জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায়
           
নির্মল বর্মন

 জাতীয় স্তরের কবি ও  প্রথম সারির নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সুযোগ্য ছেলে কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় একাধারে বিশিষ্ট কবি, অন্যান্য ধারায় - গায়ক ও  সুরকার তো বটেই । বিশিষ্ট গায়ক হওয়া সত্ত্বেও বিচিত্র, বহুমুখী প্রতিভা স্বাক্ষরের অধিকারী দিলীপ কুমার রায়।
কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় এর বেশ কয়েকটি উপন্যাস বাংলা র সাহিত্য জগতে কৃতিত্বের সুনিপুণ পরিচয় বহন‌ করে চলেছে।
         কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায়-এর প্রথম উপন্যাস ''মনের পরশ'' (১৯২৬)। 
''মনের পরশ''  উপন্যাসে  ইওরোপীয় দেশের  বিভিন্ন স্বভাব ও মানসিকতার নরনারীর দৃষ্টিভঙ্গি, সহানুভূতি ও ভাবনা সমানুপাতিক চিন্তায় স্পর্শকাতর আকাঙ্খা বর্ণিত। সংগীতশিল্পী হিসেবে সামাজিক প্রেক্ষিতে গানকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই কেম্ব্রিজ-প্রবাসী গান প্রশিক্ষণার্থী পল্লব, মি.টমাস, মিসেস নর্টন,  মি. স্মিথ ইত্যাদি নানা ভাবনার ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন। আনন্দ উপভোগ করেছেন এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এছাড়াও ম্যাডাম রিশার মহোদয়ের সান্নিধ্য পল্লব লাভ করেছিল। ম্যাডামের সংস্পর্শে পল্লব "নির্মম নীতিকাঠিন্য" পরিহার করে মুক্তির সুযোগ সন্ধান উপলব্ধি করতে পেরেছেন। উপন্যাস'টি একটু রহস্যে ঘেরা তর্ক প্রাধান্য থাকার জন্য উপন্যাস  রসবস্তু সংগত সমন্বিত যুথবদ্ধ হতে পারেনি বলা যেতেই পারে।

🍂

''রঙের পরশ'' (১৯৩৪) উপন্যাসে ' অতনু ও দীপা'র প্রেম জটিল রহস্যময় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দর্শকদরবারে উপস্থাপিত হওয়ায় বাংলার সারস্বত সমাজে শোরগোল পড়ে যায়। বিষয়বস্তুতে "পরিবেশ সৃষ্টিতে, আবেগ প্রকাশে, প্রেমের স্মৃতিরোমন্থনে, বিষাদ- দীর্ঘশ্বাস ও হাস্য-পরিহাস সৃষ্টি" তে কথাসাহিত্যিক পারদর্শিতার সুনিপুণ পরিচয় বহন করেছেন। উপন্যাসে ভিন্ন রেখায় অবস্থিত তিন নায়িকা রুভা ,  দীপা,  ও লরা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত।
স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী হলেও কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতিতে বিস্ময়াবিষ্ট । কথাকার দিলীপ কুমার রায় এর 'প্রেম-রহস্য ও রসমূলক উপন্যাসদ্বয়  :-
 ''বহুবল্লভ'' (১৯৩৫) ও ''দুধারা'' (১৯৩৫)। 
কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় এর "বহুবল্লভ" উপন্যাসে " প্রেমের সূক্ষ্ম, ব্যাপক ও বহুমুখী বিশ্লেষণ স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত" প্রেক্ষিতে প্রস্ফুটিত। রায় সাহেবের ঔপন্যাসিক কথাবার্তায় স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম কারণ তাঁর  অসাধারণ আন্তরিক অন্তদৃষ্টি ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভবধর্মিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর ''বহুবল্লভ'' উপন্যাসে  ডায়েনা ও শ্রীলা'র  বিপরীত আকর্ষণের মধ্য দিয়ে প্রদীপ এর  চলচ্চিত্ততা সুকৌশলে বর্ণিত ।  ডায়েনা ও শ্রীলা'র পরস্পর বিপরীত প্রকৃতি ও মুখী। বস্তুতঃ শ্রীলা 'অকৃতজ্ঞ, অভিমানিনী' কিন্তু ডায়েনা সাধারণত স্থির শান্ত ।  প্রদীপের প্রণয়াকাঙ্খিণী হওয়া সত্ত্বেও প্রদীপের কাছে দুজনেই পরিত্যক্ত ও সান্নিধ্য বঞ্চিত হওয়ার একটাই কারণ একনিষ্ঠতার অভাব। 
       কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় এর "দুধারা'' উপন্যাস আসলে 'দ্বন্দ্বময় রহস্যময় প্রেমের রূপ' যা বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের আকর্ষণ করেছে।
বস্তুতঃ তার্কিকতা মূল লক্ষ্য হলেও ফাঁকে ফাঁকে করুণ হৃদয়াবেগও করুন রস সঞ্চারিত ও পরিবেশিত হয়েছে। প্রেমের অগ্নিগর্ভ আলোড়নের ছবি বাস্তবরেখায় চিত্রিত।
কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায় এর অন্যান্য উপন্যাসগুলি :- ''দোলা'' (দুই খণ্ড, ১৯৩৫-৩৬), ''তরঙ্গ রোধিবে কে'' (দুই খণ্ড, ১৯৩৮) মর্যাদাসম্পন্ন উপন্যাস।

ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক হিসেবে দিলীপকুমারের সার্বজনীন গুণাবলী গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো:-
১.প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অন্তরঙ্গ মিলনায়ত সৃষ্টি।  
২.প্রেমে কি একনিষ্ঠতা কাম্য ? বা অপরিহার্য অঙ্গ  কাম্য?বা এ বিষয়ে সাহিত্যিকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত:- " বহুমুখী প্রেম সমর্থনযোগ্য, তা হৃহৃদয়ের দৈন্য নয়, বরং তা ঐশ্বর্য"।  ৩.দিলীপকুমারের সতীত্বের মূল্যায়ন সতত পরিবর্তনশীল কিনা ? এ প্রসঙ্গে ঔপন্যাসিক স্বয়ং বলেছেন -
       "সতীত্বের গৌরব প্রেমের স্থায়িত্বের মধ্যে নিহিত নয়। কেননা প্রেম স্থায়ী হয় বন্ধুত্ব বা মনের মিলের জন্য, কিন্তু বন্ধুত্ব প্রেমের অপরিহার্য অঙ্গ নয়"।
বর্তমান সময় ও সমাজে 'বন্ধু' শব্দটি বিরাট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও 'বন্ধুত্ব ' কখনোই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রেমের গূঢ় ভাবার্থময় অঙ্গ হতেই পারে না।
৪. ''বস্তুত: "চিন্তাশীলতা ও নিবিড় রসোপলব্ধির যুগপৎ মিলন'' দিলীপ কুমারের রচনা প্রয়াসকে  দিয়েছে সুসামঞ্জস্য চমৎকারিত্ব। 
৫ দিলীপ কুমারের  সংস্কৃতিমনস্কতা, উদারতা ও আধুনিক জনপ্রিয় শব্দ বন্ধুত্বতা উপন্যাসের আবেদনকে  সমৃদ্ধ করেছে।
দিলীপ কুমার রায় কবি , কথাসাহিত্যিক,সুগায়ক ও সমাজমনস্ক গবেষক হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের আন্তরিকতায় সেভাবে স্থান লাভ করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। আলোড়ন সৃষ্টিকারী বন্ধু ও প্রেম নিয়ে মারত্মক গবেষণা করলেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক ক্ষণস্থায়ী দেখানোর চেষ্টা করেছেন বটে। তথাপি তথ্যপ্রযুক্তি ও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক দিলীপ কুমার রায়।

Post a Comment

1 Comments