জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি -- ৩৬ পর্ব / চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ভেনিসিয়া

বার্লিনের ডায়েরি -- ৩৬ পর্ব /  চিত্রা ভট্টাচার্য্য   
জলকন্যা ভেনিস 

অন্তহীন সাগরের নীলজলরাশির  বিশাল ঢেউয়ের তালে তাল মিলিয়ে ভাসছে অত্যাধুনিক সুদৃশ্য ট্রেন টি তার দুদিকে রাজ হাঁসের মত সাদা পাখা মেলে । সমুদ্রের গভীরে রাশিরাশি প্রবালের মধ্যদিয়ে কখনো মুঠো ভরে মুক্তো কুড়িয়ে কখনো লাল নীল হলুদ রঙের মাছ আঁচলে ধরে খুশিতে উত্তাল সাগরের তলদেশে মৎসকন্যা জলপরী দের সাথে ডুব সাঁতারের খেলায় মেতেছি। ভেনিসের মোহময় সৌন্দর্য ওকে পাগল করে নিশীর ডাকের মত নিয়ে চলেছে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে। শ্রীময়ী ভাবে ,ট্রেন নয় নির্ঘাৎ সাবমেরিনে জলের তলায় ওরা চলেছে।  তিতির ,ঋষভ কাউকে না  দেখে প্রাণপণ  ডেকেও সাড়া পায় না। ভারী আশ্চর্য্য! লাগে। 
ভেনিসের প্রাসাদ

মিলানো স্টেশন থেকে রওনা হওয়ার আধঘন্টা পরে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে কোনো এক স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়ালে শ্রী চোখ খুলে তিতির ঋষভ কে কাছেই দেখে শান্তি পেল। ওর অবেলার মধুর ঘুমটি তে ইতি পড়লো । উঃ এরই মধ্যে স্বপ্নে পাড়ি দিয়েছিলো একেবারে মহাসাগরের তলদেশে ।  

   ডান হাত টায় বেশ জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে তিতির শাসন করে , তুমি ঘুমোচ্ছিলে ? কত যে দৃশ্য পার হয়ে গেল মিস করলে-- ,দেখ কী সুন্দর ! তুমি ভাবতেও পারবে না। শ্রী থতমত খেয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। সত্যি অপূর্ব ভাষাহারা এই অপরূপ সৌন্দর্য। চারপাশে গ্রেইপ ভাইন (grape vine) দ্রাক্ষা কুঞ্জ যা থেকে তৈরী হয় বিশ্বখ্যাত ইতালীয়ান ওয়াইন।  পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সম্পূর্ণ জায়গা জুড়ে মাইলের পর মাইল আঙ্গুর চাষের ক্ষেত। আঙ্গুর ক্ষেতের ঘন জমাটি  বুনন চিনতে ভুল হয় না। ঢাল দেওয়া পাহাড়ি জমিতে সবুজায়ন । বন জঙ্গল পার্ক ,নদী নালা হ্রদের ওপরে লোহার  ব্রিজ পেরিয়ে ,দূর মাঠের প্রান্তরে গ্রামের সাধাসিধে দালান খামার বাড়ির আটচালার শেড চোখের নিমেষে পার হয়ে  দুরন্ত গতিতে ট্রেন ছুটছে।

পাহাড়ের পেট কেটে সুড়ঙ্গ বানিয়ে একটার পর একটা  অন্ধকার পথে গতির ঝড় তুলে পাথুরে দেওয়ালের ভিতর দিয়ে ট্রেন হুশহ্যাশ বেরিয়ে যাচ্ছে , টানেলগুলো কোনটা বিরাট লম্বা কোনটা আবার বেশ সংক্ষিপ্ত ,ঘন  আঁধারে ঢাকা একটু আলোতে হুঁশ করে মাথা তুলেই আবার অন্ধকারের গহ্বরে , সমস্ত পথ জুড়ে আঁধার আলোর লুকোচুরির খেলা চলছিল । 

         অদ্রিজার  কানে হেডফোন , ঋষভের হাতে  নিউজ পেপার। শ্রীময়ীর   ভাবুক মন ভেনিসের জন্মলগ্নের --আদি সৃষ্টির তত্ত্বের তালাশে বিস্তৃত রহস্যের সন্ধানে। সাংবদিক বর্ণিত  " জলকন্যা ভেনিস" ওকে  রীতিমত ভাবিয়ে চলেছিল। বিশ্ব ইতিহাসের বইয়ে এই জলের রাজ্যের রাজত্ব ও শহর নগরী গড়ে ওঠার পেছনে যে চমকপ্রদ ঐতিহাসিক কাহিনী আছে তাতেই মনোনিবেশ করেছিল। পরপর তথ্য সাজিয়ে কল্পনার তুলিতে ঘটনার ঘনঘটা সযত্নে ডায়েরিতে লিখে রাখছিল। ওকে বিস্ময় বোধ করে,  অন্তহীন নীল জলের ঢেউয়ের দোলায়  দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শহর টি র লবনাক্ত জলের স্রোতের ধাক্কায় বা সামুদ্রিক ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে  গুড়িয়ে যায়না।  খন্ড খন্ড হয়ে দূরে ভেসে ও যায় না ?  

  প্রায় ১৬০০ বছর আগে এই অদভুত ঐতিহাসিক নগরটির জন্ম হয়েছিল। প্রাচীন যুগে  ৪২১ খ্রিস্টাব্দে কোনো ভৌগোলিক বিপর্যয় বা কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের কারণে তরল লাভা থেকে ১১৮ টি ছোট বড়ো দ্বীপ মালার সমষ্টি জেগে উঠেছিল। আড্রিয়াটিক সামুদ্রিক বা ভূমধ্যসাগরের উপকূলে গড়ে ওঠা  দ্বীপ গুলো ইতালীর উত্তর পূর্ব ভেনেতো এলাকায় অবস্থিত জলকন্যা ভেনিস নগরীর স্থাপনা করে সৃষ্টি হয় অনুপম সুন্দর একটি প্রজাতন্ত্রের রাজধানী। সমুদ্র তল থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২  মিটার ৭ফুট ,এবং স্থল ভাগের  তুলনায় জলভাগের পরিমান অনেক বেশী  হওয়াতে ভেনিস জলপথে অপূর্ব মোহনীয় সৌন্দর্যে পরিপূর্ন এক প্রাকৃতিক রূপসী নগরী হয়ে বিশ্বসভায় বন্দিত । এই সুন্দর তম ভাসমান শহরটির  আয়তন ৪১৪.৫৭বর্গ কিলোমিটার।

 জলের ওপর গড়ে ওঠা সাম্রাজ্য টির  বিস্ময়ের অলিগলির জলপথ ভেনিস কে এক অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে । পো এবং পিয়াভ এই দুই নদীর মোহনায় অবস্থিত ভেনিস আর্কিপেল্যাগো প্রায় শতাধিক ছোট বড়ো দ্বীপের সমষ্টিতে গড়ে উঠেছিল। তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে ১৭৭টি খাল। প্রতিটি দ্বীপের  সাথে যোগাযোগের  জন্য রয়েছে ৪০৯ টি সেতু ।  তবে ১০০টির বেশী দ্বীপ নিয়ে শহরটি গড়ে উঠলেও বেশীর ভাগ ভবন এবং বাসস্থান দ্বীপগুলোতে সরাসরি নির্মান করা হয়নি। সমতল ভূমি থেকে সাগরের লবনাক্ত জল এই দ্বীপমালা গুলোকে ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এই  দ্বীপমালাতেই অমানসিক পরিশ্রম ও ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার জোরে  ধীরেধীরে পঞ্চম শতকের থেকে ভেনিসিও সভ্যতার নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন শুরু হয়।  

  তৎকালীন সময়ের ইতিহাস বলে, পশ্চিমারোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আল্পস পর্বত মালা জুড়ে হানা দেওয়া উত্তরের বর্বর অসভ্য জাতি হুন দস্যুরা রোমের প্রাক্তন অঞ্চল গুলো নিজেদের অধীনে আনার জন্য অকথ্য অত্যাচারে নিরীহ অধিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সেই সময়ে নৃশংস হুন দস্যু প্রবল পরাক্রমশালী এটিলার বার্বরিয়ান দস্যুবৃত্তিতে অতিষ্ঠ সাধারণ জনজীবন। প্রাণহানী ধর্ষণ ধনসম্পদ  লুন্ঠন অগ্নিসংযোগ যাবতীয় দস্যুবৃত্তি তারা নির্বিবাদে চালাতো। এই  নির্মম বর্বরতা ও  অত্যাচারের থেকে নিস্তার পেতে স্পাইনা ,আদ্রিয়া ,আলতিনো ইত্যাদি সiম্প্রদায়ের অসহায় নিপীড়িত উদ্বাস্তু জনসাধারনেরা ভূমধ্য সাগরের উপকূলে এই জলমগ্ন দ্বীপ সমষ্টির অঞ্চলটিতে প্রাণরক্ষার্থে আত্মগোপন করতে আশ্রয় নিয়েছিল। 

সেকালের ভেনিসীয় দের জীবন যুদ্ধে প্রথম দিকে যাঁরা মৎসজীবি ,যাদের সাঁতার এবং জলের ওপর ভেসে ঘুরে থাকার অভ্যাস মানসিকতা ও অভিজ্ঞতা আছে তাদের মধ্যেই এমন জলীয় জায়গায় বসবাসের প্রবণতা অধিক ছিল। কিন্তু পরের দিকে তা অপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে এবং আত্মরক্ষার্থে স্থায়ী আবাস নির্মাণের চিন্তা তাদের কে ও উৎসাহিত করে। যদিও সমুদ্রে মৎসশিকার করে এদের  নিত্য আহারের ব্যবস্থা  চালু  ছিল কিন্তু মাথা গোজার ঠাঁই বিশেষ ছিল না। জলমগ্ন দ্বীপে বসবাসের যোগ্য গৃহ নির্মাণ ছিল বাস্তবিকই  খুব কঠিন ততোধিক দুঃস্বপ্নের কাজ ।

 তবে  বার্বরিয়ান দস্যুরদল জলপথে  নৌকেন্দ্রিক যাতায়াতে বা নৌবিদ্যায় মোটেই পারদর্শী ছিল না। বরং পদাতিক আগ্রাসনে এবং ঘোড়ায় চড়ে দস্যু বৃত্তিতে এরা সুপটু ছিল। ফলত দস্যুরা এই জলাভূমিতে ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ  হওয়ায় ঐ নিরীহ জনসাধারণ অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণরক্ষার্থে  জলাভূমির অঞ্চল গুলোতে আত্মগোপন করতে বিশেষ ভাবে উদ্যোগ নিয়েছিল। এবং বসবাসের জন্য উপযুক্ত বালুময় তিনটি  দ্বীপ  " টরসেলো ,জেসোলো ,ও মালামোক্কর "। এই দ্বীপ গুলো কে ঘিরেই ভাগ্যতাড়িত মানুষ গুলো ভেনেতিয়ান উপহ্রদে এই সুন্দরী ভেনিসিয়া নগরীর ভিত্তি স্থাপন ও সমৃদ্ধি বিস্তার করে তুললেও  সমস্যা দেখা দিয়েছিল জায়গার স্বল্পতা এবং জলাভূমিতে টেকসই বসবাস যোগ্য গৃহ নির্মাণের  সম্ভাবনা নিয়ে।                                                                                                                                  -- ,                                                                          প্রথম দিকে শত শত ওক ও  লার্চ গাছের গুঁড়ি  দিয়ে পাইলিং করে তার ওপর বাসগৃহ  নির্মাণ করা শুরু হয়েছিল। শুরুতে জনবল অধিক না থাকায় কিছু কাঠ খড় এবং মাটি দিয়ে কম ওজনের ঘর বাড়ি তৈরী করে বসবাসের উপযুক্ত করা হতো। কিন্তু সেই বাড়ি ঘর মোটেই  মজবুত না হওয়ায় প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা বিভিন্ন কারণে ক্ষণস্থায়ী এবং ভঙ্গুর হয়ে বসবাসে বিস্তর সমস্যা দেখা দিল। এমনি ভাঙা গড়ার খেলা বহু কাল পর্যন্ত  চলার পর  ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার অত্যাচারিত মানুষের  জনসংখ্যা  ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। জনসাধারন  নিজেদের আবাস স্থল ছেড়ে সমুদ্রের উপর পাকাপাকি ভাবে গৃহ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
ভূমধ্য সাগরের তীরে গড়ে ওঠা আধুনিক শহর ভেনিস।

এর ও বহু কাল পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাহায্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে স্বীয় প্রচেষ্টায় ও মেধায় পাকা পোক্ত ঘর বাড়ি স্থাপনা ও নির্মাণের কাজে ক্রমশঃ তারা পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। 

শ্রী কে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে সাংবাদিক অবাক হয়ে বলেছিলেন আমি আপ্লুত ম্যাডাম "তুমি একজন ভার তীয় লেডি হয়ে আমার জন্মভুমি দেশটার এত বিশদ ইতিহাস জানো ! "  

  ক্রমশঃ বহু চিন্তা ভাবনা ও পরিশ্রমের ফলে ভেনিসীয় প্রকৌশলীরা জল নিষ্কাশনের মাধ্যমে কৃতিত্ব পূর্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক অগ্রগতি তে খাল খনন ও জল ধারার গতিপথের পরিবর্তন সাধন করে শক্ত পোক্ত মজবুত ভবন নির্মাণে সমর্থ হয়। এবং কয়েক শতক ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে ,নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা বিজ্ঞান চেতনা ও  সূক্ষ্ণ প্রযুক্তির সাহায্যে  তিলে তিলে বহুঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে এই শহরটি রীতিমত আধুনিক সভ্যতার যুগোপযোগী এক সর্বাঙ্গ সুন্দর নাগরিক জীবনে পরিণত হয়েছিল। পনের ষোলো শতকের পর  থেকে ভেনিসের এক গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয়েছিল। পৃথিবী বিখ্যাত প্রবাদ প্রতিম ভেনেসিয়ান মার্চেন্ট দের বিশ্ব জোড়া খ্যাতিতে তখন ভেনিস হয়ে উঠেছিল প্রাচ্য দেশের মূল সেতু।  
চলার পথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

অদ্রিজা অনেক ক্ষণ ধরে শ্রী কে একভাৱে চলন্ত ট্রেনে খাতায় কলম চালাতে দেখে কৌতূহলী হয়ে  জিজ্ঞেস করে কী এত মন দিয়ে লিখছো মা ?  সেই মুহূর্তে নোট বুক বন্ধ করে ও খুব মৃদু স্বরে তিতির কে পড়ে শোনায় , ভেনিসের উৎপত্তির ইতিহাস ও ভৌগোলিক বর্ণনা যা মিলানো চত্বরে সকাল বেলার আড্ডার মহাসভায় এগিয়ে ছিল। এবং সাংবাদিকবন্ধু টির জরুরী ফোন না এলে হয়তো আরো অনেক খবর শ্রী  সংগ্রহ করে নিত। আরো বিস্তর কাহিনী যে আলোচনায়  বাকী রয়ে গেল।        
  ট্রেন থেকেই অদ্রিজা দেখছিল পশ্চিম দিগন্তের  দিক টি কালো করে  শীতের কুয়াশা ঢাকা আকাশ থেকে আলো মুছে গিয়ে পথ দ্রুত আঁধারে বিলীন হলো। শান্ত সন্ধ্যার ছায়াছায়া অন্ধকারে পৃথিবীর বুকে সুধীরে রাত নেমে এসেছিলো। ওরা এসে পৌঁছলো  ভেনিসের মেসত্রে স্টেশনে। সুন্দর পরিষ্কার ছিমছাম সাজানো ষ্টেশন যেমন বিদেশের সর্বত্র দেখেছিল।  শহরের প্রতিটা কোণ  সেজে উঠেছে আসন্ন প্রায় উৎসব  খ্রিস্ট মাসের ''বড় দিনের " সাজের বাহারী আলোয়। সন্ধ্যে রাতের তারায় ভরা স্বচ্ছ  আকাশ তারই বার্তা বহন করে  দিকে দিকে উৎসবের আয়োজনে মুখরিত হয়ে উঠেছে । এক নতুন দিনের শুভ মুহূর্তের আগমনের শুভেচ্ছার আশীর্বানী সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। আসন্ন প্রায় রাতের নির্মল আকাশে পূর্ণ মায়াবী চাঁদ সামনের একটা বিরাট ঝাঁকাওয়ালা  ওক গাছের মাথার ওপর উঠে এই শহরে নতুন পদার্পন কারী  আনাড়ি ঘাবড়ে যাওয়া  মানুষ গুলো কে দেখে যেন দুরন্ত বালকের মত  মিটি মিটি  হেসে চলেছিল। 

খুব ঠান্ডা হাওয়া বইছিল ,তাপাঙ্ক সম্ভবতঃ তিন ,চার ডিগ্রি হবে গুটিগুটি পায়ে দ্বিধা সংঙ্কোচে  ষ্টেশনের গেট পেরিয়ে  আড্রিয়াটিক সাগরের পূর্বতীরে ইউরোপের অন্যতম ঐতিহ্যময়  ভেনিসিয়া নগরীর দিকে চলতে শুরু করেছিল। ঋষভ বলে,দেখ কেমন  অন্যান্য যাত্রীরা সমানে সমস্বরে " ভিনিজিয়া--"ভিনিজিয়া " বলে উচ্চরবে  আনন্দ প্রকাশ করছে ।  আদ্রিজা বলে  আলেক্সেই এর কাছে শুনেছি , ইতালিয়ানরা ভেনিস কে জলকন্যার মত ভিনিজিয়া নামে ও  ডাকে। আবার সুপ্রাচীন শিল্প কলা ও স্থাপত্য সৌন্দর্যের জন্য প্রশংসা করে বলে কুইন অব আড্রিয়াটিক।  
ভাসমান শহর জলকন্যা ভেনিস।

  ওরা ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে গুগুলের  প্রদর্শিত পথে পূর্বে নির্ধারিত হোটেলটি খুঁজতে  পিতা পুত্রি  এগিয়ে গিয়েছে লোকালয়ের দিকে।  প্রচণ্ড শীতের  রাত অস্বাভাবিক ঠান্ডায় শ্রী  প্রায় অবশ। ভয় দ্বিধা উৎকণ্ঠায় আশঙ্কায় ওর গলা শুকিয়ে কাঠ।  নির্জন ফুটপাতের এক প্রান্তে  মালপত্র সমেত ও একাকী  অপেক্ষারতা। ১৫ মিনিট হয়ে  গিয়েছে। তিতিরদের দেখা  নেই। আশঙ্কা বিভ্রান্তি তে ভয়ানক বিব্রত হয়ে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় ও দিশেহারা।  ঠিক তখনই  দেখা হলো ওর ই মত শাড়ি পরা এক বাংলাদেশী তরুণি লিপির সাথে। কর্মসূত্রে ওরা দীর্ঘকাল ভেনিসের ই বাসিন্দা। অদ্ভুত আনন্দ ধারায়  শ্রী শিহরিত হয়ে উঠলো। আশার আলোয়  অজানা  উত্তেজনার  স্রোত তিরতিরিয়ে  ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে গিয়েছিল। মাতৃভাষায়  নিজের সমস্যার কথা লিপি কে জানাতে  ঠিক পাঁচ মিনিট ও লাগলোনা  ওর  নির্দেশিত পথে হোটেলের দরজায় পৌঁছতে।গুগুল প্রায়ই পথ  নির্দেশে এমন বিভ্রান্তির  সৃষ্টি করে  যে কাছের জায়গাটি ও কত দূরের  দেখায়।    

বিদেশ বিভুঁইতে সেই জনপ্রাণী হীন শীতের রাতের ফুটপাতের সামান্য টিমটিমে আলোয়  লিপির উপস্থিতি দেবদূতের মত মনে হয়েছিল। সেইপথে দেখা স্বল্প পরিচয়ের মেয়ে লিপি আরা  শ্ৰীময়ীর সঞ্চয়ের ঝুলিতে উজ্জ্বল হয়ে রইলো।  ভেনিসে থাকার পরের দুটোদিন ওকে কতবার সেখানে অলিতে গলিতে বিভিন্ন জায়গায় শ্ৰীময়ী ওকে খুঁজেছিল,কিন্তু আর দেখা পায়নি।

গাছ গাছালি তে ভরা কিছুটা  পথ পার হয়ে  সুন্দর মরশুমি ফুল  ও অর্কিডের বাগান  পেরিয়ে পুরোনো স্থাপত্যের স্টাইলে সাজানো হোটেল টিতে পৌঁছে সে রাতে অপার মানসিক  শান্তি পেয়ে মানুষের প্রতি অসীম শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে মন ভরে  গিয়েছিল। 
                                        (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments