জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—রাশিয়াবারো মাসের গল্প/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—রাশিয়া
বারো মাসের গল্প
চিন্ময় দাশ


দুটো মেয়েকে নিয়ে এক বিধবার সংসার। তার নিজের মেয়েটির নাম হেলেনা। আর, মারুক্লা হোল তার স্বামীর প্রথম বউয়ের মেয়ে। মা-বাপ মরা মারুক্লার উপর খবরদারি চালায় মা-মেয়ে দুজনেই। কী বদখত লম্বা একখানা নাম রে তোর! মারু নামে ডাকব আমরা। মা মেয়ে মারু নামেই ডাকে মেয়েটাকে।  
মারু দেখতে যতো সুন্দর, হেলেনা ঠিক ততটাই কুরূপা। বয়স যতো বাড়ছে, ততোই সুন্দরী হয়ে উঠছে মারু। আর, হেলেনা ততোটাই অসুন্দর। 
তাতেই জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে মা মেয়ে। মেয়েটাকে ভয়াণক অত্যাচার করে তারা। সংসারের যতো রকম কাজ—সবই চাপায় মারুর উপর। 
মারু বুঝতে পারে না, কী তার দোষ। কেন দুজনেই বিরূপ তার উপর। কতো রকমের কাজ থাকে একটা সংসারে—ঘরদোর সাফসুতরো করা, রান্নাবান্না, বাসনপত্র মেজে তোলা, কাপড় কাচা, সেলাই-ফোঁড়াই। কাজের কি শেষ আছে? গাই দোয়া, গরুর জন্য ঘাস কেটে আনা, জ্বালানি জোগাড় করা—সব করতে হয় তাকে, সবই। 
একাই সব কিছু করে মারু । মা-মেয়ে বসে থাকে আরাম করে। কুটোটিও নাড়ে না তারা। কেবল হুকুমের পর হুকুম করে যায়। হেলেনা তো পটের বিবি সেজে বসে থাকে। জমকালো পোষাক চাই। মিষ্টি সুগন্ধি চাই। বায়নাক্কার শেষ নাই তার।
তবুও কোন কিছুতেই আপত্তি করে না মারু। মুখ ভার নাই কোনও কিছুতেই। একেবারে একটা ভেড়ার মতো স্বভাব তার। সব সয়ে যায় মুখ বুজে। 
কিন্তু মা মেয়ের নির্যাতনের খামতি আই। দিন দিন রূপসী হয়ে উঠছে মারু। হেলেনা যত বড় হচ্ছে, ততই যেন কদাকার হয়ে উঠছে মেয়েটা। তাতে রাগ, হিংসা, অত্যাচার সব কিছুরই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দুজনের।
মার মনের ভাবনা, এ মেয়ে সংসারে থাকলে, হেলেনার বিয়ে-সাদি হবে না কোন দিন। দিন যায়, অত্যাচারের মাত্রাও বাড়ে ক্রমশ। এতো খাটায়, কিন্তু ভালো করে দু,বেলা দুটো রুটিও দেয় না মেয়েটাকে। 
তখন শীতের মাঝামাঝি। একদিন হেলেনা মারুকে ডেকে বলল—পাহাড়ে যা। বেগুনি ফুল এনে দে আমাকে। গাউনে লাগাতে হবে। আর শোন, ফুল যেন টাটকা থাকে। আর গন্ধও থাকে যেন।
মারু বলল—সে কী, বোন? এই ভরা শীতে বেগুনি ফুল! কেউ শুনেছে কোন দিন? 
হেলেনা চিৎকার করে উঠল—ওরে হতচ্ছাড়ি! সাহস তো কম নয় তোর? মুখের উপর তর্ক করছিস? একটা কথাও নয় আর। এখুনি গিয়ে পাহাড়ে চড়। ফুল না নিয়ে ফিরলে, মেরেই ফেলব তোকে। এই বলে রাখলাম।
বরফ পড়ছে বাইরে। মা-মেয়ে দুজনে মিলে ধাক্কা মেরে বের করে দিল মারুকে।
চোখের জল মুছতে মুছতে পাহাড়ে চড়তে লাগল মেয়েটা।
পুরু বরফে মোড়া চারদিক। পায়ের পাতা ডুবে যাচ্ছে, এত বরফ। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। জনমনিষ্যির দেখা নাই কোথাও। এক সময় বনের ভিতর পথও হারিয়ে গেল মারুর। খিদেও লেগেছে খুব। ঠক ঠক করে কাঁপছে ঠান্ডার চোটে। যীশুকে ডাকতে লাগল বেচারি—মেরেই ফেলো আমাকে, প্রভু। আর পারছি না। 
প্রভুরও দয়া হোল তার দুর্দশায়। তখনই কিছুটা উপরে একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ল মারুর। এক্টু ভরসা এল মনে। আলোটাকে খুঁজে খঁজে, পাহাড়ের একেবারে মাথায় উঠে এল মেয়েটা। 
সেখানে বড়সড় একটা আগুনের কুণ্ড। কুণ্ডটাকে বড় বড় বারোটা পাথরের চাঁই গোল করে ঘেরা। চারটে দলে ভাগ হয়ে, বারোজন অদ্ভূত জীব বসে আছে, বারোটা পাথরের মাথায়।
প্রথম তিনজনের মাথায় পাকা চুল। দাড়ি-গোঁফও তাই। যেন বরফের স্তুপ ডাঁই করে রাখা আছে মাথা-মুখ জুড়ে। পরের তিনজনের মাথার চুল কাঁচা পাকা। বুড়ো হতে দেরি আছে তাদের। তার পরের তিন জন যুবক বয়সী। দেখতেও ভারি সুন্দর তারা। শেষের তিনজন সবে যুবক হয়ে উঠছে। বারো জনের কারও মুখে কথা নাই। নীরবেই বসে আছে তারা। 
বারোজনকে এই অবস্থায় দেখে,দেখে, প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল মেয়েটা। একটু বাদে সাহস ফিরে আসতে লাগল মনে। সে জানে না, আসলে এই বারো জন হোল বছরের বারোটা মাস।  
ঠাণ্ডায় শরীর জমে আসছে মারুর। একেবারে বড় পাথরে প্রথমে বসে আছে যে, দেখেই বোঝা যায়, সে সবার চেয়ে বড়। তার কাছে গিয়ে বলল— তোমরা নিশ্চয় স্বর্গের লোক। তা, দয়া করে তোমাদের এই আগুন একটু পোয়াতে দেবে আমাকে? ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি একেবারে। 
যাকে বলল, সে হচ্ছে জানুয়ারি। বছরের প্রথম মাস সে। বারো জনের দলটাতে সে-ই হোল বড়। সে-ই মুখিয়া। জানুয়ারি বলল—কেন দেবো না গো? আগুন কি ফুরিয়ে যাবে নাকি তাতে? পোয়াও না।
মারু তাড়াতাড়ি বসে গেল আগুন পোয়াতে। কী আরাম, কী আরাম! যেন জীবনটাই ফিরে আসছে একটু একটু করে। জানুয়ারি বলল—তা, এই ঠাণ্ডায় তুমি এখানে কেন এসেছ বলো তো? কিসের খোঁজে?
--বেগুনি ফুল খুঁজতে এসেছি আমি।
--এখন কি বেগুনি ফুলের সময়, বাছা? দেখছ না, চার দিক জুড়ে কেবল বরফ, আর বরফ! বেগুনি ফুল ফোটার সময় তো এখন নয়।
মারু বলল—জানি তো। কিন্তু আমার সৎ মা আর বোন জোর করে পাঠিয়েছে আমাকে। ফুল না নিয়ে গেলে, মেরেই ফেলবে আমাকে। সেটাও বলে দিয়েছে। পারো যদি, দয়া করে ফুলের হদিস বলে দাও আমাকে।  
হাতে একটা ছড়ি ছিল জানুয়ারির। উঠে দাঁড়িয়ে, তার দলের শেষ জনের কাছে গিয়ে বলল—ভাই, মার্চ! এই ছড়িটা নিয়ে যাও। ফুলের জোগাড় করে দাও মেয়েটিকে। 
মার্চ উঠে, আগুনের কুণ্ডের উপর একবার ঘুরিয়ে নিল ছড়িটাকে। অমনি আগুনের বড় একটা শিখা জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। আকাশমুখো হয়ে, আগুন ছড়িয়ে পড়তে লাগল চার দিকে। তার তাত লেগে, বরফ গলে যেতে লাগল। ঝোপঝাড়ে গাছপালায় পাতা গজিয়ে উঠল। ঘাসের মাঠ ফুটে উঠল সবুজ রঙে। 
এখন যেন বসন্তকাল। রঙ ফিরে এলো ফ্যাকাশে হলুদ হয়ে যাওয়া ফুলগুলোতে। মাঠ জুড়ে কেবল বেগুনি ফুলের মেলা। মার্চ বলল—যাও গো, মেয়ে। যত চাও ফুল তুলে নাও। তবে তাড়াতাড়ি কোর। আগুনের তাত তো বেশি সময় থাকবে না।
মারুর মুখে হাসি। মুঠো ভরা ফুল নিয়ে ফিরে চলল মেয়েটা। তার আগে, সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে ভুলে গেল না। 
ফুল হাতে বাড়ি ফিরেছে মারু। তা দেখে, তার সৎমা আর বোন তো অবাক। কী করে সম্ভব হোল এটা। জিজ্ঞেস করল—আরে, কোথায় পেলি তুই এই ফুল?
--কেন, পাহাড়ের মাথায়। কত ফুলই তো ফুটে আছে। অজানা অচেনা বারো জন উপকারীর কথা খোলসা করল না সে। 
পরদিন হেলেনা বলল—আজ যা। স্ট্রবেরি খেতে মন চাইছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে নিয়ে আয়। তবে দেখিস, পাকা আর মিষ্টি হওয়া চাই কিন্তু। নইলে বিপদে পড়বি। 
মারু তো আকাশ থেকে পড়ল—স্ট্রবেরি? এখন এই শীতে? এমন উদ্ভট কথা শুনেছে কখনো কেউ? 
--আবার মুখের ওপর কথা। হেলেনা মুখ ঝামটে উঠল—কালকের কথা মনে নাই বুঝি? 
আবার মা-মেয়ে ধাক্কা মেরে, বরফের মধ্যে বের করে দিল তাকে। আবার ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পাহাড়ের মাথায় পৌঁছেছে সে। একই ভঙ্গীতে গোল করে আগুনকে ঘিরে বসে আছে বারো জন।
মারু বলল—ঠাণ্ডার মারা পড়তে বসেছি। একটু আগুন পোয়াতে দেবে তোমাদের? 
জানুয়ারি মুখ তুলে দেখল মেয়েটাকে। কাঁপছে থর-থর করে। বলল—আজ আবার এসেছ বিপদের মধ্যে? আজ আবার কী চাই তোমার? 
--স্ট্রবেরি নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে আজ। 
--এই ভরা বরফের দিনে স্ট্রবেরি! এখন তার সময় নাকি? জানুয়ারি তো অবাক।
মারু বলল—সে তো আমিও জানি গো। কিন্তু তারা মানলে তো। না নিয়ে গেলে, মেরেই ফেলবে আমাকে। কিছু একটা উপায় করে দাও তোমরা। 
জানুয়ারি উঠে দাঁড়াল। দ্বিতীয় সারির শেষ জন বসে আছে জানুয়ারির একেবারে মুখোমুখি। জানুয়ারি বলল—ভাই জুন, আজকের কাজের ভারটা তুমি নাও। 
জুন এক কথায় রাজি। জানুয়ারির হাত থেকে ছড়িটা নিয়ে, এক পাক ঘুরিয়ে নিল আগুনের উপর। আবার আগুন জ্বলে উঠল বড় বড় শিখায়। তার তাত লেগে বরফ গলে যেতে লাগল। মাঠ-ঘাট পাহাড়-পর্বত ভরে উঠল সবুজ নীলিমায়। গাছেরা সেজে উঠল পাতার সাজে। পাখিরা গান গাইতে শুরু করল। ফুলে ফলে ভরে উঠল চার দিক। যেন এখন গ্রীষ্মকাল।
দেখতে না দেখতে রঙ বদলাতে লাগল ফলেদের। তারা পাকতে শুরু করেছে এখন।
পেকে উঠেছে স্ট্রবেরিও। সারা মাঠ জুড়ে মেলা বসে গিয়েছে তাদের। যেন রক্তের মতো টকটকে লাল রঙের কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে কেউ সারা পাহাড় জুড়ে।  
জুন বলল—যত চাই, নিয়ে নাও পাকা স্ট্রবেরি। তবে, তাড়াতাড়ি করো।
ভারি আনন্দ মারুর মনে। অ্যাপ্রণ ভর্তি পাকা ফল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে এল সে। 
মা-মেয়ের তো নিজেদের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। তারা চেঁচিয়ে উঠল—কোথায় পেলি তুই পাকা স্ট্রবেরি? 
– কেন? পাকা ফল তো বলতে গেলে, বিছিয়ে আছে পাহাড়ের মাথায়। তুলে নিয়ে এলাম। 
আজও বারোজনের কথা বলল না তাদের। কয়েকটা ফল মায়ের হাতে দিয়ে, বাকি নিজেই খেয়ে ফেলল হেলেনা। একটা ফলও তুলে দিল না মারুর হাতে। করুণ মুখ করে সেদিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। 
পাকা স্ট্রবেরি খেয়ে লোভ বেড়ে গেল হেলেনার। পরদিন পাকা আপেল আনবার হুকুম হোল মারুক্লার উপর। সে বলল—এই বরফের দিনে, একটা পাতাও নাই গাছে। পাকা ফল কোথায় পাওয়া যাবে? 
চিৎকার কর উঠল হেলেনা—যত বাজে বকবক। আর মুখে মুখে তর্ক করবার বদ অভ্যাস। তাড়াতাড়ি রওণা দে। নইলে … ।
সৎমা এসে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে দিল মেয়েটাকে। কপাটও বন্ধ করে দিয়েছে। তার শব্দ কানে এলো মারুর। 
🍂
আবার পাহাড়ে উঠেছে মেয়েটা। শীতে জমে যাওয়ার জোগাড়। সেদিনও নীরবে বসে আছে বারোজন। মেয়েটা আজও একটু আগুন পোয়াতে চাইল। জানুয়ারি মুখ তুলে দেখল মেয়েটাকে—আবার এসেছ তুমি? আজ কী চাই তোমার?
--পাকা আপেল চেয়েছে আজ।
--বরফ পড়ছে এখন। এটা কি পাকা আপেলের সময়, বাছা? 
--সে তো জানি। কিন্তু খালি হাতে ফিরে গেলে, মেরেই ফেলবে যে আমাকে। বলে দিয়েছে দুজনে।
তৃতীয় দলের শেষ জনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল জানুয়ারি—ভাই সেপ্টেম্বর। তুমি কি কাজটা করে দেবে? 
--অবশ্যই। বলে সেপ্টেম্বর এগিয়ে এল। ছড়িটা ঘোরাতেই আগুনের শিখা জ্বলে উঠল আবার। বরফ গলে যাচ্ছে। পাতা গজিয়ে উঠছে গাছে গাছে। শরতের ফুল দেখা গেল কয়েকটা গাছে। ফল ধরল তাতে। পেকেও উঠল সেগুলো।
কিন্তু আপেল কোথায়? এদিক ওদিক তাকিয়ে, অনেক উঁচুতে একটা গাছ চোখে পড়ল মারুর। কয়েকটা পাকা ফলও আছে গাছটাতে। 
সেপ্টেম্বর বলল—তাড়াতাড়ি করো। দেরি করলে লাভ হবে না।
কিন্তু অতো উঁচু গাছে উঠবে কী করে সে? গাছটা ধরে ঝাঁকাতে লাগল মেয়েটা। তাতে একটা ফল পড়ল। একটু বাদে আর একটা। দু’হাতে দুটো আপেল কুড়িয়েছে মারু। সেপ্টেম্বর বলল—ওতেই হবে। চলো এবার। 
দু’হাতে দুটো পাকা ফল। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে, বাড়ির পথ ধরল মেয়ে।
পাকা আপেল দেখে, হেলেনার খুশি ধরে না। বলল—কোথায় পেলি তুই ফলগুলো?
--কেন, পাহাড়ের মাথায়। গাছে গাছে পাকা ফল সেখানে। 
--তাহলে, মাত্র দুটো কেন তোর হাতে? নির্ঘাত বাকিগুলো রাস্তায় খেয়ে ফেলেছিস?
--সে কী বলছ তুমি? মারু ভয় পেয়ে বলল—দিব্বি করে বলছি, খাওয়া তো দূর। চেখেও দেখিনি আমি।
-চেখেও দেখিনি আমি। মুখ ভেঙচে উঠল হেলেনা। তাহলে মাত্র দুটো নিয়ে ফিরে এলি কেন?
মারু বলল—কী করব আমি? গুণে গুণে বারোজন রাখাল বসে থাকে যে সেখানে। ভেড়া চরায় তারা। তারাই তো মানা করল আমাকে। আর নিতে দিল না। গাছ ঝাঁকাতে দুটো আপেল পড়েছিল। বলল—দুটো নিয়েছিস। এই যথেষ্ট। এবার বাড়ি ফিরে যা। তাড়িয়ে দিল আমাকে যে।
কথা বাড়াল না হেলেনা। মাকে ডেকে বলল—শুনেছ তো, মা? গাছে গাছে আপেল পেকে আছে। আমার ক্লোকটা দাও। আমি যাচ্ছি। রাখাল-টাখাল কারও কথা শুনব না আমি। সব আপেল পেড়ে আনব গাছ মুড়িয়ে। একটা থলে দাও তুমি আমাকে।
গরম জামাকাপড়ে সারা শরীর ঢেকেছে। টুপি পরেছে বড় দেখে। মুখও আড়াল হয়েছে তাতে। পাহাড়ের রাস্তা ধরে আপেল পাড়তে রওণা দিল হেলেনা। 
কত দূর যাওয়ার পর, পথ হারিয়ে ফেলেছে, এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল দিকভ্রান্ত হয়ে। এক সময় সেই আগুন চোখে পড়ল তারও। 
পৌঁছে দেখল, বেঢপ চেহারার কতকগুলো জীব বসে আছে সেখানে। আগুনের কুণ্ডটাকে গোল করে ঘিরে বসে আছে তারা। কাউকে মুখের কথা বলবারও দরকার বোধ করল না মেয়েটা। কিছুক্ষণ ধরে আগুনে গা-হাত-পা সেঁকে নিল। 
উঠতে যাবে, বড় চেহারার জন বলল—এখানে কী জন্য এসেছ? কিছু খোঁজ করছ কি? 
হেলেনা তেরিয়া হয়ে বলল—তাতে তোমার দরকারটা কী? তোমাকে বলতে যাব কেন আমি? হুঁকোমুখো বুড়ো কোথাকার! 
অভব্যের মতো কথাগুলো বলেই, বনের দিকে রওণা হয়ে গেল হেলেনা।
গালাগালি শুনলে, কার না মাথা গরম হয়। জানুয়ারিরও হয়েছে। ভুরু কুঁচকে গম্ভীর গলায় হাঁক দিল-- ডিসেম্বর। 
আর কিছু বলতে হোল না। ছড়িটা বাতাসে এক পাক ঘুরিয়ে নিল ডিসেম্বর। তখন এক কাণ্ড। কোত্থেকে ঘন কালো মেঘেরা এসে, ঢেকে ফেলল আকাশকে। আগুণের কুণ্ডটা নিভে গেল। বরফ পড়তে লাগল অবিরল। পাহাড় জুড়ে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের গুমগুম আওয়াজ।
আচমকা এমন আবহাওয়ার কথা কল্পনাও করেনি হেলেনা। বরফে জমে যাওয়ার অবস্থা তার। গরম পোষাক কোন কাজেই আসছে না। কাঁপছে ঠকঠক করে।
এদিকে তার মা পথ চেয়ে বসে আছে হেলেনার জন্য। জানালা খুলে খুলে তাকিয়ে দেখছে বাইরের দিকে। দরজা খুলে তাকাছে এক বার। অস্থির হয়ে ঘরবার করছে ঘনঘন। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। হেলেনার দেখা নাই।
--আচ্ছা মেয়ে বাবা। আপেল পেয়ে, ঘরে ফেরার কথাটাও ভুলে যেতে হয়? মা বিড়বিড় করে উঠল। তারপর, নিজের যতো গরম পোষাক ছিল, সব জড়িলে নিল গায়ে। মা বেরিয়ে গেল মেয়ের খঁজে। 
অঝোর বৃষ্টিধারার মতো বরফ পড়ছে বাইরে। সবকিছু ঢাকা পড়ে গিয়েছে বরফের তলায়। এদিক ওদিক মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে তীব্র বেগে। হুইসেলের শিসের মতো শব্দ, পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে। কিন্তু মায়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না কেউ।
এদিকে মা আর বোনের জন্য পথ চেয়ে বসে আছে মারু। দিনের পর দিন চলে গেল। একবার সংসারের এটা ওটা কাজ করে। একবার যীশুর ছবির সামনে গিয়ে, হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করে—প্রভু, সুস্থ্যভাবে ফিরিয়ে দাও দুজনকে। আবার প্রতীক্ষা করে বসে থাকে। আবার  কাজ। আবার প্রতীক্ষা। আবার প্রার্থনা। কিন্তু যীশু সে কথা শোনেন কি শোনেন না, কে জানে। না মা, না বোন—কেউ ফিরে এলো না আর।
ফিরবে কী করে? সেদিনই ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে, পাহাড়েই মারা পড়েছিল মা মেয়ে দুজনেই। বাড়ি ফিরবে কী করে? এমনকি, শেষ দেখাটাও হয়নি দুজনের।
বাবার রেখে যাওয়া ছোট্ট একটা বাড়ি, ছোট একটা সব্জির খেত, আর একটা গাইগরু—সম্বল বলতে এই মাত্র। এই নিয়ে দিন চলত মারুক্লার। 
একদিন হল কী, এক ভালোমানুষ রাখাল ছেলে এসে হাজির। গোটাকয়েক ভেড়া নিয়ে চরাতে বেরিয়েছে সে। কোথা থেকে এল সে, কেউ জানে না। সেই রাখাল ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেল দুঃখিনি মেয়েটার।
সেদিন থেকে জীবন বেশ সুখেই কেটে যায় তাদের। 
আর হ্যাঁ, একদিন দুজনে মিলে পাহাড়ে চড়েছিল। বারোজন অজানা অচেনা জীব তিন-তিনবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল মারুক্লাকে। তাদের ধন্যবাদ দিতে গিয়েছিল দুজনে। 
কিন্তু পাহাড়ের মাথায় কেউ ছিল না কোথাও। না বারোটি জীব। না তাদের বসবার বারোটা পাথর। এমনকি, আগুনের কুণ্ডটারও সামান্য চিহ্নটুকুও নাই। ভোজবাজির মত সব যেন কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে।

Post a Comment

0 Comments