ভোলগা নদীর খোঁজে – ৬১
বিজন সাহা
কালমিকির পথে
আমাদের ভোলগা নদীর গল্প এখানেই শেষ করা যেত। রুশরা বলে শেষ সেনা সমাহিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হয় না। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা দুবনা ফিরে যাচ্ছি এই যাত্রার শেষ হবে না। তাছাড়া এর পরে আমি আরও কয়েকটি ভোলগা তীরের শহরে বেড়াতে গেছি। সবচেয়ে বড় কথা ১৯৯৪ সালের ১৮ মে থেকে আজ পর্যন্ত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে আমি ভোলগা তীরের দুবনা শহরে বাস করছি। এসব সম্পর্কে না বলে ভোলগার গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই গল্প চলবে।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওনা হলাম এলিস্তার পথে। এলিস্তা কালমিকির রাজধানী – দাবার শহর নামে পরিচিত। মূলত মরুভূমি এলাকা। তবে বালি নয়, আগাছা দিয়ে ভর্তি মাঠের পর মাঠ। গাড়ি এগিয়ে চলছে। পথে পড়ছে বিভিন্ন ধরণের মাইল ফলক যেখানে মাহাচকালা, গ্রজনি ইত্যাদি পরিচিত সব নাম। মনে মনে ভাবছি ঐসব এলাকা ঘুরে মস্কো ফিরলে খারাপ হয় না। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল দেমিদের। ফোন এসেছে আস্ত্রাখান থেকে, যে বাসায় ছিলাম তাদের কাছ থেকে। আসলে এসব বাসা ভাড়া দেয় কোন কোন কোম্পানি। স্থানীয় লোকজন বাসা ভাড়া দিতে চাইলে সেটা করে কোম্পানির মাধ্যমে। ক্লায়েন্ট কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে। ওরাই বিভিন্ন অফার দেয়। লোকজন নিজেদের সুবিধা মত বাসা নেয়। এসব হয় ট্যুরিস্ট সিটিগুলোয়।
মরু পথ
আপনারা মানিব্যাগ ভুলে গেছেন। আমাদের যে ক্লিনার তিনি বাসা পরিষ্কার করতে গিয়ে এসব পান। - - ওদিক থেকে এক মহিলা বলল। দেমিদ অবাক। আমাদের সবই ঠিক আছে। একটু খুঁজে দেখা গেল দিলীপ তার মানিব্যাগ ফেলে এসেছে। অরূপ আমাকে বার বার বলে দিয়েছিল যে দিলীপ একটু মনভোলা, আমি যেন খেয়াল রাখি। ফলে টাকাপয়সা সব আমার কাছেই ছিল। ভ্রমণের সময় সব খরচ আমার হাত দিয়েই হত। সমস্যা হলে অরূপকে জানাতাম, ও টাকা পাঠিয়ে দিত। আসলে অরূপ এই ব্যবস্থা করে যাতে বাজেট ফেল না করে। ইতিমধ্যে ঘন্টা দেড়েক ড্রাইভ করা হয়ে গেছে। কী করা? আমরা ফিরে গেলাম আস্ত্রাখান। এক মহিলা অপেক্ষা করছিলেন, তার কাছ থেকে হারানো মানিব্যাগ সংগ্রহ করে চললাম ভোলগার তীরে দুপুরের খাবার খেতে। প্রথম দিন তুষার আমাদের যেখানে ট্রিট দিয়েছিল সেখানেই গেলাম আবারও। এরপর রওনা হলাম এলিস্তার পথে। পথে কিনলাম আস্ত্রাখানের তরমুজ। বাসার জন্য। একটা যাবে মস্কো, আরেকটা দুবনা। যাচ্ছি যাচ্ছি, বিভিন্ন রকমের গল্প করছি, হাসাহাসি করছি দিলীপের ভুলো মনের জন্য। এক সময় দেমিদ বলল আমরা এলিস্তার দিকে মোড় নিতে ভুলে গেছি। সেটা অবশ্য খুব দ্রুতই ধরা পরে, তবে এই হাইওয়েতে চাইলেই গাড়ি ঘুরানো যায় না। আমাদের আরও প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার সামনে যেতে হল সেই জনহীন পথ ধরে। এবার সবাই একটু সতর্ক হলাম, যেন জায়গা মত মোড় নিতে ভুলে না যাই।
আমরা এগিয়ে চলছি এলিস্তার দিকে। আস্ত্রাখান থেকে এলিস্তার দূরত্ব প্রায় ২৯০ কিলোমিটার, আর গাড়িতে ৩১৩ কিলোমিটার। এই রাস্তা একেবারেই অন্যরকম। রাস্তায় কোন গাছপালা নেই বললেই চলে। পথে এক জায়গায় চোখে পড়ল খালের মত – অথবা বিল। সেখানে নেমে বেশ কিছু ছবি তুললাম আমরা। আবার শুরু হল অন্তহীন মাঠ – বা কাঁটা গাছ। এখানে সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল ভেড়ার পাল। উঁচুনিচু মাঠে ওরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথাও কোন রাখালের দেখা পালাম না। কে জানে এসব বন্য ভেড়া নাকি রাখাল দূর থেকে ওদের প্রতি খেয়াল রাখছে। তবে এই দৃশ্য এত দিন পর্যন্ত দেখে আসা দৃশ্যের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। এই বিস্তীর্ণ জনশূন্য ভূমির মধ্যে হঠাৎ জেগে উঠল একটি ছোট জনপদ। আমরা সেখানে নেমে কিছু খাবার কিনলাম। এদিক সেদিক হেঁটে কিছু ছবি তুললাম। কোন উঁচু বিল্ডিং এখানে দেখা গেল না। দেখেই বোঝা যায় এখানে মানুষের জীবনযাত্রা একেবারেই অন্য রকম। যদিও রাশিয়ায় এক জনপদ থেকে আরেক জনপদ বেশ দূরেই অবস্থিত, তবে কালমিকিতে দুরত্বটা যেন আরও বেড়ে গেছে।
আমরা এগিয়ে চলছি, সামনে অন্তহীন পথ। আমার মনে পড়ল কাজাখস্তানের সেই স্তেপভূমির কথা। খুব করে চাইলাম যেন তাড়াতাড়ি এলিস্তা পৌঁছুতে পারি যাতে সেখানে লাগেজ রেখে এই এলাকায় সূর্যাস্ত দেখতে পারি। এভাবে চলার পর এক সময় পথে ধারে একটি প্যাগোডা চোখে পড়ল, বুঝলাম এলিস্তা খুব দূরে নয়। আমার যে প্যাগডা দেখার খুব অভিজ্ঞতা আছে তা নয়। ছোটবেলায় মায়ের সাথে বুদ্ধ গয়ায় গেছিলাম, তখন কিছু কিছু দেখেছি। আর দেখেছি সিংগাপুরে। ভারত বৌদ্ধ ধর্মের জন্মস্থান হলেও এবং এক সময় বৌদ্ধ ধর্ম সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়লেও আজকাল খুব একটা দেখা যায় না, বাংলাদেশেও কিছু কিছু এলাকা ছাড়া খুব কমই প্যাগোডার দেখা মেলে। প্রথম দর্শনে এলিস্তা আমার কাছে খুবই ছোট কোন শহর বলে মনে হল। আসলে এক সময়ে কালমিকি আর এলিস্তার কথা এত শুনেছি যে এখন কল্পনা আর বাস্তবের সাথে মেলাতে পারছি না। নব্বইয়ের দশকে যে সব রাজনীতিবিদের নাম মানুষের মুখে মুখে ঘুরত এদের মধ্যে কিরসান ইলুমঝিনভ একজন। নেমৎসভ, কিরিয়েঙ্কোর পাশাপাশি ইলুমঝিনভের নামও তখন উচ্চারিত হত। ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণকারী এই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কালমিকির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাশাপাশি ১৯৯৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছেলেন দাবার বিশ্ব সংস্থা ফিদের প্রধান। এসময় এলিস্তায় প্রায়ই বিভিন্ন দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। এমনকি শহরকে দাবার মত করে সাজানো হয়েছিল। সেটা আমরা অবশ্য পরে দেখেছি। অনেক খুঁজে আমরা নির্ধারিত বাসায় এসে পৌঁছুলাম। বিশাল বাসা। আসবাবপত্র সব যেন মনে হয় বিশাল বিশাল মানুষদের জন্য। সব কিছুই বড় বড়। কারুকাজ দেখে মনে হয় যেন রাজপ্রাসাদ। আমার মনে পড়ল বুখারেস্টের কথা। আমি দুই বার স্বল্পকালীন ভ্রমণে সেখানে গেছিলাম। ইনস্টিটিউট বুখারেস্টের বাইরে মাগুরেলে বলে এক শহরে। ওখানেই গেস্ট হাউজ। তবে বার দুই বুখারেস্ট গেছি বেড়াতে। পথে পড়ত রাজপ্রাসাদের মত এক বাড়ি, যেন পুরানো দুর্গ। আমার স্থানীয় সহকর্মী মিহাই বলতেন এটা জিপসিদের বাড়ি। ওরা একটু টাকা পয়সার মালিক হলেই এই ধরণের বাড়ি তৈরি করে। এই বাড়িতেও দেখলাম আধুনিকতার চেয়ে পুরাতনকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
মরুভূমিতে সূর্যাস্ত
বাসায় জিনিসপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম শহরে। কোথায় যাওয়া যায়? প্রথমত খাবার কিনতে হবে। তারপর? আমার চোখে ভাসছিল আসার পথে পেছনে ফেলে আসা স্তেপভূমি। তাই আবার চললাম পেছন পানে। আজ সারাদিন আমরা ওয়ান স্টেপ ফরোয়ার্ড আর ট্যু স্টেপ ব্যাকোয়ার্ড করেই চলছি। আবার পথে পড়ল প্যাগোডা। আরও অনেক দূর এগিয়ে হাতের ডান দিকে দেখি কিছু ঘরবাড়ি। একে ঘরবারি না বলে পরিত্যাক্ত ফার্ম বলাই ভালো। মেঠো পথে গাড়ি চলল। এক সময় আমরা এসে পৌঁছুলাম সেই খামার বাড়ি মত এক জায়গায়। লোকজন নেই। কিছু ছবি তুলে চললাম আরও পেছনে। আসার পথে একটি জায়গা চোখে পড়েছিল, সেটাও কোন ফার্ম মনে হয়। তবে কেন যেন মনে হয়েছিল ওখান থেকে সূর্যাস্ত ভালো দেখা যাবে। তাই হল। আমরা প্রায় সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে চললাম সেখানে। শুধু সূর্য ডুবছে পশ্চিমে আমরা যাচ্ছি পূবে। হ্যাঁ, ধারণা ঠিক ছিল। জনমানব শূন্য এই বিশাল মাঠের ভেতর ছিল কয়েকটি গাছ, দূর থেকে মনে হয় পত্রপল্লবহীন। ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে অস্তগামী সূর্য আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলছিল। আমরাও মনের আনন্দে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওর ছবি তুলছিলাম। এই এক সমস্যা। সব সময়ই মনে হয় শ্রেষ্ঠ ছবিটা হবে পরেরটা। কিন্তু পরেরটা আর তোলা হয় না। ফটোসেশনে ক্লান্ত সূর্য এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা রওনা হই শহরের দিকে। পথে সুপার মার্কেট থেকে কিনে নেই রাতের আর সকালের খাবার। ইতিমধ্যে ঠিক হয়েছে এখানে আমরা পুরো একটা দিন আর দু রাত কাটাব। ফলে আগামীকাল অনেক কিছুই ঘুরে দেখা যাবে। পরশু সকালে আরও একটু ঘুরে পা বাড়াব ভোলগাগ্রাদের পথে।
আস্ত্রাখান থেকে এলিস্তা
https://www.youtube.com/watch?v=zW0Xar20G4Q&t=11s
0 Comments