জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৪ / সালেহা খাতুন

সপরিবারে মেজোমামা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৪ / সালেহা খাতুন 

বিয়ের পরে সাধারণত মেয়েরা ঠিকানা পরিবর্তন করে। কোথাও কোথাও নামের সঙ্গে স্বামীর নামের খণ্ডাংশ জুড়ে নেয়। কিন্তু সালেহা খাতুন আশৈশব সালেহা খাতুন আছে এবং থাকবে। আপাত নিরীহ মেয়েটা তাহলে ভেতরে ভেতরে বেশ জেদি। শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা সে কোনোদিন গ্রহণ করেনি। ওখানকার ভোটার লিস্টে নাম লেখায় নি। এখনও তার পারমানেন্ট অ্যাডড্রেস হাওড়া জেলাতেই। আর হবে নাই বা কেন?

এর পেছনে মজার এক গল্প আছে। বিয়ের দিন শ্বশুর বাড়ির রীতি অনুযায়ী একটি সুদৃশ্য মাটির হাঁড়িতে অর্ধেকটা চাল ভরে শাশুড়িমা পাঠিয়ে ছিলেন ছেলের সঙ্গে। হাঁড়িটি পূর্ণ করে আমার মায়ের পাঠানোর কথা। কিন্তু মা এবং তাঁর জায়েরা জানতেন না নিয়মটি। বরং কিছু না বুঝে তাঁরা হাসাহাসি করেন এবং বলেন আমরাই ভাত রেঁধে খেয়ে নেবো। শ্বশুরবাড়ি যেতে শাশুড়িমা বললেন, “সালেহা সেই হাঁড়িটি কই?” ভবিতব্য খণ্ডানো কি অতোই সোজা! বললাম নিয়মকানুন জানেন না বলে তাঁরা হয়তো সেটি পাঠান নি। শাশুড়িমা বললেন, “যাঃ , তোমার কপালে তাহলে শ্বশুরবাড়ির ভাত আর জুটলো না। ওটি যদি তোমার মা পূর্ণ করে পাঠাতেন, তবেই চিরদিন তুমি এ বাড়ির অন্নে কাটাতে পারতে”। লোকসংস্কার আর লোকবিশ্বাস এমন করেই মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে যায়।

আসলে বিধাতাও মনে হয় চেয়েছিলেন, সালেহা নিজের ভাত নিজে জোগাড় করে নেবে। আর হয়তো তারই জন্য আমাকে নানান সংকটে ফেলে পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন। কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউয়ে নানান দিক থেকে আমাকে প্রশ্নবাণ ছোঁড়া হলো। এসবের উত্তর সন্তোষজনক ভাবে দিতে পারি ঐ আংশিক সময়ের অধ্যাপনা এবং এম.ফিল. - এর ডিসার্টেশান পেপারটির জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানেলে আমার নাম দেখতে পেলাম। 

🍂

আমার থেকে পরে যারা নেট কোয়ালিফাই করে এবং কেউ কেউ আমার থেকে নেট পরীক্ষার জন্য কেমন প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সে বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছিল, তাদের নাম প্যানেলের শুরুর দিকে দেখলাম। হয়তো তাদের ধারাবাহিক অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট আমার থেকে বেটার ছিল। জানিনা। নিজেকে এভাবেই বুঝিয়েছি। দু’হাজার একের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ আমার হাতে কলেজ সার্ভিস কমিশন থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এলো। সুদিন দোরগোড়ায় হাজির। কোন কলেজে জয়েন করতে হবে? লেখা আছে মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়। আনন্দ আর ধরে না। 

কিন্তু সঠিক ঠিকানায় কীভাবে পৌঁছবো? বাবা মেজোমামাকে ডেকে পাঠালেন। মেজোমামা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পোস্ট অফিসে চাকরি করেছেন। সব ঠিকানায় পৌঁছনোর দিশা নিমেষেই দিয়ে দেবেন। বললেন ট্রেনে মেচেদা স্টেশনে নেমে ওখান থেকে ইটাবেড়িয়াগামী বাস ধরে গেলে রাস্তার ধারেই কলেজটি পড়বে। বাবার সঙ্গে চলে গেলাম মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়ে। দিনটা ছিল পনেরো মার্চ দু’হাজার এক সাল। ভেতরে চাপা উত্তেজনা। প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে নিয়ে গেলেন ওখানকার স্টাফরা। সেদিন কলেজে সেমিনার চলছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব অমলেন্দু দে অন্যতম বক্তা। বাবার মাস্টারমশাই। কতদিন পর ছাত্র-শিক্ষকের মিলন ঘটলো। আনন্দ আর ধরে না। 

আগেই বলেছি আমার জীবন হর্ষ আর বিষাদের সমন্বয়ে গড়া। ঐ কলেজে আমার জয়েন করা হলো না। প্রিন্সিপাল হরিপদ মাইতি জানালেন তাঁর কলেজে বাংলার কোনো পোস্ট ফাঁকা নেই। দু’বছর আগেই ঐ পোস্টে একজন জয়েন করেছেন। যে পোস্টে পাঠানো হয়েছিল, সেই পোস্টে আগে অধ্যাপক শ্রুতিনাথ চক্রবর্তী ছিলেন। তিনি ওখান থেকে অন্য কলেজে যাওয়ার পর নন্দিনী ম্যাডাম জয়েন করেছেন। কলেজ সার্ভিস কমিশনের এমনধারা কার্যকলাপে হৃদয় ভেঙে গেল। সে যন্ত্রণা লেখার মতো শব্দ ভাণ্ডার আমার নেই। প্রিন্সিপাল হরিপদবাবু বললেন, “ মা আমি অত্যন্ত দুঃখিত। তোমাকে আমার কলেজে নিতে পারলাম না। আমি অফিশিয়াল চিঠি দিয়ে কলেজ সার্ভিস কমিশনকে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে দিচ্ছি”।

চাকরি হাতের মুঠোয় এসেও ধরা দিল না। চোখে জল এসেছিল কিনা তাও নেই মনে। বাবা আমার সঙ্গে সব জায়গায় যান না কিন্তু এবার আমার সঙ্গে ছিলেন। আশ্চর্য হয়ে ভাবি জীবন থেকে যখনই পালাতে চেয়েছি বাবা হাতটা শক্ত করে ধরেছেন। ওই রকম ভয়ংকর সময় আমার জীবনে দুবার এসেছিল। বাবার পাশে থাকাটা আশ্চর্যজনক ভাবে দুবারই ঘটেছিল। মুগবেড়িয়া কলেজে সবাই অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করেছিলেন আমার আর বাবার সঙ্গে। অমলেন্দু দে বাবাকে বললেন, “ওদুদ তুমি চিন্তা করো না, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে”। বাংলার বিভাগীয় প্রধান স্বপনবাবু বললেন, “নতুন কোনো কলেজে জয়েন করে আমাকে জানিয়ে দিও”। ফোন নম্বর দিলেন।
মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহাবিদ্যালয়ের সেই চিঠি

 কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। রাস্তার অপর প্রান্তে দাঁড়ালাম। কলেজের সুদৃশ্য গেট দু’চোখ ভরে দেখে নিলাম। আর কোনোদিন ওখানে যাওয়া হয়নি। ফাইলে এখনও কলেজ সার্ভিস কমিশনের সেই রেকমেণ্ডেশন লেটারটি সংরক্ষিত আছে। 
বাবাকে কঠিন হৃদয়ের মানুষ বলেই জানি। ছাত্রদরদী মানুষটির নরম হৃদয়ের পরিচয় সেদিন পেলাম। প্রকৃত অর্থে আমি বাবার ছাত্রীও তো বটে। আমার অনেক অ্যাপ্লিকেশনের ড্রাফট তিনিই করে দিয়েছিলেন। সে লেখাও আমার কাছে আছে। এ প্রসঙ্গে একটি মজার কথা বলি, আমার দাদুর কাছে মায়ের একমাত্র ডিম্যান্ড ছিল ইংরেজি জানা পাত্র ছাড়া তিনি বিয়ে করবেন না। পাত্ররূপে বাবা উৎরে গিয়েছিলেন। 

মূল প্রসঙ্গে ফিরি। মুগবেড়িয়া থেকে ফেরার পথে হাতটা শক্ত করে ধরে বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন। বললেন, “এখনি ভেঙে পড়ো না। তোমাকে অনেকদূর যেতে হবে”। লড়াই আমার জারি রইলো। কলেজ সার্ভিস কমিশনের অফিসে গিয়ে মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর মহা বিদ্যালয়ের দেওয়া চিঠিটা জমা দিলাম।

বলে না বিপদ যখন আসে চারদিক থেকে হুড়মুড় করে আসে। কানোরিয়া তখনো বন্ধ। এদিকে যে অর্থটুকু পার্টটাইম অধ্যাপনার জন্য পেতাম তাও বন্ধ হয়ে গেল। কেননা সি এস সির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েছি বলে আমার জায়গায় অন্য আর একজনকে নিয়োগ করা হয়। খাবো কী? একূল অকূল দুকূল গেল। দর্শনের আর এক পার্টটাইম অধ্যাপক অপর্ণাদি জানতো আমার পরিস্থিতি। সে প্রিন্সিপাল ড. কালাচাঁদ সাহাকে সবটা খুলে বলে। তিনি সে সময় আবার আমাকে ফিরিয়ে আনেন প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের আংশিক সময়ের অধ্যাপনায়।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments