জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


 প্রতিটি সকালের এক নিজস্ব সুর থাকে, শুকতারার শান্ত উপস্থিতির মতো, পাহাড় পথের স্বচ্ছতোয়া কলস্বরা ঝোরাটির মতো। আর সে বিরল সকাল যদি বয়ে আনে গঙ্গোত্রী দর্শনের মতো পূণ্য বার্তার, তবে তো… 
মনে আছে,আগের দিনের মনোরম স্বপ্ন যাপনের পরে গঙ্গোত্রী যাত্রার সকালে কেমন যেন এক অজানা শিহরণে মনপ্রাণ ভরেছিল বিরজার। প্রতিটি দিনেই স্নানাদি সেরে গাড়িতে ওঠা যেন নৈমিত্তিক হয়ে গিয়েছিল দলটির। দাদা ঠিকই বলেন,মানুষ তো অভ্যাসের দাস। সকাল সন্ধ্যার মামুলি জীবনসংগ্রামে যে মানুষগুলি তেল-নুন-স্বেদ-স্বাদের সন্ধানে দিনাতিপাত করে, এই অনন্ত উদার প্রকৃতির মাঝে এসে সে যেন আপনাকে নতুন করে ফিরে পায়। খন্ড থেকে অখন্ডে, স্বার্থ থেকে সমৃদ্ধির উত্তরণে। 
চারপাশের পান্না সবুজ গাছপালাগুলি গাড়ির গতির সঙ্গে সঙ্গে সরে সরে যাচ্ছে, পিছলে যাচ্ছে তায় সকালের রোদ। হঠাৎ পিসিমা বলে উঠলেন, 
-’হ্যাঁ রে মা অরু, তোদের দেশে কুসুম ফলে! আমার বাপ ঘরের দেশে এমন গর্মিদিনে গাছভরা কুসুম ফলতো। আমরা সব গাছে উঠে পেড়ে পেড়ে খাতাম। কি তার স্বাদ, কি সোন্দর তার বর্ণ!’
-’মা তুমি গাছে উঠতে! তুমি পারতে!’
চিরকালের শান্তশিষ্ট,নড়বড়ে থুপথুপে মাকে এতো কথা বলতে দেখে অবাক হয়ে বললেন দাদা। আর বিরজা ভাবছিলেন, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এলে মানুষের মন হয়তো এমনভাবেই আগলভাঙা হয়ে পড়ে, 
‘হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি… ‘
এই সব গল্পগাছা-রঙ্গরসিকতা চলতে চলতেই গাড়ী পৌঁছে গিয়েছিল ভাগীরথীর ডানতীরের গঙ্গোত্রী মন্দিরে, মাত্রই ঘন্টা দুয়েকের পথ। একটু দূরেই ছিল উষ্ণ প্রস্রবণ, লোকবিশ্বাস,এই উষ্ণ জলে অবগাহন স্নানে শরীর ও মনের সমস্ত ক্লেদ ও গ্লানিমুক্তি হয়। তাই  শুনে দুই মায়ের সঙ্গে দুই কন্যে মনের সুখে স্নান করতে  নামলেন, অতঃপর পূজা। মন্দিরটির আকার আয়তন যমুনোত্রী মন্দিরের মতো, সেই যেখানে গতদিনে সই পাঠালেন তাঁরা… মনে পড়তেই দুজনের সে কি হাসি! 
দাদা এবং সইয়ের বরের রসিকতা, 
-’আবার এখানেও নাহয় সই পাতানো হোক।’
-’না। আর লাগবে না। আমরা আমৃত্যু সইই থাকবো।’
দুজনে সমস্বরে বলেছিলেন, এবং এটাই সত্যি, কথা তাঁরা রক্ষাও করেছেন আজীবন। 
যাইহোক, কুন্ডে স্নান, মন্দিরে পুজো,খরস্রোতা নদীর পাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি সেরে পাশের দোকানে পুরী-সবজী খেয়ে যখন সবাই আবার গাড়িতে উঠলেন, 
অল্পবয়সী ড্রাইভার ভাইটি ভাঙা ভাঙা বোধগম্য হিন্দিতে জানালে, মন্দিরটি নাকি অষ্টাদশ শতাব্দীতে গোর্খা জেনারেল অমর সিং থাপা নির্মাণ করেছিলেন। কথিত যে যমুনোত্রীর মতো গঙ্গোত্রীতেও পূণ্যস্নানে জন্ম জন্মান্তরের পাপ ক্ষয় হয়। কি মনে হতে একখানা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বিরজার বুকের গভীর থেকে। সাত্ত্বিক কুলীন ব্রাহ্মণ কন্যা এবং বধূ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় গোঁড়ামি তার আশৈশব নেই। জ্যাঠামশায়ের শিক্ষায় শিক্ষিত সে, পূজা আচরণ যে একেবারেই লৌকিক এবং পৌত্তলিক তা সে জানে। কিন্তু জীবনপথে চলতে গেলে কিছু আচার তো মানতে হয়, তাই তা অমান্যও করতে নেই। তা না হলে, এ জীবনের পরে কার কি হবে, মৃত্যুর পরে মানুষ কোথায় যায়, আত্মা আদৌ আছে কিনা, এসব প্রশ্ন তো অমীমাংসিত,কোন পূরাণকথা, লোককথায় তার ব্যাখ্যা নেই। 
তাই পাপ ক্ষয়, পূণ্য সঞ্চয় এসব নয়, মামুলি জীবনের বাইরেও যে বৃহত্তর জীবন পড়ে আছে, বইপত্র, ভ্রমণকাহিনীতে তিনি যা যা পড়েছেন, তা দেখতেই তিনি বেরিয়েছেন। তারমধ্যে পাপ পূণ্যের বিষয় নেই। তবে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের সঙ্গে তাঁর কোন বিরোধও নেই। 
🍂
বাইরে তখন চকচকে নীল আকাশের তলার পাহাড় শ্রেনীর মধ্যকার রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে ছুটে চলেছে গাড়ি, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে গল্প। হঠাৎ গলা বাড়িয়ে গঙ্গাজল সই বলে উঠলো, 
-’হ্যাঁ রে সই! তুই মাঝেমধ্যেই এমন উদাস হয়ে যাস কেন রে? কি ভাবিস মনে মনে?’
পাশে বসা পিসিমা গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, 
-’আহা! এই কচি বয়সেই মেয়েটা আমার যা দুঃখ পেয়েছে… থাকতে দেখা না বাপু ওকে আপনমনে!’
বিরজার মনেমনে রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান বেজে উঠলো সুরে… 

সুরের ছন্দে, গতির ছন্দে আবার খানিক গল্পগাছা পারস্পরিক হাসিঠাট্টার মধ্যেই গাড়ি চলতে লাগলো, পথে কোন এক অচেনা পথের বাঁকে একটুখানি সমতল পেয়ে সবাই মিলে সঙ্গে থাকা মুড়ির টিন বার করা হলো। আমতেল, ছোলা বাদাম ভাজা দিয়ে মেখে বেশ খাওয়া হলো। ছেলেদের বাটিতে বাটিতে পরিবেশন করে দুই সই  একসঙ্গে খেতে বসলেন।পিসিমার ভাঁড়ার থেকে নেওয়া নারকেল নাড়ুর প্রসংশা করলো সবাই।দাদা মুচকি মুচকি হাসছিলেন,কারণ তিনি জানতেন,বিরজাই ওসব বানিয়েছিলেন নিজের হাতে। সেই সেদিন দুপুরবেলা, বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে বৌদিদিকে না জানিয়েই একা একা কুড়িটি নারকেল কুরিয়ে উনুনে বসানো ঘরের গরুর দুধের ঘন ক্ষীরের সঙ্গে তা মিশিয়ে দোলো চিনি দিয়ে যখন নাড়ছিলেন, সুগন্ধে আশপাশ আমোদিত, দাদা বেরিয়ে এসেছিলেন ঘরের আরাম ছেড়ে। আবছায়া রান্নাশালের এককোনে পাতা মাটির উনুনের লকলকে অগ্নিশিখায় তখন তাঁর ফর্সামুখ লালে লাল। 
দাদা হেসেছিলেন তার দিকে তাকিয়ে, প্রশ্রয়ের হাসি, বন্ধুত্বের হাসি। সে ছায়া আজও ভালো তাঁর চোখে, তিনিও প্রত্যুত্তর দিলেন হেসে। রোদ যেমন হেসে লুটিয়ে পড়ে নব শ্যামল শস্পভূমিতে, কেউ খেয়াল করলো না, তেমনই এক নির্মল খনসুটী খেলা করলো দুইটি সম্পর্ক রহিত পরিনত ভাইবোনের হাসিতে। 
গাড়ি গড়ালো চাম্বার উদ্দেশ্যে। সেদিনকার গন্তব্য তাঁর ছিল চাম্বা পেরিয়ে গুপ্তকাশী,পথে যেতে যেতে চোখে পড়েছিল তেহরি বাঁধ।কি বিপুল জলরাশি…গাড়ির বড়োরা না নামলেও তাঁরা সবাই নেমেছিলেন,দেখেছিলেন অবাক বিস্ময়ে…এত্তো জল, এত্তো ঢেউ,এত্তো তীব্র গতিতে জল আছড়ে পড়তে পারে! তখনও সমুদ্র দেখা হয়নি।দাদার মুখে গল্প শুনেছিলেন,সমুদ্র নাকি অন্যরকম সুন্দর,সে নাকি অনন্ত…
মনে মনে ভেবেছিলেন,সুযোগ পেলে সমুদ্র দর্শনও হয়তো হবে তাঁর।তবে সেই বার, তেহরি বাঁধে খানিক সময় নষ্ট করে ফেলার জন্য বড়ো দের বকুনি খেয়েছিলেন তাঁরা,বেশ মনে আছে। কারন, তখন তো এখনকার মতো এমন আগে থেকে ব্যবস্থা করে যাওয়ার চল ছিল না, তায় ধর্মশালায় সেসব হোতোও না। এবং তেহরি থেকে গুপ্তকাশীর দূরত্বও কম ছিল না।এবং সেদিন যেখানে পৌঁছতে রাতও হয়ে গিয়েছিল তাঁদের।
তবে ওমন শীতের রাতে পৌঁছেও সমস্যা তেমন কিছু হয়নি। সারা জীবন জীবনের ঘাটে-অঘাটে ঘুরে এইটুকু অন্তত শিখেছেন বিরজা, সাধারণ ভাবে,মানুষ মানুষের বন্ধুই, পরস্পরকে সাহায্য করে বেঁচে থাকতেই সে খুশি। আর এই খুশির মুল্যে সামাজিক অবস্থান, ভাষা, লিঙ্গ কখনও অন্তরায় হয়না।

Post a Comment

0 Comments