষণাও ভাইরাল হয়ে যায়। তারই ফলস্বরূপ শুরু হয় ভালো ভাইরাসের চাষ। ক্রিস্পার নামে একধরনের জেনেটিক কাঁচি দিয়ে কেটে কেটে তৈরী হয় এই ভাইরাস। তারপর তাদের শরীরে চালিয়ে দেওয়া হয় নানা রকম রোগের সংগে যুদ্ধ করার জন্য। এখনও গবেষণা চলছে ন্যানো ক্যাপসুল নিয়ে যাতে মাইক্রো মিনিয়েচার একটা সম্পূর্ণ অপারেশান থিয়েটারকে শরীরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে কন্ট্রোল করে শরীরের অসুস্থ অংশে গিয়ে অন দি স্পট রিপেয়ার বা ট্রিটমেন্ট করা যাবে। 

সেন্টার থেকে বলল, নির্মাণের ব্রেনে নাকি নতুন নিউরন গজাবে এই ভাইরাস থেকে। অনির্বাণ এখন কিছুটা শুনেছে দাদুর কাছে আর ব্রেন ইঞ্জিনীয়ারিং দিয়ে একটা ব্রেন লজিক বা ব্রেল নামে মডেলও তৈরী হয়েছে। অনির্বাণ মেডের প্রস্তাবটা ফিড করে দিল ব্রেলে। বেশ কয়েক মিনিট পরে উত্তর এলো, নট ফিসিবল। রিস্ক ৯০ গেন ১০। অগত্যা নির্মাণ না বলতে বাধ্য হলো। আর সেই সংগে বুঝতে পারলো এআইএর করিশ্মা। তাড়াতাড়ি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল দাদুর সংগে। সময় বেঁধে দিয়েছে বস। দু দিন চলে গেল তা থেকে। ঠিক হল শনিবার। সকাল ১১টায়। 

=তোর মনে প্রশ্ন ছিলো তো এই যে নিউরাল নেটের কন্ট্রোল বা সহ্যসীমা ও ওজনগুলো ঠিক কে করে। সেটাই হলো মজা। আর একবার ঝালিয়ে নিই ব্যাপারটা। মনে আছে তো, এক একটা নিউরনে এসে ঢুকছে অসংখ্য ডেন্ড্রাইটের। সিগনাল। প্রতিটি ইনপুটের কিন্তু ওজন এক না। আবার কোনটা পজিটিভ কোনটা নেগেটিভ। ধরো তোর সামনে এসে দাঁঢিয়েছে তোর বান্ধবীর পোষা কুকুর। তার হাবভাব ভালো না। সে যেন তোকে ঘুসপেটি মনে করছে। আবার তোর বান্ধবী বলছে কিচ্ছু করবে না ওকে আদর করো একবার, দেখবে কেমন পায়ের কাছে শুয়ে পড়বে পোষা ডগির মত। তোর মাথায় আসছে অনেক সিগনাল। কোন সিগনাল বলছে পালাও কোন সিগনাল বলছে নো প্রবলেম ওকে আদর করো। কখনো মনে হচ্ছে কামড়ালে ইনজেকশানের কথা। কখনো মনে হচ্ছে বান্ধবী রাগ করবে বা হাসাহাসি করবে। কোন সিগনাল পজিটিভ কোনটা নেগেটিভ। কোনটার জোর বেশি। কোনটা কম। এবারে এইগুলো জুড়ে একটা মান বা ভ্যালু হবে। সেটা যদি ভয়ের সহ্যসীমা পেরিয়ে যায়, ব্যাস তুই দৌড় লাগাবি। 

যখন তোর কোন জ্ঞান নেই, অভিজ্ঞতা নেই তখন এই ওজন ও সহ্যসীমাগুলো ঠিকঠাক নেই হয়ত শূন্য। হয়ত যা খুশি একটা। এইবারই শুরু হবে লারনিং প্রসেস। কেউ শেখাবে না। নিজে থেকেই এআই শিখবে অভিজ্ঞতা থেকে। দুবার আদর করে কুকুর খুব খুসি হল। খুশির ওজন বাড়ল। একদিন হঠাত ঘ্যাঁক করে উঠল, অমনি ভয়ের ওজন বেড়ে গেল। এইভাবে ব্রেন শিখতে থাকে ওজন বাড়িয়ে কমিয়ে। 
আমরা যদি একটা ছবি থেকে মানুষ সনাক্ত করার কথাটা ভাবি তখন সেটা কিভাবে হবে? আমাদের মাথাই হোক বা পারসেপ্ট্রন যন্ত্রই হোক, তারা শুরু করবে গেস ওয়ারক করে। একটা ছবি দেখে সব সার্কিট ঘুরে ধর ব্রেন বলল, এই ছবিটা আমার মনে হয় এই নাম। সেটা ঠিক হবার কোন কারণ নেই কারণ ওজন ও সহ্যসীমা সবই তো এলোমেলো। তাহলে? এই যে ভুল্টা হল, সেটা ব্রেন বা এ আই নোট করবে, আর নিজের বিভিন্ন নিউরনের ইনপুটের ওজনগুলো পাল্টাবে। বল যায় ব্রেন বা এআই নিজের ভুল থেকে শিখতে শুরু করবে। এ আইকে যখন ট্রেনিং দেওয়া হয়, তখন এমনি হয়ত এক হাজার ছবি দেখানো হল, এ আই আন্দাজ করা আক হাজারটা যা খুসি নাম বলল। এবার ট্রেনিং যে প্রোগ্রাম সে এই ভুলগুলো নোট করবে আর শুরু হবে ভুল কমানোর চেষ্টা। প্রতিটি ওজন আর সহ্যসীমাকে পাল্টান হবে আর আবার ভুল মাপা হবে। এটা যদি কম্পিউটারে করা হয়, কোটি কোটি বার এই ভুল মাপা আর ঠিক করার খেলা খুব কম সময়েই করা যাবে, আর এমনি করে একসময় ভুল কমতে কমতে প্রায় শূন্য হয়ে যাবে। তখন বলা হবে এই এআইটি ছবি চিনতে সক্ষম। 
তাতেও কি ভুল হবে না? সামান্য ভুল আমরাও করে থাকি। অ-বাবুকে ভুল করে ক-বাবু ভেবে ফেলি, যদি অনেক বছর পরে দেখা হয়। তেমনি ভুল এআইও করবে। হয় সেই ভুলটাকে মনে নেওয়া হবে নৈলে আবার মডেলকে ট্রেনিং দিতে হবে। 

মডেল মানে কি? এটা বলা বা বোঝানো একটু শক্ত। আসলে ঐ ভুল থেকে কি ভাবে ওজন আর সহ্যসীমা পাল্টাবো সেটাই মডেল। বিভিন্ন জিনিষের বিভিন্ন মডেল। আমাদের ব্রেনও এভাবে গড়ে উঠেছে কিনা বলা যায় না, কারণ লক্ষ বছরের হিউম্যান ও তার আগে কোটি বছরের ডাইনোসর থেকে বনমানুষ বা হোমো ইরেকটাস থেকে অস্ট্রেলোপিথিকাস হয়ে নিয়েনডারথাল পেরিয়ে আজকের মানুষ হাওয়ার পিছনে বিবর্তনের এক বিরাট ভূমিকা। কিন্তু মস্তিষ্কের কাজ করার পদ্ধতি যে অনেকটাই একরকম সেটার অনেক প্রমাণ আছে। 

মানুষের মাথার বেশ কিছু অংশ আলাদা আলাদা স্পেশালিস্টের মত কাজ করে। শোনার মস্তিষ্ক, দেখার মস্তিষ্ক বা চলা ফেরার মস্তিষ্ক বেশ অনেকটাই আলাদা। এরা যেন এক একরকম মডেল। ঠিক যেমন এআই নিউরাল নেটে ছবির মডেল একরকম আবার হাতের লেখার মডেল আর এক রকম। আবহাওয়ার একরকম মডেল আবার ভোটের আগে রাজনৈতিক মতিগতির একরকম মডেল। কিন্তু মজার কথা এই এআই এর নিউরাল নেট কেমন করে সম্পূর্ণ অজ্ঞান থেকে এমন এক জায়গায় পৌঁছয় যখন এমনকি ৯৮ ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ঠিক ঠাক বলতে পারে। 

লম্বা লেকচার শেষ করে দাদু থেমে একটু হেসে ওর দিকে তাকালো। অনুক্ত প্রশ্ন হচ্ছে, কি রে কিছু বুঝলি? 
অনির্বাণ মোটামুটি বুঝেছে মনে হল। তবু আর একটা খটকাও থেকে গেল।
=দাদু, এ থেকে কিন্তু বোঝা গেল না কি করে এআই পদ্য লেথে বা ছবি আঁকে বা গান বানায়। চিনতে পারা এক জিনিষ, আর কিছু তৈরী করা আর এক ব্যাপার না কি। 

দাদু ওর ধন্দ বুঝতে পেরে বলা শুরু করল শ্রীগুরুজিপিটির কথা। যার প্রথম নাম ছিল ক্যাটজিপিটি দালি ইত্যাদি। আর্যাবর্ত যখন বিশ্বগুরু হলো তখন এই সব একসাথে মিলে এই অ্যাপ শ্রীগুরুজিপিটি নামে বাজারে আসে। এখন সব পাবলিক এআই শ্রীগুরুজিপিটিই দেখাশোনা করে। =দাদু একটু বোঝাবে এআই কি করে কবিতা লেখে বা ছবি আঁকে? এ তো আর ছবি দেখে জাস্ট চেনা নয় বা রোগের লক্ষণ দেখে রোগ বলা নয়, এ তো একেবারে সৃষ্টি। 

🍂
=ধুর। আর পারিনা বকবক করতে।
দাদু একটু টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলেন টানা লম্বা লেকচার দিয়ে। বয়স তো হলো। হঠাৎ বললো তোর দিদার কথা মনে পড়ে? 
অনির্বাণ এই সময়টাকে ভয় পায়। কি বলবে বুঝতে পারে না। ওর বিমও গাইড করতে পারে না। সত্যি কথাটাই বলে, 
=না গো। কিছুই মনে পড়ে না। কদিনই বা দেখেছি। তোমরা বান্গালোরে থাকতে। আর বাবা চলে এসেছে মাইগ্রেট করে। দেখলাম কোথায়। 
=এই দেখ। বলে দাদু হাতটাকে নাচায়। বডিমাউস ওর সবসময়ই অন। এ দিয়ে দূর থেকে বসেও হাওয়ার হাত দিয়ে মাউসের কাজ চলে। দাদুর ঘরটা অন্ধকার হয়ে যায় আর দেখা যায় প্রায় নাটকের স্টেজের মত আনমনে ছোট ছোট পায়ে নেচে হেঁটে আসছে এক কিশোরী। নাচতে থাকে আর তার পিছনে বেজে যায় টেগোর সং। নাচতে থাকে আর তার বয়স বাড়তে থাকে। গানের কলি পাল্টাত থাকে আর বয়স বাড়তে থাকে। একসময় দেখা যায় চুল সব শাদা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে দিদা। পিছনে কাপড় ধরে টানছে এক দুরন্ত শিশু। 
=এটা তুই। 
=কি করে করলে?
=কেন এআই। তোর আর দিদার লাইফ ডেটা আপলোড করে দিলাম সাইটে। বললাম তোর ছোট বেলার একটা ছোট্ট ফিল্ম বানাতে। বানিয়ে দিল। এতো সবাই পারে। তুই জানিস না?

অনির্বাণ পলিটিক্স নিয়েই বেশি পড়াশোনা করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি, পৃথিবীর পলিটিকাল জোনগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, কো অপারেশান, কমপিটিশান এসব নিয়েই ওর থিসিস। এআই নিয়ে খেলা করার সময় হয় নি ততটা। এখন এসব দেখে ওর মনটা একটু ভারী হয়ে গেল। কি দরকার ছিল হৃদয় খুঁড়ে কষ্ট জাগাবার। চোখটা হঠাৎ করকর করে ভিজে উঠল। তাড়াতাড়ি লজ্জা পেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে দেখল দাদু ওর দিকে চেয়ে আছে। চোখ মরুভূমির মত শুকনো। মুখে একটু হাসি, সেটা হাসি না অন্য কিছু সেটা এআই হয়ত বলতে পারবে। 
=ঠিক আছে আজ তুই যা। আবার একদিন বসব। দাদু আসতে আসতে বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অনির্বাণ খট করে সুইচ অফ করে দেয় ভারচুর। 

পরের দিনটা কেটে যায় নির্মাণের ব্যবস্থা করতে। ওর অসুস্থতা বেড়ে গেছে আরো। কেয়ার সেন্টার থেকে আবার জোর দিতে লাগলো ব্রেন লিঙ্ক লাগানোর জন্য। অসহায় লাগে অনির্বাণের। এর নিদান কোন এআই দেবে না। মানুষের যন্ত্রণার ভার নিজেকেই বইতে হবে। এদিকে অফিস থেকে তাড়া এসেছে প্রোগ্রেস রিপোরটের জন্য। কিছু একটা লিখতে হবে। লিখতে গিয়ে মনে হল ওর আরো ইতিহাস জানা দরকার। বসে পড়ল শ্রীগুরুজিপিটিকে নিয়ে। সলিড একটা রিসারচ দরকার। সারচ করে করে রিপোর্ট তৈরী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অনির্বাণ।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments