প্রবন্ধ।।
মানুষের অপরাধপ্রবণ মন ও মানসিকতা
সন্দীপ দত্ত
মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে কেন? এই প্রশ্নটা আজকের এই বর্তমান পরিস্থিতে দাঁড়িয়ে প্রায় প্রত্যেকের ঠোঁটে যেন লেগেই আছে। প্রশ্ন রাখাটাই স্বাভাবিক। ছোট বড় প্রতিটা অপরাধই সমাজের ভিতটাকে নাড়িয়ে দেয়। সমাজের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। বাবা মা'রা আতঙ্কে গুটিয়ে যান তাঁদের সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে। মানুষ হতে গিয়ে তাঁদের নিজেদের অজান্তে আস্তে আস্তে সে কোনও অপরাধী হয়ে উঠছে না তো! কেন এমন হয়?
মানুষের বেড়ে ওঠার পর্যায়ক্রমিক কাল হিসেবে শৈশব থেকেই যেহেতু শুরু হয়,তাই শিশুদের মস্তিষ্কের প্রসঙ্গে কিছু বলা যাক। মস্তিষ্কের আলফা ও বিটা ওয়েভের মধ্যে বিটা ওয়েভ নির্দেশ করে স্বাভাবিক সজীব কাজকর্ম। টেনশনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে বিটা ওয়েভ। আর আলফা ওয়েভ মস্তিষ্ককে বিশ্রাম নিতে বলে। সমীক্ষায় দেখা গেছে মস্তিষ্কে বিটা ওয়েভের কার্যক্ষমতা যখন ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করে,শিশু থেকে কিশোর মনের দিক থেকে খানিক খিটখিটে হয়ে যায়। মেজাজ হারিয়ে ফেলে যখন তখন। বাবা মা,ভাই বোনদের সঙ্গে রাগ দেখিয়ে কথা বলে। বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে অকারণে তর্ক বাধিয়ে দেয়। মূলত, মোবাইল বা টেলিভিশনে কাটুর্ন,ভিডিও গেম নির্ভর জীবনযাপনে অত্যাধিক পরিমাণে অভ্যস্ত থেকে তাদের হঠাৎ করে সরিয়ে নিয়ে আসা হলে শিশু কিশোরদের মনের এই গতিপ্রকৃতি দেখা দেয়। ছোটখাটো অপরাধের সেখান থেকেই জন্ম। দেখা যায়,উত্তেজিত হয়ে খাবার থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে শিশু। শিশুর বয়েস যদি আর একটু বেশি হয়,ধরা যাক বারো তেরো চোদ্দ,সে রেগে গিয়ে ভাই বা বোনের খেলার জিনিসগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে। এসব আরও অনেক কিছু ধরা পড়ে। কিন্তু বাবা মায়েরা ওসব নিয়ে ভাবেন না। মনে করেন,নিছক ছেলেমানুষি রাগ। তাঁদের যাপনশৈলি এক্ষেত্রে অনেকখানি দায়ী। তাঁরা চটজলদি অনেককিছু পেতে চান। পাড়াপ্রতিবেশীর অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করে বসেন। সুতরাং,মাতৃগর্ভ যতখানি আমাদের শিশুদের পক্ষে সুরক্ষিত,সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই সেই সুরক্ষার বলয় ভেঙে আমরা অভিভাবকেরাই তাদের চাপের মুখে ফেলি। বুঝতে শেখার বয়েস হল কি হল না,তাদের নরম মনটাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিই প্রতিযোগিতা নামক দম বন্ধ হয়ে আসা ভয়ংকর এক পৃথিবীর সামনে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় মনের ওপর নানা আঁচড়। ওঠা শুরু হয় ঘাতপ্রতিঘাতের তরঙ্গ। 'তুমি এই সামান্য বানানটা ভুল করলে কেন?' কিংবা,'পাশের বাড়ির অমুক কত ভাল। স্কুলে মিসের কাছে কোনও কমপ্লেন নেই। তুমি অমন হতে পারো না কেন?' সমীক্ষায় দেখা গেছে,হিংসের শুরু সেখাই থেকে। জীবনধারণ করতে গেলে মানুষকে চাপ নিতেই হবে। এটা যেমন স্বাভাবিক,সেই সঙ্গে আমাদের এটাও ভুললে চলবে না,আঙ্গুল তুলে অন্যের সঙ্গে তুলনা যেন বাড়াবাড়ি না হয়ে যায়। গবেষকরা দেখেছেন পৃথিবীতে কিশোর খুনির পেছনে এটা একটা বড় কারণ। উচ্চবিত্ত,উচ্চমধ্যবিত্তদের পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা কোনও অপরাধীর কেসহিস্ট্রীতে তাই ধরা পড়ে। সমাজের নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন শিশু কিশোরদের এই চাপটাই হয়ে ওঠে না পাওয়ার কষ্ট,অর্থাৎ অনটন। বাবা মা'র ভ্রূক্ষেপ নেই,কোলে বসে স্নেহ খাওয়ার অবকাশ নেই,তাই বাইরের জগতের প্রতি টান বাড়ে তাদের। পথে কুড়িয়ে পাওয়া ফেলে দেওয়া বিড়ির অর্ধেক অংশ মুখে নেয়। মায়ের কাছে চকোলেট খাওয়ার নাম করে খুচরো টাকা নিয়ে ফেবিকল কেনে। কেনে নেলপালিশ। ওই গন্ধ নিতে নিতে একদিন হেরোইনের প্যাকেটের গন্ধ নেই। আস্তে আস্তে প্রবেশ করে অন্কারে।
সমাজ সংশোধনের কথায় এলে যে সহযোগিতার প্রসঙ্গটা ওঠে,সেখানেই আমরা অভিভাবকেরা ব্যর্থ। কিশোরবয়েসে যৌনশিক্ষা না দিয়ে কাম আর লালসাকে বাড়তে দিই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাটায় নারীরা আজও যে কত অসহায়,ভয়ে ভয়ে থাকে,চারদিকের নানা ঘটনাই তার প্রমাণ।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের ওপর ভিত্তি করে ইটালির অপরাধবিজ্ঞানী সেজারে লমব্রোসো উনিশ শতকে তাঁর অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে বলেন,অপরাধীরা মানব বিবর্তনের পেছনে পড়ে থাকে। তাদের মগজের সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে না,বা বিকৃতভাবে ঘটে। তাদের মাথার খুলির গড়ন উদ্ভট এবং শরীরে ব্যথা সহ্য করবার ক্ষমতা অসীম। গবেষণায় দেখা গেছে খুনিদের নাকের গঠন খোঁচানো পাখির ঠোঁটের মতো। চোর ডাকাতদের নাক চ্যাপ্টা। ধর্ষকদের ঠোঁট ভারী এবং মোটা। যদিও পরবর্তীকালে লমব্রোসোর এই ব্যাখ্যা বাতিল হয়েছে। তবে অপরাধের জৈবিক ব্যাখ্যা একেবারে খারিজ করা যায়নি।
🍂
১৯৭০ য়ের দশকে রবার্ট মার্টন নামে এক সমাজতাত্ত্বিক বললেন,সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে জীবন যখন খাপ খায় না,মানুষ তখন অপরাধজগতে আসে।
মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের থিওরি প্রসঙ্গে বলেন, মানুষের ব্যক্তিত্ব মূলত দুটি ধারায় বিভক্ত। প্রথম ধারাটি হল অন্তর্মুখী ও বর্হিমুখী এবং দ্বিতীয় ধারাটি হল স্থির ও অস্থির। অপরাধীদের মানসিক চরিত্র হয় বর্হিমুখী এবং অস্থির অর্থাৎ স্নায়ুরোগগ্রস্ত।
একশ্রেণির সমাজতাত্ত্বিকবিদরা মনে করেন,আইনি শাস্তিই মানুষকে অপরাধজগতের দিকে বেশি করে ঠেলে দেয়। অপরাধীর গায়ে একটা বিশ্রী তকমা তাকে পাকাপাকিভাবে আরও নিষ্ঠুর অপরাধী করে তোলে। তাদের মনে এটাই গেঁথে যায়,শুদ্ধিকরণের আর যখন কোনও রাস্তা নেই,তাই আবার একটা অপরাধের দিকে এগিয়ে যায়।
সমীক্ষায় জানা গেছে,জেল খাটে সমাজের দরিদ্রশ্রেণির মানুষগুলো। বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। প্রশ্ন উঠতে পারে,তাহলে সমাজের ধনীরা কি অপরাধ করে না? নিশ্চয়ই করে। কিন্তু তারা দক্ষ উকিল নিয়োগ করে কিংবা মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে সমাজে নিজের প্রভাব খাটিয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। ছাড়া পাওয়া মানে আবার সাহস বেড়ে যাওয়া। পকেটে যখন অর্থ আছে,সুতরাং আবার একটা অপরাধ করাই যায়।
0 Comments