৪৪তম পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
আমরা মন্দির চত্বরে থাকাকালীন একদল ভক্ত এলেন যারা ধ্বজা তুলবেন। গুগ্গুলি সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ ধ্বজা তোলার সময়ে ধ্বজা, ফুলের মালা ও নারকেল নিয়ে ওঠেন। শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরের চার তলায় আদ্যাশক্তি মায়ের বিগ্রহ আছে। সেখানে পুজোর পরে ধ্বজা উত্তোলনকারী ব্রাহ্মণ তাঁর আশীর্বাদ নিয়ে মন্দির শিখরে উঠলেন। ধ্বজা তোলার পরে শিখরের গোলাকৃতি জায়গায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালেন। এই সময় নিচে অপেক্ষমান তীর্থযাত্রীদের একধারে সরিয়ে দেওয়া হল। ধ্বজাপান্ডা উপর থেকে একটি আস্ত নারকেল ফেলে দিলেন। এত উপর থেকে পড়ার ফলে সম্পূর্ণ নারকেলটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সেই টুকরো নারকেলের অংশ পাবার জন্য সকল তীর্থযাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। যেকথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি তা'হল ধ্বজা উত্তোলনের আগে ধ্বজা পুজো করা হয়। এই পুজোর জন্য আবার আলাদা পান্ডা আছেন। যে মানতকারী ধ্বজা তুলবেন তারা একটি বিরাট ঝুড়িতে ধ্বজাটি বসিয়ে তার উপরে হলুদ গাঁদা ফুল অথবা জার্মান ফুল নামে এই এলাকায় একটি হলুদ ফুল পাওয়া যায়, সেই ফুলের মালা ঢাকা দিয়ে নিয়ে আসেন। মন্দিরের চারপাশে তিনবার পরিক্রমা করার পরে ধ্বজাটির পুজো করা হলো। তারপরে ধ্বজা পান্ডা সেটি নিয়ে উপরে উঠে গেলেন। এই ধ্বজা তোলার ব্যাপারে যারা মানত করেন তারা কেবলমাত্র দ্বারকার নিকটবর্তী অঞ্চল থেকেই আসেননা। তারা রাজ্যের বহু দূরবর্তী প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুধু নয় কেউবা রাজস্থান থেকেও আসেন।
মন্দির চত্বরে একজন পাণ্ডার সাথে আলাপ হলো তিনি আমাদের মন্দিরে নিয়ে গেলেন পুজো দিতে। পূজো দেওয়ার পরে বাইরে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে এই মন্দিরের সাথে প্রায় ৩৫০০ জন ব্রাহ্মণ কোনো না কোনোভাবে যুক্ত আছেন। পান্ডার সংখ্যাও এক হাজারের কাছাকাছি। মন্দিরের বার্ষিক আয় প্রায় এক কোটি টাকা। এই আয়ের সতেরো শতাংশ ট্রাস্টি বোর্ডের তহবিলে জমা পড়ে। তবে মন্দির চত্বরে শ্রী কুশেশ্বর মহাদেব, মা দেবকী, বলদেব ও অম্বাজি সহ যে ১৬টি মন্দির রয়েছে এগুলির সেবা-পূজা ও দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত শ্রী সারদাপীঠের। ভগবান দ্বারকাধীশকে কেউ যদি অলঙ্কার দিতে চান তা ট্রাস্টের মাধ্যমে দিতে হয়।
🍂
আরও পড়ুন 👇
শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরের দ্বার খোলা হয় সকাল সাড়ে ছটায়। সাতটায় মঙ্গল আরতি ও দর্শন শুরু হয়। এই সময়ে শ্রীদ্বারকাধীশকে মাখন ও মিছরি ভোগ দেওয়া হয় এবং এই ভোগ শ্রী সারদাপীঠ থেকে আসে। সকাল সাতটা পনেরো থেকে ৮টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ভক্তদের মঙ্গল দর্শন। এই সময়ে তীর্থযাত্রীরা নয়নভরে দর্শন করেন। সকাল ৮টা ১৫মিনিটে গর্ভগৃহের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়ে শ্রী বিগ্রহকে আতরের জলে পঞ্চামৃত স্নান করানোর পরে ষোড়শোপচারে পূজো, পাদ্য অর্ঘ্যদানের পরে যজ্ঞোপবীত বসন-ভূষণ পরানো, তুলসী পূজো, আরতি ইত্যাদি। সকাল নটা তিরিশ মিনিটে শ্রী ভগবানের স্নান ভোগ। সে সময়ে তাঁকে দেশি ঘিয়ের লাড্ডু, বোঁদে, কাজুবাদাম, দই ও রাবড়ি দেওয়া হয়। স্নানের পরে শ্রী দ্বারকাধীশকে নানা অলঙ্কারে সাজিয়ে তোলা হয়। সকাল সাড়ে দশটায় পুনরায় আরতি ভোগ। সেই সময় পুরী ও লাড্ডু নিবেদন করা হয়। এই সময়ে ১৫ মিনিটের জন্য গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে। এরপরে শৃঙ্গার আরতি। শৃঙ্গার আরতির পরে দরজা খোলা হয় ভক্তবৃন্দের দর্শনের জন্য। পুনরায় বেলা বারোটায় শ্রীদ্বারকাধীশের রাজভোগ। সেই রাজভোগে থাকে বাসমতি চালের ভাত, টুবের ডাল, সবজি ও মিষ্টান্ন। এই রাজভোগের খরচ যে কোন তীর্থযাত্রী বহন করতে পারেন। রাজভোগ নিবেদনের পরে সেই প্রসাদ প্রসাদঘরে আসে। এখানে উল্লেখ্য যে দেবকী মন্দিরের পাশে শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং এই মন্দিরের পিছনে ভোগ ভান্ডার ও প্রসাদ ঘর। ১২টা ১৫ মিনিটে বানতাভোগ ও কেশর মিশ্রিত মিষ্টি জল দেওয়া হয়। কিন্তু তার পূর্বে পাশা খেলার সরঞ্জাম সাজিয়ে দেওয়া হয় যাতে শ্রীভগবান পাশা খেলতে পারেন, কারণ তিনি তো সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি। রাজা-রাজড়ারাই তো পাশা খেলতেন। দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে পুনরায় গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ হয়। এই সময়ে তাঁকে মধ্যাহ্নভোগ নিবেদন করা হয়। এই মধ্যাহ্ন ভোগে বুঁদি লাড্ডু, বাদামের মিষ্টি দেওয়া হয়। এই সময়ে পুনরায় ১০-১৫ মিনিটের জন্য গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ থাকে। দুপুর দেড়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। বিকেল পাঁচটায় মন্দির খোলার পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শ্রী দ্বারকাধীশকে বিভিন্ন প্রকার ফল দিয়ে ফলভোগ নিবেদন করা হয়। তারপরে তীর্থযাত্রীদের জন্য দর্শন শুরু হয়। এরপরে সন্ধ্যা সাতটায় সন্ধ্যা প্রার্থনা এবং সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ভোগ ও আরতি হয়। আরতির পরে পুনরায় ৮টা ১৫ মিনিটে রাত্রিকালীন ভোগ নিবেদন হয়। ভোগ নিবেদনের পরে রাত্রি সাড়ে আটটায় শয়নারতি এবং নটায় গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ হয়। এই সময়ে শ্রীবিগ্রহের বেশভূষা পাল্টানো হয়। রাত্রি সাড়ে নয়টায় শ্রীভগবানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য স্তুতি করেন ব্রাহ্মণেরা। শয়নস্তুতির পরে পৌনে দশটায় মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়। এই সময়ে শ্রী দ্বারকাধীশের উৎসবমূর্তি শ্রীগোপালজীকে গর্ভগৃহে শ্রীদ্বারকাধীশের বাম পাশে রাখা হয়।
শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরে বৎসরের বিভিন্ন সময়ে নানা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দোলের সময় পালকিতে বসিয়ে মন্দিরের ভেতরে উৎসবমূর্তি গোপালজীকে ঘোরানো হয়, আবার রথযাত্রার সময় রুপোর রথে এই উৎসবমূর্তিকে বসিয়ে পূজারী ও পান্ডারা সেই রথ টানেন। এছাড়াও তুলসী বিবাহ খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। সেই সময়ে উৎসবমূর্তিকে পালকিতে বসিয়ে সমগ্র দ্বারকা শহর পরিক্রমা করানো হয়। এছাড়াও জন্মাষ্টমী উৎসব এখানে খুব আড়ম্বর সহকারে পালন করা হয়।
মন্দির থেকে দুপুর বারোটায় বেরিয়ে মন্দিরের নিকটবর্তী একটি গুজরাটি হোটেলে দুপুরের আহার পর্ব সম্পন্ন করে আমাদের থাকার জায়গাতে ফিরে গেলাম। দুপুরে বিশ্রামের পরে পুনরায় বিকেল চারটায় বেরোলাম। এই সময়ে শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরের আশেপাশের অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ থাকে কারণ মন্দির যতক্ষণ বন্ধ থাকে ততক্ষণ লোকজনের আনাগোনা খুব কম। এইখানে অনেকগুলি ট্রাভেল এজেন্সির অফিস আছে। এদের সাথে যোগাযোগ করে নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, গোপী তালাও, ওখা এবং বেটদ্বারকা ঘুরে আসা যায়। দোকান এবং মন্দির বন্ধ থাকার জন্য আমরা পায়ে পায়ে গোমতী নদীর তীরে চলে গেলাম। যেখানে গোমতী নদী আরব সাগরের সঙ্গে মিশেছে সেই স্থানে সমুদ্রনারায়ণ মন্দির একটি দর্শনীয় স্থান। গোমতী নদীর বাঁধানো ঘাটটিও সুন্দর। এই ঘাটে অনেকগুলি ছোট মন্দির আছে। দ্বারকা মন্দিরময় শহর। গোমতী নদীর তীরে এসে আমরা প্রথমে সমুদ্রনারায়ণ দেবতার মন্দির দর্শন করতে গেলাম। মন্দির অভ্যন্তরে গোমতী দেবী, বরুন দেব, মীরাবাঈ ও অষ্টভবানীর বিগ্রহ আছে। মন্দির অভ্যন্তরে একটি পবিত্র কুণ্ড আছে যেখানে তীর্থযাত্রীরা বিভিন্ন শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত করেন। মন্দির অভ্যন্তরে পঞ্চনদ তীর্থ যেগুলি আসলে পাঁচটি জলের কূপ। এই কূপগুলি পঞ্চপান্ডবের নামে চিহ্নিত। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে দিবারাত্রি আরব সাগরের জল ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। মন্দির স্থাপনের পশ্চাতে একটি পৌরাণিক কাহিনী আছে যেটি এখানে উল্লেখ করছি। ত্রেতাযুগে রাবণ বধের পরে ব্রহ্মহত্যার দায়ে শ্রীরামচন্দ্রের শুদ্ধিকরণের প্রয়োজনে অযোধ্যার কুলগুরু বশিষ্ঠমুণি স্বর্গ থেকে নিজ কন্যা গোমতী দেবীকে এখানে আনয়ন করেন। শ্রীরামচন্দ্রকে শুদ্ধিকরণের পরে গোমতী নদী পুনরায় আরব সাগরে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দেন। মন্দির সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সমুদ্রনারায়ণ মন্দিরের নিকটেই চক্রনারায়ণ মন্দির যেখানে মন্দিরগাত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন চক্র খোদিত আছে। এখান থেকে আমরা গেলাম ভাদকেশ্বর মহাদেব মন্দির। গীতা মন্দিরের সন্নিকটে ৫০০০ বছর পূর্বে স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ সমুদ্রের বুকে একখণ্ড পাথরের উপরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই শিবলিঙ্গের নাম চন্দ্রমৌলিশ্বর শিব। আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বৎসর পূর্বে আদি শঙ্করাচার্য ভারত পরিভ্রমনকালে এখানে এসে গোমতী ও আরব সাগরের মোহনায় এই শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করেন এবং জনসমক্ষে প্রচার করেন। মন্দির অভ্যন্তরে ১৩০০ শিবলিঙ্গ, ১২০০ শালগ্রাম শিলা এবং আদি শঙ্করাচার্য থেকে পরম্পরাক্রমে ৭৫ জন শঙ্করাচার্যের ধাতুমূর্তি বিরাজিত। মন্দিরের পূজারীর কাছে জানতে পারলাম এই মন্দিরকে ঘিরে একটি অলৌকিক বা দৈব ঘটনা আছে। প্রতি বৎসর জুন /জুলাই মাসের একটি নির্দিষ্ট তিথিতে সমুদ্র দেবতা এখানের মহাদেবকে জলাভিষেক করেন। কিছু সময়ের জন্য ওই দিন আরব সাগরের জলরাশি সম্পূর্ণ মন্দিরকে জলপ্লাবিত করে ভগবান চন্দ্রমৌলিশ্বর শিবের আরাধনা করেন। অবশ্য কিছু সময় পরে সমুদ্র দেবতার জলাভিষেক শেষ হলে সমুদ্রের জল ধীরে ধীরে মন্দির থেকে নেমে যায়। এই ভাদকেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের ডান দিকে গীতা মন্দির যেখানে মন্দির অভ্যন্তরে গীতার শ্লোক লিপিবদ্ধ আছে। ভাদকেশ্বর মহাদেব এবং গীতা মন্দির দর্শন করে আমরা সুদামা সেতুর উপরে গিয়ে দাঁড়ালাম উদ্দেশ্য সূর্যাস্ত প্রত্যক্ষ করা। ১৬৬মিটার বিস্তৃত সুদামা সেতুর মধ্যভাগ থেকে দেখতে পেলাম দিবাবসানে সূর্যদেব অপরূপ রঙে গোমতীর ঘাটগুলিকে রাঙিয়ে দিয়ে টুপ করে আরবসাগরে নিমজ্জিত হয়ে গেলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা সকলেই ক্যামেরা ও মোবাইল দিয়ে সেই অপরূপ দৃশ্যকে তাদের স্মৃতিপটে উজ্জ্বল করে রাখার চেষ্টা করছেন। সেই অপরূপ সূর্যাস্ত দেখার পরে আমরা ধীরে ধীরে গোমতীর তীরে এসে দ্বারকাধীশ মন্দিরে যেয়ে সন্ধ্যা আরতি দর্শন করে আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম।
0 Comments